প্রিয়তম গল্পের লিংক || ইসরাত জাহান ফারিয়া

প্রিয়তম পর্ব ১
লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া

অংক স্যারের সাথে রিতুর বিয়ে।
বাবার মুখে কথাটা শুনেই রিতু চোখ বড়বড় করে তাকালো। বাবুল মিয়া তার বড় মেয়ে ইশিতাকে বললেন,
–বুঝলি রে, খুব করে ধরছে স্যারের মা’টা। রিতুরে
নাকি তার খুব পছন্দ হইছে। তাছাড়া ভালো পরিবার, সহায়-সম্পদ আছে। আমি কি করে না করি? তাই কথা দিয়া আসলাম স্যারের মারে।
রিতু চোখে সব অন্ধকার দেখলো। টাল সামলাতে ব্যর্থ হয়ে বেহুঁশ হয়ে পড়ে যেতে লাগলে ওর বড় বোন ইশিতা এসে ওকে ধরলো। উৎকন্ঠিত হয়ে বলল,

–বাবা পরে কথা বলো। আগে পানি আনো। রিতুর চোখেমুখে পানির ছিঁটা দিতে হবে।
বাবুল মিয়া রান্নাঘর থেকে পানি এনে রিতুর মুখে ছিঁটা দিতে দিতে ভীতু কন্ঠে ডাকলেন,
–রিতু? আম্মা উঠ! কি হইলো তোর? ও মা…
চোখেমুখে পানির ছিঁটা পেতেই রিতু ওঠে বসলো।
বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

–আমি বিয়ে করবো না বাবা।
বাবুল মিয়া ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
–এইসব কইলে কি চলে মা? মাইয়া মানুষের বিয়া করতেই হয়।
–আমি করবো না। তোমার সাথেই থাকবো।
–আমি বাপ হইয়া ঠিকঠাক তোগো ভালোমন্দ কিছু দিতে পারি না। কিন্তু ওইহানে তুই সব পাবি, সুখী হবি!
–তাই বলে তুমি আমার বিয়ে ঠিক করবে অংক
স্যারের সাথে?

–তাতে কি হইছে রে মা?
রিতু কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল,
–আমি অংকে ফেল করেছিলাম বাবা। তুমি ভুলে গেছ?
ইশিতা দাঁত বের করে হাসলো,
–ফেল করছিস তো কি হইছে? এইসব কোনো ব্যাপার না। আমিও তো ইংরেজিতে ফেল মারতাম। তাই বলে কি আমার বিয়ে করিনাই?

–আমার লাজলজ্জা আছে। আমি পারবো না। ম’রে গেলেও না।
বাবুল মিয়া জিভে কামড় দিলেন। আরে! বিষয়টা একদমই তার মাথায় ছিলো না। রিতু বরাবরই অংকে কাঁচা। গত পরীক্ষায়ও হায়ার ম্যাথে ফেল করেছে ত্রিশ পেয়ে। সেসময় কলেজ থেকে গার্ডিয়ান কল পেয়ে বাবুল মিয়া প্যারেন্টস মিটিংয়ে গিয়েছিলেন।

সেখানেই দেখা হয়েছিলো রিতুর কলেজের ম্যাথের গেস্ট টিচার ইফাদ আনিসুরের সাথে।
কমবয়েসী ছেলে। চোখা নাক, সুন্দর চোয়াল। লম্বা, ফর্সায়, সৌন্দর্যে সবকিছুতে দশে দশ। এমন সুদর্শন ছেলে তিনি খুব কমই দেখেছেন। বাবুল মিয়া এবার ছলছল ভেজা চোখে মেয়ের দিকে তাকালেন। অপরাধী সুরে বললেন,
–বিয়াতে রাজি এই মর্মে আমি কথা দিয়া ফালাইছি।
রিতু থমকে গেলো। একমুহূর্ত পরেই আর্ত সুরে চেঁচালো,
–স্যার রাজি হলো কীভাবে? ছিহ! আমি তার স্টুডেন্ট…
বাবুল মিয়া ওঠে চলে যেতে যেতে বললেন,
–হেইডা বেয়াইন সাহেবা দেখব…

বাহ! এর মধ্যেই বেয়াইন সাহেবা? রিতুর চোখ ভিজে কান্না এলো। অংক স্যার যে এ বিষয়ে কিছুই জানে না সেটাও বুঝলো। স্যার জানলে নিশ্চয়ই এ সম্বন্ধে রাজি হবে না রিতুর বিশ্বাস। অতবড় মানুষটা ওর মতো গরিব ঘরের ফেল্টুসকে বিয়ে করতে বয়েই গেছে। হুহ! এটুকুই ভরসা রিতুর। বাবা যে রিতুর কথা শুনবেন তা না, নিজের মর্জি মতোই চলবেন রিতু বেশ জানে। মা মরা দুই মেয়ে নিয়ে বাবুল মিয়ার টানাপোড়েনের সংসার। পানের ব্যবসা করে যে ক’ টাকা পান তা দিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়।

এসএসসিতে ইংরেজিতে ফেল করায় বড় মেয়ে ইশিতাকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলেন। তবে যার তার কাছে নয়। খুঁজে খুঁজে পয়সাওয়ালা পরিবারে সম্বন্ধ করেছেন৷ ইংরেজিকে যমের মতো ভয় পাওয়া ইশিতাকে তুলে দিয়েছিলেন ইংলিশ টিচারের কাছে। ইশিতার কোনো কথাই তখন তিনি শোনেন নি৷ সেবার বোনের বিয়েতে রিতু বেশ আনন্দ করেছিলো। আয়েশ করে পোলাও, মাংস খেয়েছিলো। ইশিতা কাঁদতে কাঁদতে বিদায় নেওয়ার সময় রিতুর সাথে কথাই বলেনি। এরপর রিতু বাড়ি এলে বোনকে এভাবে ক্ষ্যাপাতো,

–ইংলিশ টিচারের কি-না বউ কিনা ইংলিশে ফেল করা ছাত্রী? ইয়াক…লোকে কি বলেরে আপু?
ইশিতা যদিও বিবাহিত জীবনে খুব সুখী তবুও বোনের খোঁচা শুনে তখন রাগ নিয়ে বলতো,
–তোর কপালেও আমার মতো দুর্গতি আছে৷ দেইখা নিস…
বড় বোনের অভিশাপ মিলে গেলো রিতুর সাথে।

ওর আর কিছুই করার নেই। বাবার কথার অবাধ্য হলে বাবা ভীষণ কষ্ট পাবে, যেটা স্বপ্নেও ভাবতে পারে না রিতু। মা মারা যাওয়ার পর মানুষটা বিয়ে করেন নি আর৷ একা হাতে ছোট দুই মেয়েকে বড় করেছেন। নিজে না খাইয়ে তাদের খাইয়েছেন। তাই বাবার কথা পারতপক্ষে অমান্য করে না ওর দুই বোন।
সপ্তাহ তিনেক আগে বাবার সাথে রিতু গিয়েছিলো কাঁচাবাজারে। সেখানেই হঠাৎ দেখা হয়েছিলো অংক স্যার আর তার মায়ের সাথে। বাবুল মিয়া সরলসোজা মানুষ। সেঁধে গিয়েছিলেন তাদের ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করতে। স্যারের মা নাজিয়া ইসলাম রিতুকেই বারবার দেখছিলো। ভদ্রমহিলার চেহারা সুরত, চিন্তাধারা বেশ প্রখর ছিলো। ভালোই লেগেছিলো ওর। কিন্তু মহিলা

যে এতদূর যাবে এতকিছু তো মনে হয়নি। রিতু তাই বিষাদগ্রস্ত হয়ে বসে রইলো। অংক স্যারকে বিয়ে? যে তার ফেল মারার সব ঘটনা জানে? কলেজপড়ুয়া এতবড় মেয়েকে অংক না পারার অপরাধে ক্লাসে কান ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখে? একটু ভুলচুক করলেই যে অপমান করে? রিতু যার সব শাস্তি মুখ বুজে সহ্য করে, সেই স্যারকে বিয়ে? স্বপ্নেও অসম্ভব! রিতু ক’টা দিন তক্কেতক্কে রইলো। মনে মনে দোয়া করতে লাগলো বিয়েটা যাতে না হয়। স্যার যাতে রাজি না হোন। রিতুর দোয়া কবুল হলো৷ দু’দিন পর বাবুল মিয়া এসে জানালেন অংক স্যার রাজি না, বিয়েটা হচ্ছে না। শুনে তো রিতু আনন্দে আটখানা হয়ে গেলো। খুশিতে তার নাচতে ইচ্ছে করলো। দু-রাকাত নফল নামাজ পড়ে শুকরিয়া আদায় করলো। প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিলো। ঘন্টা লাগিয়ে গোসল করলো। মাথায় শ্যাম্পু করলো। পেটভরে ভাত খেলো। এরপর মনের সুখে ঘুমাতে গেলো। অন্যদিনের তুলনায় সেই রাতে ওর খুব ভালো ঘুমও হলো।

কিন্তু পরদিন সকালে ওর ঘুম ভাঙলো হৈচৈ শুনে। বিরক্ত হয়ে ঘরের বাইরে আসতেই দেখতে পেলো ওর দুই ফুফু, এক খালা আর মামারা তাদের স্বামী-সন্তান নিয়ে বাড়িতে হাজির। তারা ওঠোনে বসে মহানন্দে মাছ, মাংস কাটছেন। সেইসাথে হাসাহাসিও চলছে পুরোদস্তুর। রিতু ইশিতাকে কোথাও দেখতে পেলো না। মেহমানদের চোখ ফাঁকি দিয়ে রান্নাঘরে এসে দেখলো ইশিতা মসলা বাটছে। চোখেমুখে ঘাম, ক্লান্তি। রিতুকে দেখেই তারস্বরে চেঁচালো,

— ক’টা বাজে খেয়াল আছে? নবাবজাদী হইছোস। শ্বশুরবাড়িতে ওমন নবাবজাদীগিরি করলে লাত্থি মাইরা বাইর কইরা দিব।
রিতু বিরক্ত গলায় বলল,
–রাখো তোমার ফালতু কথা। বাড়িতে এত মেহমান কেন? কাহিনী কী?
–ওদের ভাইয়ের বাড়ি, ইচ্ছা হইসে তাই আইছে।
তোর কী?

— তাই বলে এত সকালে?
ইশিতা মসলা বাটতে বাটতেই বলল,
–কেন তোর ঘুমের ডিস্টার্ব হইছে? নবাবজাদী…
রিতু রাগী গলায় বলল,
–আমি কি তাই বলেছি? তুমি অহেতুক…

–কানের কাছে ঘ্যানরঘ্যানর না কইরা গিয়া গোসলটোসল দে। হাতমুখ ধুস নাই খাচ্চর মাইয়া কোথাকার। তোর জামাই তো সামনের দরজা দিয়া বাড়িতে ঢুকাইয়া পেছনের দরজা দিয়া বাইর কইরা দিব।
রিতু অসহ্য হয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো।
বেরুতেই বড়ফুফুর সামনে পড়ে গেলো। বড়ফুফু ওকে ধরেই একটা চিৎকার দিয়ে বললেন,
— তোর ঘুম ভাঙছে তাইলে? আমরা তো সেই ভোরে আইসা বইয়া আছি, তোর কোনো খোঁজ নাই।
রিতু কিছুটা অপ্রস্তুত হেসে বলল,

— হঠাৎ আমার খোঁজ কেন?
বড়ফুফু হেসে বললেন,
— তোর বাপে জরুরি তলব করলো কাল রাইতে।
বলল আইজ আইতেই হইবো তোদের। বলি, এমনে হঠাৎ কেউ মাইয়া বিয়া দেয়? তোর ফুফা তো শুইনা অবাক…
রিতু ভ্রু কুঁচকালো,

— বিয়ে মানে? কার বিয়ে?
— তোর বিয়া। কেন তুই জানোস না?
রিতু হতভম্ব হয়ে গেলো,
— ম মানে?
বড়ফুফু হায় হায় করে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন,

— আমাগোরে না হয় জানায় নাই, তাই বইলা নিজের মাইয়ারেও জানায়বো না?
রিতু দুচোখে অন্ধকার দিকে দেখলো। ঢলে পড়ে যেতে যেতে বলল,
— আমাকে ধরো ফুপি…
.
রিতুর যখন সম্বিৎ ফিরলো দেখলো ওকে ঘিরে সবাই
দাঁড়িয়ে আছে। ইশিতা ওকে ধমক দিয়ে বলল,
–বিয়ের কথা শুনলে কেউ ফিট খায়া যায়? নাটইক্কা মাইয়া…
বাবুল মিয়া এসে রিতুর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,
— তুই কষ্ট পাবি তাই জানাই নাই মা। ভাবছিলাম একেবারে বিয়ের আসরেই জানাবো, তাইলে যদি একটু কম কষ্ট পাস…
খালা, ফুফুরা সব চুপ করে রইলো। কেউ টু শব্দও করলো না। রিতু ধীরেসুস্থে ওঠে বসলো। বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,

— আমার কষ্ট নিয়ে তোমার এত চিন্তা? এত ভাবো আমাকে নিয়ে অথচ আমার জীবনটা নিয়ে তোমরা ছিনিমিনি খেলছো? সবকিছু মজা মনে হচ্ছে তোমাদের?
বাবুল মিয়া মেয়ের প্রশ্নের জবাব দিলেন না। রিতু
চিৎকার করলো,
— চুপ করে আছো কেন? তুমি, আপু সব জানতে তাইনা? আমাকে কাল তাহলে মিথ্যে বললে কেন? আমি কী না করেছিলাম তোমাদের?
বাবুল মিয়া কাচুমাচু করে বললেন,

— তুই নাওয়াখাওয়া ভুলে কষ্ট পাচ্ছিলি, তাই….
–তাই আমাকে মিথ্যে বলবে? তাও আবার বিয়ের মতো একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নিয়ে?
–আমরা মিথ্যে বলতে চাইনি। তুই বিয়ে করতে চাস না শুনে জামাই বাবাজিই বললো তোকে আগেভাগেই জানানোর দরকার নেই, ঠিক সময়ে জানালেই চলবে।
রিতু চমকে ওঠলো,
— কীহ?
ইশিতাও মাথা নাড়ালো,
— হুম৷ জামাই বললো বইলাই তোরে জানাই নাই।
রিতু ফুঁসে ওঠলো,
— তো পাত্রটা কে? অংক স্যার?

বাবুল মিয়া আর ইশিতা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতেই রিতু সব বুঝে গেলো। এই অংক স্যার এমন হাড় বজ্জাত আগে তো টের পায়নি। এতদিন জানতো লোকটা অংক পড়ায়, কিন্তু অংক পড়ানোর সাথে সাথে বাটপারি আর লোক ঠকিয়ে কার্য আদায়ের ব্যবসা ও যে করে তা তো জানতো না। ছিহ! রিতু তাকে বুঝদার, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন লোক ভেবেছিলো। এই তার নমুনা? শিক্ষক হয়ে ছাত্রীর দিকে নজর? ছাত্রীকে বিয়ে করতে ঠকবাজির আশ্রয় নেওয়া? লু’চু লোক!

রিতু শক্ত, গম্ভীর হয়ে বসে রইলো। এতদিন অনেক সম্মান দেখিয়েছে, তার সব অন্যায় মুখ বুজে মেনে নিয়েছে। আর না, কিছুতেই না। বিয়ে করতে চায় তো ওকে? করুক বিয়ে। বিয়ের পরই একে সে উচিৎ শিক্ষা দেবে। ইফাদ আনিসুরকে দেখে নেবে এই অংকে ফেল মারা রিতু!

প্রিয়তম পর্ব ২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here