প্রিয়দর্শিনী পর্ব ২১ (শেষ অংশ)

প্রিয়দর্শিনী পর্ব ২১ (শেষ অংশ)
প্রজ্ঞা জামান তৃণ

মুহতাসিম ভিলায় আনন্দমুখর পরিবেশ। দর্শিনী আবিদকে সোফায় পাশাপাশি বসানো হয়েছে। দুই পরিবারের সবাই আবিদ দর্শিনীকে ঘিরে রয়েছে। দর্শিনী নিহালের ব‍্যাপারটায় কিছুটা মন খারাপ করেছিল কিন্তু আবিদের সংস্পর্শে সবটা কিছুক্ষণের জন‍্য ভুলে গেছে। আবিদ পাশে থাকলে মনখারাপ দর্শিনীকে ছুঁতে পারেনা।

আদিবা, আবিদ দর্শিনী দুজনের পাশাপাশি ছবি তুলছে। এদিকে আবিদ মুগ্ধ হয়ে তার দর্শিনীকে দেখছে। দর্শিনীও আবিদের দিকে তাকায়। যতটা প্রেমপূর্ণ মুগ্ধ নজরে দর্শিনী আবিদকে দেখছে। ততটা ক্রোধের সঙ্গে প্রজ্জ্বলিনী, আসফি আবিদকে পরোক্ষ করে। প্রতিটা ভালোবাসার গল্পে একজন খলনায়ক থাকে। এখানে আবিদ দর্শিনীর ভালোবাসায় খলনায়ক আসফি আর প্রজ্জ্বলিনী।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তারা দুজনই চায়না আবিদ দর্শিনীর মিলন হোক। দুজনের এমন হিংসাত্মক মনোভাব কারো নজরে না পড়লেও আবিদের নজরে ঠিক পড়েছে। দুজনের চাইল্ডিশ আচরণে সবার অগোচরে আবিদ তাচ্ছিল্যপূর্ণ বাঁকা হাসে। অনুসা বেগম দর্শিনীর পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,

‘মাশআল্লাহ্! আমার ছেলের হবু বউকে জামদানি শাড়িতে দেখতে ভারী সুন্দর লাগছে। ঠিক যেন স্নিগ্ধ পরী। একটাই ইচ্ছে খুব তাড়াতাড়ি চৌধুরী বাড়িতে লক্ষ্মী হয়ে এসো।’
দর্শিনী মিষ্টি মধুর হাসলো। অনুসা বেগম ‍দর্শিনীর গলায় ডাইমন্ডের নেকলেসটা পড়িয়ে দিলেন। পুস্পিতা ডাইমন্ডের আংটিটা আবিদের হাতে দেয়।

আবিদ মিষ্টি মধুর হেসে দর্শিনীর মুখোমুখি হয়ে বসে। সে দর্শিনীর দিকে তাকিয়ে বাম হাত বাড়াতে ইশারা করে। আবিদ দর্শিনীর বাম হাতের অনামিকা আঙ্গুলে ডায়মন্ডের আংটিটা পড়িয়ে দেয়। সবাই উচ্চস্বরে আলহামদুলিল্লাহ্ পড়ে। সবশেষে আশরাফ মুহতাসিম দামী প্লাটিনামের পুরুষালী আংটিটা দর্শিনীর হাতে দেয়। দর্শিনী সেটা আবিদের বাম হাতের অনামিকা আঙ্গুলে পড়িয়ে দেয়। দুইপক্ষ আনন্দে উচ্ছসিত হয়।

অবশেষে আবিদ দর্শিনীর বাগদান সম্পূর্ণ হয়।শাহরিয়ার চৌধুরী আশরাফ মুহতাসিম একে অপরের সঙ্গে আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছে। তারা আনন্দে হাত মেলবন্ধন করে। একে অপরকে জড়িয়ে মিষ্টি মুখ করায়। অনুসা বেগম, প্রিয়মা বেগম সবার মতো একে অপরকে মিষ্টি মুখ করায়। উজানও আরহানের সঙ্গে হাত মেলবন্ধনে আবদ্ধ হয়। তারা এভাবে মিষ্টি মুখ করে আনন্দটুকু একে অপরের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেয়।

এসব দেখে প্রজ্জ্বলিনীর স্বাভাবিক ভাবে বিরক্ত লাগে। তাইজন‍্য সে উঠে চলে যায় নিজের রুমে। সবাই অতো গুরুত্ব দেয়নি। তবে আসফি বেশ কয়েকবার প্রজ্জ্বলিনীকে খেয়াল করেছে। সে আবিদের প্রতি প্রজ্জ্বলিনীর চোখেমুখে অদ্ভুত বিতৃষ্ণা দেখতে পেয়েছে। যথাসম্ভব আবিদকে প্রজ্জ্বলিনী ঘৃণার চোখে দেখে। তারা কী আগে থেকে পূর্বপরিচিত শত্রু ছিল? প্রজ্জ্বলিনীর কী এই বিয়েতে মত নেই? যদি তার সন্দেহ সত্যি হয়, তবে আবিদ দর্শিনীকে আলাদা করা তার জন‍্য সহজ হবে। আসফি আবিদ দর্শিনীকে আলাদা করতে প্রজ্জ্বলিনীর সাহায্য নিতে পারবে। সবাই যখন মিষ্টি মুখ করতে ব‍্যাস্ত আবিদ অগোচরে শাহরিয়ার চৌধুরীকে বলে,

‘বাবা! আমি চাই বিয়েটা পরের শুক্রবারে হোক। তুমি রাজি করাবে আশরাফ আঙ্কেলকে। মনে করো তোমার ম‍্যাজিস্ট্রেট ছেলে তোমাকে অগোচরে চ‍্যালেন্জ ছুড়ে দিয়েছে। আমি জানিনা কীভাবে করাবে কিন্তু তোমাকে রাজি করাতেই হবে।’
শাহরিয়ার চৌধুরী ভ্রুকুঁচকে ছেলের দিকে তাকায়। তার ছেলে অবাস্তবিক আবদার কেনো করছে? বিয়ে এক দু’দিনের বিষয় না। আয়োজন করতেও সময় লাগে। শাহরিয়ার চৌধুরী ছেলের উদ্দেশ্যে বলেন,

‘এতো তাড়াহুড়োর কী খুব প্রয়োজন?ধীরে সুস্থে বিয়েটা হলে ভালো হতো না? আশরাফ মুহতাসিম আহমেদ মুহতাসিমকে কীভাবে জানাবো? তারা এতো তাড়াতাড়ি বিয়ের জন‍্য রাজি হবেন কী?’
আবিদ ভাবলেশহীন। সে জানে শাহরিয়ার চৌধুরী চাইলে সব সম্ভব। আবিদ বাবার উদ্দেশ্যে নির্বিকারভাবে বলে,
‘সেটা তুমি ভালো জানো। আমার কাছে হার মানতে পারো না তুমি, বাবা। টাকা পয়সা খরচ করলে দ্রুত বিয়ের আয়োজন অসম্ভব নয়। তোমাকে সবাইকে রাজি করাতেই হবে। আই বিলিভ ইউ, যাস্ট ডু ইট।’

শাহরিয়ার চৌধুরী চিন্তিত হয়ে ছেলেকে সমর্থন করে। আবিদ অগোচরে বাঁকা হাসে। সে দর্শিনীর দিকে একবার তাকিয়ে আশরাফ মুহতাসিমের উদ্দেশ্য বলে,
‘আমি দর্শিনীর সঙ্গে কথা বলতে চাই আঙ্কেল। আপনার কোন আপত্তি না থাকলে আমি কী কথা বলতে পারি?’
আশরাফ মুহতাসিম মনোমুগ্ধকর হাসে। আবিদের ছোট ছোট বিষয় যেমন, আচার-আচরণ কথাবার্তায় তিনি মুগ্ধ হোন। তিনি আবিদের দিকে তাকিয়ে বলেন,

‘অবশ‍্যই! আমি ও চাইছিলাম বিয়ের ডেট ঠিক করার আগে তোমরা দুজনে আলাদা কথা বলে নেও। এতে তোমাদের মতামত নিয়ে আমরা এগোতে পারবো। বিয়ের ডেট ফিক্সড্ করতে আমাদের সুবিধা হবে।’
আশরাফ মুহতাসিম দর্শিনীর উদ্দেশ্যে বলেন,

‘মামনি! আবিদকে নিয়ে রুমে যাও। কথা বলে আসো তোমরা।’
দর্শিনী বাবার কথায় উঠে দাঁড়ায়। আবিদকে তার সঙ্গে যেতে বলে। হৃদি দর্শিনীর দিকে তাকিয়ে অগোচরে দু’ষ্টু ইশারা করে। দর্শিনী হৃদির দিকে বিস্মিত চোখে তাকায়। আবিদ দর্শিনী পাশাপাশি রুমের দিকে হেঁটে যায়। আসফি সব দেখেও কিছু করতে না পারার জন‍্য আফসোস করে। একপর্যায়ে ধৈর্য্য ধরে নিজের রাগ দমন করে নেয়।
আবিদ দর্শিনী দু’জনে রুমের উদ্দেশ্যে হেঁটে যাচ্ছে। হঠাৎ কী ভেবে আবিদ দর্শিনীর উদ্দেশ্যে বলে উঠে,

‘দর্শিনী! ছাদে যাবো রুমে না।’
দর্শিনী প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে ফিরে তাকায়। আবিদ দুষ্টুমি করে বলে,
‘কালকের মতো আপনাকে লজ্জায় ফেলতে চাইনা এজন্যই ছাদে যেতে চাইছি। আজকের দিনে বদ্ধরুমে আপনাকে একা পেয়ে আমি নিজেকে কন্ট্রোল করতে ব‍্যার্থ হলে বিষয়টি ভালো দেখাবে না। তাই আরকি ছাদে চলুন।’ ____বলে আবিদ অমায়িক হাসে।

দর্শিনী আবিদের কথা মতো ছাদের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়। আবিদ দর্শিনীর পিছু পিছু যেতে থাকে। সে দর্শিনীকে লজ্জা পেতে দেখে বলে উঠে,
‘হতে পারে কোনো রাস্তায়, কোনো হুড তোলা এক রিক্সায়! আমি নীল ছাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে, তুমি অদ্ভুত এক খেয়ালে, আর আমি তোমাতেই, আমি সেইজন দর্শিনী! লোকে পাগল বলুক মাতাল বলুক আমি তোমার পিছু ছাড়বো না।’
দর্শিনী আবিদের কথায় মনোমুগ্ধকর হাসে। আবিদ দর্শিনীর উদ্দেশ্যে আবারো বলে,

‘আমার নিজেকে সত্যি পাগল মনে হচ্ছে দর্শিনী। আমি টিনএজার প্রেমিকদের মতো আচরণ করছি। সব দোষ আপনার। আপনি আমাকে এমন অসুস্থ করে দিয়েছেন। আমি আপনি নামক অসুখে আক্রান্ত।’
দর্শিনী ছাদে পৌঁছে আবিদের দিকে তাকিয়ে বলে,

‘আপনাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি? কীভাবে আপনাকে আমি নামক অসুখ থেকে সুস্থ করবো আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরী?’
উপরে বিস্তর নীল আকাশ, সুন্দর প্রাণোচ্ছল বিকেল। ছাদের চারপাশে ফুল ফলমূলের গাছ লাগানো। আবিদের হঠাৎ ফুপির কথা মনে পড়ে। তার ফুপি বাগান খুব পছন্দ করতো। দর্শিনী উত্তরের আশায় আবিদের দিকে চেয়ে আছে। আবিদ দর্শিনীর দিকে তাকিয়ে বলে,

‘আমি আপনি নামক অসুখ থেকে সুস্থ হতে চাইনা দর্শিনী। বেঁচে থাকতে হলে আপনাকে আমার প্রয়োজন। অক্সিজেন আপনি আমার। প্লীজ যা কিছু হয়ে যাক আমাকে ছেড়ে কখনো যাবেন না দর্শিনী। আমি বাঁচতে পারবো না তাহলে।’
দর্শিনী আবিদের কথায় বুকের বাঁপাশে ব‍্যাথা অনুভব করে। আচমকা সে আবিদকে জড়িয়ে ধরে। আবিদ মনোমুগ্ধকর হাসে। দর্শিনীকে বুকের মধ‍্যে শক্ত করে মিশিয়ে নেয়। একসময় অনুভব করে পান্জাবী অশ্রুতে সিক্ত হচ্ছে। তারমানে দর্শিনী কী কাঁদছে? আবিদ বিচলিত হয়ে দু’হাতে দর্শিনীর মুখটা আজলা করে ধরে। দর্শিনীর চোখ বেয়ে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে ত‍ৎক্ষনাৎ। আবিদ জিগ্যেস করে,

‘আপনি আবারো কাঁদছেন? আপনাকে নিয়ে আমি কী করবো দর্শিনী? আমার কিছু হয়নি, হবেও না ভয় নেই। আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরী এতো সহজে আপনার পিছু ছাড়বে না দর্শিনী।’
দর্শিনী আবারো আবিদকে জড়িয়ে ধরে। শাড়ি পরিহিত স্নিগ্ধ রমনীকে বুকে জড়িয়ে আবিদের অন‍্যরকম অনুভব হয়। মনের মধ‍্যে দর্শিনীকে তীব্র ভাবে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা অনুভূত হয়। কিন্তু আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরী হেল্পলেস। আবিদ দর্শিনীর গলাই মুখ গুজে দেয়। দর্শিনীর পিঠে আলতো করে হাত রাখে। অনুভূতিতে আবিদ দর্শিনীর শরীর ঝিমঝিম করে উঠে। দর্শিনী ঐভাবে বলতে শুরু করে,

‘আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরী আমি আপনাকে ভালোবাসি, অনেক বেশি ভালোবাসি। আপনি ব‍্যাতিত কাউকে কল্পনা করতে পারিনা। সেই প্রথম দেখার দিন থেকে বর্তমান, আমৃত্যু পযর্ন্ত আপনাকে ভালোবাসবো।কখনো ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাববো না, কোনদিন না।’

আবিদ দর্শিনীকে আলতো করে ছাড়িয়ে আশেপাশের সৌন্দর্য দেখতে থাকে। হঠাৎ নজর পড়ে, টবে লাগানো লাল টকটকে গোলাপ গাছটার দিকে। গুনে গুনে ছয় সাতটা ফুল ফুঁটে আছে। সেখান থেকে একটা ফুল তুললে নিশ্চয়ই ক্ষতি হবে না। আবিদ লাল গোলাপের গাছ থেকে একটা ছোট্ট গোলাপ ফুল তুলে নেয়। এরজন‍্য অবশ‍্য গোলাপ গাছের কাঁটার আঘাত পায়। সাথে সাথে হাতের আঙ্গুলে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয়।

আবিদ তোয়াক্কা না করে লাল গোলাপটা দর্শিনীর কানের পাশে গুজে দেয়। মসৃণ ছেড়ে রাখা বাদামী চুল, সঙ্গে কানে উপর ছোট্ট লাল গোলাপটা দারুন লাগছে আবিদের। এই লাল গোলাপের থেকে তার ব‍্যাক্তিগত গোলাপ আরো বেশী সুন্দর। আবিদ দর্শিনীকে লক্ষ‍্য করে মনোমুগ্ধকর ভাবে হাসে। দর্শিনীও আবিদকে হাসতে দেখে মুগ্ধ হয়। দর্শিনীর হঠাৎ আবিদের হাতের দিকে চোখ পড়ে। আবিদ গোলাপ গাছের কাঁটার আঘাত পেয়েছে।

দর্শিনী ব‍্যতিব‍্যাস্ত হয়ে উঠে। যেন আঘাতটা তার লেগেছে। যদিও অল্প আঘাত। দর্শিনী আবিদের ডান হাতের আঘাত পাওয়া আঙ্গুলে ঠোঁট ছুঁয়ে দেয়। একফোঁটা রক্ত দর্শিনীর ঠোঁটে লেগে যায়। দর্শিনীর রক্ত ন‍্যায় লাল ঠোঁটে আবিদের একফোঁটা রক্ত লেগে আছে। আবিদের ইচ্ছে করছে দর্শিনীর ঠোঁটে ঠোঁট মিলিয়ে সবটা শুষে নিতে। সে নিজেকে মনে মনে শা’ষায়। আবিদ হাত দিয়েই ঠোঁটের উপর রক্তের ফোঁটা মুছে দেয়। তারা একে অপরের দিকে বেশকিছু ক্ষণ তাকিয়ে থাকে। আবিদের হঠাৎ নিহালের ব‍্যাপারটা মনে পড়ে যায়।

প্রিয়দর্শিনী পর্ব ২১ ( ১ম অংশ )

[ অনেকে গমরঙা ত্বক কী জানতে চেয়েছিলেন। আসলে উজ্জ্বল শ‍্যামবর্ণের উপর আলো পড়লে গমরঙের মতো লাগে। আমি এখানে ঐ অর্থে উপমা হিসাবে ব‍্যবহার করেছি। এবার থেকে নিয়মিত গল্প পাবেন। ভুলত্রু’টি ক্ষমার নজরে দেখবেন রিচেক করা হয়নি। আগের মতো রেসপন্স করবেন পাঠকবৃন্দ 🧡]

প্রিয়দর্শিনী পর্ব ২২