ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ১৭

ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ১৭
নীহারিকা নুর

বাহিরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। চারদিকে শুনশান অবস্থা। আশপাশে আর একটা গাড়ি ও দেখা যাচ্ছে না। না কোন মানুষ। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বুঝল এখন ঘোর সন্ধ্যা। এই মুহুর্তে এমন একটা জায়গায় অবস্থান করছে যেখানে কোন হসপিটাল ও পাওয়া সম্ভব নয়। এদিকে তরুর মাথার রক্ত দেখে বেশ ভয়ে যায় তুরাগ।

চোখের সামনে বারবার সেদিন মিথিলার রক্তাক্ত মুখশ্রীর কথা মনে পড়ে। হঠাৎ খেয়াল হয় ফাস্ট এইড বক্স গাড়িতেই রয়েছে। দ্রুত হাতে সেটা তুলে নেয় তুরাগ। ড্রেসিং করে ব্যান্ডেজ করে দেয়। তরুর তো মাথা ঝিম ঝিম করছে এখনো। পানির বোতল এগিয়ে দেয় তুরাগ। পানি পান করে শান্ত হতে বলে। কাপাকাপা হাতে পানির বোতল হাতে তুলে নেয়। এসিটা এতক্ষণ অফ করা ছিল। কাচ সামান্য নামানো ছিল। তরু বৃষ্টি দেখবে বলছিল।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এজন্যই খোলা রেখেছিল। তা দিয়ে পানির ঝাপটা এসে অবশ্য তরুর এক সাইড ভিজিয়ে দিয়ে গেছে। কাচ তুলে দিল তুরাগ। এসি টা অন করে দিল। তরুকে রিলাক্স করতে বলে নিজে দরজা খুলে বেড়িয়ে গেল। এই ঝুম বৃষ্টিতে কোথায় যাচ্ছে লোকটা। একদম ভিজে যাবে তো। তরু ভাবল একবার জানতে চাইবে যে কোথায় যাচ্ছে। কিন্তু এই মুহুর্তে কথা বলতে মন চাইল না তাই চুপ করেই রইল।

তুরাগ বাহিরে চলে গেছে বেশ অনেকক্ষণ হতে চলল। ধরনীতে দিনের আলো নিভে অন্ধকার নেমে এসেছে। এই মুহুর্তে ভয় ভয় লাগতে শুরু করে তরুর। এরকম অচেনা একটা জায়গায়। যতই তুরাগ ভাই পাশে থাকুক। তবুও ভয় হচ্ছে। তুরাগ ভাই নিজেও একটা ভয়ের কারণ। তহমিনা তরুকে শিখিয়েছে পুরুষ মানুষ থেকে দূরে থাকার জন্য। হোক সে বন্ধু বা কাজিন। আমাদের সমাজ এখন এগুলো খুব স্বাভাবিক ভাবে নিলেও পুরুষ মানুষ এর মন পরিবর্তন হতে সময় লাগে না।

তার উপর আশ পাশে কোন কিছু ই চেনা নেই তরুর৷ তুরাগকেই কতটুকু চিনে ও। ভয়ে ভয়ে আরো কয়েক মিনিট কে’টে গেল। তখনো তুরাগ এর ফেরার নাম নেই। এবার মনে হচ্ছে তরুর বেড়িয়ে দেখা উচিত। কোন বিপদ হলো না তো। মন বারবার উল্টা পাল্টা ভাবছিল। মনের সাথে যুদ্ধ করে না পেরে অবশেষে নিজেও বেরিয়ে পড়ল গাড়ি থেকে। চারদিকে অন্ধকার কিছুই দেখা যাচ্ছে না। এদিকে পানির বড় বড় ফোটা এসে শরীর ছুয়ে দিচ্ছে।

আবার গাড়িতে ঢুকে পড়ল তরু। গাড়ির হেডলাইট জ্বালিয়ে দিল। তার আলোয় দেখা গেল তুরাগকে। গাড়ি থেকে কিছু টা সামনেই রাস্তার উপর সোজা হয়ে শুয়ে আছে সে। তরু ভয় পেল যদি কোন গাড়ি চলে আসে। আবার গাড়ি থেকে নেমে গেল সে। পা বাড়াল তুরাগ যেখানে শুয়ে আছে সেই স্থান এর উদ্দেশ্যে। সেখানে গিয়ে দেখতে পেল আকাশের দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে সে। চোখ গুলো ভীষণ লাল হয়ে আছে। মনে হয় কেধেছে৷ তবে চোখের পানি বৃষ্টির পানির সাথে মিলিয়ে গিয়েছে।

– তুরাগ ভাই আপনি এভাবে মাঝখানে শুয়ে আছেন কোন গাড়ি চলে আসে যদি।
– আসবে না মিস তরুলতা। এই সময় এই রাস্তায় কোন গাড়ি আসে না।
– হোক তবুও। আমার মনে হচ্ছে আমাদের ফেরা উচিত। ফুপি চিন্তা করতেছে।
– বসুন না মিস তরুলতা। বৃষ্টিকে উপভোগ করুন৷ এরকম খোলা আকাশের নিচে ভিজতে আসলেই অনেক আনন্দ আছে।
– হ্যা ফাটা মাথা নিয়ে এখন আমি বৃষ্টি বিলাস করি।

তরুর কথা শুনে লাফ দিয়ে উঠে বসে তুরাগ। ওর তো খেয়াল ই ছিল না যে তরু মাথার ব্যান্ডেজ নিয়ে ভিজতেছে। তুরাগ উঠে দাড়ালো সেখান থেকে। হাটা ধরল গাড়ির দিকে। তরুকে তাড়া দিল উঠে আসার জন্য। তরুর বিনাবাক্য ব্যয়ে গাড়িতে উঠে বসল। এবার তুরাগকে বেশ ঠান্ডা মনে হচ্ছে। হয়ত বৃষ্টির সাথে কষ্টগুলোকে ভাগ করে এলেন। গাড়িতে এসে ফাস্ট এইড বক্স তরুর হাতে ধরিয়ে দিল। আর বলল

– মিস তরুলতা নিজের ব্যান্ডেজ নিজে করে নেন। এটা নিয়ে বৃষ্টিতে ভেজার শাস্তি এটা।
তরু ফাস্ট এইড বক্স নিয়ে সেটার দিকে কিছু সময় তাকিয়ে রইল। ও কি করে নিজের মাথায় নিজে ব্যান্ডেজ করবে সেটাই তো বুজছে না। তাই এড়াতে বলল
– তুরাগ ভাই মাথা সামান্য কে’টেছে। ফাটে তো নি। ব্যান্ডেজ করতে হবে না।
তুরাগ এর ধমক শুনে দমে গেলো তরু। তুরাগ নিজেই নিয়ে এবারও ব্যান্ডেজ করে দিল। ফাস্ট এইড বক্স রেখে ড্রাইভিং এ মনযোগ দিল তুরাগ৷

এদিকে তরু মনে মনে ভাবছে এদের দুজনের জন্য কিছু তো একটা করা উচিত। তবে কি করতে পারে ও। আচ্ছা মিথিপুকে যদি ফুপির বাসায় নিয়ে আসা যায় তাহলে বিষয়টা কেমন হয়। তবে তুরাগ কে এই মুহুর্তে এসব নিয়ে কি বলবে তরু সেটাই বুজতে পারতেছে না৷ বেশ কিছু সময় নিরবতার পরে তরু জানতে চাইল

– আচ্ছা তুরাগ ভাই আমি তো আপনার ছোট। তবে আপনি আমাকে সব সময় আপনি করে বলেন কেন।
– আপনাকে সম্মান করি মিস তরুলতা তাই।
– সম্মান…..
– অবশ্যই। আপনি একজন স্ট্রং মনের অধিকারিনী। এতটুকু সম্মান তো দেয়াই যায়। আপনি যে পরিস্থিতে পড়েছিলেন ওরকম একটা পরিস্থিতিতে অনেক মেয়েরাই ভেঙে পড়ে। তবে আপনি শক্ত মনের পরিচয় দিয়েছেন। সেজন্য একটু সম্মান তো পেতেই পারেন।

তরু মনে মনে ভাবল কি আর হলো কি। ওর ইচ্ছে ছিল এই প্রশ্নটা দিয়ে শুরু করে মিথিপুর টপিকটা আনবে। দমে গেলো না তরু। আবার জিজ্ঞেস করলো

– আচ্ছা তুরাগ ভাই আরেকটা কথা জিজ্ঞেস করি?
– আর একটাই কিন্তু। এর চেয়ে একটা বেশি কথা বললেও কিন্তু আর উত্তর দিব না।
– আচ্ছা মিথি আপুকে যদি সাইয়্যিদ ভিলায় নিয়ে আসা হয় তবে কি আপনার সব কষ্ট দূর হবে।
তরুর কথায় আবারও ব্রেক কষল তুরাগ। চোখ ছোট ছোট করে তাকালো তরুর দিকে। মনে মনে বলল আরে আমি এত বছরেই সোজা করতে পারি নাই মিথুরে আর তোম্রা তো নিউ প্লেয়ার।

– আচ্ছা তরুলতা আপনার মাথায় হঠাৎ এই কথা?
– আপনাদের ব্যাপারে সবটাই শুনলাম৷ আমার মনে হয় মিথিলা আপুকে নিয়ে আসলেই সব সমস্যা দূর হয়ে যাবে।
– সে আসবে না। আসার হলে অনেক আগেই আসত।
– আচ্ছা শেষ চেষ্টা করতে তো কোনো সমস্যা নেই।
– হুুম দেখা যাক৷ যদি পারো তাইলে তো ভালোই।
– হুম।

বাসায় আসতে আসতে রাত প্রায় দশটা বেঝে যায়। দুজনের ভেজা কাপড় শরীরেই শুকিয়ে গেছে। দরজার কলিং বেল দিল তরু। এতক্ষণ বেশ চিন্তায় ছিলেন নুর নাহার। কলিং বেল এর শব্দ পেতেই দৌড়ে গেলেন দরজা খুলতে। দরজা খুলেতে খুলতে প্রস্তুতি নিলেন কিছু বলার জন্য। কিন্তু তরুর মাথায় ব্যান্ডেজ দেখে যা বলার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেছিলেন তা গলার কাছে এনেই গিলে নিলেন। কি হয়েছে জানার জন্য ব্যাস্ত হয়ে গেলেন। তরু এতবার বলল যে কিছু হয় নি তবুও তিনি না শুনে ছাড়বেন না৷

– আরে ফুপি ভেতরে তো ঢুকতে দাও।
দরজা থেকে সরে দাড়ালেন নুর নাহার। তবে তিনি আবার তরুর পেছন পেছন হাটা ধরলেন। এদিকে তুরাগ নিজের রুমে চলে গেল। এখন ফ্রেশ হওয়া অত্যান্ত জরুরি।
এদিকে তরুর শুরু হয়ে গেছে হাচি। হাচি দিতে দিতে নাক মুখ লাল বর্ন ধারণ করেছে। নুর নাহার এবার ঘাবড়ে যান। তরুর অসুস্থ হওয়ার থেকেও বড় কথা নুরুল ইসলাম তাকে কথা শোনাতে ছাড়বেন না৷ তরুকে ধরে ওর রুমে নিয়ে আসে। এদিকে তরুর শরীর একটু একটু করে খারাপ হতে থাকে।

রাত্রবেলা গা কাপিয়ে জ্বর আসে তরুর। নুর নাহার এর আজ আর ঘুম আসে না। তিনি বসে থাকেন ভাতিজির মাথার কাছে। একটু চোখ লেগে আসছিল। এমন সময় তরুর ফুপি ফুপি বলা শুনে ঘুম ছুটে পালালো৷ জ্বরের ঘোরেই হাত দিয়ে ফুপির হাতটা ধরল।

ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ১৬

– কি হলো মামনি কিছু বলবে?
– ফুপি একটা কথা রাখবে?
– হ্যা বলো। অবশ্যই রাখব।
– চলো না আমরা সবাই মিলে গিয়ে মিথিলা আপুকে নিয়ে আসি। তুমি তাকে স্যরি বলবা৷ পারবা না।
জ্বরের ঘোরে নাকি মানুষ আবোল তাবোল বকে। তবে তরু এসব কি বলছে।

ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ১৮