ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ১৮

ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ১৮
নীহারিকা নুর

সন্তান অসুস্থ হলে মা যেমন পাশে বসে সারা রাত সেবা করে তেমনি সারাটা রাত জেগে পাশে বসে সেবা করে গেছেন নুর নাহার। মাথায় জলপট্টি দিয়েছেন। স্যুপ করে এনে খায়িয়েছেন।
সকালের মিষ্টি রোধ জানালার ফাক গলিয়ে তরুর চোখে পড়তেই ঘুম ভেঙে গেল তরুর। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসতেই পাশে নুরনাহারকে দেখতে পেলেন।

জলপট্টি দিয়ে খাটের পাশেই মাথা ঠেকিয়ে বসে ছিলেন নুরনাহার। সেখানেই ঘুমিয়ে গিয়েছিলেন। অবাক হয় তরু। কত সরল দেখাচ্ছে মুখখানা। এই মুহুর্তে তরুর যেন সব অবিশ্বাস্য লাগছে। কাল মোহনার বলা নুরনাহার এর সাথে এই নুরনাহার এর যেন কোন মিল নেই। ছোট থেকে ফুপুদের আসা যাওয়া একটু কম ছিল বাড়িতে। তবে যখন আসত খুব আদর করত তরুকে। অথচ কাল মোহনার ভাষায় তাকে অহংকারী বলা হলো। সব গোলমেলে লাগে তরুর। আবার মনে হয় হয়ত সেই এক্সিডেন্ট এর পরেই কিছুটা নরম হয়েছেন। কি জানি৷

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

– কি ব্যাপার এভাবে এক ধ্যানে তাকিয়ে কি দেখছো মামনি?
নুর নাহার এর কন্ঠ কানে যেতেই অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে তাকায় তরু। এতক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তার দিকে তাকিয়ে ভাবনায় পড়ে গিয়েছিল। নুরনাহার নেমে দাড়ায় বেড ছেড়ে। এদিক ঘুরে এগিয়ে আসে তরুর সামনে। হাত রাখে তরুর কপালে। জ্বর আছে কিনা অনুমান করার চেষ্টা করে। জ্বর কমে গেছে অনেকটা। হাপ ছেড়ে বাচলেন নুরনাহার। জবাবদিহি বিষয়টা তার মোটেই ভালো লাগে না।

– তোমার জ্বর তো কমে গেছে। কিছু খাবে? নুডলস করে দেই?
– আরে ব্যাস্ত হইও না ফুপি। আর আমার ভার্সিটির এডমিশন ডেট কিন্তু সামনেই।
– আচ্ছা আমি দেখবো। এখন কিছু তো খাবে। সারারাত জ্বর ছিল। এখন ক্লান্ত লাগছে নিশ্চয়ই। তুমি ফ্রেশ হও।
তরু বেড থেকে নামতে না নামতেই কলিং বেল বাজার শব্দ পাওয়া যায়।

– এই সকালে কে আসল ফুপি?
– কি জানি। তুমি ফ্রেশ হও আমি দেখছি।
তরুকে সেখানে রেখেই বেরিয়ে যান তিনি। তবে তরুর কৌতুহল হয় জানার। তাই ফ্রেশ না হয়ে উপর থেকে উকি দেয় দেখার জন্য কে এসেছে?

সেই মুহুর্তে সেখান থেকে তুরাগ যাচ্ছিল নিচের দিকে। তরুকে এভাবে উকি ঝুঁকি দিতে দেখে জিজ্ঞেস করে – কি মিস তরুলতা এভাবে উকি ঝুঁকি দিয়ে কি দেখছেন? আমাদের বাসায় চু’রি করার ধান্দা আছে নাকি?
সকাল সকালই মেজাজ খারাপ করে দিল। আস্ত একটা খবিশ। তবে এই মুহুর্তে তার সাথে তর্ক করার মোটেও ইচ্ছে নেই তরুর। তাই বলল নিচে কে এসেছে দেখতে এসেছি।

– ওহ চলুন আমিও দেখি।
এরপর দুজনেই নিচের দিকে তাকায় দেখার জন্য। নিচে একটা মেয়ে এসেছে। মুখে মাস্ক পড়া। তরু চিনতে পারে না। তখনই মাথায় একটা গাট্টা মে’রে তুরাগ বলে – আপনার সাথে বাদরামি করার জন্য আরেক বাদর চলে এসেছে।

– কিহহ।
– বাদর নাম্বার ২।
– তুরফা…
– হুম।
তরু আর কিছু না ভেবে ছুট লাগায় নিচের দিকে। পেছন থেকে চুলের বিনুনি টেনে ধরে তুরাগ।
চুলে অনেক ব্যাথা লাগে তরুর। এবার মেজাজটা বেশিই খারাপ হয়।

– কি সমস্যা কি আপনার।
– আরে এমন হনুমান এর মতো নিচে যাচ্ছেন কেন? মুখ তেলতেলে হয়ে গেছে, চোখে ময়লা। ওয়াক। যান ফ্রেশ হয়ে তারপর নিচে যাবেন।

মুখ থমথমে হয় তরুর। ঘুম থেকে উঠে খেয়াল করে নি চোখের দিকে। আর ঘুমুলে মুখটা একটু তেলতেলে হয়ে যায়। এজন্য এভাবে ওয়াক করার কি আছে। কথায় বলে না যার জন্য করি চু’রি সেই বলে চোর। এই লোকের গার্লফ্রেন্ডকে আনার প্লান করতাছে ও আর এই লোক ওকে অপমান করার কোন উপায় যেন ছাড়তে চায় না।
সামনে এগিয়ে চুলের বিনুনি টেনে ছাড়িয়ে নিল তরু। এরপর পেছন ঘুরে নিজের রুমে ঢুকে তুরাগ এর মুখের উপর দরজা লাগিয়ে নিল।

আহাম্মক হয়ে দাড়িয়ে রইল তুরাগ। ও তো এভাবে বলেছিল তরুকে ক্ষেপানোর জন্য। তবে তরুর এভাবে চুপচাপ চলে যাওয়াটা ঠিক লাগল না তুরাগ এর। তবে কি মেয়েটা কষ্ট পেল। যাই হোক পরে দেখা যাবে নে।
নিচের দিকে পা বাড়ায় তুরাগ। আজ তাড়াতাড়িই বেরুবে। এদিকে নির্বাচন চলে এসেছে। পার্টি অফিসে যেতেই হবে আজকে। নয়ত কালাম ভাই ভীষণ ক্ষেপে যাবেন। আগে এখান থেকে তুরফার সাথে দেখা করেই বেড়িয়ে যাবে তুরাগ।

কেমন আছো ভাইয়া?
সিড়ি বেয়ে তুরাগকে নামতে দেখেই কথাটা জিজ্ঞেস করলে তুরফা৷ ও তো উপরেই যাচ্ছিল তুরাগ এর সাথে দেখা করতে। মাঝপথে ভাইয়ের সাথে দেখা হওয়ায় আবার উল্টো ঘুরে ভাইয়ের সাথেই নিচে নেমে এলো তুরফা। তুরাগ তুরফার কথার জবাব দিয়েই জানতে চাইল

– তা এই সকাল সকাল কোত্থেকে টপকালি তুই?
– আমার এক্সাম শেষ। কালকেই শেষ হয়েছে। পাচটায় এক্সাম শেষ হয়েছে। বাসায় লাগেজ গোছানো ছিল। বাসায় গিয়ে ফাইল পত্র গুছিয়ে রেখে তখনই রওনা দিয়েছি। নাইট কোচে ঢাকায়। আর এখন তোদের বাড়িতে টপকাইছি।

– এ বাসাটা মনে হয় তোর না?
– অবশ্যই না। ভার্সিটি এডমিশন এর পরই তো এটা পর হয়ে গেছে। ভার্সিটি শেষ করে শ্বশুর বাড়ি যাব। তোদের বাসায় আর থাকব না হুহ।

– হুহ বুজেছি। দাড়া বাসায় এসে আম্মুকে বলতেছি। তোর যে নতুন বাড়িতে যাওয়ার ইচ্ছে সেটা জানাতে হবে না।
– ভাইয়াআআআআ
– আমার পার্টি অফিসে যেতে হবে। আসছি আমি। বাসায় আরেকটা বাদর আছে। চুল টেনে দিয়েছি বলে চটেছে বোধ হয়। দেখ গিয়ে।
– কে ভাইয়া।

– বাদড়ে বাদড়ে মাসতুতো ভাই তাই না। যা তোর মাসতুতো ভাইকে খোজ।
তুরাগ আর কথা না বলে বেড়িয়ে গেল।
তুরাগ বেড়িয়ে যেতেই ফিক করে হেসে দিল তুরফা। তার ভাইয়ের যত কাজের চাপ থাক, যত সমস্যা থাক তার সামনে কখনো তা প্রকাশ করে না। তার সাথে সর্বধা খুনসুটি করেন। ভালোই লাগে ভাইয়ের এই ভালোবাসা।
কে এসেছে সেটা দেখা জরুরি। সোফা থেকে উঠে দাড়ায় তুরফা। পা টিপে টিপে কিচেন এর সামনে যায়।

– ভেতরে আয়। এখনো কি বাচ্চা নাকি এমন পা টিপে হাটছিস কেন।
– ওফফ আম্মু তোমাকে দেখতে কে বলেছে। আচ্ছা কে এসেছে আমাদের বাসায়?
– তরু এসেছে।
– কিহহ। তুমি আগে বলবে না। ছোট পুতুল আমাদের বাসায় আসছে।
– ঢং বাদ দে। তরু এখন অনেক বড়। ভার্সিটি এডমিশন নিবে ও।
– যাই হোক। আমি দেখে আসি।

উপরে এসে খুজে বের করল তরুর রুম। কিন্তু ভেতর থেকে বন্ধ দেখে অবাক লাগল তুরফার। দরজা বন্ধ করে আছে কেন। আজব। আস্তে আস্তে দরজায় ধাক্কা দেয় তুরফা। অল্প সময় ব্যাবধানে দরজা খুলে দেয় তরু। সামনে তরুকে দেখে হালকা করে জড়িয়ে ধরে তুরফা। এতক্ষণের মন খারাপ যেন মুহুর্তেই ভালো হয়ে গেলো তরুর।

– অনেক দিন পর দেখলাম পিচ্চি। কেমন আছিস বল?
– আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুমি?
– আলহামদুলিল্লাহ।
– এত দিন পর দেখবা না। যাও আমাদের বাসায়।
– হুম তা ঠিক। অনেক দিন যাওয়া হয় না৷ বুঝিস ই তো স্টাডি নিয়ে ব্যাস্ত।
– হুম বুঝি বুঝি। তোমরা বড়লোক মানুষ। গরিব ুর বাড়ি কেন যাবা৷
– এই পা’গলি কি বলছিস তুই এসব।

– ঠিকই তো বলছি। তোমাদের এই টাকা পয়সাই তো আজ একটা মেয়ের জীবন শেষ করে দিয়েছে তুরফা আপু।
তরুর মুখে এসব শুনে চোখ বড়বড় হয়ে যায় তুরফার। তরু এসব কীভাবে জানল। তরুকে জিজ্ঞেস করে
– তুই কি মিথির কথা বলছিস।
– হুম।
– তার কথা কীভাবে জানিস?

– আমি তুরাগ ভাইয়ার সাথে মিথিলা আপুর বাসায় গিয়েছিলাম।
তুরফা বুঝে না কি হচ্ছে এখানে। ওর যে মিথিলার সাথে যোগাযোগ হয় না এমন নয়। ফোনে কথা হয়। সেই আগের ন্যায় বন্ধুত্বটা রয়ে গেছে। তবে তুরাগকে সব ধরনের কথা এড়িয়ে যায় মিথিলা। তুরাগ ভাইয়া এখনো মিথিলার বাসায় যায় এটা মিথিলা তুরফাকে কখনো বলেনি তাই মনঃক্ষুণ্ন হয় তুরফা।
আচ্ছা তরু আমি ফ্রেশ হয়ে আসি। এ ব্যাপারে পরে কথা বলব। পুরো রাত জেগে ছিলাম ঘুম আসছে অনেক। বেড়িয়ে যায় তুরফা।

সেখানেই দাড়িয়ে থাকে তরু। সবাই এভাবে এড়িয়ে যায় কেন। কাল রাতে জ্বর ছিল ঠিকই। তবে হুশে ছিল তরু৷ আর জ্বরের ঘোরে কথা বলার অভ্যাস নেই তরুর৷ ইচ্ছে করেই ফুপিকে বলেছিল মিথিলা আপুকে এ বাসায় আনার জন্য। তবে তিনি এড়িয়ে গেছেন।

ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ১৭

এখন আবাট তুরফাও ঘুমের কথা বলে চলে গেল। তাহলে কেউ কি চায় না মিথিলা ফিরে আসুক। এটার কারণ কি আপু হাটতে পারে না এটা। তারা কি বোঝা এড়িয়ে যওয়ার প্রচেষ্টা করতেছে। তারা যদি এমনটা ভেবেও থাকে তবে তা হতে দিবে না তরু।

ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ১৯