ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ১৯

ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ১৯
নীহারিকা নুর

ভাইয়া তুই কোথায় আছিস তাড়াতাড়ি বাসায় আয়। আমরা এখনি বের হবো। মিথিদের বাসায় যাবো। জলদি আয়। কোন ব্যাস্ততা দেখাবে না। তাড়াতাড়ি চলে আসবে।
– এই তোরা কেন যাবি ও বাসায়? আমি গতকালই গিয়েছিলাম আজ আবার কেন যাবো?
– তোমাকে আসতে বলছি আসো। আম্মুও যাবে।

আর কোন কথা না বলেই লাইন কে’টে দেয় তুরফা। ফোন হাতে নিয়ে সেদিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে তুরাগ। হচ্ছে টা কি এসব। কিছুই তো বুঝতেছে না।
তুরাগকে এভাবে এক ধ্যানে ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে আসল প্রান্ত। পেছন থেকে কাধে হাত রাখতেই সেদিকে ঘুরে তাকালো তুরাগ। প্রান্ত জানতে চাইলো

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

– কি হয়েছে এভাবে অন্যমনস্ক হয়ে বসে আছিস যে?
– কি করব ভাবছি।
– কি ভাবছিস সেটাই তো জানতে চাচ্ছি।
– আম্মু নাকি মিথিলাদের বাসায় যেতে চাচ্ছে আবার।
– কিহহহহ।

– এভাবে চেচাস কেন আশপাশে দলের ছেলেপুলেরা আছে।
– আচ্ছা আচ্ছা। কিন্তু কেমনে সম্ভব ভাই।
– তুই ও যেখানে আমিও সেখানে। এখন কীভাবে বলব বল। আমাকে বাসায় যেতে বলছে। আমাকেও নাকি নিয়ে যাবে।
– তুই রাজি হয়েছিস?
– তার কি সময় দিছে। বাসায় যেতে হবে বলে ফোন কে’টে দিল।
– তাহলে তো তোর একবার বাসায় গিয়ে দেখা উচিত।
– এদিক সামলাতে পারবি তো।
– একদম।
– আচ্ছা।

– কি ব্যাপার সবাই তৈরি হয়ে বসে আছো যে। আর সবাই যাবেই বা কেন?
– আমাদের ভালো লেগেছে তাই যাবো। যদি যেতে চাস তাহলে গাড়ি বের কর৷ নয়ত ড্রাইভারকে নিয়ে আমরা একাই চলে যাব।
– অদ্ভুত। বললে কি জাত যাবে নাকি।
– মিথিলাকে দেখতে যাব। এবার হয়েছে। এবার গাড়ি বের কর।
নুরনাহার যেতে চেয়েছে এখন তাকে বললেও সে কোন ভাবেই শুনবে না তাই বাধ্য হয়ে তুরাগ চলে যায় গাড়ি বের করতে। ড্রাইভারকে নেয় না তুরাগ। তুরাগ নিজেই ড্রাইভিং সিট এ বসে পড়ে। ফ্রন্ট সিটে বসে নুরনাহার। আর তরু আর তুরফা দুজন পেছনে।

সবাই মিলে রওনা দিয়েছে মিথিলার বাড়ির উদ্দেশ্যে। আজ যে করেই হোক মিথিলাকে ঢাকা নিয়ে আসবেই সেটা নিয়ে আলোচনা করে তুরফা আর তরু। এ নিয়ে বেশ অনেক প্লান করা হয়ে গেছে সকাল থেকে। সেখানে গিয়ে কি বলবে না বলবে সব ভাবা হয়ে গেছে। মিথিলার বাড়ি পৌঁছে দরজায় কড়া নাড়তেই দড়জা খুলে দেয় মোহনা। তরু আর তুরফাকে দেখে মোহনার মুখে হাসি ফুটে উঠে, ঠোঁটে মিষ্টি হাসি ফুটিয়ে বলে,

তুরফা আপু কেমন আছো তুমি? কত দিন পর এলে আমাদেরকে দেখতে?
তুরফা মোহনার হাসি মাখা মুখের দিকে তাকিয়ে নিজে একটা হাসি দিয়ে মোহনার গাল টেনে বলে,
আলহামদুলিল্লাহ, আমি ভালো আছি। তুই বল তোরা কেমন আছিস?
মোহনা হাসি মুখে জানায় তারাও ভালো আছে। তুরফার পাশে তরুকে দেখে বলে,

আমিও কি পাগল তোমাদেরকে দরজার সামনে দাঁড় করিয়ে কথা বলছি। এসো ভীতরে এসো।
তরু আর তুরফা ভিতরে প্রবেশ করে। তাদের পেছনেই দাড়িয়ে ছিল নুরনাহার আর তুরাগ। নুরনাহার এর মুখে নেমে এসোছিল অন্ধকার। এটা কিসের তা বুঝতে পারল না মোহনা। তবে মিষ্টি হেসে সালাম দিল মোহনা৷ তিনিও একটু মুচকি হাসি দিয়ে সালাম এর জবাব দিলেন। পুরো বিষয়টায় তুরাগ ছিল নিশ্চুপ। মোহনাও আর তাকে ঘাটায় নি।তরু মোহনাকে জিজ্ঞেস করে,

মিথিপুর রুমে যাব আমরা।
হ্যাঁ তোমরা যাও আমি আসছি।
মোহনার কথায় সম্মতি জানিয়ে তরু আর তুরফা মিথিলার ঘরের দিকে যায় আর মোহনা চলে যায় ওদের জন্য নাস্তা রেডি করতে।

মিথিলার ঘরের দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করলো তরু আর তুর্ফা দড়জা খোলার শব্দ পেয়ে মিথিলা দরজার দিকে তাকায়।
তরু আর তুরফাকে দেখে মৃদু হাসে। তুরফা মিথিলার মাথায় পাশে গিয়ে বসে আর তরু আগের দিন যেখানে বসে ছিল ঠিক সেখানেই বসে। মিথিলা বালিশে হেলান দিয়ে বসা ছিল। তুরফা এগিয়ে গিয়ে বুকে জড়িয়ে নেয় মিথিলাকে। মিথিলার চোখ ছলছল হয়।৷ এই তুরফা মেয়েটা বড্ড ভালোবাসে ওকে। মিথিলা এটা বুঝে পায় না যে ওমন মেন্টালিটির মায়ের এরকম মিশুক একটা মেয়ে হতে পারে।

মিথিলার চোখে পানি দেখে নিজ হাতে মুছিয়ে দেয় তুরফা।
এই বিষয়গুলো দেখে লজ্জা পায় তরু। এই সকাল বেলায়ই না কি ভুলটা বুঝেছিল তুরফাপুকে। অথচ দেখো তুরফাপু কত ভালোবাসে মিথিপুকে।
মিথিলার নহর যায় তরুর দিকে। তরুকে মাথা নিচু করে হাসতে দেখে মিথিলা জিজ্ঞেস করে

– কি ব্যাপার পিচ্চি মনে মনে কার কথা ভেবে হাসছো?
তুরফার কথায় লজ্জা পায় তরু।
– আরে আপু কি যে বলো না৷ কার কথা ভাববো আবার।
– তুমি তো কালকেই দেখে গেলে। আজই আবার চলে এলে যে। ভীষণ মিস করছিলে বুঝি আমাকে।
– হুম খুউউব৷ তোমার মতো একটা মিষ্টি মেয়েকে মিস না করে পারা যায়। তবে আরো একটা আবদার নিয়ে আমরা এসেছি৷ আমি তো তোমার ছোট বোনের মতোই তাই না। ছোট বোন হলে আবদার তুমি রাখতে না আপু।

– আরে পা’গলি মেয়ে এভাবে বলছো কেন। আচ্ছা কি বলবে বলো না।
– না ইয়ে মানে। এই তুরফা আপু তুমি বলো না৷
– আমি….।
ওদের দুজনকে এভাবে করতে দেখে ধমক দেয় মিথিলা৷
– কি সমস্যা তোদের। আরে বল। টেনশন হয় তো আমার।
– আপু আমরা তোমাকে আমাদের সাথে নিয়ে যেতে এসেছি।
একদমে কথাগুলো বলে চোখ বন্ধ করে নেয় তরু। মিথিলা মাথা ঘুরিয়ে তুরফার দিকে তাকায়। তুরাফাও এক দৃষ্টিতে মিথিলার দিকে তাকিয়ে আছে।

– তুরফা ও এসব কি বলছে।
– ঠিকই বলছে। দেখ বোন আম্মু আর ভাই ও এসেছে। আম্মু অনুতপ্ত। সে ক্ষমা চাইতে এসেছে। তুই তাকে ক্ষমা করে দিস। ক্ষমা মানুষের মহত গুন৷ আমার আম্মু বলে বলছি না তবে কেউ অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চাইলে তাকে ক্ষমা করে দিতে হয়। আজ যদি তুই তাকে ফিরিয়ে দিস তবে তার আর তোর মধ্যে কোন পার্থক্য থাকবে না। সেও তো অহংকার করেছিল আর আজ তুই ক্ষমা না করে ইগো ধরে বসে থাকলে তোর আর তার মধ্যে পার্থক্য থাকবে না৷

কথাগুলো ভীষণ ভাবে কানে লাগে মিথিলার। আসলেই তাকে ক্ষমা করে দেয়া উচিত৷ তবে মিথিলা তো মনে মনে অনেক আগেই তাকে ক্ষমা করে দিয়েছে। সে যেটা করেছিল তার সন্তান এর ভালো ভেবেই করেছিল। প্রতিটা মা ই চাশ তার ছেলের জন্য দেখেশুনে একটা লক্ষী বউ আনতে। সেখানে যদি ছেলে তাকে সেই সুযোগ টা না দেয় তবে তার রাগ থাকতেই পারে এরা স্বাভাবিক। সেই রাগ থেকেই হয়ত কথাগুলো বলেছিল তিনি।

তবে এক্সিডেন্টটা ওর ভাগ্যে ছিল এজন্যই হয়েছে। এজন্য নুর নাহারকে দায়ী করাটা বোকামি। তাকে তো অনেক আগেই ক্ষমা করেছে। তবে তুরাগকে এভয়েড করার কারণ মিথিলা চাচ্ছিল তুরাগ যেন অন্য কাউকে বিয়ে করে সুখী হতে পারে। ও তুরাগ এর বোঝা হয়ে থাকতে চায় নি। তবে এখন সবাই যে সিচুয়েশনে ফেলছে মিথিলাকে হয়ত এখন অন্যরকম কিছু হয়েও যেতে পারে।

তুরাগ আর নুরনাহার সামনের রুমে রাখা চেয়ারে বসল। মোহনা ইতোমধ্যে চা নাস্তা দিয়ে গেছে সামনে। কিছু সময় পরে বাহির থেকে হাত মুছতে মুছতে ঘরে প্রবেশ করলেন মিথিলার মা শাহানা। তাকে আসতে দেখে উঠে দাড়ালেন নুরনাহার। মুখে হাসি ফুটিয়ে সালাম দিলেন।
নুরনাহার এর এই নম্র ব্যবহার ভীষণ পছন্দ হলো শাহানার। তিনি সালামের জবাব দিয়ে বললেন

– অনেক সময় অপেক্ষা করালাম আপা। আসলে বাহিরের রান্নাঘরে রান্না বসিয়েছি। তাই আসতে দেরী হলো।
– সমস্যা নেই আপা। আজ আপনি বাড়িতে যে। ডিউটি নেই।
– শরীরটা ভীষণ খারাপ লাগছে আপা তাই আজ ছুটি নিয়েছি।
মনটা কিছু টা খারাপ হলো নুর নাহার এর। আসলে আজ মিথিলার বাবা বেচে থাকলে হয়ত শাহানাকে এত কষ্ট সহ্য করতে হতো না। নিয়তি যে কখন কার সাথে কি খেলা খেলে কেউ বলতে পারে না।

বেশ অনুনয়ের সুরে শাহানার কাছে আবদার খানা পাতল নুরনাহার। কিন্তু প্রথম দফায় নাকোচ করে দিল শাহানা৷ গরীব হতে পারেন তবুও কারো দয়া নিয়ে বেচে থাকবেন না তিনি। প্রথম যখন মিথিলার বিয়ের কথা উঠেছিল তখন রাজী ছিলেন শাহানা। মেয়ে বিয়ে করে শ্বশুর বাড়ি গেলে কথাটা ভিন্ন ছিল। তবে তাদের পরিবার সহ সবাইকে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করছে নুরনাহার এটা কি করে সম্ভব।

নুরনাহার বেশ কয়েকবার ক্ষমা চাইলেন শাহানার কাছে। নুরনাহার বললেন তিনি মিথিলা মায়ের কাছে ও ক্ষমা চাইবেন।
নুরনাহার এর এভাবে ভালো মানষিকতা দেখে ভালো লাগল শাহানার। তবে তিনি ঢাকায় যেতে নারাজ।
তুরাগ ও অবাক চোখে তাকিয়ে আছে নুর নাহার এর দিকে। তার মায়ের এই রুপ তো ভীষণ অচেনা ওর কাছে। তিনি সব সময় তার কঠিন বাঘিনি রুপেই থাকেন। তবে আজ ভালোও লাগছে তুরাগ এর৷

– ড. আবির এভাবে আর কতদিন চলবে৷ আপনি এভাবে গা ঢাকা দিয়ে কেন রয়েছেন। এভাবে থাকলে তো সমস্ত কাজ বন্ধ হয়ে পড়ে থাকবে।
– স্যার বোঝার চেষ্টা করুন। আমি চাইলেও আসতে পারছি না। আমাকে চব্বিশ ঘণ্টা অবজরবেশন এ রাখা হচ্ছে। বাড়ির চারপাশে পুলিশ এর টহল। চেম্বার এর চারপাশে পুলিশ এর টহল। কি করব আমি।

– তাহলে তোমার বাবা বুড়োটা ঘাপটি মে’রে আছে কেন? দেখো আবির কোন ভুলচুক করার চিন্তা ভুলেও করো না। বেচে ফিরতে পারবে না বলে দিলাম। এই রাস্তায় আসা যতটা কঠিন এই পথ থেকে ফিরে আসা তার থেকেও বেশি কঠিন। যেহেতু একবার এসেই পড়েছো তাহলে আর কোন চালাকি করার চেষ্টা করো না।
– স্যার আপনি কি বলছেন এসব। আমি কোনদিন ও আপনার সাথে বেইমানি করব না আই প্রমিজ।
– হুহ গ্রেট। তবে সাবধান ভুলেও পুলিশ এর জেড়ার মুখে পড়ো না। পুলিশ তোমাকে সন্দেহ করতেছে তার মানে নিশ্চয়ই তোমার বিরুদ্বে কোন ক্লু পেয়েছে। একটা পদক্ষেপ ও যেন ভুল না হয়।

– স্যার এই নুরুল ইসলাম কিন্তু অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করতেছে। কেন আর কোন পুলিশ অফিসার নেই। তারা তো এত বাড়াবাড়ি করে না। শুনেছি এখন আবার ঢাকায় আসতেছে।
– তাহলে ওর পোস্টিং টা পাহাড়ি এলাকায় করার ব্যাবস্থা করি কি বলো আবির।
– ভালো সিদ্ধান্ত স্যার। তবে আমার মনে হয় আমাদের প্রথম এট্যাক ওর কলিজায় করা উচিত।
– কি বলছো আবির?

– স্যার ওর মেয়েকে আমাদের ডেরায় নিয়ে আসি। তারপর অর্গান গুলো রেখে বডিটা ভাসিয়ে দেই।
– হা হা হা। জিনিয়াস আবির৷ এজন্যই তো তোমাকে এত ভালো লাগে আমার।
– আর একটা নিউজ আছে স্যার।
– হুম বলো।

– নুরুল ইসলাম এর মেয়ে এখন আপনার চিরশত্রু কালাম মোল্লার ডানহাত তুরাগ সাইয়্যিদ এর বাসায়।
– কি বলছ।
– ইয়েস স্যার।
– এক ঢিলে সব পাখি খতম।

ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ১৮

কথা শেষ করে বিচ্ছিরি ভাবে হাসতে হাসতে ফোন কে’টে দিল ফোনের অপর পাশে থাকা লোকটি। ফোন হাতে বসে আছে আবির আহমেদ। এক ঢিলে সব পাখি বলতে কি বুঝিয়েছে এটা বুঝল না সে।

ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ২০