ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ২০

ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ২০
নীহারিকা নুর

সারাদিন নীরবাচ্ছন্ন হয়ে থাকা পরিবেশটা এখন মানুষের কোলাহলে হই হই করছে৷ তায়েফ সাইয়িদ বাসা থেকো বেরিয়ে যাওয়ার পর নুরনাহার একা বাসায় থাকত। একা একা বোরিং হয়ে যেত। আর সেই বাসাটাই এখন কিনা মানুষের কোলাহলে পরিপূর্ণ। যেন পূর্ন একটা ফ্যামিলি মনে হচ্ছে তাদের।
মিথিলা এ বাসায় আসতে রাজি হওয়াতেই মুলত খুশির বন্যা নেমেছে। সব থেকে বেশি খুশি তো তুরাগ হয়েছে। যেভাবেই রাজি হোক না কেন হয়েছে যে এই বেশি।

দিন তার আপন গতিতে চলে যাচ্ছে। তুরফার ভার্সিটির ছুটি শেষ হওয়ায় তুরফাকে চলে যেতে হয়েছে। তুরাগ আবারও তার শখের প্রফেশনটায় একটু একটু করে জয়েন করার চেষ্টা করতেছে। এখন কারো ইনভাইটেশন ফিরায় না৷ কোনখানে কনসার্ট হলে সেখানে এটেন্ড করে। বাসায় বসে সে লাইভ প্রোগ্রাম দেখে মিথিলা, তরু এমনকি বাসার সবাই। তুরাগ এর গান সর্বধাই সবার পছন্দের তালিকায় শীর্ষ স্থান দখল করে ছিল।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সবার লাইফ মোটামুটি হাসি খুশিই চলছিল। মোহনা আর তরু ব্যাচমেট হওয়ায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয় ওদের সেম ভার্সিটিতেই ভর্তি করে দিবে। যাতে দুজন সব সময় এক সাথেই থাকতে পারে। তরু আর মোহানার ফ্রেন্ডশিপটাও জমজমাট।
সেদিন নুরনাহার এর কথা মতো তুরাগই তরু আর মোহনাকে ভার্সিটিতে এডমিট করিয়ে গিয়েছে। সেখানে অবশ্য দুজনকে কাজিন বলেই পরিচয় দিয়ে এসেছে।

প্রথম দিন তুরাগ নিজেই মোহনা আর তরুকে ভার্সিটির সামনে নামিয়ে দিয়ে গেছে। গেট থেকে দুজন আস্তে আস্তে ভেতরের দিকে পা বাড়াচ্ছে। তখন দূর থেকে ছেলেদের শিস বাজানোর শব্দ কানে এলো। মোহনা খপ করে হাত চেপে ধরল তরুর। তরু যে ভয় পায় নি এমনটা নয়।

তবুও স্ট্রং থাকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ফার্স্ট ডে তে র্যাগিং এর বহু কাহিনি শুনেছে। ভয় মূলত এখানেই। ওরা শিস বাজানো ছেলেগুলোর দিকে পাত্তা না দিয়ে আবারও পা বাড়ায় ক্লাসরুমের দিকে। তখনি দুটো ছেলে এসে হাত আড়াআড়ি করে দাড়ায় ওদের সামনে। মোহনা দুপা পিছিয়ে যায়। তখনো তরুর হাত ধরা। তরু আবার পেছন থেকে টেনে ওকে সামনে আনে। ফিসফিস করে বলে ভয় পাস না এদের সামনে৷ এরপর তরুই জানতে চায়

– কি চাই।
– বাহ। প্রথম দিনেই এত তেজ। ভালো লাগল। তবে এত তেজ থাকা ভালো না মেয়েদের বুঝলি।
– সেটা বলতে বাধ্য নই। ক্লাস শুরু হয়ে যাবে। সরুন সামনে থেকে।
– ভার্সিটিতে এসেই সিনিয়রদের সাথে তিড়িং বিড়িং করো না মেয়ে খুব বড় বিপদে পড়ে যাবে।
ছেলে গুলোর ধমকানি শুনে ভয় পাচ্ছে মোহনা। ছেলেগুলো বলল ওদের ভাই নাকি ডাকছে তার ওখানে।

মোহনা বলে তরু চলো যাই। নয়ত ওরা যদি সিনক্রিয়েট করে। মোহনার কথায়ই সামনের দিকে পা বাড়ালো তরু।
একটা ছেলে বাইকের উপর বসে সানগ্লাসটা হাতে নিয়ে সেটা ঘুরাচ্ছে। দূর থেকে দেখেই কেমন অভদ্র টাইপ মনে হলো তরুর। আরেকটু সামনে যেতেই চেহারা স্পষ্ট হলো। এই ছেলেকে তো চিনে তরু৷ একবার না বেশ কয়েকবার দেখেছে ওকে। এমনকি ওদের বিয়ের দিনও দেখেছে।

এ তো ড. আবির আহমেদ এর ছোট ভাই। একে দেখেই মাথার শিরা দপদপ করে জ্বলে ওঠে তরুর। এর ভাই যেমন খারাপ এ ছেলেও তো বখাটে। এদের বাবার আসলে বাবা হওয়ারই কোন যোগ্যতা নেই। একটা ছেলেকেও মনুষত্য শেখাতে পারলেন না। পড়ালেখা শিখলে আর পাঠ্য বইয়ে মুখ গুজে থাকলেই মনুষ্যত্ব্য অর্জিত হয় না। এটা একটা আলাদা গুন। যেগুলো মানুষ পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান থেকে শেখে। অবশ্য এদের বাবা নিজেই তো অবৈধ পন্হায় উপার্জন করেন।

এসব ভাবতে ভাবতেই সেই ছেলেগুলোর সামনে চলে আসে তরু আর মোহনা। এতক্ষণ অন্য দিকে তাকিয়ে সানগ্লাস ঘুরাতে থাকলেও তরুর দিকে চোখ পড়ার পর সানগ্লাস ঘোরানো অফ হয়ে যায়। এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। তরুরা গিয়ে দাড়াতেই পাশ থেকে একটা ছেলে বলে ওঠে

– এটা আদিব ভাই। সালাম দেও তাকে।
মোহনা মিনমিনে কন্ঠে সালাম দেয়। আদিব সালাম এর জবাব না দিয়ে তরুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে
– কি ব্যাপার আপনি সালাম দিবেন না ভাবি?
আদিব এর মুখে ভাবি ডাক শুনে শরীর জ্বলে উঠল তরুর। এই ছেলে ওকে জ্বালানোর জন্যই ভাবি বলছে। আদিব এর মুখে ভাবি ডাক শুনে পাশে দাড়ানো ছেলেগুলো চোখ বড়বড় তাকালো। তারা তো আর জানে না গ্রামে কি হয়েছিল।

– আমি কারো ভাবি নই। কোন খারাপ লোকের বউ হওয়ার ইচ্ছে ও নেই আমার।
– ওপসস ভাবি কি যে বলন না। বিয়ে না করে কি এমনি এমনি বেডে যাবেন নাকি। অবশ্য আপনার তো আগেও এক্সপেরিয়েন্স আছে। এখন চাইলে আমাদের ও একটু সুযোগ দিতে পারেন।

মেজাজ খারাপ হয় তরুর। এই ছেলেকে দূর থেকে দেখেই খারাপ মনে হয়েছিল তরুর।তবে ওর ধারণার থেকেও বেশি খারাপ এই ছেলে। র্যাগিং এর বিষয়টা মানলেও এরকম একটা নোংরা প্রস্তাব সহ্য হলো না তরুর। মোহনার হাত থেকে হাত টেনে ছাড়িয়ে নিল। আদিব এর৷ সামনে গিয়ে গায়ের জোর দিয়ে এক চড় দিল। সাথে সাথে গালে হাত চলে গেল আদিব এর। অন্য হাত দিয়ে কব্জি চেপে ধরল তরুর। দাতে দাত চেপে বলল

– নিজ ইচ্ছায় যখন যাও তখন দোষ হয় না৷ গ্রামে থেকে সুবিধা হচ্ছিল না তাই এখানে এসে নিছো। বুঝি না আমরা তাই না। তোর এই তেজ তো আমি দেখে নিব। একদিন এর জন্য হলেও তোরে আমার করব দেখিস।
হাত টানাটানি করে। ছাড়াতে পারে না। কিন্তু মুখে থুথু ছিটায় তরু। আর বলে
– তোর তো পরিবার এর শিক্ষার অভাব আছে। আর বললি না আমি নিজ ইচ্ছায় গেছি। ওগুলা তোর জা*নো*** ভাইর ইডিট করা ছিল। ছাড় বলতেছি।

মুখে থুথু দেয়ার সাথে সাথে হাত ছেড়ে দিয়ে ধাক্কা মে’রে ফেলে দিল তরুকে। তাল সামলাতে না পেরে নিচে পড়ে গেল তরু। মোহনা দৌড়ে গিয়ে তুলল তরুকে। তরু আবার উঠে যাচ্ছিল আদিবকে আঘাত করার জন্য। কিন্তু মোহনা হাত টেনে নিয়ে আসে সেখান থেকে।
– আনলি কেন আমাকে
– ওদের সাথে ঝামেলা করো না। দেখলে না পরা খারাপ।

তরু জোড়ে জোড়ে শ্বাস নেয়। রাগ কমানোর চেষ্টা করতেছে। নিজেকে উপরে উপরে যথেষ্ট স্ট্রং রাখার চেষ্টা করে তরু তবুও একটা চাপা ক্ষোভ তাদের উপর রয়েই গেছে যাদের জন্য আজ আম্মুকে ছেড়ে এত দূরের একটা শহরে এসে থাকতে হচ্ছে।
মোহনা তরুকে টেনে নিয়ে ফাস্ট ইয়ার এর ক্লাসের দিকে এগোয়। তরুকে আর মোহনাকে ঢুকতে দেখে কয়েকটা মেয়ে এগিয়ে আসে৷ কেউ নাম জিজ্ঞেস করতেছে।

আবার কেউ বলতেছে – তোমার তো অনেক সাহস৷ তুমি ওই আদিবকে চড় মেরেছো। জানো ও অনেক বাজে। বড়লোক বাপের বখে যাওয়া ছেলে। প্রচন্ড উগ্র টাইপের। যাচ্ছে তাই করে। মারধর ওর নিত্যদিনের স্বভাব। র বিরুদ্বে কোউ মুখ খুললে তাকেও ছাড়ে না ও। এসব কথা এখন ভালো লাগছে না তরুর। তাই কথা ঘুরাতে ও সবার কাছে পরিচয় জানতে চায়। তরু আর মোহনার সাথে আরো তিনটা মেয়ের ফ্রেন্ডশিপ হয়ে যায়। সাফা, ইভা আর সাহারা। তারা একসাইড জুড়ে বসে।

নিয়ম করে দুবার মিথিলার ঘরে গিয়ে মিথিলাকে দেখে আসে তুরাগ। যদিও মিথিলা বিরক্ত হয়। ও তুরাগকে খুব ভালো ভাবে বুঝিয়ে বলছে যে তুরাগ তোমার আর আমার সাথে আগে যা হয়েছে তুমি ভুলে যাও। উপরওয়ালা চায় নি আমি একটা সুন্দর জীবন পাই। এজন্যই তো এমনটা হলো৷ কিন্তু তুমি কেন তোমার জীবন নষ্ট করবে।

কিন্তু তুরাগ বেচারা। সে তো নাছোড়বান্দা। সে বিয়ে করলে মিথিলাকেই করবে। ছেলের ত্যাড়ামি স্বভাব সম্পর্কে এতদিনে মোটামুটি ভালোই অভিজ্ঞতা আছে তায়েফ সাইয়িদ আর নুরনাহার এর। তাই এখন তারাও চান যাতে মিথিলার সাথেই বিয়েটা হয়।

মিথিলার মায়ের অবশ্য এতে আপত্তি নেই। তার সাথে কথা হয়েছে আগে তুরাগ দের সিটি করপোরেশন এর নির্বাচন এর ঝামেলা শেষ হবে। এরপরেই নাহয় বিয়েটা হবে। এই কথাটা জানার পর তুরাগ এর সবথেকে কাছের বন্ধু প্রান্ত সেও বলেছিল

– এটা তোর কেমন ডিসিশন তুরাগ। একটা পা ছাড়া মেয়েকে বিয়ে করে তুই কি করবি বল। তোর জীবনের সব আনন্দই তো মাটি।
সেদিন তুরাগ রাগ না করে বরং প্রান্তর পিঠ চাপড়ে বলেছিল

– শোন প্রান্ত। মানুষের মনের শান্তি হচ্ছে সব থেকে বড় শান্তি। এর থেকে বেশি চাই না আমি। মিথিলার সাথে থাকলে আমি মানষিক শান্তি পাই। সেটা আর কোথায় পাবো বল।
তুরাগ এর কথার জবাবে সেদিন প্রান্ত উত্তর না দিয়ে শুধু একটা হাসি দিয়ে সেখান থেকে চলে যায়। মনে মনে অনেক কিছুই বলে যা তুরাগ এর কান অবধি আর আসে না৷ প্রান্ত চায় ও না তুরাগ শুনুক৷ মন যা চাইছে তা ই করুক।

কিছু সমস্যার কারণে নবীন বরণের ডেট টা কিছুটা পেছানো হয়েছিল। কিন্তু একদম অনুষ্ঠান করবে না এটা তো হয় না৷ তাই কতৃপক্ষ নবীন বরণের আয়োজন করে ক্লাস শুরুর পাচ থেকে ছয়দিন পরে।
এই কয়দিনে পাচজনের মধ্যে একটা ভালো বন্ডিং ও সৃস্টি হয়। ঠিক করে সবাই এক রকম শাড়ী পরেই ওরিয়েন্টেশন এ যাবে। যেই ভাবা সেই কাজ। পরেরদিন সবাই ওরিয়েন্টেশন এ একরকম শাড়ী পড়েই আসে। অনুষ্ঠান তখন মাঝামাঝি পর্যায়ে। স্টেজে নৃত্য পরিবেশন চলতেছে৷ সে সময় সাফা বলে কি

– তরু দোস্ত ওঠ না আমরা একটু ওদিকে যাই৷ তোর জিজু আসবে ওখানে। দেখতে চেয়েছিলি না তাকে৷ তরু মোহনাকে ডাকে। মোহনা বলে না এই গানটা আমার অনেক পছন্দের। এই নৃত্য মিস করা যাবে না তুই যা। তরু তো বোকার মতো সাফার সাথে চলে যায়। সাফা ওকে নিয়ে যেতে যেতে একদম ভার্সিটির পেছন সাইডে নিয়ে চলে আসে। তখন প্রায় দুপুর টাইম চলতেছে। এই তপ্ত রোদে সেদিকে তেমন একটা মানুষ জন ছিল না৷ খুব নীরব পরিবেশ৷ ভার্সিটির পেছন সাইডটায় আবার অনেক গাছপালাও রয়েছে। যার কারণে সেদিকটা কিছুটা অন্ধকারাচ্ছন্ন ও। তরু বলে

– সাফা আমরা ওদিকে কেন যাচ্ছি ।
– ভাইয়া ওখানেই যেতে বলেছে।
তরু বুঝে উঠে না যে সামনে ওর জন্য কি অপেক্ষা করতেছে। ভার্সিটি থেকে অনেকটা দূরে আসার পর দেখতে পায় সেখানে একটা গাছের সাথে হেলান দিয়ে আদিব দাড়িয়ে আছে। তরুকে দেখে অমনি খপ করে ওর হাত চেপে ধরে। ভীষণ ব্যাথা পায় তরু। চোখ দিয়ে পানি বের হওয়ার উপক্রম।

তরু সাফার দিকে তাকায়। সাফা এক পা এক পা করে পিছিয়ে যাচ্ছে। তরুর চোখে চোখ পড়তেই কানে হাত দিয়ে স্যরি বোঝায়। চোখ দিয়ে পানি বেড়িয়ে যায় তরুর। এজন্যই হয়ত কাউকে সহজে বিশ্বাস করতে হয় না। বন্ধু বানানোর সময়ও ভেবে চিন্তে বানাতে হয়। তরুর এটা ভেবেই কান্না আসে যে একটা মেয়ে হয়ে কীভাবে আরেকটা মেয়েকে এভাবে বিপদে ঠেলে দিতে পারে।

ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ১৯

( আমি কিন্তু একবারের জন্যও বলিনি তরু আর তুরাগ নায়ক নায়িকা নয়৷ মিথিলার সাথে তুরাগ এর মিল হবে তাও বলিনি৷ আপনারা কল্পনায় ওদের মিল করিয়ে দেন এটা আপনাদের ব্যাপার। আর শুরুতে বলেছিলাম এটা কাজিন লাভ। তবে অন্য কাজিন দের মতো ছোট বেলা থেকে ভালোবাসা নয়। খুব তাড়াতাড়ি শেষ করব গল্প। আমার এক্সাম। আপনাদের অপেক্ষা করাতে ভালো লাগে না। তাই তাড়াতাড়ি শেষ করার চেষ্টা করব। ধন্যবাদ)

ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ২১