বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৪৮

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৪৮
জাওয়াদ জামী

শাহনাজ সুলতানা ছেলের বউকে সোনার বালা দিয়ে বরণ করে নিলেন। তিনি তার টুকটুকিকে বুকে জরিয়ে নিলেন। শ্বাশুড়ির এমন ভালোবাসা পেয়ে সিক্তা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। ওর বারবার বাবা-মা’র কথা মনে হচ্ছে।

” একি টুকটুকি, তুই কাঁদছিস কেন, মা! মা’কে ছেড়ে এসে মন খারাপ লাগছে? কালকেই তো আবার মায়ের কাছে যাবি। এছাড়া তোর যখন মন চাইবে তখনই ঐ বাড়িতে যাবি। তোকে কেউ কিছু বলবেনা। চল মা, ভেতরে চল। তোর পছন্দের খাবার রান্না করেছি আমি। আমি নিজের হাতে তোকে খাইয়ে দিব। ” শাহনাজ সুলতানা পরম আদরে সিক্তাকে বাসায় নিয়ে গেলেন।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

দৃষ্টি ড্রয়িংরুমে বসে আনানের কাজিনদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিল। কিছুক্ষণ পর নিহানও তাদের সাথে যোগ দেয়। আড্ডার এক ফাঁকে ও দৃষ্টিকে ছাদে যেতে বলল। দৃষ্টি সুযোগ বুঝে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে ছাদে যায়।
নিহান অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ছিল। দৃষ্টি ভয়ে ভয়ে ছাদে এসে দাঁড়ায়। এদিক-সেদিক তাকিয়ে নিহানকে খোঁজে।
” এদিকে আয়। ভালো করে তাকিয়ে দেখ, আমি কোথায় আছি। ”

নিহানের কথা শুনে দৃষ্টি বুঝতে পারে ও কোথায় আছে। ও হাসিমুখে নিহানের কাছে যায়।
” এত রাতে ছাদে আসতে বললে কেন! কেউ দেখে ফেললে কি হবে বলতো? ” দৃষ্টি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল।
” ভয় পাচ্ছিস মনে হয়! আমি কি বা’ঘ না ভা’লু’ক, যে তোকে খেয়ে ফেলব? আর বিয়ে বাড়িতে আমরা কোথায় আছি সেই খোঁজ নিতে কেউই এখানে আসবেনা। এখন একটু কাছে আয়, তোকে জড়িয়ে ধরি। সবাই বিয়ে করে বউ নিয়ে দাঁত কেলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু আমি দেখ এতিমের মত বউ ছাড়া ঘুরছি। ”

নিহানের কথা শুনে দৃষ্টি হেসে ফেলল। কিন্তু হঠাৎই নিহান ওকে টেনে বুকে জরিয়ে নেয়। নিহানের এমন কাজে দৃষ্টি চমকায়। নিহানের বাহুডোর থেকেই থরথর করে কাঁপতে থাকে। জীবনে প্রথম পুরুষের স্পর্শে দৃষ্টি বেসামাল হয়ে গেছে। শরীরের কম্পন থামাতে ও আঁকড়ে ধরল নিহানকে। দৃষ্টির এভাবে আঁকড়ে ধরায়, নিহান নিজেকে সামলাতে পারছেনা। নিজের সাথে যুদ্ধ করে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করল নিহান।

দৃষ্টির কম্পন এখনো থামেনি। নিহান ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রয়েছে।
” দৃষ্টি, এভাবে কাঁপছিস কেন? আমাকে পা’গ’ল করে দিয়ে তুই নিজেই এভাবে কাঁপছিস! আমি তোকে এখন পর্যন্ত কিছুই করিনি। তাই কাঁপাকাঁপি বন্ধ করে, এই সময়টা উপভোগ কর। ”

” আমাকে ছাড়োনা, ভাইয়া। এভাবে থাকতে আমার ভিষণ অস্বস্তি লাগছে। ” দৃষ্টি কম্পমান গলায় বলল।
” এতটুকুতেই তোর অস্বস্তি হচ্ছে! তাহলে বাসর ঘরে তোর কি হবে রে, মামার মেয়ে? আমি কিছু করার আগেই কি সেন্সলেস হয়ে পরে থাকবি! এখন থেকে একটুআধটু অভ্যাস করে নে। ভবিষ্যতে কাজে লাগবে। ”
নিহানের কথা শুনে দৃষ্টি লজ্জায় কুঁকড়ে যায়।

” আচ্ছা ভাইয়া, ফুপু যদি আমাদের সম্পর্কের কথা জানে, তখন কি হবে? আবার আব্বু যদি জানতে পারে? আমার এসব কথা ভাবলেই ভয় লাগে। ”

” মামাকে পটানো কোন বিষয়ই নয়। তাকে আমি এক চুটকিতে পটিয়ে নিব। কিন্তু চিন্তা আমার আম্মুকে নিয়ে। বড় খালামনি কিংবা ছোট খালামনি হলে কোন চিন্তাই ছিলনা। তারা অনায়াসে আমার কথা মেনে নিত। কিন্তু আমার জননী অন্য ধাতুতে গড়া। তাকে মানাতে একটু কষ্টই হবে। তবে তুই চিন্তা করিসনা। অনার্স কমপ্লিট করেই, জবের চেষ্টা করব। একটা জব হয়ে গেলেই তোর কথা আম্মুকে বলব। ”

” তোমার অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা কবে? ”
” দুইমাস পর। পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তোর সাথে কম কথা হবে। তুই কিন্তু ভালো মেয়ে হয়ে থাকবি। রাস্তাঘাটে কারো সাথে কথা বলবিনা, হাসাহাসি করবিনা, ছেলেদের পাত্তা দিবিনা। তোর এসএসসি পরীক্ষারও তো দেরি নেই। মন দিয়ে পড়াশোনা করবি। রেজাল্ট কিন্তু ভালো হওয়া চাই। মনে থাকবে আমার কথা? ”

দৃষ্টি মাথা নেড়ে সায় দেয়।
সিক্তাকে বাসর ঘরে রেখে তনযা, দৃষ্টি, আরোশিসহ ওর কাজিনরা দরজা আগলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আনান নিজের রুমের সামনে এসে ওর কাজিন বাহিনীদের দেখে থমকে গেছে। ওদের সাথে নিহানও আছে।
” তোরা এমন খাম্বার মত দাঁড়িয়ে আছিস কেন! যা সর, ভেতরে ঢুকতে দে। আমার বউটা ভেতরে একা একা হাপিত্যেশ করছে, আর তোরা আমার দেরি করিয়ে দিচ্ছিস! ”

” দরজা খোলার চার্য দিলেই তবে ভেতরে ঢুকতে পারবে, তার আগে নয়। ” দৃষ্টি কাটকাট গলায় বলল।
” ঐ ছেমড়ি, তুই এই বাসায় কেন? তুই না কনে পক্ষের হয়ে গেইটে আমার কাছ থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা খসালি? যা ভাগ, তোকে কোন টাকা দেয়া হবেনা। ” আনান দৃষ্টিকে ধমক দেয়।

” তোমার এসব হম্বিতম্বিতে কোনও কাজ হবেনা। আপাতত তোমাকে দেখে আমরা ভয় পাচ্ছিনা। যদিও কোন কালেই তোমাকে ভয় করিনি। তাই এত কথা না বলে দশ হাজার টাকা দিয়ে দাও। ” এবার তনয়া কথা বলল।
” ঐ মাইয়া, তুইও কনে পক্ষের শ’ত্রু। তোরা আজ আমার স’র্ব’না’শ করে দিয়েছিস। গুনে গুনে পঞ্চাশ হাজার টাকা হাতিয়ে নিলি! আমার বাপের কত পরিশ্রমের টাকা। তোদেরকে আর একটা টাকাও দেবনা। যদি এখান থেকে না যাস, তবে একেকজনকে ঠেঙ্গিয়ে হসপিটালে পাঠাব। ”

” দিয়ে দে, আনান। বাচ্চা মেয়েদের আবদার রাখ। তুইতো পরে আর বিয়ে করবিনা, যে আবার তোর থেকে ওরা টাকা আদায় করবে। তাই মেয়েরা যা চাইছে দিয়ে দে। আর তাছাড়া তোর কাছে এখনও বিশ হাজার টাকা আছে। ওরা তো সব টাকা চায়নি। ” নিহান এবার মেয়েদের পক্ষ নিল।

” নিহান, তুইও শেষ পর্যন্ত শ’ত্রু’প’ক্ষে’র সাথে হাত মিলিয়েছিস! ঘুষ নিয়েছিস নিশ্চয়ই? তা কি ঘুষ দিল ওরা? ”
” বাজে কথা বাদ দিয়ে ওরা যা চাইছে দিয়ে দে। নইলে আজ রাতে তোকে অন্য রুমে কাটাতে হবে। আর আমি কখনো মিথ্যা বলিনা, তুই এটা ভালো করেই জানিস। ”

নিহানের হুমকিতে কাজ হয়। আনান মুখ কালো করে ওদেরকে টাকা দিয়ে রুমে ঢোকে।
বাসর ঘরে সিক্তা ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আনান রুমে এসে সিক্তাকে কাঁদতে দেখে পড়িমরি করে ওর কাছে ছুটে যায়।
” সিক্ত, এই সিক্ত, তুই কাঁদছিস কেন? কেউ কিছু বলেছে? প্লিজ সোনা, এভাবে কাঁদিসনা। তোর চোখের পানি আমার বুকের গহীনে ঝড় তোলে। কেন কাঁদছিস আমাকে বল? ”

” বাবা-মা’র কথা মনে হচ্ছে। এখানে আসার পর থেকে বাবা-মা’ র সাথে কথা হয়নি। ভাইয়া, ভাবী, ছোটমা সবাই কথা বলেছে কিন্তু বাবা-মা আমার সাথে কথা বলেনি। এমনটাতো হওয়ার কথা নয়! নিশ্চয়ই বাবা-মা’ র কিছু হয়েছে। তাই তারা আমার সাথে কথা বলেনি। ছোটমাকে জিজ্ঞেস করতেই ছোটমা বলল বাবা-মা ঘুমাচ্ছে।

বাসার সবাই জেগে আছে অথচ বাবা-মা ঘুমাচ্ছে, এই কথা আমি মানতে পারছিনা। তুমি একটু বাবার কাছে ফোন দাওনা। ” সিক্তা কেঁদেই চলেছে।
আনান ওর খালামনি, খালুর ফোনে ফোন দিলে সুইচড অফ পায়। তাই ও তাহমিদের কাছে ফোন দিয়ে ওর খালামনি, খালুর কথা জিজ্ঞেস করে। তাহমিদও জানায় উনারা ঘুমাচ্ছে।
আনান সিক্তাকে সব কথা জানালেও সিক্তার কান্না থামেনা। ওর এবার ভয় হচ্ছে বাবা-মা’ র সত্যিই কিছু হয়েছে।
এদিকে সিক্তার কান্না দেখে আনান নিজেকে ঠিক রাখতে পারেনা।

” সিক্ত, তুই গহনাগুলো খুলে আলমারিতে রেখে দে। জলদি কর। আমরা ঐ বাসায় যাব। তুই নিজের চোখে তোর বাবা-মা’কে দেখে আসবি। বাসার সবাই যে যার রুমে চলে গেছে। এই সুযোগে আমাদের বেড়োতে হবে। তুই গহনাগুলো তুলে রাখ, ততক্ষণে আমি শেরওয়ানি পাল্টে আসি। ”

আনান টি-শার্ট আর জিন্স নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকল। এই সুযোগে সিক্তা গহনা খুলে, আলমারিতে রেখে দিল। আনান বেরিয়ে এসে আলমারি লক করে দেয়।
এরপর ওরা নিজের রুমের দরজা লক করে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়।
রাত দেড়টায় ওরা ‘ কুঞ্জছায়া ‘ র গেইটে এসে দাঁড়ায়। সিক্তা ওর ফোন থেকে দারোয়ান চাচার কাছে ফোন দেয়। এতরাতে সিক্তার ফোন নম্বর থেকে দারোয়ান চাচা চমকে যায়। সিক্তা যখন তাকে গেইট খুলতে বলল, তখন সে দেরি না করে গেইট খুলে দেয়।

বাসার দরজার সামনে এসে দাঁড়ায় সিক্তা আর আনান। ড্রয়িংরুম থেকে তখনও কথার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। এতরাতে তো কারও জেগে থাকার কথা নয়! সিক্তা দুরুদুরু বুকে কলিং বেল চাপল।
এতরাতে কলিং বেলের শব্দে ড্রয়িংরুমের প্রত্যেকে ভিষণই অবাক হয়ে গেছে। তাহমিদ উঠে এসে দরজা খুলে দিয়ে সিক্তাকে দেখেই তাজ্জব বনে যায়। সিক্তা তাহমিদকে ঠেলে হুড়মুড়িয়ে ভেতরে ঢুকল।
সিক্তাকে দেখে তাহমিনা আক্তার, নীরা, তাওহীদ, কুহু সবাই দাঁড়িয়ে যায়।

” ছোটমা, বাবা-মা কোথায়? কি হয়েছে বাবা-মা’র ? আমার ফোন তারা রিসিভ করছেনা। ” ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল সিক্তা।
তাহমিদ আনানের দিকে তাকিয়ে চোখ রাঙায়।
” আহাম্মক, আজকে রাতেই তোকে আসতে হল? আজকের রাতটা ওকে বুঝিয়ে রাখতে পারলিনা? আয়, ভেতরে আয়। ”
তাহমিদের ঝারি খেয়ে আনান সুড়সুড় করে ভেতরে ঢুকল।

” পা’গ’লি মেয়ে, এভাবে কেউ চমকে দেয়? ভাই, ভাবি ঘুমাচ্ছে। ” তাহমিনা আক্তার সিক্তাকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন।
কিন্তু সিক্তা কারও কথা না শুনে বাবা-মা’র রুমের দিকে যায়। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে দেখল সত্যিই তারা ঘুমাচ্ছে। এভাবে বাবা-মা’ কে ঘুমাতে দেখে সিক্তার সন্দেহ হয়।

” ছোটমা, তোমরা জেগে আছ কিন্তু বাবা-মা ঘুমাচ্ছে, এমনটা কেন? আমাকে সবটা বল। ”
সিক্তার কাছে আর কিছু লুকালেননা তাহমিনা আক্তার। তিনি জানালেন, সিক্তার বিদায়ের পর তারা অসুস্থ হয়ে পরেছিল। তাই চিকিৎসা শেষে স্লিপিং পিল দেয়া হয়েছে তাদের।

সব শুনে সিক্তা আরেকদফা কাঁদল। পরে সবাই মিলে ওকে বুঝিয়ে শান্ত করল। ইতোমধ্যে কুহু খাবার গরম করে এনেছে। ও নিজ হাতে সিক্তাকে খাইয়ে দিল। আনানকে খাইয়ে দিলেন তাহমিনা আক্তার।
রাত আড়াইটায় ওরা বিদায় নেয় ‘ কুঞ্জছায়া ‘ থেকে।

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৪৭

বিঃদ্রঃ আজকে ছোট পার্টই কষ্ট করে পড়েন সবাই। আমি স্লিপিং পিল খেয়েছি। ঘুমে ঢুলুঢুলু অবস্থায় এতটুকু লিখতে পেরেছি। রাগ করবেননা কেউ ছোট পার্টের জন্য।

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৪৯