ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ২১

ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ২১
নীহারিকা নুর

তরু উঠে আসার প্রায় মিনিট দুয়েক এর মাঝেই নৃত্য শেষ হয়ে গিয়েছিল তাই মোহনাও উঠে তরুকে খুজতে আসছিল। ক্যাম্পাস এ না দেখে ক্যাম্পাস এর পেছন সাইডে উকি দেয়। সেখানে দেখে সাফা একা একা ফিরে আসতেছে। মোহনা দৌড়ে সাফার কাছে যায়। মোহনাকে দেখেও না দেখার ভান করে চলে যাচ্ছিল সাফা। মোহনা জানতে চায় তরু কোথায়। সাফা উত্তর দেয় আমি জানি না খুজে নাও গিয়ে। মোহনা সাফার হাত চেপে ধরে শক্ত করে৷

– বল বলছি তরু কোথায়?
– আমি সত্যি জানি না। ব্যাথা লাগছে ছাড়ো আমায়।
– তুই ওকে নিয়ে ভার্সিটির পেছন দিকে গেছিস তাইলে তুই একা কেন আসতেছিস? ভালোয় ভালোয় বল তরু কোথায়। যদি ওর কিছু হয় না ভাইয়া তোকে জ্যান্ত কবর দিয়া দিবে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

– কে তোমার ভাইয়া। সময় নষ্ট না করে তরুকে খোজো যাও।
সাফার হাত ছেড়ে দেয় মোহনা। ওরও মনে হয় শুধু শুধু এই মেয়ের পেছনে সময় নষ্ট না করে দেখা উচিত তরু কোথায়। মোহনা ছুটে যায় ভার্সিটির পেছন দিকে। ওর মনে হচ্ছে ওর কানে তরুর চিতকার শুনতে পাচ্ছে। চোখ বন্ধ করে বোঝার চেষ্টা করে চিতকার এর আওয়াজ কোথা থেকে আসছে।

শব্দ শুনে সেদিকে দৌড়ে যায় মেহনা। যা ভেবেছিল তাই। তরু ঠিক বিপদে পড়েছে। তরুকে আগেই বলছিল কারো সাথে ঝামেলা না করতে। আদিব এর এক হাত তরুর দুহাত শক্ত করে ধরে আছে আর এক হাত কোমড়ে আকড়ে তরুকে কাছে টানার চেষ্টা করতেছে। তরুর ছটফটানিতে বারবার আদিব এর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে তরু। মোহনা পাশে পড়ে থাকা একটা লাঠি তুলে নেয়।

পেছন থেকে গিয়ে জোরে আঘাত করে আদিব এর মাথায়। প্রচন্ড আঘাত লাগায় তরুর হাত ছেড়ে মাথায় হাত দেয় আদিব৷ সেই সুযোগে মোহনা তরুর হাত ধরে আদিব এর থেকে টেনে দূরে সরিয়ে আনে। ছিটকে নিচে পড়ে তরু। মোহনা আবার টেনে তোলে ওকে৷ ফিসফিস করে তরুর কানে বলে

– এদিকে এই সময় কেউ আসবে না। এই জা*নো*য়ার এর হাত থেকে বাচতে চাইলে আমার হাত ধরে দৌড় লাগা।
বেশ কাজে লাগে কথাটি। এবার মোহনার হাত টেনেই তরু দৌড়াতে থাকে। একবারে ক্যাম্পাস এর বাহিরে চলে আসছে ওরা। হাটুতে ভর করে নিচে ঝুকে জোড়ে জোড়ে শ্বাস ফেলে দুজনই। শ্বাস নেয়ার গতি কমে আসলে মোহনা জিজ্ঞেস করে এখন কি করবি।
– রিক্সা ডাক বাসায় যাব।

সন্ধ্যা ঘোর হয়ে রাতের অন্ধকার নেমে এসেছে বেশ অনেক সময় হলো। সারাদিন দৌড় যাপ এর পর এখন একটু রেস্ট নেয়ার প্রয়োজন। আগে তো আর বাসায় ফিরত না। এখন সময় পেলেই বাসায় চলে আসে। তাই আজও চলে আসল। কিন্তু বাহির থেকে দেখতে পেল পুরো বাড়ি অন্ধকার। শুধু কর্নার এর দিকের দুইটা রুমে বাতি জ্বলতেছে। এত তাড়াতাড়ি তো সবাই ঘুমিয়ে যাওয়ার কথা না। তাই অবাক হলো তুরাগ। দ্রুত পায়ে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করল। সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে দেখতে পেল মিথিলার রুমের বাতি জ্বলতেছে। আগে সেদিকেই পা বাড়াল তুরাগ। বাহির এ দাড়িয়ে দরজায় নক করল। ভেতর থেকে জবাব আসে

– কে?
– আমি। ভেতরে আসলাম।
– হুম।
ভেতরে ঢুকতে ঢুকতেই মিথিলাকে জিজ্ঞেস করে

– এই মিথু বাসার সবাই গেছে কোথায় বলতে পারো।
– সবাই বাসায়ই আছে।তুমি একটু আমাকে হুইল চেয়ারটায় বসতে সাহায্য করো না। আমি একটু তরুর রুমে যাবো।
– হঠাৎ তরুর রুমে কেন। তরুর সাথে কথা থাকলে বলো আমি ওকেই ডেকে দেই।
– না ওকে ডাকতে হবে না। সবাই ওর রুমেই আছে। তুমি ও চলো দেখে আসি মেয়েটার কি অবস্থা।
– কি হয়েছে আবার অসুস্থ নাকি ও।
– না৷ ওর সাথে আজ খারাপ কিছু হতে যাচ্ছিল। মেয়েটা সেই দুপুর থেকে কান্নাকাটি করতেছে। ভয় পেয়েছে মনে হয় প্রচুর।
– কি হয়েছে খুলে বলোতো আমাকে।

মিথিলার মুখ থেকে সবটা শুনে রাগে শরীর রি রি করে ওঠে। মনে চায় এখনি ওই ছেলের হাত ভেঙে গুড়ো করে দিতে। কত বড় অসভ্য ছেলে। ভার্সিটিতে পড়ালেখা করতে আসে আবার নিজের ভার্সিটির মেয়েদের সম্মানে হাত দেয়। কিছু একটা ভাবে তুরাগ৷ রাগে সামনে থাকা টি টেবিল এ জোড়ে আঘাত করে। উঠে যায় মিথিলার পাশ থেকে।

পাশের রুমের দরজা খোলাই ছিল। একবার উকি দেয় সেই রুমে। নুরনাহার এর কোলের মধ্যে মাথা রেখে গুটিশুটি মে’রে শুয়ে আছে তরু। চোখ ফুলে গেছে কান্না করতে করতে। রুমের ভেতরে আর ঢোকে না তুরাগ। বাসায় এসেছিল রেস্ট নিতে। তা আর হলো কই। মাথা গরম করে বেড়িয়ে গেল বাসা থেকে। বাসা থেকে বের হতে হতে ফোন দিল প্রান্তকে। বলল দলের কিছু ছেলেপুলেদের একসাথে করতে। আর আদিব এর ঠিকানা খুজে বের করতে।
তুরাগ এর কন্ঠ শুনে প্রান্ত বুঝতে পারল বেশ রেগে আছে। তাই বলল

– মাথা ঠান্ডা কর ভাই। কি হয়েছে বল।
মাথা ঠান্ডা করার কথা শুনে জোড়ে ধমক দিল তুরাগ। বলল
– আমার বাড়ির মেয়েদের সম্মানে হাত দিছে ওই কু*** বা**। ওরে খুজে বের কর।
প্রান্তের নিজেরও মেজাজ খারাপ হলো। তুরাগকে শান্ত করার চেষ্টা না করে দলের ছেলেদের খবর নিল।

বন্ধুদের সাথে ক্যারম খেলায় ব্যাস্ত ছিল আদিব। হাসি ঠাট্টা করছিল আর ক্যারম খেলতেছিল। হঠাৎ করে কেউ একজন খুব জোরে ক্যারম বোর্ড এর মাঝ বরাবর আঘাত করে। মাঝখান থেকে ভেঙে যায় বোর্ড। আদিব ছাড়া বাকি তিনজন ভয়ে ভয়ে তাকায় কে আঘাত করল দেখার জন্য। হাতে হকিস্টিক নিয়ে দাড়িয়ে আছে কেউ একজন। কিন্তু মুখে মাস্ক পড়া তাই চিনতে পারল না ওরা।

ওরা সেখান থেকে একটু দূরে সরে দাড়াল। কিন্তু ঘাড়ত্যাড়া মানুষ কি কখনো সোজা হয়। যেমন আদিব। ও উঠে যায় মাস্ক পড়া ব্যাক্তিকে মারতে। আদিব গিয়ে পান্জাবির কলার ধরে। সাথে সাথে এক বিকট চিতকার দেয় আদিব। সেখানে থাকা বাকি তিনজন ভয়ে ভয়ে তাকায় দেখার জন্য যে কি হয়েছে। দেখে যে হাত চেপে ধরে বসে পড়েছে আদিব। ওদের আর বুঝতে বাকি নেই যে, যে হাত দিয়ে কলার ধরেছিল সে হাত ভেঙে গেছে। ওরা আর সামনে না আগিয়ে ভয়ে দৌড় লাগায় সেখান থেকে কয়েক মুহুর্তের মাঝে ছোট খাট একটা ধ্বংসযজ্ঞ হয়ে যায় সেই রুম এর ভিতর যেখানে বসে ক্যারম খেলছিল আদিবরা। আদিব এর অবস্থা খুবই ভয়াবহ। নাক দিয়ে রক্ত ঝড়ছে, ঠোট কে’টে গেছে। ভাঙা হাত নিয়ে ব্যাথায় গগন বিদারি চিতকার করছে।

ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে সবাইকে নিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে যায় তুরাগ। আশপাশে লোকজন জড়ো হয়েছে তবে আদিব এর কাছে এগোনোর সাহস কারো নেই। এতদিন এই এলাকায় যাচ্ছে তাই করে বেরিয়েছে ও। ওর যন্ত্রনায় অতিষ্ঠ ছিল মহল্লার মেয়ে গুলো। আজ এর এমন পরিস্থিতি দেখে অনেকেই মনে মনে সন্তুষ্ট। তবুও নিজেদের স্বাভাবিক করে দাড়িয়ে আছে সেখানে।

তুরাগরা বেরিয়ে যাওয়ার প্রায় কয়েক মুহুর্ত পরেই সেখানে একটা কালো রং এর গাড়ি এসে থামে। সেটা থেকে এক প্রকার দৌড়ে বেড়িয়ে আসে ড. আবির। তাড়াহুড়োয় কি করবে মাথায় আসে না। ভাইয়ের শরীর থেকে শার্ট খুলে সেটা দিয়েই ভাঙা হাত গলার সাথে ঝুলায়। ড্রাইভার এর সহায়তায় গাড়িতে তোলে আদিব কে। ব্যাক সিটে শোয়ায়। হসপিটাল এ নিয়ে আসে আদিবকে। যন্ত্রনায় জ্ঞান হারিয়েছে আদিব।
হসপিটালে এনে রক্তগুলো মুছিয়ে দিয়ে হাত ব্যান্ডেজ করে ড্রেস চেন্জ করে দিয়েছে আদিব এর। কেবিন এর সামনে পায়চারি করতেছে আবির। অপেক্ষা ভাইয়ের জ্ঞান ফেরার।

তিনদিন যাবত ভার্সিটি বন্ধ করে দিয়েছে তরু আর মোহনা। তরু এখানো ভয় পেয়ে আছে। সে কোন ভাবেই যাবে না ভার্সিটিতে। যদিও পরেরদিন সকালেই নিউজ এ দেখেছে আদিব এর অবস্থা। কিন্তু যারা মে’রেছে সবাই হেলমেট পড়া ছিল। তাই কারো চেহারা দেখা সম্ভব হয় নি। তবুও তরু শিওর এটা যে তুরাগ ভাই ই করেছে। তাকে কিছু জিজ্ঞেস করে নি তরু। এখন আদিব কয়েকদিন এ আর ভার্সিটিতে আসতে পারবে না।

তাই ভার্সিটিতে তো যাওয়াই যায়। তাও মন সায় দিচ্ছে না। সবাই অনেক বোঝানোর পরে রাজি হলো যাওয়ার জন্য। মিথিলা বারবার করে মোহনাকে বলে দিল তরুর হাত যেন না ছাড়ে। মিথিলা ওর ফোনটা মোহনাকে দিয়ে দিল। যেন যেকোনো প্রয়োজনে ফোন দিতে পারে। তুরাগ নিজেই ওদের নিয়ে বের হলো। একদম গেট অবধি পৌছে দিয়ে গেল। বলল ক্লাস শেষ হলে যেন ফোন দেয়।

তাহলে আবার এসে নিয়ে যাবে। তরুরা ভার্সিটিতে পৌছানো মাত্রই কেউ একজন ফোন দিয়ে ড. আবির আহমেদ কে নিউজটা জানালো। তিনি ফোনে বুঝিয়ে দিলেন কি কি করতে হবে। তিনি এত দিন অপেক্ষা করে ছিলেন কবে বের হবে বাসা থেকে। বাসা থেকো তুলে আনা সম্ভব না। তারউপর তাকে নিজেকেই তো পুলিশ অবজারবেশন এ রাখছে। তাই খোলামেলা ভাবে কিছু করা সম্ভব না। তবে আজ এই মেয়ের শেষ দিন।

অন্ধকার একটা রুমের মাঝ বরাবর কম পাওয়ারি একটা লাইট জ্বলতেছে। সেখানেই বসা তরু। তবে ও একা নয়। আরো ছ থেকে সাতজন মানুষ সেখানে আছে। সবার চোখে মুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। সবাই জানে তাদের জীবনের অন্তিম সময় আসন্ন। সেই ভয়েই চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে। ওরা যে একটা চক্রের ফাদে আটকা পড়ে আছে। একটা লোক এগিয়ে এলো তরুর দিকে। ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল

– আচ্ছা তোমাকে দেখে তো বেশ বুদ্ধিমতি মেয়ে মনে হচ্ছে তাহলে তুমি কীভাবে এই প্রতারণার ফাঁদে পা দিলে।
– কি বলছেন। আর আপনাদের কেন এভাবে আটকে রেখেছে।
– সে কি তুমি এখনো বুজতেছো না কেন আটকে রেখেছে এভাবে।
আমি বলছি।
গম্ভীর পুরুষালী কন্ঠ শুনে চমকায় তরু। মাথা তুলে তাকায় সেদিকে। তবে এখানে আবিরকে কোনভাবেই আশা করে নি। আবিরকে দেখে উঠে দাড়ায় তরু।

– ওহ এটা তাহলে আপনি। কেন তুলে এনেছেন আমাকে।
এক পা দুপা করে সামনের দিকে আগায় আবির৷ তরু এক পা এক পা করে পিছিয়ে যায়। এই মুহুর্তে আবির ঠিক কি চাচ্ছে তা কল্পনার বাহিরে তরুর। মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করে তরু। এই দুইটা মাসের মধ্যে জীবন পুরো এলোমেলো হয়ে গেছে ওর। এখন সামনে কি হতে যাচ্ছে তা বলা মুশকিল। আবির জোরে জোরে পা ফেলে ধরে ফেলে তরুকে। তরুর পেছনে হাত দিয়ে হিজাব এর উপর থেকেই চুল এর গোড়াসহ টেনে ধরে। তরুর মনে হচ্ছে চুলগুলো বুঝি সব ছিড়ে যাচ্ছে।

– তোর বাপ ভাই সবাই মিলে উঠে পড়ে আমার উপর লেগেছে। আমি শান্তিতে বিজনেস করছিলাম ভালো লাগল না তোর বাপের। আমার ভাইটার এত সুন্দর জীবন যাপন সহ্য হলো না তোর নাগর এর। বিয়ে ভাঙতেই আবার এখানে নতুন নাগর জুটিয়েছিস। বাহ ভালোই। কিন্তু এবার তোর কি হবে বল তো। আমার ভাইটা ওখানে ব্যাথায় ছটফটাচ্ছে। আমি কেমনে সহ্য করি বলো।

” অন্যের সন্তান, ভাই, বোন যখন ব্যাথায় ছটফটায় তখন তারা কীভাবে সহ্য করে বলতো। তুই নিজ হাতে এত এত নিষ্পাপ জীবন ধ্বংস করিস তখনতো কষ্ট লাগে না। এখন নিজের ভাইয়ের বেলায় এত কষ্ট কিসের ক্রিমিনাল আবির আহমেদ”

অন্ধকার এর কারণে চেহারা ঠিক বুজতে পারল না তবে এটা বুঝতে পারল এখানে একজন দুজন নয় বেশ অনেক জন লোক দাড়িয়ে আছে। তাদের এগিয়ে আসা পায়ের শব্দে এতটুকু বুঝতে পারল এরা পুলিশ ফোর্স। তাদের সু এর আওয়াজ শুনে এটা স্পষ্ট।

ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ২০

– আ আ আ আপনারা? এখানে।
– এখানে আসার জন্যই তো এত ড্রামা আবির আহমেদ। আপনি খুব চালাক মানুষ। খুব তাড়াতাড়ি রঙ বদলে ফেলেন। আপনাকে ধরা এতটা সহজ কাজ ছিল না। তাই তো ফাদ পাততে হলো আপনার জন্য।
আবির এর বুঝতে বাকি থাকে নেই যে তরুকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করছে এরা। কিন্তু এই অবধি পৌছালো কি করে সেটাই মাথায় আসছে না।

ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ২২