ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ২২

ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ২২
নীহারিকা নুর

তহমিনাকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে তরু। ছাড়াছাড়ির কোন নাম নেই। না খাওয়া দাওয়ায় মন আছে। নিজেও খাচ্ছে না মা কেও খেতে দিচ্ছে না। ফুফু ফুফা সবাইকে ফিরিয়ে দিয়েছে। ও মাকে ছাড়বে না। সবাই বোঝালো না খেলে অসুস্থ হয়ে যাবে। কিন্তু ওর বাবা বাসায় না আসা অবধি ও খাবে না।

সেইখানে বসে যে ভয় পেয়েছে তার রেশ এখনো রয়ে গেছে। এমনিতে যথেষ্ট স্ট্রং। তবে এরকম রক্তারক্তি কান্ড এর আগে কখনো চোখের সামনে দেখেনি। ওর মা বারবার জানতে চাইছে কি হয়েছে তারও জবাব দিচ্ছে না। ভোর রাতের দিকে যখন নুরুল ইসলাম মেয়েকে বাসায় রেখে গেছেন বলে গেছেন ওর খেয়ালরাখতে। বাকি কথা তিনি বাসায় এসে বলবেন।তহমিনা বেগমকেও তিনি ফোন দিয়ে দিয়েছিলেন।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সকাল হতে হতেই তিনিও হাজির হয়েছেন ননদের বাসায়। এর আগে কারো সাথে কথা না বললেও মা আসতেই মায়ের বুকে ঝাপিয়ে পড়েছে। সকাল গড়িয়ে দুপুর এখনো সেভাবেই রয়েছে। নুরনাহার খাবার রেখে গেলে তহমিনা চেষ্টা করেছেন মেয়েকে খাওয়ানোর। কিন্তু বারবার বলতেছে – বাবা আসলে খাবে। এরপর আর জোর করেনি কেউ।

দুপুর গড়িয়ে তখন বিকেল। সেসময় কলিং বেল এর আওয়াজ কানে আসতেই দৌড়ে দরজা খুলতে যায় তরু। সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। এতক্ষণ নড়ছিল ও না। আর এখন দিব্যি দরজা খুলতে চলে গেছে। দরজা খুলতেই নজরে এলো নুরুল ইসলাম৷ তরু ঘুরে ঘুরে বাবার চারপাশ থেকে দেখতে লাগল। আবার বাবার ড্রেস গুলো টেনে টেনে দেখছিল। তহমিনা এসে টেনে মেয়েকে সরালেন।

– কি হলো কি তরু। পাগল হয়ে গেলে নাকি।
– আম্মু আমি তো দেখছিলাম বাবা ঠিক আছে কিনা৷
– ঠিক থাকবে না কেন। তার আবার কি হবে।
– আম্মু আজ না বাবার চোখের সামনে আবির সু’ই’সাইড করার চেষ্টা করেছিল। নিজের হাতের শিরা নিজে কে’টে ফেলেছে। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছিল। বাবা যখন হাত ধরতে গেছে ওমনি বাবার দিকে ছু’রি তাক করে বলেছিল কাছে আসলে ছু’রি চালিয়ে দিবে। আমি তো ভয় পাচ্ছিলাম। এজন্যই তো দেখছি বাবা ঠিক আছে কিনা।

– কি হয়েছে কি একটু বলো তো। মেয়েটা সকাল থেকে কেমন অস্বাভাবিক আচরণ করছে।
– ভেতরে চলো সব বলতেছি।
🌼 তরু আর মোহনা যখন ভার্সিটির বাহিরে তুরাগ এর জন্য অপেক্ষা করতে ছিল তখন মোহনার ফোনে একটা ফোন আসে। ফোনটা আর কেউ না বরং তুরাগ করেছিল। ফোন করার পরে মোহনা সেই ফোন সহ ব্যাগটা তরুর হাতে দিয়ে আইসক্রিম খাবে বলে ভার্সিটি থেকে কিছুটা দূরে যায়। রাস্তার পাশে তরুকে দাড় করিয়ে রেখে অপজিট সাইডে যায় আইসক্রিম আনার জন্য।

তখন গাড়িতে বসে কেউ তরুর মুখে ক্লোরোফর্ম স্প্রে করে। যার প্রভাবে ক্ষনিক সময়ের জন্য হুশ হারা হয় ও। প্লান মাফিক আবির এর লোকেরা ওকে তুলে নিয়ে যায়। পেছনে তুরাগ ফলো করে তাদেরকে। যখন জ্ঞান ফেরে তখন এক প্রকার ধস্তাধস্তিতে ফোনসহ ব্যাগটা গাড়ির ভেতরেই পড়ে। যে ফোনটা তুরাগ এর সাথে কলে কানেক্টেড ছিল। সেই ফোন ট্রেস করে আমরাও ফোর্স নিয়ে চলে যাই সেখানে।

আমরা চারদিক ঘেরাও করার পরেই আবির এর সামনে যাই। আবিরকে ধরার আগে ওর অন্যন্য গার্ডসদের এরেস্ট করি। যখন আবির এসব জানতে পারে ও চাচ্ছিল না পুলিশ এর হাতে ধরা দিতে। এসব ক্রিমিনালরা মূলত এরকমই হয়। নিজে ম’রে যাবে তবু গ্যাং লিডার এর নাম প্রকাশ করবে না। আবির ও সেই প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। ওর পকেটেই ছিল নাইফ। যা দিয়ে নিজের হাতের শিরা নিজে কে’টে ফেলে সুই’ সাইড এর প্রচেষ্টা চালায়।

তখন হাত থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছিল। তোমার আলগুছে মেয়ের সামনেই এসব হয়েছিল। তুমি তো জানোই ও এসব রক্ত সহ্য করতে পারে না। এজন্যই ভয়ে এমন গুটিয়ে গেছে। মাথা ঘুরে পরে গিয়েছিল। তুরাগ ছিল সেখানে। ও কোলে তুলে তরুকে বের করেছিল সেখান থেকে। তুরাগ এর গাড়িতেই নিয়ে এসেছে ওকে। আমাকে আর দেখতে পায়নি বলে ও ভেবেছিল হয়ত আবির আমার ক্ষতি করেছে। এজন্যই এত ভয়ে ছিল।আসার এরকম চেক করছিল তাও এই ভয়েই।
তহমিনা বেগম আগলে নেন মেয়েকে। তারপর জানতে চান

– আবির এখন কোথায়? জেলে নিশ্চয়ই।
– চিকিৎসাধীন আছে। প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। আর বাকিরা জেলে। তবে ওদের গ্যাং লিডারকে এখনো ধরা যায়নি।
কথার মাঝখানে নুরনাহার বললেন

– হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নে নুরু। তোর বউ মেয়ে এখনো না খেয়ে আছে। তোর সাথে খাবে বলে।
– খাব না আমি।
তরুর কথায় সবাই মুখ ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকায়। নুরুল ইসলাম উঠে আসে নিজের জায়গা থেকে। তরুর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে

– কেন খাবে না মামনি। বাবা চলে এসেছি তো।
– ছি: বাবা। তুমি নিজের মেয়ের জীবন নিয়ে এভাবে বাজি ধরতে পারলে। যদি আজ আমার কিছু হয়ে যেত।
– তুরাগ তো তোমাদের পেছন পেছনই ছিল। ওর দলের লোকেরা ছিল ওর সাথে। ওই আবির এর বাচ্চা তোমার কিছু করতে পারত বলো।

– বাবা তুমি কি আমারে বাচ্চা ভাবো। যা বলবা তাই বিশ্বাস করব।
– রাগ করে না সোনা। আবিরকে আমরা বেশ অনেক দিন যাবত অবজারভেশনে রেখেছিলাম। কিন্তু ও ভীষণ ধূর্ত। নিজেকে সামলে চলেছে এতদিন৷ ওর ফোন কল ট্রেস করে তোমার বিষয়টা জানা গেছে। এজন্যই তোমার মাধ্যমে ওকে ধরার চেষ্টা করেছি। যদিও অনেক রিস্কি ছিল বিষয়টা তবুও। আমার মা তো অনেক ম্যাচিওর। রাগ করে না মা। তুমি কি চাও না দেশের একজন শত্রুর ধ্বংস হোক। ও কত খারাপ লোক ছিল জানো? জীবন্ত মানুষকে অজ্ঞান করে তাদের শরীরের বিভিন্ন অর্গান কে’টে নিত। সেগুলো বিদেশে বহু মুল্যে বিক্রি করত। একজন জীবন্ত মানুষকে এভাবে কষ্ট দিত। কত মানুষকে মে’রেছে। ওকে না ধরলে তো এরকম আরো বহু মানুষ মা’রা যেত। তুমি কি সেটা চাও বলো।

– ওফফ বাবা থামো। বুঝেছি আমি।
– তবে আমার কথা আছে এখানে ( তহমিনা)
এবার সবার নজর পড়ে তহমিনার উপরে। নুরুল ইসলাম জিজ্ঞেস করে
– তুমি আবার কি বলতে চাও।
– আমি আমার মেয়েকে এখানে আর এক মুহুর্তের জন্য ও রেখে যাবো না। এখানে যেসব হচ্ছে। কোনদিন না জানি আমার মেয়েটাকেই হারিয়ে ফেলি। আমি আর রিস্ক নিতে চাই না।
নুরনাহার বলল

– কিন্তু ভাবি মা যদি কিছু বলে।
– দেখেন আপা এরকম অনেক সহ্য করেছি। এখন আপনাদের মায়ের জন্য আমি আমার মেয়েটাকে তো রিস্কি লাইফ দিতে পারি না। আপনার মা যদি রাজি না থাকে প্রয়োজনে আমি আমার বাপের বাড়িতে গিয়ে থাকব আমার মেয়েকে নিয়ে।
– কিন্তু ওর ভার্সিটি?
– এই পড়ালেখা পড়ালেখা করে এত কিছু। ওর পড়ার দরকার নেই ভালো ভার্সিটিতে। প্রয়োজনে ওকে ট্রান্সফার করে নিয়ে যাবো।

নুরুল ইসলাম স্ত্রীর পাশে বসলেন। শান্ত করার চেষ্টা করলেন স্ত্রীকে। এখন ক্ষেপে আছে। এই মুহুর্তে কিছু বলা মানে শুধু শুধু সংসারে ঝামেলা টেনে আনা। নারী জাতির রা’গ, ঘৃণা ভয়ঙ্কর জিনিস। তারা যখন ভালোবাসে মন প্রাণ উজার করে ভালোবাসে। আবার যদি ঘৃণা করে তখন একদম মন থেকে ঘৃণা করে। আর রে’গে গেলে তো ভয়ঙ্কর কিছু করে ফেলার সামর্থ্য রাখে। নুরুল ইসলাম স্ত্রীকে বললেন
– আচ্ছা তুমি তোমার মেয়েকে নিয়ে যেও সমস্যা নেই। এখন খেতে চলো।
– আমি কাল সকালের বাসেই চলে যাবো।
– আচ্ছা বাবা যেও। আমি নিজে গিয়ে তুলে দিয়ে আসব এখন চলো।

টাকার লোভ মানুষকে তিলে তিলে ধ্বংস করে দেয়। আমাদের জীবনে চলার পথে টাকার দরকার আছে অবশ্যই। তবে সেটা অবৈধ পন্থায় নয়। লোভ মানুষকে ধ্বংস ছাড়া কিছুই দেয় না। যেমনটা হয়েছে আবির এর, তার বাবার আর তাদের সাথে থাকা লোকগুলোর।

এখন তারা পুলিশ এর আঘাত গুলো মুখ বুঝে সহ্য করতে রাজি তবুও গ্যাং লিডার এর নাম বলতে নারাজ। কারণ তার নাম প্রকাশ করলে হয়ত যে নাম প্রকাশ করবে তার জীবন পাখি খাচাছাড়া হবে। এসব পথে আসলে যেমন অবৈধ পন্হায় বেশি টাকা উপার্জন করা যায় তেমনি জীবন থাকে সর্বধা ঝুকির মধ্যে৷ পুলিশ কনস্টেবল গুলো মে’রে মে’রে ক্লান্ত৷ তবু এদের মুখ খোলার নাম নেই। সমস্যা নেই রিমান্ডে নিলে ঠিকই মুখ খুলবে। কতদিন আর সহ্য করা যাবে এসব।

অপরাধীদের অবস্থা “জলে কুমির ডাঙায় বাঘ” এর ন্যায়। মুখ খুললেও জীবন বিপন্ন হবে। আর না খুললে রিমান্ডে নেয়া হবে।
যেসব মানুষ গুলোকে উদ্ধার করা হয়েছে তাদেরকে নিজ নিজ গৃহে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পরিবার এর মানুষ এর সে কি খুশি। খুশি যেন উপচে পড়ছে।

তরু তরুর মায়ের সাথে বাড়িতে চলে এসেছে বেশ কয়েকদিন হতে চলল। তবুও মনটা যেন ঢাকাতেই পড়ে আছে। বারবার সবার কথা মনে পড়ছে। মোহনার সাথে কথা হয় ফোনে। প্রতিদিন ক্লাসে কি পড়ায় সেসব বিষয় ও জেনে নেয়। নোটগুলোর পিক পাঠায় মোহনা। সেগুলো রেগুলার খাতায় তোলে। তরু জানে তুরাগ মিথিলাকে অনেক ভালোবাসে।

তবুও অষ্টাদশী কন্যার প্রথম বারের মতো কারো জন্য মনে অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছিল তাকি এত সহজে ভুলে যাওয়া যায়। প্রথম বার মায়ের ইচ্ছেতে বিয়েতে রাজি হলেও তখন নিজেকে কেমন অনুভুতি শুন্য লাগছিল। এবার কারো জন্য অনুভূতি জাগ্রত হলো। তা প্রকাশ পাবার আগেই মাটিচাপা দিতে হয়েছে। অনেক চিন্তা ভাবনার পর মনে মনে ঠিক করলো মোহনার থেকেই জিজ্ঞেস করবে – মিথিপু তুরাগ ভাই কেমন আছে। যেই ভাবা সেই কাজ। একদিন নোট নেয়ার জন্য ফোন দিলে তখন জানতে চায় তুরাগ এর ব্যাপারে।

– আচ্ছা মোহনা মিথিপু কেমন আছে? তুরাগ ভাইয়ার সাথে সব ঠিকঠাক হয়েছে।
– মোটামুটি। তবে ভাইয়া তো এখন ভীষণ ব্যাস্ত। সময় দিতেই পারে না কাউকে।
– কেন। কিসের ব্যাস্ত এত।
– আরে তুমি জানো না ভাইয়াদের নির্বাচন এর আর মাত্র বারো দিন বাকি আছে। যদিও তারা নমিনেশন পায় নি৷ তবুও আমার মনে হচ্ছে তারাই জয়ী হবে।

– তরু এসব ব্যাপারে আর কথা বাড়ায় না। ও এসব বিষয় এত কিছু বোঝে না। তাই বলে জয়ী হলেই ভালো। এরপর তো বিয়ে খেতে চলে আসব কি বলো।
ফোন রেখে দেয় তরু। তবে মন কেন যেন মানতে চাচ্ছে না৷ আর মাত্র বারো দিন বাকি। এরপরই সে অন্য কারো। হলেও কিছু করার নেই। কি বা করতে পারবে ও। যেখানে তুরাগ এর সবটা জুড়ে মিথিলার বাস

ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ২১

(ট্রাই এঙ্গেল প্রেম এ এক পক্ষকে তো হেরে যেতেই হয়। আর অল্প কয়েক পর্ব হয়ত বাকি। কেউ তরুর সাথে মিল চায় কেউ মিথির সাথে। এখন আমি একটু দেখি ট্রাই এঙ্গেল প্রেমে কে জিতে যায়। মিল যার সাথেই হোক গল্পকে গল্পের মতো দেখাই উত্তম)

ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ২৩