ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ২৩

ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ২৩
নীহারিকা নুর

বারোটা দিন যেন চোখের পলকেই শেষ হয়ে গেল। মনে হচ্ছে যেন খুব তাড়াতাড়িই দিনগুলো চলে গেল। আর মাত্র একটা রাত বাকি আছে নির্বাচন এর। কালাম মোল্লা তার নিজ বাড়িতেই সবার খাওয়া দাওয়ার ব্যাবস্থা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তুরাগ, প্রান্ত এরা দুজন মিলে তাকে নিষেধ করল ঝামেলা করতে।

তিনি একা মানুষ। বিয়ে করেন নি এখনো, মা ও বেচে নেই তাই এসব ঝামেলা কে করবে। তুরাগ এর বাসায় কাজ করার জন্য অনেক জনই আছে। তুরাগ ওর মা কে তিনবেলার খাবার রান্না করতে বলল। চল্লিশ পয়তাল্লিশ জনের খাবার তৈরি করা মুখের কথা নয়। সবাই সকাল থেকে খেটে খেটে ক্লান্ত প্রায়। এখানো দলের ছেলেপুলেরা আসছে। তাদের খাবার বেড়ে দিচ্ছে নুরনাহার আর মিথিলার মা। মোহনাও কিচেনে কিছু একটা করছে। সুফিয়া আবার রান্না বসিয়েছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মিথিলা একা একা রুমে আছে। ওয়াশরুমে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করলো। কিন্তু একা একা তো যেতে পারবে না। তাই কয়েকনার মা মা বলে ডাক দিল। কিন্তু ওপাশ থেকে কোন সাড়া পাওয়া গেল না। মোহনাকে ডাকল। সেও শুনল না। সাহস করলো একা একাই যাবে। খাটের পাশ থেকে হাত বাড়িয়ে হুইল চেয়ার টেনে আনল। মোহনা বলতে গেলে সব সময়ই মিথিলার পাশে পাশে থাকে। মিথিলা তো একা একা হুইল চেয়ারে বসতে পারে না।

কমোডেও তুলে বসিয়ে দিতে হয়। কিন্তু কতকাল আর অন্যের বোঝা হয়ে থাকতে মনে চায়। একজন প্রতিবন্ধী মানুষের জীবন এতটাও সহজ নয়। একটা সময় পরিবার এর মানুষ ও বিরক্ত মনে করে। যদিও মুখে প্রকাশ করে না কিন্তু মনে মনে বিরক্ত হয়। মিথিলার যে এমনটা হয়নি তা না। মোহনা ওকে যথেষ্ট ভালোবাসলেও মাঝে মাঝে ডাকলে জোরে চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে কথা বলে। মিথিলা বোঝে যে মোহনা বিরক্ত। কিন্তু তবুও নিরুপায় হয়ে ডাকতেই হয়।

আজ কষ্ট করে একা একাই যাওয়ার চেষ্টা করে। হাতে ভর দিয়ে দিয়ে খাট থেকে হুইল চেয়ারে বসে। অনেক কষ্টের পরে সফল ও হয়। যাওয়ার সময় যেতে পারে। কিন্তু বিপত্তি ঘটে বের হবার সময়। এবার আর সফল হয় না হুইল চেয়ার উঠে বসতে। হুইল চেয়ার এক সাইডে বাকা হয়ে যায়। খুব জোড়ে টাইলস এর উপরে যায়। হুইল চেয়ার উল্টে গায়ের ওপর পড়ে। নিচে পড়ার সময় হাত উল্টোভাবে পড়েছে। মনে হচ্ছে হাত ভেঙে গেছে। প্রচন্ড যন্ত্রণা হচ্ছে।

সহ্য করতে পারে না মিথিলা। গলা ফাটিয়ে চিতকার দেয়। চিতকারে মনে হচ্ছে পুরো বাড়ি কেপে উঠল। তুরাগ খেতে বসেছিল কেবল। খাবার ছেড়ে উঠে হাত না ধুয়েই দৌড় লাগায় দোতলার উদ্দেশ্য। সবাইই এল প্রকার দৌড়ে উপরে আসে। কিন্তু রুমে এসে দেখে মিথিলা রুমে নেই। তাহলে গেল কোথায় মেয়েটা। নুরনাহার খেয়াল করে ওয়াশরুম এর ডোর ভেতর থেকে লক করা। সেখান থেকেই কান্নার আওয়াজ আসছে।

অনেক ডাকার পরেও দরজা খুলতে পারে না মিথিলা। তুরাগ সবাইকে সামনে থেকে সরিয়ে দিয়ে ভেঙে ফেলে দরজা। ভেতরে ঢুকে দেখে হুইল চেয়ারটা মিথিলার গায়ের উপরে পড়ে আছে। সেটাকে টেনে তুলে আগে। দুহাতে পাজাকোলে তুলে নেয় তুরাগ। মিথিলার কান্না তখনো থামেনি। তায়েফ সাহেব ও তখন বাসায় ছিলেন। তিনি গিয়ে তাড়াতাড়ি করে গাড়ি বের করলেন। তুরাগ মিথিলাকে নিয়ে পেছনে বসল। মিথিলার মা আর মোহনাও গেল সাথে। নুরনাহার বাড়ির সবটা সামলে পড়ে আসবেন তাই তিনি আসেন না।

রাত তখন বেশি হওয়ায় সব গুলো টেস্ট তখন করাতে পারে নি। ডাক্তার আরো অনেক গুলো টেস্ট করিয়ে নিতে বলেছে। তায়েফ সাইয়িদ এর অফিস খোলা রয়েছে। তার সেখানে যেতেই হবে। এখন হসপিটালে মিথিলাকে টেস্ট করদনোর জন্য কে থাকবে। আজ নির্বাচন। তুরাগকে তো সেখানেই থাকতে হবে। তায়েফ সাহেব আদেশ করে গেল তুরাগ যেন মিথিলাকে টেস্ট করানোর জন্য নিয়ে যায়। আজ যদি ও মিথিলাকে একা রেখে চলে যায় তাহলে বিয়ে ক্যান সেল। যদি বিপদের সময়েই পাশে থাকতে না পারে তাহলে আর থাকার দরকার নেই। ঘরে ঢোকাও বন্ধ। এমনিতেও এই রাজনীতিতে আসা নিয়ে বাপ ছেলের যুদ্ধ লেগেই আছে। এখন আবার পেয়েছে সুযোগ।

তুরাগ পড়ে যায় মহা মুশকিলে। নির্বাচন কেন্দ্রে না যেতে পারলেও ঝামেলা। সেখানে কি হয় না হয় কে জানে। এই বাবাকে নিয়েও আর পারা গেল না। তায়েফ সাহেব এরকম কথা ইচ্ছে করেই বলেছেন। কারণ তিনি হচ্ছেন শান্ত স্বভাবের মানুষ। কোন রকম ঝামেলায় তিনি জড়াতে চান না। তিনি চান তার ছেলেও যেন এসব থেকে দূরে থাকে। তার অবাধ্য ছেলেকে তিনি কখনোই কথা শোনাতে পারেনি।

নিজের ইচ্ছে মতোই করেছে। এই রাজনীতিতে যোগ দেয়াটাও নিজের জেদ এর বশেই করা। তাই আজ সুযোগ বুঝে মিথিলাকে এর মধ্যে টেনেছেন৷ মিথিলার জন্য তার ছেলে কতটা পাগল এটা সবাই ই জানে। তাই তো এই ট্রিকস খাটালেন। কাজেও লাগল তার ট্রিকস।

তুরাগ প্রান্তকে ফোন করে জানালো দুপুরের আগে ও আসতে পারবে না। ততক্ষণ যেন ওদিক সামলে রাখে। প্রান্ত প্রথমে জোর করছিল তুরাগকে নেয়ার জন্য। তুরাগ সাথে থাকা মানেই একটা ভরসা। কিন্তু এখন যখন তুরাগ একবার বলেছে দুপুরের দিকে আসবে তাহলে তখনই আসবে। একে জোড় করে লাভ নেই। তুরাগ আসবে না শুনে কালাম মোল্লার মুখখানাও ফ্যাকাসে আকার ধারণ করল। এই ছেলেটা তার পাশে থাকলে তার শক্তি মনে হয় দ্বিগুণ বেড়ে যায়।

সাড়ে বারোটার মতো বাঝে। ল্যাব থেকে রিপোর্ট গুলো হাতে নিয়ে বের হচ্ছে তুরাগ। এগুলো নুরনাহার এর কাছে দিয়ে তুরাগ কেন্দ্রে যাবে। নুরনাহার ই রিপোর্ট গুলো ডাক্তারকে দেখিয়ে ঔষধ গুলো নিতে পারবে। এগুলো ভাবতে ভাবতেই হাটছিল তুরাগ। এমন সময় ফোন বেঝে ওঠে। পকেট হাতড়ে ফোন বের করে। ফোনস্ক্রিন এ প্রান্ত নামটা তখন জ্বলজ্বল করছে। কাল বিলম্ব না করে ফোন রিসিভ করে তুরাগ।

অপর পাশ থেকে প্রান্তর হাপিয়ে যাওয়া কন্ঠে জোড়ে জোড়ে শ্বাস নেয়া অনুমান করতে পারে। বুকের মধ্যে মনে হচ্ছে কেউ ড্রাম পেটাচ্ছে। উপরওয়ালাকে স্মরণ করে তুরাগ। দোয়া করে যেন খারাপ কিছু না হয়। ততক্ষণেও ওপাশ থেকে প্রান্তর কোন কথা শোনা যায় না। ঘাবড়ায় তুরাগ। আস্তে আস্তে ডাকে প্রান্তকে। প্রান্ত কিছু বলতে পারছে না। জোড়ে শ্বাস টানতে টানতে শুধু বলে

– ভাই হসপিটালেই থাকেন। আসতেছি ওখানে। ঝামেলা হয়ে গেছে।
– কি হয়েছে। এই প্রান্ত। প্রান্ত।
-……..
– কথা বলছিস না কেন।
– কালাম ভাই এর মাথায় কো’প লাগছে। রক্তের বন্যা বয়ে যাচ্ছে ভাই।
কেদে ফেলে প্রান্ত।

হাত কাপতে থাকে তুরাগ এর। হাত থেকে ফোনটূ পড়ে যায়। ও তো এরকম কিছুরই ভয় পাচ্ছিল। ভয়টা তাহলে সত্যিই হলো। রাগে শরীর কাপতেছে এখন। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর এতো কড়া পাহাড়া থাকার পরেও এরকম কিছু হতে পারে। কল্পনাতীত বিষয়। এরকম কাজ কে করতে পারে তা বুঝতে একটুও সময় লাগে না তুরাগ এর। ফোনটা ফ্লোর থেকে তোলে। সুইচড অফ হয়ে গেছে।

পাওয়ার বাটনে প্রেস করে ধরে রাখে কিছি সময়। ফোন ওপেন হয়। রিসেন্ট কল লিস্ট থেকে প্রান্তর নাম্বার টা নিয়ে আবার ডায়াল করে সেই নাম্বারে। রিং হতে হতে কে’টে যায় ফোন। আবারও ফোন দেয়। এবারও রিসিভ হয় না। মা’রামা’রি তাহলে গুরুতরই হয়েছে। এবার কন্টাক্ট লিস্ট থেকে ইমননএর নাম্বার বের করে। ডায়াল করে সেই নাম্বারে। রিং হওয়ার কয়েক সেকেন্ড এর মাথায়ই রিসিভ হয় ফোন। আর কোন কথা বলেই সরাসরি জিজ্ঞেস করে

– কে করেছে?
– ভাই শান্ত হন।
– আমি জানতে চাচ্ছি কে করেছে।
– চৌধুরীর লোকেরা৷
– পরপর দুইবার হইয়াও খায়েশ মেটে নাই ওনার। যেই দেখছে জনগন এদিকে ঝুকছে অমনি এখন গায়ে আঘাত করার প্লান করছে।

ইমন তুরাগকে শান্ত হতে বলে। বোঝায় যে আগে কালাম মোল্লা ঠিক হোক। এরপর তিনি যা বলবেন তাই হবে।
তুরাগ আর কিছু না বলে ফোন কে’টে দেয়। রিপোর্ট গুলো নিয়ে দৌড়ে মিথিলার কেবিন এর দিকে যায়। নুরনাহার এর হাতে রিপোর্ট গুলো দিয়ে দৌড়ে আবার চলে আসে। নুরনাহার রিপোর্ট গুলো হাতে নিয়ে তাকিয়ে আছে ছেলের যাওয়ার দিকে। তিনি তুরাগকে কিছু একটা বলতে চাচ্ছিলেন৷

কিন্তু সেটা আর বলা হলো না। ডাকও দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তুরাগ বলছে এসে কথা বলব। এখন সময় নেই। প্রতিটা টিভি চ্যানেল এ একই নিউজ ঘুরতেছে। নির্বাচন কেন্দ্রে মা’রামা’রির ফলে গুরুতর আহত হয়ে হসপিটালে ভর্তি মেয়র পদপ্রার্থী কালাম মোল্লা। তুরাগ এর এখন রাগে মাথার রগ মনে হচ্ছে ছিড়ে যাচ্ছে। টিভি গুলা ভেঙে ফেলতে মন চাচ্ছে। আফসোস হচ্ছে সকাল বেলায়ই কেন গেল না সেজন্য। ভোট এখনো চলতেছে। কে জয়ী হবে বলা মুশকিল। সিটি হসপিটালেই আনা হয়েছে কালাম সাহেবকে। তুরাগ হাজির হয় সেখানে। ততক্ষণে মাথায় ব্যান্ডেজ করা হয়ে গেছে তার। তার সাথে কথা বলতে আসে তুরাগ।

– ভাই স্যরি।
– আরো পাশে আয় বেটা। স্যরি কেন বলছিস।
– আপনার বিপদের সময় আপনার পাশে থাকতে পারলাম না।
– যা হওয়ার তা হয়েছে। এখন দেখ কেন্দ্রের কি অবস্থা। আমিও একটু পর যাবো দেখি কি না কি হয়।
– শান্ত হন ভাই। জনগন আপনার পক্ষে আছে। চিন্তা করবেন না। কিন্তু এই কাজটা কে করল ভাই। একবার নাম কন। ওরে মাটির তলে পুইতা ফালামু একবারে।

কালাম মোল্লা পিঠে হাত রাখেন তুরাগ এর। তুরাগকে ছোট ভাইয়ের মতো স্নেহ করেন তিনি। তুরাগ ও যে তাকে কম শ্রদ্বা করে না এটা তো জানা কথাই। তিনি তুরাগকে বলেন
– শান্ত হ ভাই। শোন এই জগতে টিকে থাকা এত সহজ না। মেজাজ গরম করে কিছু করা ঠিক না। রগচটা মানুষ নেতা হতে পারে না।

– ভাই কেডায় করছে আপনি নামটা বলেন। ওটে কিছু বলব না। খালি নামটা শুনি।
– রাশেদ চৌধুরীর ছোট ভাই।
– ওয় এত বড় সাহস কেমনে পাইলো ভাই। ওরে তো আমি ছাড়ব না।
– শান্ত হ।
কে শোনে কার কথা। মেজাজ গরম হয়ে গেছে তুরাগ এর। হনহন করে বেড়িয়ে যায় হসপিটাল থেকে।

ডক্টর এসে রিপোর্ট গুলো দেখে গেছে। হাতের দুটো হাড়ের একটা আরেকটার উপর উঠে গেছে। কিছুটা ফাটল ও ধরেছে। ব্যান্ডেজ করে দিশেছে তার। এছাড়া আর কোন ইন্টার্নাল ইনজুরি হয় নি৷ তাই চাইলে আজকেই বাসায় নিয়ে যেতে পারবে মিথিলাকে।

ড. যেহেতু পারমিশন দিয়ে দিয়েছে তাহলে এখানে কষ্ট করে থেকে কী লাভ। এর থেকে বাসায় নিয়ে গেলে এক্সট্রা কেয়ার করার সুযোগ পাবে। তাই নুরনাহার ঠিক করে এখনই বাসায় চলে যাবে। ড্রাইভারকে আগেই ফোন দিয়েছিল। তিনি নিচে এসে অপেক্ষা করতেছে। নুরনাহার, মিথিলা, মোহনা, ওদের মা আর ড্রাইভার সহ পাচজন ছিল গাড়িতে।

ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ২২

গাড়ির মধ্যে সবাই মুলত আজকের নির্বাচন নিয়েই আলোচনা করতে ছিল। এমন সময় ড্রাইভার হঠাৎ করে ব্রেক কষায় সামনের দিকে ঝুকে যায় সবাই। মাথা তুলে সামনে যা দেখে তা দেখার জন্য প্রস্তুত ছিল না কেউই। মালবাহী একটা বড় ট্রাক রং রুটে খুব স্পিডে চালিয়ে আসতেছে। সামনে গাড়ি দেখেও স্পিড না কমিয়ে বরং আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। গাড়ির ভেতরে থাকা পাচজনই নিজের চোখের সামনে নিজেদের ভয়ঙ্কর ভবিষ্যত ভেসে ওঠে। মুহুর্তের মাঝেই রাস্তা থেকে ছিটকে দূরে গিয়ে পড়ে গাড়ি। কি ভয়ানক অবস্থা সেখানে।

ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ২৪