রাজনীতির রংমহল পর্ব ৩৮

রাজনীতির রংমহল পর্ব ৩৮
সিমরান মিমি

নিরব হয়ে দুহাত দিয়ে পরশের বাহু আঁকড়ে ধরে তার কাধে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে স্পর্শী। দুরেই একটা ছোট্ট পরটার হোটেল।আলতো ভাবে পরশকে ছাড়িয়ে উঠলো সে।তারপর দোকানের দিকে ইশারা করে বললো-
আমার ও অনেক খিদে পেয়েছে নেতামশাই।চলুন,কিছু খেয়ে নেই।

পরশ কোনো বাক্যব্যয় করলো না।ধীর পায়ে স্পর্শীর সাথে পা মেলালো।এ যেন সে কোনো ঘোরের মধ্যে আছে।আদোও সে যে মুক্ত তা বিশ্বাস হচ্ছে না।হোটেলের মধ্যে ঢুকেই সেখানকার কিশোর ছেলেটার কাছে স্পর্শী বললো-
ছয়টা পরোটা,ভাজি আর দুটো ডিম দিয়ে যাও এই টেবিলে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

বেশ কিছুক্ষণ পর তাদের বলা খাবারগুলো নিয়ে এলো টেবিলে।তৃপ্তির সাথে খেয়ে নিল পরশ।স্পর্শীও যেন আজ বহুবছর পর তৃপ্তির সাথে খাচ্ছে।খাওয়ার পর্ব শেষ হতেই আলতো হাতে পরশের দাড়ি ধরে হেসে দিলো স্পর্শী।বললো-
ইশশ!একদম দাড়ি,গোফ,চুলে দাদা শ্বশুর-দাদা শ্বশুর লাগছে।তা বুড়ো মশাই,আপনার নাতি গুলো কোথায়?
পরশ হাসলো।সত্যিই চুল, দাড়ি-গোঁফ বড় হয়ে গেছে।চেয়ারের ফাঁক দিয়ে হাতটা কে গলিয়ে স্পর্শীর কোমড় চেপে ধরলো।শিউরে উঠলো স্পর্শী।পরশ তাকে আরেকটু কাছে নিয়ে নিচু স্বরে বললো-

আগে তো বাসায় যাই।তারপর না হয় প্রমাণ দেব আমি আদোও বুড়ো নাকি জোয়ান’ই আছি।
থরথর করে স্পর্শীর পুরো শরীর এক পরিচিত অনুভূতিতে দগ্ধ হয়ে কেপে উঠলো।এপাশ-ওপাশে তাকিয়ে আলতো স্বরে পরশকে বললো-

নেতামশাই,চলুন তো এখন।আগে সেলুনে যাব।তারপর বাসায় যাওয়া যাবে।
পরশ ছেড়ে দিলো।তারপর একটা রিক্সা নিয়ে চললো সামনের সেলুনে।পরশের দাড়ি কাটছে সেলুনের ছেলেটা।স্পর্শী পাশেই আয়নার দিকে তাকিয়ে পরশকে দেখছে।হঠাৎ ই উত্তেজিত কন্ঠে বললো-
এই না না।একদম ক্লিন সেইভ করবেন না।সামান্য দাড়ি রাখবেন।

দোকানদার মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো।পরশকে রেখেই পাশের বিরিয়ানির দোকানে গেল স্পর্শী।মাস প্রায় শেষের দিকে।বাসায় তেমন কোনো বাজার’ই নেই।এখন গিয়ে কে রান্না করবে?ভেবেই দু প্যাকেট বিরিয়ানি কিনে পুনরায় সেলুনে চলে এলো।তারপর পরশকে নিয়ে বাস ধরে ধরে চলে এলো বাসার সামনে।চারতলা বিল্ডিং।এর তিনতলাতেই স্পর্শী থাকে।পরশকে নিয়ে তিন তলায় উঠে ফ্লাটের সামনে এলো।

চাবি দিয়ে খুলতেই দৃশ্যমান হলো সামনের অফিস রুমটা।ভারী ভারী মোটা বইয়ে ভর্তি আশেপাশের টেবিল।বেশ সাজানো -গোছানো অফিস পেরোতেই ভেতরের রুমে ঢুকলো স্পর্শীয়া।পেছনে পরশ ও গেলো।ভেতরে ঢুকতেই অবাক হয়ে গেলো।অফিস রুমে ঠিক যতটা আভিজাত্যপূর্ণ ভেতরের রুমটা ঠিক ততটাই সাদামাটা।রুমের এক কোনায় একটা পাটি বিছানো।তার উপরে পাতলা একটা চাদর আর বালিশ। কিছুটা দুরেই একটা র‍্যাক।আর তার পাশেই একটা টেবিল।

পরশ ভ্রু কুচকে স্পর্শীর দিকে তাকাতেই পাত্তা দিলো না সে।টাওয়াল হাতে ধরিয়ে ঠেলে বাথ্রুমে ঢুকিয়ে দিয়ে বললো-
যান তো।সেলুন থেকে এসেছেন দ্রুত গোসল করে নিন।
গতকালকেই পরশের মুক্তির আবেদন টি স্পর্শীর হাতে এসেছে।দেখামাত্রই মার্কেটে গিয়ে দুটো শার্ট,প্যান্ট নিয়ে এসেছে।গোসল করে বের হতেই সেগুলো ধরিয়ে দিয়ে নিজে গোসল করতে গেল।
মাথা মুছতে মুছতে স্পর্শী বাইরে বের হতেই পরশের থমথমে মুখের সামনে পড়লো।ভ্রু কুচকে তাকাতেই পরশ গম্ভীর কন্ঠে বললো-

এসব কি?
স্পর্শী কিছুটা বুঝলো।পরক্ষণেই অস্বীকার করে বললো-
কোথায় কি?
পরশ কোনোরকম ভণিতা ছাড়াই থমথমে কন্ঠে বললো-
রুমে খাট নেই কেনো?কোনো আসবাব নেই কেন?রান্নাঘরে কোনো বাজার নেই কেনো?শুধুমাত্র দুটো ডিম আর আলু,ডাল পড়ে আছে।

স্পর্শী থমকালো।ভীষণ অসস্তিতে পড়লো৷ইনিয়ে-বিনিয়ে আলতো হেয়ালী করে বললো-
এ মা,রুমে আসতে পারেন নি,এর মধ্যেই গোয়েন্দা গিরি শুরু হয়ে গেল।চলুন এখানে বসুন।আমার খুব ঘুম পাচ্ছে।একটু ঘূমাবো।

পরশকে একপ্রকার টেনে পাটির উপর শোয়ালো।তারপর আলতো ভাবে বুকের উপর মাথা দিয়ে ঝাপটে ধরলো স্পর্শীয়া।পরশ নিজেও জড়িয়ে ধরলো স্পর্শীকে।বেশ কিছুক্ষণ নিরব থাকার পর পরশ বললো-
এরকম পাগলামী করার কি কোনো দরকার ছিলো পাখি?তুমি তো অবুজ নও।তাও এসব ছেলেমানুষী কেন?

আরো গভীর ভাবে জড়িয়ে ধরলো স্পর্শী।এই যে নগ্ন বুকটায় আজ কত বছর পর নাক ঘষছে সে।এই পুরুষালী গন্ধ টা তো অক্সিজেনের থেকেও বেশী দরকার ছিলো তার কাছে।তাও আজ এতোবছর ধরে দুরত্বে ছিলো। ঠোট ভেঙে এলো স্পর্শীর।নিচু কন্ঠে ভাঙা ভাঙা স্বরে বলল-

আমি পারতাম না নেতামশাই।কিভাবে পারতাম?আপনি ওই চার দেয়ালের মধ্যে ছোট্ট একটা পাটির উপর সারা শীত -গরম মিলিয়ে চার বছর কাটিয়েছেন।আপনাকে রেখে ওই নরম বিছানায় কিছুতেই আমার ঘুম আসতো না।ভালো-মন্দ কিছু খেতে গেলেই আপনার কথা মনে আসতো।দু-বেলা ওই আধপোড়া রুটি,এক বেলার ওই অসহ্য গরম ভাতের সাথে বিদঘুটে তরকারি কিভাবে খাচ্ছেন আপনি।

আমার গলা দিয়ে কোনো ভালো খাবার একদম নামতো না নেতামশাই।প্লিজ এ বিষয়ে কোনো কথা বলবেন না।আমার সহ্য হয় না।ভীষণ কান্না পায়।আমি এতটাও বুঝদার হতে চাই না।চাই না।
কান্নার বেগ বেড়ে গেল স্পর্শীর।যেন বহুদিনের কষ্টকে উগড়ে দিচ্ছে পরশের সামনে।পরশ উত্তেজিত হয়ে গেলো।জোরে বুকের সাথে ঝাপটে ধরলো।বললো-

এভাবে কাদে না পাখি।আমি তো চলে এসেছি।প্লিজ থামো।
স্পর্শী থামলো না।হঠাৎ ই সেই কান্নাভেজা ঠোট দুটো আকড়ে ধরলো পরশ।হতভম্ব হয়ে গোল গোল হয়ে তাকিয়ে রইলো স্পর্শী।নিজেকে ছাড়াতে গেলেই আরো গভীরভাবে আকড়ে ধরলো পরশ।যেন আজ বহু বছরের তৃষ্ণা একসাথে মেটাচ্ছে।পরিচিত এই অনুভূতির থেকে অনেকদিন দুরত্বে রয়েছে দুজন।আজ সেই দুরত্ব ঘুচতেই মেতে উঠেছে অজানা সুধার ছোয়া নিতে।

পরশের বুকের উপর শুয়ে আছে স্পর্শী।পুরুষালী এই প্রশস্ত বুকটায় আজ বহুদিন পর আঙুল দিয়ে আঁকি বুকি করে সে।অনেকক্ষণ পর বললো-
আজকে সন্ধ্যায়’ই আমরা বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিবো।ওকে।আর এই ঢাকায় আসবো না।
পরশ অবাক হলো।বললো-
তাহলে তোমার ওকালতি কে করবে?
ব্যাস্ত কন্ঠেই স্পর্শী বললো-

সব বাদ।এইসব পেশায় আর নিজেকে জড়াবো না।এতোদিন ও তো থাকতাম না।শুধু আপনাকে ছাড়ানোর জন্য পড়ে রয়েছি।জানেন নেতামশাই,ভেবেছিলাম অন্য সবার মতো নয়।আমি নিজে সত্যের প্রতিষ্ঠা করবো।কিন্তু বিশ্বাস করুন এই ওকালতিতে সত্যের ভিত অনেক দুর্বল।আমি সত্যের উপর বিশ্বাস করেই এই পেশায় নেমেছিলাম।কিন্তু না, জীবনের প্রথম কেস টাতেই হারলাম।আমি আর এসব চাকরী-বাকরী কিচ্ছু করবো না।শখ মিটেছে আমার।এবার শুধুমাত্র সংসার করবো।শশুর -শাশুড়ীর সেবা করবো আর স্বামীকে নিয়ে সুখে শান্তিতে থাকবো।এসব পুলিশ-কেস,জেল-জরিমানা এসবে আর আমি নেই।
পরশ আলতো হাসলো।বললো-

মা কেমন আছে?ওদের কিছু জানিয়েছো?
নিমিষেই মুখে বিষাদ ছেয়ে গেল স্পর্শীর।বেশ কিছুক্ষন চুপ থেকে বলল-
আমার কারো সাথে দেখা বা কথা হয় না নেতামশাই।সেই যে বাড়ি ছাড়লাম আর পিরোজপুরে পা রাখিনি।কিভাবেই বা রাখবো?মায়ের মুখের দিকে তাকানো যায় না।বাবাও চুপচাপ থাকে। সেদিনই প্রতিজ্ঞা করেছি আপনাকে না নিয়ে ও বাড়িতে আর ফিরবো না।তবে বাবা আর প্রেমার সাথে মাঝেমধ্যে কথা হয়।এই আপনি শুনেছেন না প্রেমা এইচএসসি তে গোল্ডেন পেয়েছে।

রাজনীতির রংমহল পর্ব ৩৭

পরশ হাসলো। বললো-
হ্যা, আব্বু বলেছে।
দুজনের চোখে কোনো ঘুম নেই।একে একে মনের সকল কথাকে উগড়ে দিচ্ছে স্পর্শী।আর পরশ মুগ্ধ হয়ে তার তোতাপাখির কথা শ্রবণ করছে।

রাজনীতির রংমহল পর্ব ৩৯