বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৫১

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৫১
জাওয়াদ জামী

পরদিন ফজরের নামাজ আদায় করেই তাহমিদ কুহুকে নিয়ে বেরিয়ে পরল। তাহমিদ সারা রাস্তা কুহুকে জড়িয়ে ধরে রইল। ড্রাইভার থাকায় কুহুর বেশ লজ্জা লাগছিল। কিন্তু ওর করার কিছুই নেই। এই নাছোড়বান্দা যে ও ছাড়বেনা, সেকথা কুহু ভালো করেই জানে। তাই ও চুপ থেকে তাহমিদের কথা শুনতে লাগল।

সকাল নয়টার দিকে তাহমিদ ড্রাইভারকে কোন রেস্টুরেন্টের সামনে দাঁড়াতে বলে রেখেছিল। ড্রাইভার রাস্তার ধারে ভালো একটা রেস্টুরেন্ট দেখে গাড়ি থামায়। ওরা সেখানে সকালের নাস্তা করে, আবারও গাড়িতে উঠল।
ওরা যখন ফুলতলা পৌঁছে তখন বেলা এগারোটা বাজে। গাড়ির হর্ণ শুনেই দৃষ্টি আর শিহাব বাড়ির ভেতর থেকে দৌড়ে বাহিরে আসল।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তাহমিদ, কুহু গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে ওদের দুই ভাইবোনকে জড়িয়ে ধরল।
ড্রাইভার ব্যস্ত হয়ে পরেছে গাড়ি থেকে জিনিসপত্র নামাতে। তাহমিদ বিয়ের পর শ্বশুর বাড়িতে প্রথম আসছে, তাই সে দশ রকম মিষ্টি, ৫-৭ রকম ফল, শিহাব, দৃষ্টির জন্য আইসক্রিমের বড় বক্স এনেছে এখানকার বাজার থেকে। এছাড়াও চকলেট কেকসহ আরও অনেক কিছু এনেছে।
এতসব কিছু দেখে দৃষ্টি আর শিহাব অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।

” ভাইয়া, এসব কি করেছ তুমি! এত কিছু এনেছ কেন? এসব কে খাবে? ” দৃষ্টি জিজ্ঞেস করল।
” কেন আমি খাব। শ্বশুর বাড়িতে এসব এনেছি নিজে বসে বসে খাওয়ার জন্য। আমি খাব তোরা দেখবি। তাইনা শিহাব? ” তাহমিদ হেসে জবাব দিল।
ততক্ষণে শিউলিও বেরিয়ে এসেছে। তাহমিদকে দেখে সে সামনে এগিয়ে আসল।
” বাজান, আইসা পরছ? কিমুন আছো তোমরা? তোমার মা’য়ে ভালো আছে? বড় আপা, আম্মা, দুলাভাই হেরা কিমুন আছে? ”

তাহমিদ শিউলিকে সালাম দিয়ে জানাল সবাই ভালো আছে। শিউলি ওদেরকে নিয়ে ভেতরে আসল।
সামনে নানানরকম খাবার নিয়ে বসে আছে তাহমিদ। এত খাবার সে খাবে কেমন করে! এদিকে শিউলিও নাছোড়বান্দার ন্যায় তাহমিদকে খাওয়ার জন্য জোড়াজুড়ি করছে।

বাধ্য হয়ে তাহমিদ দৃষ্টি আর শিহাবকে নিয়ে খেতে শুরু করল। শিউলি তাহমিদকে হালকা নাস্তা দেয়ার কথা বলে, কয়েকরকম পিঠা, লুচি, সেমাই, পায়েস, মিষ্টি, দই খেতে দিয়েছে।
তাহমিদ সব আইটেম থেকে একটা করে নিয়ে মুখে দেয়। কুহু তাহমিদকে দেখে হাসছে। আজ পা’গ’ল ডক্টর বেশ চিপায় পরেছে। শিউলি আক্তার কুহুকেও খেতে বলল। কিন্তু কুহু আসার পথে খেয়েছে, তাই এখন আর কিছু খায়না।

কায়েস মেয়ে-জামাই আসার খবর শোনামাত্রই দোকান থেকে বাড়ি ফিরেছ।
তাহমিদ কেবলই খাবার শেষ করে বারান্দায় বসে দৃষ্টি শিহাবের সাথে গল্প করছিল।
ঠিক তখনই কায়েস বাড়িতে ঢুকল।
কায়েসে দেখে তাহমিদ বারান্দা থেকে উঠানে আসল।

” আরে রোমিও যে, কেমন আছো? তোমার বাড়িতে এসেছি, কিন্তু তুমিই নেই। যেন মনে হচ্ছিল, লবন ছাড়া তরকারি। ” তাহমিদ একহাতে জড়িয়ে ধরল কায়েসকে।
কায়েস মেয়ে জামাইয়ের মুখে এমন কথা শুনে কপাল চাপড়ায়। এই ছেলে আর শোধরাবার নয়।তাহমিদ যে নিজের ছেলেমেয়ের সামনে তাকে রোমিও ডাকবে এটা সে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে।
দৃষ্টি শিহাব তাহমিদের কথা শুনে হাসছে। কুহু কপাল কুঁচকে তাহমিদের দিকে তাকিয়ে আছে।

” তা ভাগ্নে, খাওয়াদাওয়া কিছু করেছ? নাকি শ্বাশুড়ি তোমাকে না খাইয়ে রেখেছে? ”
” কি যে বল রোমিও! আমার শ্বাশুড়ির মত শ্বাশুড়ি আর দুইটা হয়না। আমাকে কত কিছু খাইয়েছ জান? অবশ্য আমার শ্বশুরও কম যায়না, তাইনা রোমিও? ”

” তোমার শ্বশুর আবার কবে হলাম আমি! আগে যেমন মামা ছিলাম, এখন তেমন রোমিও হয়েছি। শ্বশুর হওয়া আমার আর হলোনা। এবার বল, তোমার বাড়ির সবাই কেমন আছে? বড় আপা, আমার বেয়ান, আম্মা সবাই ভালো আছে তো? ”
” সবাই ভালো আছে, শ্বশুরমশাই। তোতোমার বেয়ান তোমার সাথে কথা বলতে চেয়েছে। সময় করে তার সাথে কথা বল। ”

” আচ্ছা বলব। এবার যাও গোসল করে নাও। দুপুরের খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। আজ সবাই একসাথে বসে খাব। ”
” কিছুক্ষণ আগেই না খেলাম! আবারও তুমি খাওয়ার কথা বলছ! এটা ঠিক নয়। শিহাব, চল আজকে নদীতে গোসল করব। অনেকদিন নদীতে গোসল দিইনা। দৃষ্টি তুই যাবি নাকি? ”
” না ভাইয়া, তুমি শিহাবকে নিয়ে যাও। ”

তাহমিদের কথা শুনে শিহাব আর দেরি করলনা। কুহু তাহমিদের টাওয়েল, ট্রাউজার আর টি-শার্ট বের করে একটা শপিং ব্যাগে ভরে শিহাবের হাতে দিলে, ওরা বেরিয়ে যায়।
” কুহু, তুই তো কিছুই খাইলিনা! হাঁসের মাংস ঝাল ঝাল কইরা রানছি। গরম ভাত দিয়া একটু খাইয়ালা। ” শিউলি আক্তার কুহুকে বলল।

কুহু অবাক হয়ে শিউলির দিকে তাকিয়ে রয়। সেই আগের ছোটমার সাথে এখনকার ছেটমার আকাশপথে তফাৎ। যে ছোটমা আগে নিজেরা খাবার পর পাতিলের তলার খাবার কুহুর জন্য রাখত। আজ সে-ই কুহুকে আগে খেতে বলছে! আনন্দে কুহুর চোখে পানি এসে যায়।

” না ছোটমা, এখন কিছুই খাবনা। শরীরটা ভালো লাগছেনা। মাথা ঘুরাচ্ছে। তাছাড়া খাওয়ার রুচিও নেই। ”
” কেন রে? তর কিছু হইব নাকি? তর মুখটাও কিমুন শুকনা দেখা যায়। কয়মাস চলতাছে? ”
” না ছোটমা, তেমন কিছুই নয়। অনেকদূর পথ জার্নি করে এসেছি, তাই বোধহয় এমন লাগছে। ” মুখে বললেও কুহু ঠিকই চিন্তায় পরে যায়। গত দেড়মাস যাবৎ ওর পিরিয়ড অফ রয়েছে। কুহু মনে করেছে এমনটা হতেই পারে। এর আগেও এমন হয়েছে। কিন্তু আজ ছোটমার কথা শুনে ওর একটু চিন্তা হচ্ছে। তাহমিদ বলে দিয়েছে, তিন বছরের আগে কোন বাচ্চাকাচ্চা নেয়া যাবেনা। যদি সত্যিই তেমন কিছু হয়, তবে ও তাহমিদকে কি বলবে!

তাহমিদ শিহাবকে নিয়ে দুই ঘন্টা পর বাড়িতে আসল। ওরা আসলেই শিউলি টেবিলে খাবার দেয়। কায়েসও ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল।
বিকেলে দৃষ্টির জোড়াজুড়িতে ওরা চারজন বেড়াতে বের হয়। ওরা প্রথমে হেঁটে নদীর ধারে যায। এরপর সেখান থেকে বাজারের দিকে যায়।
দৃষ্টি শিহাবকে অনেক খাবার কিনে দিয়ে ওরা বাজারের পাশে বাগানের দিকে যায়।

” আরে তুমি কায়েসের বড় মাইয়া না? তোমরতো শুনছি বিয়ে হইছে। আর তুমিই তো এই মাইয়ার জামাই? আগে থেকেই গ্রামে আসতা। এখন পারমানেন্ট হয়া গেলা কায়েসের বাড়িতে। ” ওরা বাগানে বসে চিপস, চকলেট খাচ্ছিল। কোথায় থেকে জমিরউদ্দীন মেম্বার এসে উপরোক্ত কথাগুলো বলল।

মেম্বারকে দেখেই সবাই বিরক্ত হলেও, তাহমিদ হাসিমুখে তার কথার উত্তর দেয়।
” জ্বি, আগে মেহমান হিসেবে বেড়াতে আসতাম, এখন জামাই হিসেবে আসব। কি করব বলুন, আমার শ্বশুরের মেয়েটাকে দেখে মাথা এমনভাবে আউলিয়ে গেল, তাকে বিয়ে না করে থাকতেই পারলামনা। আর এতেই পারমানেন্ট হয়ে গেলাম। আর জানেনই তো জামাই মানেই ছেলে। তাই পারমানেন্ট হিসেবে পরিচয় দিতে গেলে নিজেকে শ্বশুরের ছেলে ভাবতে হয়। আমিও তাই ভাবি। ”

” এই মাইয়ারে দেখে কতজনের মাথা যে আউলায় দিছে, তা কেবল সে-ই জানে। উঠতি বয়সের মাইয়াদের স্বভাবচরিত্র খুব একটা ভালো হয়না জানোইতো? তা তুমি যেন কিসের ডাক্তার? রুগী হয় নিয়মিত? কামাই রোজগার কেমন হয়?”
মেম্বারের কথা শুনে সবার মাথা গরম হয়ে গেছে। দৃষ্টি রা’গে ফুঁসছে। শিহাব দাঁত কিড়মিড় করছে। শুধু স্বাভাবিক আছে তাহমিদ। ও মিটমিটিয়ে হাসছে।

” এটা ঠিকই বলেছেন। উঠতি বয়সের মেয়েদের ছোঁকছোঁক করার স্বভাব থাকে। তবে আমার বউ এসব ক্ষেত্রে কাউকে পাত্তা দেয়নি। তবে এখনকার ছেলেরাও কিন্তু কম যায়না। অনেকের তো বুড়ো বয়সেও নাতনিদের বয়সি মেয়েদের দেখলে লালা ঝরে। তারা বড়-ছোট বাছবিচার না করেই মেয়েদের ওপর হামলে পরে। তাদের কাছে বুড়ি,কচি সবই সমান। একটা হলেই হয়।

অবশ্য তাদের রুচির সমস্যা আছে বলে আমি মনে করি। তাইনা মেম্বার সাহেব? আর আপনাদের দোয়ায় আলহামদুলিল্লাহ আমার রুগী ভালোই হয়। আপনার যদি কখনো হার্ট অ্যাটাক হয়, তবে আপনি ঢাকায় যাবেন। আমি আমার জুনিয়রদের বলে দেব, আপনার সেবাযত্ন করতে। ওদের হাত যশও খুব ভালো। রুগীরা ওদের হাসি দেখলেই অর্ধেক সুস্থ হয়ে যায়। ”
জমিরউদ্দীন মেম্বার তাহমিদের কথা শুনে গম্ভীর হয়ে গেছে। ও এদিকওদিক তাকিয়ে পালানোর পথ খুঁজছে।

” আচ্ছা, আমি তাইলে যাইগা। ” জমিরউদ্দীন যাওয়ার সময় কুহুর দিকে তাকিয়ে কুটিল হাসি দিল, যা তাহমিদের চোখে পরে যায়।
” কুহু, যে কয়টা দিন গ্রামে থাকবে, খুব সাবধানে থাকবে বুঝলে? এই মেম্বার লোকটার চাহনি খুব খারাপ। আর দৃষ্টি তুইও সাবধানে থাকবি। রাস্তাঘাটে একা একা চলাফেরা করবিনা। ”

” ঠিক আছে, ভাইয়া। আমি অবশ্য এই বুড়োর সাথে আর কথা বলিনা। তাকে দেখলেই অন্য রাস্তা দিয়ে হাঁটি। শা’লা বুড়া, দুইদিন পর ক’ব’রে যাবে, তাও স্বভাব ঠিক হলোনা। ”
” দৃষ্টি, তুই গালি দিচ্ছিস! তা-ও ছেলেদের গালি! নিহান জানে? ও জানলে তোর খবর আছে। তা-ও যেনতেন খবর নয়। একেবারে বিবিসি, সিএনএনের খবর। ”
তাহমিদের কথা শুনে দৃষ্টি বিষম খায়। কুহু হা করে তাকিয়ে আছে তাহমিদের দিকে। আর বেচারা শিহাব তাহমিদের কথার মানে বুঝতে পারেনা।

” ভাইয়া, নিহান ভাইয়া কেন দৃষ্টিপুকে খবর করবে? নিহান ভাইয়া তো এখানে আসেইনা। সে জানবে কেমন করে! ” বেচারা শিহাব সরল মনে প্রশ্ন করে বসল।
দৃষ্টি ওড়নায় মুখ ঢেকে বসে আছে।
কুহু একবার তাহমিদের দিকে তাকাচ্ছে, তো আরেকবার দৃষ্টির দিকে তাকাচ্ছে।
তাহমিদ দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসছে।

” ও বউ, তুমি এমন ক্যাবলাকান্তের মত এদিক-ওদিক তাকাচ্ছ কেন? তোমার বোন ডুবে ডুবে শরবত খাচ্ছে। তা-ও যেনতেন শরবত নয়, ফান্টা মেশানো লেবুর শরবত। তার ভেতর আবার গোল মরিচের গুড়া আর বিট লবনও মেশানো হয়েছে। একের ভেতর অনেক। টক,মিষ্টি, ঝালঝাল শরবত। একবার খেলে বারবার খেতে মন চাইবে। ”
এবার কুহু সব বুঝতে পারল। ও দৃষ্টির দিকে তাকাল। মেয়েটা তখনও ওড়নায় মুখ ঢেকে রয়েছে।

ওরা সন্ধ্যার আগেই বাড়িতে যায়। তাহমিদ বারান্দায় উঠতেই কায়েস ওকে হাত ধরে ড্রয়িং রুমে নিয়ে যায়। সেখানে দু’জন বয়স্ক ব্যক্তি বসে রয়েছে। কায়েস তাদের সাথে তাহমিদকে পরিচয় করিয়ে দেয়। তাহমিদ জানতে পারল তারা কায়েসের মামাত ভাই। তারা এসেছেন বিয়ের দাওয়াত দিতে। বড় ভাইয়ের মেয়ের বিয়ে, তাই তার সাথে ছোট ভাইও এসেছেন দাওয়াত করতে। শিউলি কুহুকেও ড্রয়িং রুমে যেতে বলল।

কুহু রুমে আসলে তাদের সাথে কুহুকে পরিচয় করায় কায়েস। বয়স্ক ভদ্রলোকেরা কায়েসের পরিবারের পাশাপাশি তাহমিদ কুহুকেও দাওয়াত করল। সাতদিন পর বিয়ে।
কিন্তু তাহমিদ জানাল, সে বিয়েতে থাকতে পারবেনা, চাইলে কুহু সেখানে যেতে পারে।

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৫০

দুইদিন ফুলতলা কাটিয়ে তাহমিদ আজ বিদায় নিবে। ও সারারাত কুহুকে বুকে জরিয়ে রেখেছিল। সারারাত নানান উপদেশ দিয়েছে কুহুকে। সেই সাথে বলেছে, ও চাইলে বিয়েতে যেতে পারে। সকাল নয়টার দিক তাহমিদ বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠল। কিন্তু ওর মন পরে রইল কুহুর কাছে।

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৫২