বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৫২

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৫২
জাওয়াদ জামী

নিস্তব্ধ রাত। থালার মত চাঁদ আলোর পসরা সাজিয়ে ধরনীকে তার রূপ বিলিয়ে দিচ্ছে। মৃদুমন্দ সমীরণ এক গাছ থেকে আরেক গাছে প্রেমের পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে। চারপাশে ঝিঁঝিঁদের ডাকে কান ঝালাপালা হবার জোগাড়। রাতের কোলে ধরনী নিজেকে সঁপে দিয়েছে। তেমনি রাতও ধরনীর দেহে তার পরশ দিয়ে, ঘুমের রেশ নামিয়েছে। সবাই ঘুমিয়ে গেলেও, কুহু নামক মেয়েটির চোখে ঘুম নেই।

তার মন পরে আছে সেই পা’গ’ল ডক্টরের কাছে। বিয়ের নয় মাস হতে চলল। এরমধ্যে দুই কি তিন রাত তাহমিদ কুহুকে ছেড়ে বাহিরে রাত কাটিয়েছে, তা-ও মেডিকেল ক্যাম্পের জন্য। কিন্তু এবারের বিষয়টা সম্পূর্ণ আলাদা। হয়তো দশ থেকে পনের রাত তাকে ছাড়া কুহুর কাটাতে হবে। এই বিরহ কুহু সইবে কেমন করে! তাকে ছাড়া প্রতিটি রাত যে বিরহেরা বিষন্নতার প্রহর কাটাবে, তা কি সে জানে?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সে কি জানে, তার বুকে মাথা না রাখলে কুহুর চোখে ঘুম নামক প্রশান্তিরা হানা দেয়না? সে কি জানে, তার সুক্ষতম ছোঁয়ায়ও কুহুর তনু-মনে সুখের পরশ এসে বাসা বাঁধে? কতকিছুই আনমনে ভেবে চলছে কুহু। দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালার কপাট বন্ধ করতে গিয়ে লক্ষ্য করল, ওর আঁখির কোনে জমা হয়েছে অশ্রুবিন্দু। অতি সন্তপর্ণে আঁখিজল মুছে নিল বিরহী কন্যাটি। বিছানায় তাকিয়ে দেখল দৃষ্টি ওর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। এই মেয়ে এখনো জেগে আছে! অথচ আগে কখনোই দৃষ্টিকে এত রাত অব্দি জাগতে দেখেনি কুহু। দৃষ্টির হাসির কোন কারণ খুঁজে পায়না কুহু। ও কপাল কুঁচকে তাকায় দৃষ্টির দিকে।

” আপু, তুমি বুঝি ভাইয়াকে মিস করছ? এত মিস না করে এবার ঘুমাও। সকাল হতে দেরি নেই। এখন না ঘুমালে, সারাদিন তোমাকে ঘুমিয়েই কাটাতে হবে। সেই সাথে আমাকেও। তোমার জামাই মশাইয়ের কড়া নির্দেশ, তোমাকে এই কয়দিন ঠিকঠাক দেখে রাখতে হবে। তার কথার অন্যথা হলে, আমাকে পঁচা পানিতে চোবাতে চেয়েছে ভাইয়া। আর আমি এতটাই পা’গ’ল নই যে স্বেচ্ছায় পঁচা পানিতে নামব। তাই তোমার পা’গ’ল ডক্টরের ভালো বউ হয়ে এখনই শুয়ে পর। ”

” আমার কথা বাদ দে। তুই জেগে আছিস কেন? আগেতো আমি তোকে হাজার চেষ্টা করেও এত রাত অব্দি জাগিয়ে রাখতে পারিনি। কিন্তু সেই তুই-ই এখন স্বেচ্ছায় রাত জাগছিস! ঘটনা কি? ”
কুহুর চিলচক্ষুর দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি ভ্যাবাচ্যাকা খায়। এতক্ষণ যে ভয়টা ও পাচ্ছিল, সেটাই বুঝি হতে চলেছে।

” আপু, আমার না খুব ঘুম পেয়েছে। তুমি তারাতারি এসে শুয়ে পর প্লিজ। এই যে দেখ আমার চোখ নিজ থেকেই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আমি জোড় করে তাদের খুলে রেখেছি। ”
” তোর আর নিহান ভাইয়ার মধ্যে কি চলছে? কালকে উনাকে জিজ্ঞেস করব, কিন্তু হয়ে উঠেনি। এবার আমাকে সবকিছু সত্যি করে বল। ”

কুহুর কথা শুনে দৃষ্টি বড় একটা হাই তুলল। এমন ভাব ধরল যেন ও ঘুমে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে।
” আপু, আমি ঘুমালাম হুম। তোমার জামাইকে বলো আমি তোমার সাথে রাত সাড়ে তিনটা পর্যন্ত জেগে ছিলাম। আর এক সেকেন্ড যদি আমি জাগি, নির্ঘাত চোখের নিচে পাতিলের তলার কালি পরবে। ” দৃষ্টি কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পরল। ও কিভাবে কুহুকে জানাবে, প্রতিরাত জেগেই ও নিহানের সাথে কথা বলে!

কুহু বুঝল দৃষ্টি ওকে কিছু বলতে চায়না। তাই ও আর দৃষ্টিকে কিছুই বললনা। চুপচাপ বিছানায় এসে শুয়ে পরল।
তিনদিন কেটে গেছে ফুলতলা। তাহমিদ শত ব্যস্ততার মাঝেও কুহুকে ফোন করতে ভোলেনা। এমনকি দিদুন আর ওর শ্বাশুড়িও প্রতিদিন ফোন করে ওর খোঁজ নেয়। কুহু মাঝেমাঝে ভাবে কত ভাগ্য করলে একটা মেয়ে এমন সংসার পায়। এমন শ্বাশুড়ি সবার কপালে জোটেনা। প্রতিটা মেয়েই চায়, তার একটা সংসার হবে। যে সংসারের মধ্যমনি হবে সে।

আদরে, ভালোবাসায় আগলে রাখবে, সংসারের প্রতিটা মানুষকে। সংসারের মানুষগুলোও সুখী হবে তাকে নিয়ে। একটা নিজের মানুষ হবে। যে মানুষটা সুখে-দুঃখে তার পাশে থাকবে। যার বুকে মাথা রাখলেই নিমেষেই সকল দুঃখ উবে যাবে। এমন সংসার কুহু পেয়েছে। সকলের ভালোবাসায় আজ সে সিক্ত। আজ সে পূর্ণ। অজান্তেই পেটে হাত যায় ওর। ছোটমার কথা যদি সত্যি হয়, তবে নিশ্চয়ই ঐ বাড়ির সবাই খুব খুশি হবে। আর সেই মানুষটা? সে-ও নিশ্চয়ই অখুশি হবেনা। কুহু সিদ্ধান্ত নেয়, ও ঢাকায় ফিরেই টেস্ট করাবে। ও স্বচক্ষে তাহমিদের প্রতিক্রিয়া দেখতে চায়

” কি রে কুহু, তুই এম্নে দাঁড়ায় রইছস ক্যা? বেলা কত হইছে তা দেখছস? সকালের খাওন কখন খাইবি? হাঁসের মাংস দিয়া দুইডা গরম ভাত খাইবি চল। আমিও তর জন্য এহনো খাইনি। বাপের বাইত্তে আইসা না খাইয়া থাইকা, অসুখ বাধাইলে তোর শাউরি কি কইব জানোস? আয় দুইডা খাইয়া তর ছোড দাদার বাইত্তে যা। তর দাদি তরে ডাকছে। ”

এই ছোটমাকে কুহু যতই দেখছে ততই অবাক হয়ে যাচ্ছে। তার চোখে কুহু নিজের জন্য চিন্তা দেখতে পাচ্ছে।
” দেখেছিস সিক্ত, তোর পা’গ’ল ভাই এবার ফুলতলা গেল, কিন্তু আমাদের একবারও বললনা। মানুষ যে স্বার্থপর হয়, তা তোর ভাইকে দেখেই আমি জানলাম। সে কিন্তু জানে, আমিও অনেকদিন থেকে ফুলতলা যাইনা। ” আনান মন খারাপ করে বলল।

” ভাইয়া গেছে তার শ্বশুর বাড়িতে। এতদিন সে তার বড়মার বাবার বাড়িতে গেছে। তাই সেখানে তোমরাও থাকতে। কিন্তু এখন সে নিজের শ্বশুর বাড়িতে গেছে, যাচ্ছে, যাবে। তাই চাইলেও সেখানে তোমার যাওয়া চলবেনা। তুমি তোমার শ্বশুর বাড়িতে যাও। জামাই আদর খেয়ে আস। কেউ কিছু বলবেনা তোমাকে। অযথা আমার ভাইয়ার দিকে নজর দিচ্ছ কেন? খালি আমার ভাইয়াকে দোষ দেয়ার রাস্তা খোঁজ? ” সিক্তাও আনানকে ছাড় দেয়না।

” আমি বারবার কেন ভুলে যাই, তুইও তোর ভাইয়ের বোন। তাকে কিছু বললেই যে তুই ছ্যাঁৎ করে উঠিস, এটা আমার যে কেন মনে থাকেনা! এক কাজ কর আমাকে কয়েকটা চুমু দে, আদর কর। তাহলে হয়তো স্মৃতিশক্তি প্রখর হবে। ”
” খালি বাহানা খোঁজ আদর নেয়ার! যাও পড়তে বস। তার পরীক্ষা শুরু হয়েছে, অথচ পড়ার চিন্তা নেই। সারাদিন মন-মস্তিস্ক আদর আদর করতেই থাকে! রেজাল্ট খারাপ হলে আমার ভাইয়া যে তোমাকে কি করবে, তা তুমি ভালো করেই জান। ”

” থাক, ঐ হিটলারের ভয় দেখানোর দরকার নেই। তোরা আসলেই হিটলারের বংশধর। তোর ভাই জাত হিটলার আর তুই তার চ্যালা। হিটলারকে বলে দিস, ঐ এই আনানের রেজাল্ট কখনো খারাপ হয়না। সে অলওয়েজ ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। ” আনান ভাব নিয়ে বলল। ওর কথা বলার ধরন দেখে সিক্তা মুচকি হাসল।

” কুহু মা, তুই দত্তপাড়া যাবি? আমার মামাতো ভাই এসে দাওয়াত করে গেল। সেখানে না গেলে খারাপ দেখায়। আর তুইও এখানে আছিস, তোকে না নিয়ে গেলে তারাও মন খারাপ করবে। তারা তো তোকেও দাওয়াত করল। ” কায়েস রাতে খাবার টেবিলে বসে মেয়েকে জিজ্ঞেস করল।

” উনি ও তো আমাকে সেখানে যেতে বলেছেন, বাবা। আমারও ইচ্ছে আছে সেখানে যাওয়ার। তাদের কাউকেও চিনিনা। এই সুযোগে তাদেরও চেনা হয়ে যাবে। ”
” না বাবা, আপুর কোথাও যাওয়া হবেনা। গ্রামে এসেছে সাড়ে আটমাস পর। এতদিন পর এসেই সে ড্যাং ড্যাং করে এ গ্রাম, ও গ্রাম বেড়াতে যাবে, তা হবেনা। কতদিন পর আপুকে কাছে পেলাম। তাকে কোথাও যেতে দেবনা। তুমি আর আম্মু দত্তপাড়া যেও। আমি আর আপু বাড়িতেই থাকব।” দৃষ্টি বাঁধ সাধল বাবা আর বোনের কথায়।

” আমিও দত্তপাড়া যাবনা, আব্বু। আপুদের সাথে আমিও থাকব। তুমি আর আম্মু যেও সেখানে। ” শিহাবও যেতে নিমরাজি হয়।
কুহু দেখল ওর ভাইবোন কেউ যেতে রাজি নয়, তাই ও আর কিছু বললনা। সিদ্ধান্ত নিল সে দত্তপাড়া যাবেনা।
তাহমিদ ফোন করলে কুহু জানায়, ও বিয়েতে যাবেনা। দৃষ্টি ওকে কোথাও যেতে দিতে চায়না।

তাহমিদ কুহুর সাথে কথা বলা শেষ করে, কায়েসকে ফোন দেয়। কায়েসও জানায় দৃষ্টি কিছুতেই কুহুকে বিয়েতে যেতে দিতে চাচ্ছেনা। শিহাবও ওদের সাথে থাকতে চায়। তাহমিদের সাথে কথার একপর্যায়ে কায়েস জানায়, তারাও ছেলেমেয়েদের রেখে দত্তপাড়া যাবেনা। তাহমিদ বুঝতে পারল, কুহুর জন্যই তার শ্বশুর বিয়েতে যেতে চাচ্ছেনা। তাই তাহমিদ কুহুকে রেখেই তাদের বিয়েতে যেতে বলল।

বৃহস্পতিবার থেকে বিয়ের দাওয়াত হলেও, কায়েস শিউলিকে নিয়ে শুক্রবার সকালে দত্তপাড়া যায়। শিউলি সকালে উঠেই ছেলেমেয়েদের জন্য রান্না করেছে। এরপর তাদের খাইয়ে দিয়ে, সব কাজ সেড়ে তৈরি হয়। তবে যাওয়ার আগে কায়েস তার ছেলেমেয়েদের দেখাশোনার জন্য পাশের বাড়ির সেই বৃদ্ধাকে তাদের কাছে রেখে যায়। ওদের আসতে যদি রাত হয়, সেই ভেবেই সে বৃদ্ধাকে নিয়ে এসেছে।

সারাদিন তিন ভাইবোন হৈ-হুল্লোড়ে কাটাল। সন্ধ্যা হওয়ার আগেই বৃদ্ধা বাড়ির মূল দরজা ভালোভাবে বন্ধ করে দেয়। এরপর দৃষ্টি আর কুহুর সাথে গল্প করতে বসে। শিহাব নিজের ঘরে পড়তে বসেছে।
মাগরিবের আজান দিলে ওরা সবাই নামাজ আদায় করে নিল। এরপর কুহু যায় রান্নাঘরে। সবার জন্য নুডলস রান্না করবে। কায়েস একটু আগেই ফোন দিয়ে মেয়েকে জানিয়েছে, তাদের ফিরতে একটু রাত হবে।

কুহু নুডলস নিয়ে রুমে এসে ভাইবোন আর সেই দাদিকে দেয়। ওরা খেতে খেতে গল্প করছে।
রাত নয়টা। গ্রামাঞ্চলে অনেকেই এই সময় ঘুমিয়ে যায়। কুহুরা কেবলই খেয়ে উঠেছে। শিহাব খাওয়ার পর সোজা টিভি দেখতে বসেছে। তখনই কেউ দরজায় কড়া নাড়ে।

” আপু, এই সময় কে আসল? তুমি বস আমি দেখে আসি। ” দৃষ্টি কুহুকে বলল।
” যে আসে আসুক। তোর যেতে হবেনা। আজ বাবা নেই, তাই কে এসেছে সেটাও জানার প্রয়োজন নেই। ”
পরপর বেশ কয়েকবার দরজায় কড়া নাড়ল কেউ। কিন্তু ভেতর থেকে কারো সাড়াশব্দ না পেয়ে, বাহির থেকেই বলল,
” আমি দোকান থেকে এসেছি। কায়েস চাচাকে হিসাবের টাকা দিতে। তার কাছে ফোন করেছিলাম, সে বলল বাড়িতে টাকা পৌঁছে দিতে। ”

গলাটা কুহুর কেমন পরিচিতি মনে হল। কিন্তু ধরতে পারলনা কার গলা এটা।
দৃষ্টি সেই দাদিকে নিয়ে দরজা খুলতে যায়। কুহু বারান্দায় এসে দাঁড়ায়।
দরজা খুলেই দৃষ্টি ভীতু চোখে শুকনা ঢোক গিলল। জমিরউদ্দীন মেম্বারের সাথে সবুজ দাঁড়িয়ে আছে। মির্জাপুরের সেই সবুজ! যে কুহুর পেছনে আঠার মত লেগে থাকত। দৃষ্টি দরজা বন্ধ করতে গেলেই সবুজ দরজায় ধাক্কা দেয়। টাল সামলাতে না পেরে দৃষ্টি পরে যায়। মেম্বারের সাথে সবুজ বাড়ির ভেতরে ঢুকল। ওদের দেখে বৃদ্ধা চিৎকার দিতে গেলেই জমির মেম্বার তাকে লা’থি মে’রে ফেলে দেয়। ব্যথায় বৃদ্ধা কুঁকড়ে যায়। ততক্ষণে সবুজ দরজা লাগিয়ে দিয়েছে।

শব্দ শুনে কুহু একটু সামনে এগিয়ে আছে। হঠাৎ সবুজকে দেখেই ওর কলিজা শুকিয়ে গেছে।
এদিকে দৃষ্টি বেশ ব্যথা পেয়েছে। ও উঠান থেকে উঠতে চেষ্টা করছে। আর জমির মেম্বার বৃদ্ধার মুখ তার কাছে থাকা গামছা দিয়ে বেঁধে দিয়েছে। এরপর দড়ি দিয়ে বাঁধল বৃদ্ধার হাত-পা। সে দড়ি সাথে করেই নিয়ে এসেছে।
কুহুকে দেখে সবুজ এগিয়ে আসল।

” কি আমার কোকিল পাখি, ফুড়ুৎ কইরা উইড়া গিয়া অন্যের ডালে বাসা বাঁধলা? অথচ তোমাকে আমি আমার করতে চাইছিলাম। আদরে ভরিয়ে দিতে চাইছিলাম তোমাকে। তুমি আদর নিলা ঠিকই, কিন্তু অন্য মানুষের আদর নিলা। ”
” বেয়াদব ছেলে, এক্ষুণি বেরিয়ে যান। এখানে আসার সাহস কোথায় থেকে পেয়েছেন? ”
” তোমারে পাইতে গেলে সাহস একটু লাগেই। আজ তোমারে পাইছি। ঢাকা শহর তন্নতন্ন করে খুঁজেও তোমারে পাইনি। আজ যখন পাইছি, তোমারে ছাড়বনা। ”

এবার কুহু ভয় পেয়ে যায়। সবুজের হাবভাব ওর ভালো লাগছেনা। ও মাথা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করছে, কিন্তু ভয় ক্রমশই ওকে গ্রাস করে চলেছে।
সবুজ আরেকটু এগিয়ে এসে কুহুর হাত ধরে নিজের দিকে টেনে নেয়। কুহু এক ঝটকায় ওর বুকে গিয়ে পরল। সবুজের হাত কুহুর কোমড় বাজেভাবে ছুঁয়ে দিচ্ছে।

ঘৃণায় কুহুর শরীর রি রি করে উঠল। ও কোনরকম সবুজের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে টেনে থা’প্প’ড় মারল সবুজের গালে।
কুহুর এমন কাজে প্রচন্ড রেগে গেছে সবুজ। সে পাল্টা কুহুকে থা’প্প’ড় মে’রে বসল৷ এরপর এক লা’থি মারল কুহুর পেটে। কুহু পেট চেপে ধরল ব্যথায়। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
কুহুর এমন অবস্থা দেখে দৃষ্টি দৌড়ে এসে ওকে ধরল।

” কু’ত্তা’র বা’চ্চা, তুই আপুকে মারলি কেন? তোর এতবড় সাহস? ” দৃষ্টি গালি দেয় সবুজকে।
” আমার সাহস তুই দেখবি? তবে দেখ। ” এই বলে সবুজ দৃষ্টিকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে কুহুর কাছে যায়। কুহুর চুলের মুঠো ধরে পরপর কয়েকটা থা’প্প’ড় দিয়ে আছড়ে ফেলল বারান্দার গ্রীলে।
কুহু যেন দুই চোখে অন্ধকার দেখল। লুটিয়ে পরল উঠানে। ওর মাথা ফে’টে র’ক্ত ঝরছে। পায়ের দিকটাও ভেসে যাচ্ছে র’ক্তে।

কুহুকে এভাবে দেখে দৃষ্টি ভয় পেয়ে গেছে। চেঁচামেচির শব্দে শিহাবও বেরিয়ে এসেছে। উঠানে দুই বোনকে পরে থাকতে দেখে ও ছুটে যায় সেখানে।
জমির মেম্বার এসে দৃষ্টিকে ধরেছে। দুই বোনের করুন অবস্থা দেখে হাতের কাছে নিজের ব্যাট পেয়ে, সেটা নিয়ে দৌড়ে যায় সবুজের কাছে। সবুজের সামনে যেয়ে বারি মারল ওর পায়ে।

সবুজ তখন নিজের মধ্যে নেই। রাগে অন্ধ হয়ে গেছে সে। কুহুকে না পাওয়ার রা’গে তার হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়েছে। শিহাবের হাত থেকে ব্যাট কেড়ে নিয়ে, সেটা দিয়েই বারি দিল শিহাবের হাতে। শিহাব ব্যথায় কঁকিয়ে উঠল। ও নড়াচড়ার শক্তি হারিয়েছে।
” হা’রা’মি বুড়া, তুই আমাকে ধরে আছিস কেন? ছাড় বলছি। আমাকে আপুর কাছে যেতে দে। ” দৃষ্টি গালির তুবড়ি ছুটিয়েছে।

” তোমারে তো ছাড়ার জন্য ধরিনাই, ময়না পাখি। প্রথম দিন তোমার বইনের ডাঙ্গর শরিল দেইখা, আমি পা’গ’ল হইয়া গেছিলাম। কিন্তু তার বিয়া হওয়ায় কিছুই করবার পারলামনা। এখন তোমার এই শরিল আমারে পা’গ’ল কইরা দিছে। তোমার এই ডাঙ্গর শরিলডার গন্ধ না নিলে আমি আইজ ম’ই’রা যাব। তোমারে পাওয়ার জন্য আমি এত কষ্ট করলাম। সবুজরে নিজের দলে টানলাম। আইজ এত কাছে আইসা আমি পিছায় যাবনা। ” মেম্বার কথা বলছে আর দৃষ্টির মুখ বাঁধছে। দৃষ্টি কিছুতেই তার শক্তির সাথে পেরে উঠলনা।

মেম্বারের কথা শুনে দৃষ্টি ভয়ে ঢোক গিলল। আজ ওর সাথে কি হতে চাচ্ছে ভেবে ওর হাত-পা অবশ হয়ে যাচ্ছে।
” আপনে কি কথাই কইবেন, নাকি আসল কাম করবেন? আমার পাখিডায় তো জ্ঞান হারায় পইরা রইল। তারে কাছে পাওয়ার জন্য আমি দিনরাত ছটফট করছি, কিন্তু শেষ সময়ে পাখি আমারে ফাঁকি দিল। ” সবুজ নিথর হয়ে পরে থাকা কুহুর দিকে তাকিয়ে আফসোস নিয়ে বলল।

শিহাব কুহুর কাছে গিয়ে ওকে ডেকেই চলেছে। কিন্তু মেয়েটার কোন সাড়াশব্দ নেই। সে যেন র’ক্তে’র সাগরে ভাসছে।
মেম্বার দৃষ্টিকে টেনে ঘরের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। উঠানে হাত-পা, মুখ বাঁধা অবস্থায়পরে থাকা অসহায় বৃদ্ধার সবকিছু চেয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করার নেই।

” মেম্বার, তোমার কাম হইলে আমারেও ভাগ দিও। একটারে নাহয় না-ই পাইলাম। এখন আরেকটা হইলেও চলব। ”
কায়েসের বাড়ির চারপাশে বাগান। আর ওদের চাচার বাড়ি একটু দূরে। তাই ওর বাড়িতে চিৎকার, চেঁচামেচি হলেও শোনার কোন উপায় নেই। তাছাড়া মেম্বার বুদ্ধি করে আগে বৃদ্ধার মুখও বেঁধে দিয়েছে। একসময় সে দৃষ্টির মুখও বেঁধে দেয়। তাই দৃষ্টি আর চিৎকার করার সুযোগ পায়না।

রাত বারোটার কিছুক্ষণ পর কায়েস আর শিউলি বাড়িতে আসল। তার মামাতো ভাইয়ের বউ মেয়েকে বিদায় দেয়ার পর অসুস্থ হয়ে পরেছিল। তাই তাকে সেই অবস্থায় রেখে কায়েসরা আসতে পারেনি। ওরা একটা সিএনজি ভাড়া করে গেছিল দত্তপাড়া। সেই সিএনজিতেই বাড়ি ফিরেছে।

সিএনজির ভাড়া মিটিয়ে দরজার কাছে আসতেই
থমকে দাঁড়ায় কায়েস। দরজা হাট করে খোলা দেখে ওর মনে কু ডাকছে। দ্রুত পায়ে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করল।
উঠানে চাচিকে বাঁধা অবস্থায় দেখে শিউলি দৌড়ে গিয়ে তার বাঁধন খুলে দেয়।
হঠাৎ কায়েসের চোখ যায় বারান্দার পাশে পরে থাকা কুহুর দিকে। ওকে জড়িয়ে ধরে শিহাব ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
কায়েস গিয়ে মেয়েকে ডাক দেয়। কিন্তু তার কোন সাড়া পায়না।

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৫১

” ও বাবা কায়েস, তুমি যাইয়া দেখ, শ’য়’তা’ন’গু’লা দৃষ্টির কি করছে। মাইয়াডা বাঁইচা আছে কিনা দেখ। ”
চাচির কথায় হুঁশ আসল কায়েস, শিউলির। ওরা একে একে সব রুম দেখল। শেষে কোনার রুমে গিয়েই শিউলি চিৎকার দিয়ে উঠল। দৌড়ে ভেতরে যেয়ে বিছানা থেকে চাদর তুলে নিয়ে ঢেকে দিল দৃষ্টির শরীর।

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৫৩