বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৫০

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৫০
জাওয়াদ জামী

খাবার টেবিলে বসে টুকটাক কথা বলছে রাশেদিন পরিবারের সদস্যরা। আজ আয়েশা সালেহাও তাদের সাথে যোগ দিয়েছেন। তাহমিদ আজ ইচ্ছে করেই দেরি করছে। পরিবারের সাথে তার ইদানীং সময় কাটানো হয়ে উঠছেনা। প্রতি সপ্তাহে মেডিকেলের পাশাপাশি সারাদেশে মেডিকেল ক্যাম্প করতে হচ্ছে ওকে। কখনো কখনো রাতে বাসায় ফিরতে পারছেনা।

এ নিয়ে কুহুর অভিযোগের শেষ নেই। ও সব সময়ই বলে, সারাদিন যেখানেই থাকুক না কেন রাতে অন্তত বাসায় আসতে হবে। কিন্তু তাহমিদের পক্ষে কুহুর কথা রাখা সম্ভব হচ্ছেনা। তাই কুহুর অভিযোগের পাল্লা দিনদিন বেড়েই চলেছে।
” দাদুভাই, তোমাদের বিয়ের আটমাস হতে চলল, কিন্তু এরমধ্যে একবারও শ্বশুর বাড়িতে যাওনি। আর না কুহু সোনা গিয়েছে সেখানে। এটা কিন্তু বড্ড অন্যায় হচ্ছে কুহুর সাথে। ওর ও তো ইচ্ছে করে বাবার বাড়িতে গিয়ে কিছুদিন থাকতে। তুমি ওকে নিয়ে কবে যাচ্ছ ফুলতলা? ” আয়েশা সালেহা নাতিকে আরেকবার মনে করিয়ে দিলেন। তিনি প্রতি সপ্তাহে একবার নাতিকে মনে করিয়ে দেন, কুহুকে নিয়ে ফুলতলা যাওয়ার কথা।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” হ্যাঁ বাবু, তুই কিন্তু অন্যায় করছিস কুহুর সাথে। ওর ও তো ইচ্ছে করে বাবার বাড়িতে যেতে। মেয়েটা কতদিন ফুলতলা যায়নি। তুই কয়েকদিন ছুটি নিয়ে, কুহুকে নিয়ে ফুলতলা থেকে ঘুরে আয়। তুই সেখানে গিয়ে থাকতে পারিস আর না পারিস, কুহুকে রেখে আসবি। ও দশ পনের দিন সেখানে থেকে আসবে। ”

তাহমিদ মায়ের কথা শুনে, কুহুর দিকে আঁড়চোখে তাকায়। কুহু সেটা লক্ষ্য করে মুচকি হাসল।
এদিকে তাহমিদ চিন্তা করছে, এতদিন ও কুহুকে ছাড়া থাকবে কেমন করে! মা ওকে ভালোই প্যাঁচে ফেলেছে। সবার সামনে কিছু বলতে পারছেনা, আবার সহ্যও করতে পারছেনা। কিছুক্ষণ ভেবে ও মুখ খুলল।

” মা, তোমাদের কথা মেনে নিলাম। আমি কুহুকে নিয়ে ফুলতলা যাব। আমি সেখানে দুইদিন থাকব। আর কুহুও আমার সাথে দুইদিনই থাকবে। দুইদিন পর ও আমার সাথে ঢাকা ফিরবে। এরমধ্যে নিজের গ্রামও দেখা হয়ে যাবে, বাবা-মা, ভাই-বোনের সাথেও সময় কাটাতে পারবে। তাই সেখানে ওর দশ-পনের দিন থাকার কোন প্রয়োজন নেই। ”
” বাবু, এসব কি বলছিস? তোর কোন কথাই আজকে এই বাড়ির কেউ মানবেনা। কুহুর তোর সাথে ফুলতলা যাওয়া মানে, হাত-পায়ে বেড়ি পরে ঘরে বসে থাকা। তুই ওকে ইচ্ছেমত কিছুই করতে দিবিনা, এটা আমরা ভালো করেই জানি। ” তাহমিনা আক্তার ধমকে উঠলেন।

” বাপ, মাত্র দশ-পনেরো দিন তুই একটু কষ্ট করে বাসায় থাকিস। তারপরই তো কুহু চলে আসবে। এই কয়দিন তুই মনমত মেডিকেলে যাবি, মেডিকেল ক্যাম্প করবি। রোগীদের সেবা করবি। ক্ষনে ক্ষনে বাসায় আসার চিন্তা করতে হবেনা। দেখবি রোগীরা এই কয়দিন তোর ওপর খুব সন্তুষ্ট থাকবে। ” আফরোজা নাজনীন মৃদু হেসে কথাগুলো বললেন।
এদিকে কুহু সবার কথা শুনে লজ্জায় মাটিতে মিশে যাচ্ছে। মানুষটা ওকে প্রতিবারই সবার সামনে লজ্জায় ফেলে।
মা-বড়মার সামনে আর কিছু বলতে পারলনা তাহমিদ। ইচ্ছে না থাকলেও ওকে রাজি হতে হল।

” ঠিক আছে, বড়মা। আমরা আগামী সপ্তাহের মঙ্গলবার ভোরে ফুলতলার উদ্দেশ্যে রওনা দিব। সেখানে বুধবার, বৃহস্পতিবার কাটিয়ে বৃহস্পতিবার রাতে সোজা দিনাজপুরের উদ্দেশ্য রওনা দিব। শুক্রবার দিনাজপুর মেডিকেল ক্যাম্প আছে। কুহু থাকবে ফুলতলা। ও যেদিন আসবে তার আগে ফোন করলে, তোমরা কেউ গিয়ে ওকে নিয়ে আসবে। ”
তাহমিদ আর কোন কথা না বলে চুপচাপ নাস্তা করে ওপরে যায়। অথচ ও প্রতিদিন নাস্তা করেই সোজা মেডিকেলে বেড়িয়ে যায়। কিন্তু আজ তার উল্টোটা হল।

তাহমিদকে ওপরে যেতে।দেখে কুহুও ওর পিছুপিছু ওপরে যায়।
কুহু রুমে আসতেই তাহমিদ ওকে জাপ্টে ধরল।, কুহুর অধরে অধর ছোঁয়াল। অনেকক্ষণ পর কুহুর রেহাই মিলল। মেয়েটার কপালে কপাল ঠেকিয়ে কিছুক্ষণ নিশ্চুপ রইল।

” বউ, আমাকে ছেড়ে থাকতে তোমার কষ্ট হবেনা? আমার যে তোমাকে ছাড়া একটা দিন একা থাকতে কষ্ট হবে। এই বিরহ আমাকে পো’ড়া’বে কয়েকটা দিন। নি’ষ্ঠু’র বউ আমার, তুমি মা, বড়মাকে কিছু বললেনা কেন? কেন বললেনা, তুমিও আমার সাথেই ফিরতে চাও? আমাকে কত রাত তোমাকে ছাড়া একা কাটাতে হবে, তুমি বুঝতে পারছ? ”
” আমি কি একবারের জন্য ফুলতলা যাচ্ছি। মাত্র তো দশ-পনেরো দিন থাকব সেখানে। আপনি এতেই এত অস্থির হচ্ছেন! আপনি যদি না চান তবে আমি যাবনা। মা, ফুপুকে আমি বোঝাব। ”

” পা’গ’ল কি তুমি না আমি? তুমি তাদের বোঝাও, আর তারা আমাকে পরে রিমান্ডে নিক। তারচেয়ে বরং তুমি ঘুরেই এস। আগামী এক বছর আর সেখানে যাওয়া হবেনা তোমার। শুধু ফুলতলা কেন, আমাকে ছেড়ে কোথাও যাওয়া যাবেনা, আগামী এক বছর। এটা তুমি তোমার মা, ফুপুকে বলে দিও। ”
কুহু তাহমিদের কথা শুনে মৃদু হেসে মাথা নাড়ায়। মানুষটার পা’গ’লা’মি ওর কাছে মন্দ লাগেনা। এতটা ভালোবাসা ওর ভাগ্যে আছে, ভাবতেই ভালো লাগে।

” সিক্ত, এই সিক্ত, কোথায় হারিয়েছিস? একটু শুনে যা। আমি তোকে ডেকে ডেকে গলা ভাঙ্গলেও, তোর কানে আমার ডাক পৌঁছায়না কখনো। তারাতারি আয়। আর এক মিনিট দেরি করলে তোর কান ধরে টেনে নিয়ে আসব। ” রুম থেকে আনান চিৎকার করে সিক্তাকে ডাকছে আর এসব বলছে।

সিক্তা রান্নাঘরে শাহনাজ সুলতানার হাতে হাতে কাজ করে দিচ্ছে। ও আনানের ডাক শুনেও না শোনার ভান করে কাজ করতে থাকে। ও ভিষণ লজ্জা পাচ্ছে। আনান ভালো করেই জানে, ও এখন খালামনির সাথে আছে। তা-ও ডেকেই চলেছে! সিক্তা মনে মনে ভাবে, ভাইয়া সাধে ওকে আহাম্মক বলেনা।
এদিকে আনানের কথাগুলো শুনে শাহনাজ সুলতানা মনে মনে হাসছেন। তার ছেলে যে এক নম্বরের বউ পা’গ’ল হয়েছে, এটা তার বুঝতে বাকি নেই।

” টুকটুকি, রুমে যা। আমার ছেলে তোকে ডাকছে। বেচারা অনেকদিন তোকে দেখেনি। একটু তাকে দর্শন দিয়ে আয়। নয়তো পড়াশোনায় মন বসাতে পারবেনা আমার বউ পা’গ’ল ছেলে। ”
এবার সিক্তা লজ্জায় চোখ বন্ধ করে ফেলল। এত লজ্জা ও কোথায় রাখবে? মনে মনে ভিষণ রাগ হল আনানের ওপর। সিক্তা হাতের কাজ রেখে হনহন করে রুমের দিকে গেল।
” কি হয়েছে, এভাবে ষাঁ’ড়ে’র মত চেঁচাচ্ছিলে কেন? তোমার জন্য খালামনির সামনে আমাকে কত লজ্জা পেতে হল জানো? নির্লজ্জ লোক একটা। ”

” ও আমার সিক্ত পাখি, রা’গ করেনা। আমার আমেনা’র মা, তোকে দেখার জন্য বুকের মধ্যে হু হু করছিল, তাই ডাকছিলাম। এখন আমাকে একটু মিষ্টি দিয়ে যা। আমার কলিজা ঠান্ডা হোক। ”
” কে আমেনা’র মা! ”
” কেন তুই। আমার গুল্টুমুল্টু বউ, আমেনা’র মা। ”

” অসহ্য ছেলে। এই সামান্য কারনে চিৎকার দিয়ে গলা ফাটাচ্ছে! কই দেখি, বুকের কোথায় হু হু করছে? কাঁ’চি কোথায় গেল ? কাঁ’চি দিয়ে বুক কে’টে দেখতে হবে কোথায় হু হু করছে। তবেই তার চিকিৎসা করতে হবে। কি মিষ্টি দিতে হবে বুকের মধ্যে? ফ্রিজে মিষ্টি আছে কয়েকরকম, তাতে হবেনা? ঠান্ডা মিষ্টিও দিলাম, বুকও ঠান্ডা হল। ”

” তুই বউ না ঘষেটি বেগম! ঘষেটি বেগমও তার পতিকে প্রানাধিক ভালোবাসত। এই হিসেবে ঘষেটি বেগমও একজন ভালো পত্নী। সে সিরাজুদ্দৌলার বিরোধিতা করলেও তার পতিকে ঠিকই ভালোবেসেছিল। যদিও এটা আমার মনগড়া কথা, তবুও সে তার পতিকে ভালোবেসেছিল। তুই সিক্তা নয়, তুই মীর জাফরের প্রে’তা’ত্না।
” হয়েছে? আরও কিছু বলার আছে? তাহলে তারাতারি বলে ফেল। আমার কাজ আছে। তোমার ফালতু কথা শোনার সময় আমার নেই। ”

এবার আনান সিক্তার হাত ধরে এক টানে ওকে বিছানায় ফেলল। শক্ত করে নিজের সাথে জড়িয়ে নিল সিক্তাকে।
” এবার কোথায় যাবি যা। একটু ভালোবাসব জন্য ডেকেছিলাম। কিন্তু তুই আমাকে পাত্তাই দিচ্ছিসনা। আমি ভুগি ভালোবাসার অভাবে। তুই সেটা পূরণ না করে, উল্টো আমাকেই দোষারোপ করছিস! এখন ফটাফট কয়েকটা চুমু দিয়ে, নিজের কাজে যা। ”

সিক্তা অনেক চেষ্টা করেও আনানের শক্ত বাঁধন থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারলনা। এদিকে আনান ওর গলায় মুখ ডুবিয়েছে। সিক্তা আবেশে চোখ বন্ধ করল।
এভাবে কেটে যায় বেশ কিছুক্ষণ। আনান স্বাভাবিক হয়ে সিক্তার দিকে ওর ঠোঁট বাড়িয়ে দেয়। ইশারায় বুঝিয়ে দেয় কি করতে হবে।

বাধ্য হয়ে সিক্তাকেও সায় দিতে হয় আনানের কথায়।
কিছুক্ষণ পর সিক্তা রান্নাঘরে আসল। তবে ও লজ্জায় খালামনির দিকে তাকাতে পারছেনা। মাথা নিচু করে কাজ করছে। বিষয়টা শাহনাজ সুলতানার নজরে ঠিকই পরেছে। তিনি সিক্তার লজ্জা পাওয়া দেখে মুচকি মুচকি হাসছেন।
” হয়েছে, আর লজ্জা পেতে হবেনা। বিয়ের পর নতুন নতুন এমনই হয়। তাই আমার কাছে লজ্জা পেতে হবেনা। আমাকে বান্ধবী মনে করে নিজেকে স্বাভাবিক কর। তবে মানতেই হবে আমার ছেলে প্রেমিক পুরুষ। বউ ছাড়া নিজেকে দেবদাস ভাবে। ” শাহনাজ সুলতানা মিটিমিটি হেসে বললেন।

” খালামনি, প্লিজ। আমার লজ্জা করছে। আমি কিন্তু চলে যাব। ” সিক্তা লজ্জা দু হাতের তালুতে মুখ ঢাকল।
” আচ্ছা, আর কিছু বলবনা। তুই এই নুডলস আমার ছেলেকে দিয়ে আয়। ”
” আমি পারবনা। তুমি দিয়ে আস। ”
” আচ্ছা, যাচ্ছি। তুই একটু তরকারিটা দেখ। ”

” দৃষ্টির বাপ কই গেলা? কাইল আমার জামাই-মাইয়া আইব। তুমি আজকাই যাইয়া বাজার কইরা আনবা। গরুর মাংস, খাসির মাংস কিন্না আইনো। হাঁস, মুরগী কিননের দরকার নাই। বাইত্তে হাঁস, মুরগী আছে সেগুলান জ’বা’ই দিমু। বিয়ার পর জামাই কাইলকা পয়লা আইব। তাই বাজারের ভালো জিনিসগুলাই আনবা। নদীর বোয়াল, রুই, কাতলা আনবা। ” শিউলি কায়েসকে সব মনে করিয়ে দিচ্ছে।

” আমি জেলেদের বলে রেখেছি। কুহু যে কয়দিন থাকবে, তারা প্রতিদিন নদীর টাটকা মাছ দিয়ে যাবে। আর কি কি কিনতে হবে দৃষ্টিকে দিয়ে তার একটা লিস্ট বানাও। আমি সব এনে দিব। ”
শিউলি দৃষ্টিকে দিয়ে লিস্ট করায়। সে বাড়ির কাজের ছেলেকে পাঠিয়ে দেয় চাল গুঁড়া করে আনতে। শিউলির এখন অনেক কাজ।

কুহু সন্ধ্যায়ই ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছে। ওরা আগামীকাল ফজরের পরই রওনা দিবে। ও একটা লাগেজে দুজনের কাপড়চোপড় গুছিয়ে নিল। লাগেজ গোছানো হলে, আলমারির দিকে মনযোগ দেয়। ও যে কয়দিন থাকবেনা, তাহমিদের সে কয়দিনের কাপড় সুন্দর করে গুছিয়ে রাখল। যাতে প্রয়োজনের সময় তাহমিদ হাতের কাছে সবকিছু পেয়ে যায়।
হাতের কাজ করে, কুহু ওর শ্বাশুড়ির কাছে যায়।

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৪৯

বিঃদ্রঃ অনেকেই কমেন্টে এবং ইনবক্সে অভিযোগ করেছেন, আমি নাকি অযুহাত দিই। গল্পের পার্ট ছোট দেই আবার অযুহাতও দেই। আমার সংসার আছে। স্বামী, সন্তান, শ্বশুর-শ্বাশুড়ি নিয়ে সংসার করি। কাজের ফাঁকে ফাঁকে আমাকে লিখতে হয়। এছাড়াও আমি নিজেও অসুস্থ। সবকিছু সামলে আমাকে লিখতে হয়। এরপরও যদি আপনারা অভিযোগ করেন, আমার ভিষন কষ্ট হয়।

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৫১