নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে পর্ব ১৯

নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে পর্ব ১৯
ইফা আমহৃদ

অনিতাকে সঙ্গে নিয়ে পারুল ছুটেছিল কবিরাজের কাছে। কিছু তাবিজ দিয়েছেন, তা নিয়ে এসেছে। বাড়ির কাজের কথা ভেবে অনিতা ফিরেছে বাড়িতে। ঘরের খিল বাইরে থেকে তুলে উঠানে পায়চারি করছে অপূর্ব। আরু ঘুমাচ্ছে বিধায় সম্পূর্ণ বাড়িতে সে একা। দীর্ঘক্ষণ বসে থাকায় পায়ে ব্যথা করছে।

এছাড়া একা একা ব্যাকুল হয়ে উঠছে বলে, ব্যাকুল ভাবটাকে দমাতে উঠানে পায়চারি করছে অপূর্ব। পারুল ততক্ষণে নিকটে এসে পৌঁছে একটা সাদা কাগজে প্যাঁচানো প্যাকেট অপূর্ব হাতে দিয়ে বলেন, “তুই তবে যাসনি অপু, তবে আরেকটু বস। আমি ছাগলটা খোয়ারে তুলে হাঁস মুরগি খোপরে ঢুকাই।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“তা যান ফুফু। কী বলেছে কবিরাজ, আরুর সাথের সে চলে গেছে?” অপূর্ব সংশয় নিয়ে প্রশ্ন করে। পারুলকে বেশ উদাসীন লক্ষ্য করা গেল। এদের নজর একবার কারো পানে নিবদ্ধ হলে সহজে তার ব্যাঘাত ঘটানো সম্ভব নয়। কালো মুখে বলে, “তাবিজটা দিতে বলেছে সাথে। তাহলে আসবে না। সেদিন রাতে জ্বীন পরী ঘুরছে এসেছিল এদিকে। আরুর রূপে মুগ্ধ হয়ে ওর উপর আঁচড় করেছে। তাবিজ দিয়ে আপাতত নিয়ন্ত্রণ করা যাবে, পুরোপুরি প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। তবে তারা আরুর কোনো ক্ষতি করবে না, জোড়া না হলে করত।”

“তাবিজটা আপনি লাগাবেন, না-কি আমি চেষ্টা করে দেখব।”
“পারলে ঝুলিয়ে দাও। যত তাড়াতাড়ি লাগাব ততই মঙ্গল। আমি গেলাম।” বলেই শাড়ি উঁচু করে এগিয়ে গেল পারুল। অপূর্ব প্যাকেটটা মুঠো করে দরজার খিল নামিয়ে ঘরে ঢুকল। বিছানা ফাঁকা। আশেপাশে গভীর দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করেও আরুর সন্ধান পেল না। চারদিকে সন্দেহজনক দৃষ্টিতে চেয়ে হতাশ হলো অপূর্ব।

সবে সে বাইরে পা রাখল এবং আরু নিখোঁজ হলো‌। বিন্দু বিন্দু ঘাম কপালে জমে উঠল। উচ্চ স্বরে চ্যাঁচিয়ে অপূর্ব, “আরু, এই আরু। কোথায় গেলি আরু?”
কণ্ঠটা ততটা প্রকট হলো না অথচ অপূর্ব-র গলা ছিঁড়ে যাচ্ছে। শব্দ হারিয়ে গেছে অজানায়। চিন্তিত অপূর্ব পেছনে ফিরতেই এক টুকরো কাঠ এসে পড়ল তার পিঠে। অপূর্ব তা লক্ষ্য করে উপরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতেই আরুর পরনের জামাটা দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। মাথা বের করে রেখেছে সে। অপূর্ব ঠান্ডা অথচ বিধ্বস্ত কণ্ঠে বলে, “ওখানে কী করছিস তুই, মাত্র না তোকে শুয়ে থাকতে দেখলাম?”

“শরীরটা অস্থির লাগছে অপূর্ব ভাই। মনে হচ্ছে ভেতরে কেউ আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। দরজা তো বন্ধ তাই উপরে উঠে হাওয়া নিয়ে শরীর ঠান্ডা করার চেষ্টা করবি।” আরু মাথা ঝুঁকিয়ে বলে। অপূর্ব হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে, “হয়েছে এবার নাম।”

আরু সন্তর্পণে খুঁটিতে পা রেখে নামতেই অপূর্ব তাকে আঁকড়ে নামিয়ে নিল নিচে। বন্ধন আলগা না করেই ওভাবে দৃঢ় করে বসে অগোছাল বিছানায়। আরু কেঁপে উঠে তার স্পর্শ। বিলম্ব হলো তার ভেতর হিম হয়ে আসতে। অপূর্ব অনেক যত্নে তার হাতে তাবিজ বেঁধে দিল। আরু এক ধ্যানে অপূর্ব-র মুখশ্রীর পানে চেয়ে আনমনা হয়, আপনার সংস্পর্শে আমার দেহ ক্ষান্ত হবে জানলে আপনাকে আবদ্ধ করে নিতাম হৃদমাঝারে। মুখে বলে, “তাবিজ লাগালে নিজেকে রোগী রোগী লাগে অপূর্ব ভাই। আমি কখনো এই তাবিজ বাঁধি না।”

আরুর নাকটা আলতো করে ছুঁয়ে বলে, “তুই তো রোগী নয়, মহারোগী। রোগ হলে ওষুধ খেলে তা সেরে যাবে, কিন্তু তোর ক্ষেত্রে তাকে নিয়ে যাবে। পদ্মাবতী ব্যতিত অপূর্ব-র কোনো মূল্য নেই আরু।”
প্রেমময় দৃষ্টিতে চেয়ে নিজের কষ্টি পাথরের আংটিটা খুলে আরুর তর্জনীতে পরিয়ে দিল। অতঃপর চিবুকে দুই হাত বন্দি করে বলে, “অন্তত আমার জন্য একটু কর।”

“আপনি কি আমাকে প্রপোজ করছেন অপূর্ব ভাই?” আঙুলের পানে অপলক দৃষ্টি আরুর। অচেনা আবেশে জর্জরিত হয়েছে আজ, পরিচয় হয়েছে নতুন অনুভূতির। ঈষৎ উঁচু করে চোখদুটো নিজের চোখে স্থির করে অপূর্ব বাক্য তোলে, “না, তোমাকে আমার হতে হবে তার ক্ষুদ্র চেষ্টা করলাম মাত্র।”

সময়টা এগিয়ে বসন্তের মাঝামাঝি। চারিদিকে ফুলে সুবাস বইছে। গাছে গাছে গজিয়েছে নতুন পাতা। তিনজন কিশোরী মৃদু গতিতে ছুটতে ছুটতে কুউ কুউ কুউ করে চলেছে। তার সাথে মিলিত হয়েছে কোকিল। সাড়া দিচ্ছে ডাকে। আরু অনেকটাই পিছিয়ে। ঝোপঝাড়ের আড়াল থেকে একটা হাত বের হয়ে আরুর কোমল হাত টেনে নিয়ে গেল ঝোপে। আচমকা ঘটা ঘটনায় হতভম্ব সে। অতঃপর কালাচাঁনকে দেখে স্তম্ভিত আরু। নক ডেবে গেছে। আরু চিৎকার করে বলে, “কালাচাঁন তুই আমাকে এখানে কেন এনেছিস?”

“আমি তোকে শেষবারের মতো কইতাছি, আমার ভালোবাসা গ্ৰহণ করে নে গোলাপী। আমি তোকে সত্যি অনেক ভালোবাসি।” কঠিন তার গলা। আরু নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত করে প্রত্যুত্তর করে, “দেখ কালাচাঁন। আমিও তোকে শেষবারের মতো বলছি, আমি তোকে ভালোবাসি না।”

বাক্য শেষ হওয়া পরই আরুর উপর নেমে এলো নির্যাতন। দৃঢ় করে চেপে ধরে আরুর চোয়াল। যেন ভেঙে আসার জোয়ার। হুংকার দিয়ে বলে, “আর একবার আমার সাথে দেখা হলে, আমি তোর থেকে উত্তর নিবো। আমাকে ভালোবাসলে তো ভালো, নাহলে এই নদীতে তোরে নিয়ে আমি ঝাঁপ দিবো।”

আরুকে না পেয়ে তুর ও শেফালী সন্ধান করতে করতে এসে পৌঁছেছে সেখানে। ততক্ষণে বিদায় নিয়েছে কালাচাঁন ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা। আরুর কাঁধে হাত রেখে সংশয় নিয়ে বলে, “এখানে কী করছিস? আমরা ওদিকে তোকে খুঁজছি।”
আরুর গালে হাত রেখে বলে শেফালী, “এগুলো কীসের রাগ? রক্ত বের হচ্ছে তো।”

সন্তর্পনে আড়াল করে সবটা আরু, “পা পিছলে কখন এখানে পড়ে গেছি বুঝতেই পারিনি। ঘোর থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে তোরা চলে এলি। তখনই হয়তো লেগেছে। মা হয়তো বাড়িতে চিন্তা করছে, আমি আজ যাই।”
শেফালী ও তুর পালটা প্রশ্ন গুছিয়েছে, ততক্ষণে আরু এগিয়ে গেছে অনেকটা পথ। ফিরে চায়নি পিছু।

কিছুটা পথ পেরিয়ে যেতেই আরুর চোখে পরল একটা ডোবা। সেখানে ফুটে আছে অজস্র শাপলা ফুল। একমাত্র বর্ষার সময় আরুদের বাড়ির সামনের ধানক্ষেতে শাপলা হয়, তখন বেশ তৃপ্তি করে ভাজি করে খায়। আরু বইখাতাগুলো মাটিতে রেখে অতি সাবধানে ঝুঁকে ঝুঁকে শাপলা সংগ্রহ করে‌। অনেকগুলো শাপলা সংগ্রহ করে প্যাঁচিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয় আরু।
পারুল উঠানে কাঁথা সেলাই করছে তিস্তার জন্য। বিয়ের সময় এই নকশিকাঁথা তিস্তার শ্বশুর বাড়িতে পাঠাবে। আরু বইখাতাগুলো রোয়াকে রেখে পারুলকে উদ্দেশ্য করে বলে, “রান্না শেষ মা?”

“এখন বাজে দুইটা বিশ, তোর আশায় কি রান্না ফেলে রাখব?” বলতে বলতে দৃষ্টি মেলালেন আরুর দিকে। কপালে ভাঁজ ফেলে বলেন, “তুই আবার ঝোপঝাড়ে গিয়েছিলি? বারণ করিনি যেখানে সেখানে যাবি না।”
“যেখানে সেখানে যাইনি। ফেরার সময় দেখলাম আর তুলে নিয়ে এলাম।” উঠানে রোদে মেলে দেওয়া ফ্রকটা নিয়ে দিঘির দিকে অগ্রসর হলো আরু। পারুল অতিষ্ঠ হলেন। দ্রুতহাতে শাপলার আঁশ ছাড়াতে লাগলেন। হাতে গলায় তাবিছ লাগিয়েছে বলে কি দূর থেকে তারা আকর্ষণ করতে পারবে না? মেয়েটাকে শত বুঝিয়েও লাভ হয়না তার।

নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে পর্ব ১৮

আরুর গোসল সেরে খেতে বসতে অনেকটা সময় লাগল। তদানীং পারুলের শাপলা ভাজির করা শেষ। কিছুটা মুখে তুলতে গিয়ে থামল আরু। অপূর্ব-র কথা তার মস্তিষ্কে হানা দিল। অপূর্ব-র সাথে দেখা হয় না বহুদিন, রাতে ফিরে সকালে যায় হাসপাতালে। আগামীকাল শুক্রবার শাপলা দেওয়ার অজুহাতে গেলে আজ রাত পার করে আগামীকাল ফিরবে। কালাচাঁনের ব্যাপারে নালিশ জানাবে। অপূর্ব-র দেওয়া শর্তে রাজি হয়ে উচিত শিক্ষা দিবে কালাচাঁনকে।

নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে পর্ব ১৯ শেষ অংশ