নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে পর্ব ১৮

নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে পর্ব ১৮
ইফা আমহৃদ

করই গাছের মগডালে আরুকে হাঁটতে দেখা গেল। অথচ একজন মানুষ সেই ডালে পা রাখা মানেই ভেঙে পড়া ডালটা। অপূর্ব সহ বাকিরা আরুকে দেখে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, কীভাবে ফিরিয়ে আনবে তাকে? তথাপি অপূর্ব প্রয়াস করল, “আরু, এদিকে তাকা। শুনছিস?”

আরু ব্যস্ত কোনো অদৃশ্য ব্যক্তির সাথে কথোপকথনে, তাই শুনল না অপূর্ব ডাক। দিশেহারা হয়ে অপূর্ব গাছে উঠার জন্য পা এগোতেই মোতাহার আহসান বলেন, “উপরে বৈদ্যুতিক তার দেখছ-না? আরু কোনো মানুষের সংস্পর্শে গেলে তার শরীরে ওজন চলে আসবে। তখন ঐ মগডাল ভেঙে নিচে পড়বে এবং তারের সাথে বাঁধবে।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মাথায় হাত রেখে আরুর ফেরার অপেক্ষায় রাস্তার কিনারায় বসে রইল অপূর্ব। দীর্ঘক্ষণ সেই ধৈর্য ধারণ করতে না পেরে গাছের উঠার প্রস্তুতি নিল। করই গাছের মগডালে মেহগনি গাছের ডালপালা এসে ভিড় করেছে। মেহগনি গাছের ডালপাতা যথেষ্ট শক্তপোক্ত। তাছাড়া বিদ্যুতিক তার আরুর সামনে অপূর্ব পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে রাখলে শখ খাওয়ার কোনো সম্ভবনা নেই। বিদ্যুৎ অফিসে ফোন করে বিদ্যুৎ প্রবাহ অবরোধ করার মতো সময় অপূর্ব নেই।

সকলের বাধা উপেক্ষা করে অপূর্ব ধাপে ধাপে উঠে আরুর কাছাকাছি গেল। চোখ তুলে আরুর দিকে এক নজর তাকাতেই তার দেহটা কাঁপুনি দিয়ে উঠল। মুখশ্রীর সেই প্রাণোচ্ছল ভাবটা নেই, চুলগুলো এলোমেলো হয়ে হয়তো জট পাকিয়ে গেছে, শাড়িটা নোংরা হয়ে আছে। তবুও অপূর্ব-র প্রাণ জুড়িয়ে গেল। মগডালে এক হাঁটু তুলে কথা বলছিল আরু। অপূর্ব সন্তর্পনে তার বামহাতটা গলিয়ে দিল আরুর ফর্সা উদরে।

দৃঢ় করে জড়িয়ে ধরতেই আরুর ওষ্ঠদ্বয়ে অবরোধ ঘটল। পল্লব বন্ধ হয়ে হেলে পড়তেই অপূর্ব আরুকে আগলে নিল হৃদমাঝারে। চকিতে ডালটা ভেঙে নিচে পড়ল। আরুর সম্পূর্ণ ভর তখন বহন করছে অপূর্ব। ডালটা চেপে ধীরে ধীরে কয়েকটা ফেলতেই অপূর্ব হেলে পড়ল। ঝুলন্ত দুইজন মানুষ রইল গাছের ডালে। মোতাহার আহসান অধৈর্য হয়ে উঠলেন। অবশ্য ঐদিকটায় বৈদ্যুতিক তার নেই। তিনি প্রহরীদের আদেশ করলেন, “তোরা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কী করছিস, ওদের নামানোর ব্যবস্থা কর।”

প্রহরী দড়ি নিয়ে গাছে উঠল। অপূর্ব-র অবস্থানের ঠিক আগে দড়িটা বেঁধে শক্তপোক্ত গিট দিয়ে নেমে গেল। অপূর্ব হাত ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম তবুও আরুর জন্য সে সর্বোচ্চ যাতনা সহ্য করতে প্রস্তুত। আরু তার কাঁধে মুখ গুঁজে রয়েছে। দড়িটা ধরে ধীরে ধীরে নামল অপূর্ব। আরুকে মাটিতে শুইয়ে রেখে পাশে শুয়ে পড়ল সে। ঘনঘন শ্বাসপ্রশ্বাস নিয়ে কাত হয়ে আরুর দিকে তাকিয়ে রইল।

কাঁপা কাঁপা হাতে আরুর মুখমণ্ডল স্পর্শ করে অনুভূতি পূর্ণ হয় অপূর্ব। তার চোখের পানিটা টুপ করে আরুর চোখের তারায় পড়ে। দুহাত চোয়ালে রেখে গভীরভাবে ওষ্ঠদ্বয় ছুঁয়ে দিল আরুর ললাটে। অতঃপর আরুর মাথাটা জড়িয়ে নিল বুকে। উপস্থিত সবাই ব্রীড়ানত হয়, অপূর্ব চেয়ারম্যান বাড়ির ছেলে আর চেয়ারম্যান উপস্থিত না থাকলে কানাঘুষো শোনা যেত। এক্ষেত্রে শোনা গেল না।

মোতাহার আহসান ভ্যানগাড়ি ভাড়া করলেন। বাড়ির প্রতিটি সদস্য ভ্যানে চেপে বসতেই ভ্যান চলতে শুরু করল। অপূর্ব কোলে চেতনাহীন আরুকে নিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সে। তার প্রাণ যে জুড়িয়ে গেল।
পদ্মাপাড়ের পদ্মাবতী কী সুন্দর মুখখান, তোমার কী সুন্দর মুখখান।
দেখলে তোমায় জুড়াইয়া যায় আমার মনোপ্রাণ।

পল্লব যুগল মেলে উপরের দিকে চেয়ে রইল অপলক। গলা ও শরীর ব্যথায় আক্রান্ত। ক্ষতবিক্ষত পায়ের করতল। রিক্ত পায়ে হেঁটে গেছে বহুদূর। শরীরও যেন চলছে না। ধূপের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন ঘরের অন্তরভাগ। মেয়েকে হাত দিয়ে ধরে অনুভব করছেন পারুল।

মেয়েকে দেখে উত্তেজিত হয়ে চেতনা হারিয়ে ফেলেছিলেন পারুল।‌ সামলাতেও প্রয়োজন হয়েছিল মানুষ। আরুর চেতনা ফেরাতে প্রয়োজনীয় সবকিছু করেছে কবিরাজ। গোলাপজল পড়ে দিয়ে গেছেন গোসলের জন্য। স্বজ্ঞানে ফিরলে তাকে গোসল করানোর নির্দেশ দিয়েছেন।

ইতোমধ্যে সবকিছুর তোরজোর করে ফেলেছেন অনিতা। উষ্ণ পানিতে হিম পানি ও গোলাপজলের মিশ্রণ করে রেখেছেন। পারুলকেকে তাড়া দিলেন, “আপা সবকিছুর ব্যবস্থা করা হয়েছে, মেয়েটাকে নিয়ে এসো।”
চরম আদুরে গলায় মেয়েকে উঠানোর প্রয়াস করতে করতে বলেন, “আয় মা, গোসল করে আবার শুয়ে থাকবি।”
লোকসমাগম আরু-কে দেখতে। জাগ্রত হওয়ার পর অবশ্য কানাঘুষো শুনে সবটা অনুমান করতে পেরেছে আরু, তবে সবটাই তার কাছে কল্পনা কিংবা জাল্পনা। নিশ্চল শরীর নিয়ে উঠার বিন্দুমাত্র বল নেই দেহে। অব্যক্ত স্বরে বলে, “থাক না।”

কণ্ঠনালীতে এসে দলা পাকিয়ে রইল বুলি। অনুভব করল সে কথা বলতে পারছে না। অপূর্ব আরুর অব্যক্ত ভাষার রিপিট করে, “ও গোসল করতে চাইছে না।”
“না মা, এমন বলেনা। আমি ধরে নিয়ে যাচ্ছি। একটু কষ্ট কর।” বলতে বলতে পারুল আরুকে শোয়া থেকে বসালেন। সেদিন কাঁকড়ার আঘাতে হাতের জখম শুকিয়ে এসেছে। পা মাটিতে রেখে মৃদু ভর প্রয়োগ করতেই টনক নড়ে উঠে ব্যথায়। পা সরিয়ে করুন চোখে চেয়ে থাকে মায়ের দিকে।

অপূর্ব সহ্য করতে পারল না। পায়ের পাতাটা গভীর দৃষ্টিতে পরখ করে নিল। রক্তও জমাট বেঁধে শুকিয়ে আছে, অথচ এই ক্ষত পা নিয়ে কিছুক্ষণ পূর্বে দিব্যি গাছের ডালে হাঁটছিল। ফুফুর দিকে তাকিয়ে বিনীত অনুরোধ জানায়, “আমি ওকে কোলে নিয়ে কলতলায় যাবো ফুফু?”

“তাহলে তো ভালোই হয় বাবা।” পারুলের প্রত্যুত্তর পেয়ে দ্বি মুহুর্ত ব্যয় না করে ঝুঁকে পাঁজাকোলা করে নিল আরুকে। আরু তার তেজহীন হাতটা অপূর্ব-র কাঁধে রাখে না, শুধু চেয়ে থাকে অপলক। অপূর্ব অতি সন্তর্পণে পা ফেলে এগোয়।
কলতলা আরুদের বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে। তিন ভাইয়ের মাঝামাঝি স্থানে স্থাপন করা হয়েছে। মোতাহার আহসান কলের ব্যবস্থা করে দিলেও নারাজ জানিয়েছিল ইমদাদ। সে নিজের মতো বাঁচতে চায়। এতে মোতাহার আহসান বেশ সন্তুষ্ট হয়েছিল।

কলতলার ভেতরে ছোটো একটা টুল পেতে রেখেছেন অনিতা। অপূর্ব আরুকে সেই টুলে রেখে মায়ের দিকে তাকায় এক পলক। প্রসন্ন গলায় বলে, “আমি বাইরে আছি মা। গোসল শেষ হলে আমাকে ডেকো, ওকে নিয়ে যাবো। অন্য কোনো প্রয়োজন হলেও ডেকো আর হালকা পোশাক পরিও।”

অতঃপর অপূর্ব বেরিয়ে যায়। পারুল ভেতরে প্রবেশ করে দরজার খিল টেনে ব্যস্ত হলো তার কাছে। কবিরাজের বলা কথা অনুসরণ করে আরু-কে গোসল করাতে লাগল। ঘণ্টা খানেক বোধহয় লাগল সময়। দরজা ফাঁক করে অনিতা অপূর্ব-কে উদ্দেশ্য করে বলে, “আছিস অপু?”
“হম। আসব?”
“আয়।”

অপূর্ব ভেতরে পা রাখল। আরুকে যেভাবে বসিয়ে রেখেছিল ঠিক সেভাবে বসে আছে। চুলে বড়ো একটা গামছা জড়ানো, পরনে একটা ফ্রক। গায়ের উজ্জ্বল রঙটা জ্বলজ্বল করে উঠেছে আরুর। গাল দুটো অসম্ভব লাল। ময়লা আবরণ থেকে বেরিয়ে এসেছে যেন। অপূর্ব ধ্যান ভাঙতেই আরুকে পুনরায় পাঁজাকোলা করে নিল। গোসলের পর মেয়েটার ওজন সত্তর ভাগ কমে গেছে। আরু এবার হাত রাখল কাঁধে।

ঠান্ডা হাতের স্পর্শে কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠে অপূর্ব। হৃৎপিণ্ড অস্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। মাছ যেমন পানির সংস্পর্শে এসে সতেজ হয়ে উঠে তেমনি অপূর্ব-র পদ্মাফুল পানির সংস্পর্শে এসে খোলস ছেড়ে নিজের আসল রূপে ফিরে এসেছে। অপূর্ব ফিরে চাইল না আরুর পানে। বিন্দু বিন্দু পানি তাকে প্রণয়ের আভাস দিচ্ছে যে। নিজের পথে অগ্রসর হয় অপূর্ব। নুপূরের ঝুনঝুন শব্দটা অপূর্ব বেশ আগ্রহ নিয়ে শ্রবণ করছে।

নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে পর্ব ১৭

অনিতা আরুর ফেলে রাখা পোশাকটাকে উদ্দেশ্য করে বলে, “এগুলো কী করবি পারুল?”
“কবিরাজ সাহেব তো বলল পশ্চিম দিকে পুঁতে রেখে আসতে। আমার বেশ ভয় করছে ওদিকে যেতে। তুমি আমার সাথে যাবে ভাবী?”
“চল।”

নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে পর্ব ১৯