নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে পর্ব ১৭

নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে পর্ব ১৭
ইফা আমহৃদ

কবিরাজ সকাল সকাল খবর পেয়ে ছুটে এসেছেন। রাতে তিনি আসতে পারতেন, তবে কবিরাজরা চাইলেই সবসময় সব স্থানে যেতে পারেন না। তাদের অনেক বিধি নিষেধ মেনে চলতে হয়। কান্নায় ভেঙে পড়েন পারুল, “কবিরাজ সাহেব আমার আরুকে ওরা নিয়ে গেছে, আপনি আমার আরুকে ফিরিয়ে এনে দিন।”

“গতকাল বারবার বারণ করেছি মেয়েকে হাত ছাড়া করবি না। আমার কথা তোরা কেউ শুনলি না।” কবিরাজ অধৈর্য হয়ে বলে। পারুল অনুশোচনা বোধ করলেন। ভুল স্বীকার করে, “এমন হয়ে যাবে আমি বুঝিনি। আরু ঘুমাচ্ছিল, আমরা উঠানে বসে চা খাচ্ছিলাম। আপনি বলেছিলেন বাড়ি থেকে বের হলে তবেই আরু-কে নিয়ে যাবে, কিন্তু ওরা যে ঘর থেকে ঘুমন্ত আরুকে নিয়ে গেছে।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

কবিরাজ রাগান্বিত দৃষ্টিতে চেয়ে পানি ছিটালেন বাড়িতে, যা তিনি কিছুক্ষণ পূর্বে পড়ে নিয়ে এসেছেন। অতঃপর তেজস্রী গলায় বলে, “দরজা বাইরে থেকে খোলার সাধ্য ওদের নেই, তোরাই কেউ খুলেছিস। ওরা দূর থেকে শুধু আকর্ষণ করেছে।”
পারুলের স্মৃতিশক্তি যতদূর ভেসে উঠে সে দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ করে দেওয়ার পূর্বে তেজস্রী অয়ন রাগ দেখিয়ে বের হয়ে গিয়েছিল। আরুর চলে যাওয়ার সংবাদ অয়ন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দিয়েছিল, অথচ অয়নকে সমুখের দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে দেখেনি কেউ। এক্ষেত্রে সে পেছনের দরজা ব্যবহার করেছে। পারুল রোষে গজগজ করতে করতে অয়নকে খোঁজার প্রচেষ্টা করল। দৃষ্টিগোচর হলে আজ বোধহয় তার সেদিন দিন থাকত।

আরুর নীল রঙের শাড়িটা উঠানে দড়ির সাথে দুলছে। কাল দুপুরে মেলে দেওয়া হয়েছে, এখন বোধহয় আরুর অপেক্ষায় অপেক্ষারত সে। তাকে ঘরে নিয়ে ভাঁজ কথার তীব্র বাসনা।

মৃধা বাড়িতে ক্রন্দনরোলে মুখরিত। উঠানে হোগলা বিছিয়ে এলোপাতাড়ি বসে আছে সকলে। নির্ঘুম পেরিয়েছে গোটা এক কালরাত্রি। পারুলকে শান্তনা দিচ্ছে অনিতা, জাহানারা, মণি ও মল্লিকা। মোতাহার আহসান তার চেয়ারম্যান-ই ক্ষমতা প্রয়োগ করে আশপাশ গ্ৰামে আরুর খবর ছড়িয়েছে, অথচ এখনো আরুর সন্ধান নেই। চার ভাই, স্বামী ও বাবা বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই পারুল অশান্ত হয়ে ছুটে গেল সেদিকে। গ্ৰামীণ শাড়ির এক প্যাঁচ খুলে মাটিতে গড়াগড়ি করে মাখিয়েছে আর্দ্র ও শুষ্ক উভয় মাটি। বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলে, “বাজান, তুমি আমার আরুকে এনে দাও। কাল থেকে আমার মেয়েটার কোনো খোঁজ নেই।”

বংশের একমাত্র মেয়ে/বোন। সাত ভাইয়ের এক বোন বলেই তো ভালোবেসে তার নাম রেখেছিল পারুল। আজ বোনের কান্নায় বুকে ফেটে যাচ্ছেন তাদের। মোতাহার আহসান বলেন, “কাঁদিস না, কিছুক্ষণের ভেতরেই আমরা আরুকে পেয়ে যাবো। একজন মানুষ উধাও তো হয়ে যেতে পারে না।”

“কীসের চেয়ারম্যান আপনারা? নিজের বোনের সমস্যাই সমাধান করতে পারছেন না, গ্ৰামের সমস্যা কী সমাধান করবেন?” পারুল কাঁদতে থাকে অনবরত। চেপে রাখা হাতটা আলগা হয়ে ঝুলে গেল নিচে। হেলে পড়ার পূর্বেই ধরে ফেলল ভাইয়েরা। এতগুলো মুখ যখন হাহাকারে জর্জরিত তখন একটি মুখে ভেসে আছে প্রফুল্ল হাসি। বেশ হয়েছে আরু চলে গেছে, এবার তাকে সবাই ভালোবাসবে। উপস্থিত সবার মাঝখান থেকে বেরিয়ে গেল খেলতে। আরুর জন্য কান্না সহ্য হচ্ছে না তার। বহু কষ্টে ধরে হোগলা পর্যন্ত নিয়ে যেতেই সবাই দাঁড়িয়ে জায়গা করে দিল পারুলকে রাখার। অনিতা চাপা গলায় অন্য ঝা-দের বলে, “জাগানো দরকার নেই, বিশ্রাম করুক একটু।

সত্যি কি মেয়েটার কোনো খবর‌ আপনারা পাননি?”
“না, বউমা। কোথায় কীভাবে নিয়ে গেছে, কে জানে? এক সেকেন্ডে তাঁরা অনেক পথ পাড়ি দিতে পারে।” দাদাজানের দিকে চেয়ে ফোঁস করে‌ নিঃশ্বাস ছাড়ল অপূর্ব। উড়তে থাকা আরুর নীল রঙের শাড়িটা দড়ি থেকে নামিয়ে বুকে চেয়ে রাখল। পায়ের নুপূরের শব্দটা এখনো যেন বাজছে। চোখের তারা ভিজে আনমনে বলে উঠে, পদ্মাবতী, ক্ষমা করে দিও তোমার ব্যর্থ প্রেমিক-কে। অপূর্ব-র বুকে ফুটে উঠা পদ্মফুলটা কেউ কেড়ে নিয়ে গেল অজানায়। ফিরে এসে আগলে রাখার শেষ একটা সুযোগ দাও আমায়।”

অপূর্ব দিঘির জলে পা ভিজিয়ে শাড়িটাকে আঁকড়ে ধরে নিজের ব্যথায় কাতর হয়ে আছে। তখন সেই ব্যথার উপশম হিসেবে আগমন ঘটল আরুর। অপূর্ব-র কাঁধে হাত রাখতে হৃৎপিণ্ড অস্বাভাবিক হয়ে উঠল। চকিতে পাশ ফিরতেই আরুর আবেদনময়ী মুখশ্রী নজরে এলো তার। হাত-পা কাঁপতে কাঁপতে স্থির থাকতে না পেরে অবিলম্বে আবদ্ধ করে নিল আরুকে। দুরন্ত কণ্ঠে বলে, “কোথায় ছিলে পদ্মাবতী?”

“এই তো কাছে। কে আমাকে কতটা ভালোবাসে পরখ করতে।” আরুর শান্ত কণ্ঠ। অপূর্ব দূরত্ব বজায় রাখল না। বড্ড উন্মাদ হয়ে উঠল। আরু নিজেকে যথা সম্ভব দূরে‌ নিল। দিঘির পাড়ে বেড়ে উঠা কচু পাতা নিয়ে রঙ্গ করে বলে, “আপনার মন খারাপ না? আমি আপনার মন ভালো করে দিবো দাঁড়ান।”

অপূর্ব-র বাহু আঁকড়ে ঢালবিশিষ্ট দিঘিতে পানি ছোঁয়ার চেষ্টা করে। অপূর্ব অন্যহাতে কোমর জড়িয়ে আরুকে আগলে রাখে। বেশ খানেকক্ষণ পানিতে চুবিয়ে তুলে একই রঙ্গ করে বলে, “দেখেছেন ভিজে নি। এটা আরুর ম্যাজিক।”
“খুব সুন্দর ম্যাজিক, এজন্য তোমার একটা পুরস্কার প্রাপ্য।” দুগালে হাত রেখে দূরত্ব শূন্যতায় এনে আরুর কপালে ছুঁয়ে দিল ওষ্ঠ। নিরবচ্ছিন্ন দৃষ্টি চেয়ে রইল আরু। অতঃপর পুনরায় বুকে জড়িয়ে নিয়ে নিবৃত্ত কণ্ঠে বলে, “আমি জেনে গেছি আমার মনে কথা। যেই বয়সের দোহায় দিয়ে তোমাকে দূরে ঠেলে দিয়েছিলাম, সেই বয়স তোমাকে অধিক কামনা করছে।”

ফোনের রিংটোনে অপূর্ব-র ভাবনার সমাপ্তি ঘটে। হাসপাতাল থেকে ফোন করেছে। নতুন যোগদান করে একদিন গিয়েছিল, আরুর চিন্তা আর যায়নি। তিনটা দিন পেরিয়ে গেছে আরু নিখোঁজের। সূর্যটাও আগের মতো উঠে না অপূর্ব-র আকাশে, মেঘলা থাকে সর্বক্ষণ।

বিষণ্নতায় মাখা মন নিয়ে রিসিভ করে কল। ওপাশ থেকে কী বলল শোনা গেল না। অপূর্ব শান্ত গলায় বলে, “আমি কয়েকটা দিন যেতে পারব না। একটু অশান্তিতে আছি।”

অপূর্ব লাইন বিচ্ছিন্ন করে পুনরায় চোখের পাতা বুঝে আরুকে আহ্বান করল। মায়ের ডাকে চোখ মেলে তাকাল অপূর্ব। তিনদিন পর তার চোখের পাতা লেগে এসেছিল। একটু ঘুম পেয়েছিল। সে স্বপ্নেও আবির্ভাব ঘটেছিল আরুর। অনিতা বসতেই অপূর্ব মায়ের কোলে মাথা রাখে। জড়িয়ে ধরে বলে, “মা আমার পদ্মাবতীকে কি আমি ফিরে পাবো না?”
“তুই তো বললি, ‘ওকে তুই বিয়ে করবি না।’ তাহলে ওর জন্য উতলা হচ্ছিস কেন?” ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে জরানো গলায় বলে অনিতা।

“তুমিই তো আরুর ভালোবাসার বীজ আমার বুকে বপন করেছিলে। বীজ থেকে চারা হয়ে উঠেছে। সেই চারা অন্য কারো বুকে রোপন করতে দিবো না। এখানে বড় হবে।” প্রেমপূর্ণ কণ্ঠে বলে অপূর্ব।
অনিতা নিরবে অপূর্ব-র চুলগুলো টেনে দিচ্ছে। অপূর্ব-র বন্ধ করা চোখ থেকে এক ফোঁটা অশ্রু অনিতার শাড়িতে পড়ে। স্বযত্নে ছেলের চোখ মুছে দিয়ে বলে, “পশ্চিম দিকের লোকজন তোর বাবাকে ফোন দিয়েছিল। সেদিকে একটা মেয়েকে কড়ই গাছের মগডালে হাঁটতে দেখা গেছে। সকাল থেকে দেখা যাচ্ছে। বর্ণনা অনেকটা আরুর সাথে মিলে গেছে। তোর বাবা সেদিকে গেছে।”

নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে পর্ব ১৬

চকিতে অপূর্ব উঠে বসে। প্রাণোচ্ছল হয়ে উঠে অপূর্ব। ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটিয়ে ধীরে ধীরে ব্যক্ত করে বর্ণ, “আমি জানি ওটা আরু মা। ঐটাই আমার পদ্মাবতী। কীভাবে যেতে হবে, আমায় একটু বলো। আমি যাই।”
অনিতা প্রহরী ডেকে তাদের হাতে অপূর্ব-কে তুলে দিয়ে আরুর কাছে নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি স্ব-শরীরে ফিরিয়ে আনার নির্দেশ দিলেন। অপূর্ব সে-তো আগে আগেই ছুটে গেল।

নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে পর্ব ১৮