নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে পর্ব ১৬

নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে পর্ব ১৬
ইফা আমহৃদ

আরুর শরীরের তাপমাত্রা যেন সাধারণ তাপমাত্রাকে অতিক্রম করতে পারে অনায়াসেই। সম্পূর্ণ রাতে একটিবারের জন্যও চেতনা ফিরল না আরুর। জ্বরের মাঝে সে কেবল কাঁপছিল। পারুল লোহা গরম করে পানি পান‌ করাল আরুকে। তা গলা পর্যন্ত গিয়ে ফিরে এলো, অতঃপর গাল বেয়ে নেমে গেল। সকাল হতে না-হতেই কবিরাজ ডেকে আনা হলো।

আহসান বাড়ির সবাই ছুটে এসেছে ভাগ্নেকে দেখতে। একটা হোগলা বিছিয়ে উঠানে নামানো হলো আরুকে। কবিরাজ আরুর হাতে তেল দিয়ে মালিশ করে দিতে বললে পারুল, অনিতা, জাহানারা ও মনি গেল ব্যস্ত হয়ে উঠল। তখনও ফিরল না আরুর গেল। অবশেষে অবসন্ন হয়ে কবিরাজ বলে, “খুঁজে দেখুন তো, কোনো চিহ্ন পাওয়া যায় কি-না?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

হাত-পা খুঁজে চুলের নিচে ঘাড় পর্যন্ত যেতেই সন্ধান পেল তিনটি নখের দাগের। কবিরাজ ক্ষত তিনটি দাগ গভীর দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে বলে, “ওকে ধরে কেউ ঘরের ভেতরে নিয়ে যাও দ্রুত।”
“কেন?” চম্পা বলে।

“তা বলছি, দ্রুত করো। বেশিক্ষণ বাইরে থাকা ক্ষতিকর।” কবিরাজ উদ্বিগ্ন হয়ে বলে। অপূর্ব কষ্টেসৃষ্টে পাঁজাকোলা করে আরুকে নিয়ে ঘরে গেল। আরুর চেয়ে দ্বিগুণ একটা মেয়েকে চকিতে বহন করার ক্ষমতা রাখে অপূর্ব, সেখানে আজ আরুকে বহন করতেই তার ঘাম ঝরছে।

কবিরাজ চারটা লোহা পারুলের হাতে দিয়ে বলে, “এই লোহা চারটা ঘরের চার কোনায় রাখবি। তিনদিন আরুকে ঘর থেকে বের হতে দিবি না। চোখে চোখে রাখবি। এক চল্লিশ দিন সতর্ক রাখবি। সন্ধ্যার আর দুপুরে পশ্চিম দিকে যেতে দিবি না, ঘরে রাখবি। আমাকে একটু তপস্যা করতে হবে। তিনদিন পরে এসে যা করার করব। খবরদার ঘর থেকে বের হতে দিবি না। ওঁরা ওকে নিয়ে যাবে।”

উপস্থিত সবাই হতভম্ব হয়ে গেল। কবিরাজ পানি পড়া ও ধূপ দিলেন সকাল সন্ধ্যা ব্যবহার করতে। ইমদাদ কবিরাজকে বললেন, “কী হবে আমার মেয়েটার?”
“তোর মেয়ের মতো রূপবতী গুণবতী মেয়ে এই তল্লাটে তো দূর আট গ্ৰামেও পাওয়া যাবে না। মেয়েটাকে হারাস না, অন্তত তিনদিন ওর পাশাপাশি থাক। ঘর থেকে বের হলে কোথায় নিয়ে যাবে, ঠিক নেই। অতিরিক্ত ভয় পেয়েছে বলেই জ্ঞান ফিরতে দেরি হচ্ছে।” বলে কবিরাজ ঘরমুখো হতেই মোতাহার আহসান থামালেন। কিছু টাকা মুঠোবন্দী করে এগিয়ে দিয়ে বলে, “তোর হাদিয়া।”

“না চেয়ারম্যান সাহেব। আপনার থেকে কিছু নিবো না। আপনি আমাদের গ্ৰামের জন্য যা করেছেন, এটা নিয়ে নিজেকে ছোট করতে পারব না। তবে একটা অনুরোধ, এইবার টিউবল এলে আমাদের পাড়ায় একটা দিয়েন। বিশুদ্ধ পানির জন্য অনেক দূরে যেতে হয় গিন্নিকে। আমি তো আবার সব জায়গা যেতে পারি না।” কবিরাজের কথায় মোতাহার আহসান টাকাটা নিজের পাঞ্জাবির পকেটে ঢুকিয়ে রাখলেন। কাঁধে হাত রেখে আশ্বাস দিয়ে বললেন, “তোদের ঐ পাড়ার দুইটা কলের জন্য আপিল করেছি উপর মহলের কাছে। আসলে কল বসানোর যাবতীয় খরচ আমি দিয়ে আমার ভাগ্নের ঋণ শোধ করব।”

কবিরাজ প্রস্থান করার পরপরই পারুল সম্পূর্ণ ঘরে পানি ছিটালেন। মেয়েটাকেও পান করালেন কিছু। অপূর্ব স্থির দৃষ্টি আরুর ঈষৎ কৃষ্ণাভ মুখশ্রীর দিকে। শীর্ণ হয়ে আছে যে। বামহাতের কনিষ্ঠা আঙুল নড়তে দেখে এগিয়ে যেতে আরুর গালে হাত রাখল অপূর্ব, “আরুপাখি উঠ।”

আরু অবলোকন করল তার ঘন পাপড়িযুক্ত ডাগর ডাগর চোখ দিয়ে। কিছু বলল না। পারুলকে আদেশ করে মোতাহার আহসান, “আরুকে কিছু খাওয়া। কাল দুপুরে দুমুঠো খেয়ে এসেছে।”
“তোমরাও তো কালরাতে খবর পেয়েই ছুটে এসেছ, কিচ্ছু দাঁতে কা/টো নি। সবাই খেতে এসো।” বলেই পারুল রান্নাঘরে গেল। কালরাতে রান্না করা ভাত তেমনই পড়ে আছে। ইলিশ মাছটা পড়ে আছে হাঁড়িতে। অনিতা গেল সাহায্য করতে। মাছ টুকরোগুলো উনুনে দিয়ে একটু সেকে নিল।

ইলিশ মাছে ডিম হয়েছে বড়োবড়ো দুই খণ্ড। পারুল একটা ডিম সাত টুকরো করেছে ও অন্যটা আস্তো অপূর্ব-র জন্য রেখেছে। সবাইকে খেতে দিয়ে আরুর জন্য আলাদা বাটিতে পান্তা ভাত, একটু পেঁয়াজ, এক টুকরো ডিম, শুকনো পোড়া মরিচ নিয়ে এসেছে পারুল‌। আরু নাকোচ করে, “মা, আমার খেতে ইচ্ছে করছে না।”

“না মা, খেয়ে নে। খেয়ে শুয়ে থাক। একা খেতে পারবি? নাহলে একটু অপেক্ষা কর মা, এখান তো সবাইকে খেতে দিয়েছি।” রেখেই খাওয়ার ঘরে চলে গেল পারুল। পানি ঢেলে হাত ধুয়ে ভাতের বাটিটা নিয়ে বসল আরু। জ্বর ততক্ষণে বিদায় নিয়েছে শরীর ছেড়ে। উষ্ণ শরীরে পান্তা ভাত বেশ লাগল আরুর। অপূর্ব খাওয়া শেষে আরুর পাশে গিয়ে বসল। অতঃপর অনিতা উঠে গেল। সবসময় একজন নয় একজন আরুর পাশে থাকা উচিত।

পাতে তুলে দেওয়া বড়ো খণ্ডের ডিমটা দাঁতে কাটেনি অপূর্ব। অগোচরে নিয়ে এসেছে। আরুর আড়ালে পাতে দিয়ে হাত মুখে ফেলল রুমালে।
আচমকা ডিমটা দেখে বাকরুদ্ধ হলো আরু। খাওয়ায় অনশন করে বলে, “আমার স্পষ্ট মনে আছে, মা আমাকে এক টুকরো দিয়েছিল তাও ছোট। এখন দেখছি দুই টুকরো।”

“আমিও তো দেখলাম দুই টুকরো। হয়তো ভাতের ভেতরে ছিল, তুই দেখিস নি। বিশ্বাস না হলে মাকে জিজ্ঞেস কর।”
“তাই হবে বোধহয়।” বলেই ডিম ভেঙে টুকরো করে মুখে তুলে স্বাদ গ্ৰহণ করে ডিমের। আরু জানতেও পারল না, কেউ একজনকে তার প্রিয় মাছের প্রিয় ডিমখানা না-খেয়ে তারজন্য লুকিয়ে এনেছে।

অপরাহ্ন পেরিয়েছে। গভীর নিদ্রায় মগ্ন আরু। বাইরে প্রবেশ নিষেধ বিধায় পোশাক ছেড়ে হাতমুখ ধুয়ে নিয়েছিল আরু। অপূর্বরা রয়েছে মধ্যবয়স্করা সবাই চলে গেছে। উঠানে বসে চা বিস্কুট খাচ্ছে। উত্তর পাশ দিয়ে একটা কালো কুচকুচে বিড়াল এসে বসল সবার মাঝে। পারুল কয়েকটা মুড়ি মাটিতে রাখতেই বিড়াল ছানাটা মুখে নিল। খাওয়া শেষে আহসান বাড়ির দিকে মুখ করে পা চাটে। তুর মজার ছলে‌ বলে, “গতকাল পা চাটলে বুঝতাম, আমরা আসব বলে আগমন বার্তা দিচ্ছিস। কিন্তু এখন কেন চাটছিস?”

ভেজা মুড়িগুলো চামচ দিয়ে মুখে তুলতে তুলতে বলে অয়ন, “কালকেও এসেছিস ও‌। আমি তাড়িয়ে দিয়েছি। কালকে চাটতে পারেনি তাই আজকে এসেছে।”
অপূর্ব প্রশ্ন করে, “বিড়াল পা চাটলে অতিথি আসে?”
“হম। সবাই বলে।” পারুল বলে। বিড়াল ছানাটা ঘরের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে তিনবার ম্যাও আওড়াল। অতঃপর ছুটে চলে গেল। পারুল দৃষ্টি অনুসরণ করে অয়নকে আদেশ দেয়, “দেখতো আরু ঘরে আছে কি-না?”

অপ্রসন্ন হলো অয়ন। রোষে গজগজ করতে করতে ঘরে যেয়ে ফিরে এসে স্পষ্ট স্বরে বলে, “বুবু ঘরে নেই মা।”
কেউ কিছু বুঝে উঠার পূর্বেই অপূর্ব কাপ ফেলে ছুটে গেল ঘরে। উপস্থিত সবাই গেল পেছন পেছন। আরু-কে ডানপাশ ফিরে শুয়ে থাকতে দেখে অপূর্ব হৃৎপিণ্ডে শীতল স্রোত খেয়ে গেল। পারুল চ/ড় বসালেন অয়নের গালে। রাগান্বিত কণ্ঠে বলেন, “ইচ্ছে করছে এক চ/ড়ে সব দাঁতগুলো ফেলে দেই। মিথ্যা বলা শিখে গেছে। গুরুতর একটা বিষয় নিয়ে মজা করছে।”

চোখে পানির আগমন হতে না হতে হেঁচকি উঠে গেল অয়নের। এতে কড়া গলায় শাসায় পারুল, “আরুর ঘুম ভাঙলে ঐ কলা বাগানে বেঁধে রাখব তোকে। যা এখান থেকে।” অয়ন ছুটে গেল বাইরে। আরুদের ঘরে দুইটা দরজা। পেছনের দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ করে দিয়ে উঠানে গিয়ে বসল পারুল। পুনরায় খোশগল্পে মেতে উঠল।
পেরিয়ে গেল কিছুক্ষণ। অয়ন ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলে, “মা বুবু কোথায় জানি যাচ্ছে।”

নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে পর্ব ১৫

“মা/র না খেতে চাইলে সামনে থেকে সর।” অয়নের কথাকে ফাঁকা আওয়াজে উড়িয়ে দিলেন পারুল। অপূর্ব অস্থির হৃদয় নিয়ে তিন মিনিট ক্ষান্ত থাকতে পারেনা। ‘দেখে আসি’ ভেবে অগ্রসর হলো ঘরের দিকে। বিছানার চাদরটা কুঁচকে আছে, আরু নেই। বিছানা ফাঁকা এই ভর সন্ধ্যায় কোথায় গেল মেয়েটা? ‘পেছন দিকের দরজাটা দমকা হাওয়াতে একবার বন্ধ হচ্ছে আরেকবার খুলছে’ -কে খুলল?

নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে পর্ব ১৭