সে আমার সুকেশিনী পর্ব ১৩

সে আমার সুকেশিনী পর্ব ১৩
রাউফুন

‘কলারটা ছেড়ে চেঁচান! এতো নিকটে এসেছেন যে এই অবস্থাতেও আমি কন্ট্রোল হাঁরাচ্ছি!’
বিউটির চোখ দিয়ে তখনো যেনো আগুন ঝড়ছিলো। সায়র বিউটির এরকম বিরাগ সম্পর্কে অবগত নয়৷ এই চোখের মায়ায় সে পরেছে। এটা কি করে এই বিউটি নামক রমনীকে বোঝাবে? চাইলেও তো তার থেকে দূরে যেতে পারে না।

বিদেশে কত শত নারী তার কাছে আসার চেষ্টা করেছে অথচ সে তাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়নি কখনোই৷ হ্যাঁ তার প্রাকৃতিক ভাবে কোনো প্রব্লেম নেই কিন্তু এখনো অব্দি সে কেন যেনো অন্য কোনো নারীতে আটকায় নি। সায়রের চোখ বিউটিতে স্থির। বিউটিও রাগে ফেটে পরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। সায়র বিউটির কানের কাছে মুখ নিয়ে ম্রিয়মাণ কণ্ঠে বলল,
‘আমার চোখ কি বলে, বুঝে বলুন তো!’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

বিউটি ফোপাঁতে ফোপাঁতে সরে এলো। সায়রের কলার ছেড়ে দিতেই অনুভব করলো তার কলিজায় কাঁপন ধরেছে। সায়র তার কাছে এলে এমন লাগে কেন? কেন মনে হয় সায়র তার খুব কাছের। লোকটার চোখে কিছু দেখতে পায় সে। এমন তো আগে হয়নি। বিউটির এখনকার অনুভুতি কি তা প্রকাশ করার মতো অবকাশ পাচ্ছে না।

প্রত্যেকবার সায়র সামনে এলে সে অজানা কারণে ভেতর থেকে মূর্ছা যায়। তবে সায়র দারুণ ভাবে উপভোগ করছে বিউটির হালচাল। দুই পকেটে হাত পুড়ে বিউটির আর একটু কাছে ঘেঁষলে বিউটি চট করে সরে গেলো। সায়র হাসলো। কাষ্ঠ গলায় বললো, ‘কি হলো বলুন কি দেখতে পেলেন আমার চোখে? আপনি আপনার জন্য আমার চোখে কিছুই দেখতে পান নি?

‘আমি জানি না। আপনি যান এখান থেকে। এক্ষুনি যান!’
‘সেকি, এতক্ষণ তাকিয়ে থেকেও কিছু বুঝলেন না? ঠিক আছে আমি বলছি, আপনি আমার অনেক শখের নারী। আমি কখনো প্রেমে পরেছি কি না জানি, তবে আপনার কাছাকাছি থাকলে আমি অন্য জগতে চলে যায়। তাই তো আপনি তাড়ালেও আমি আপনার কাছে বার বার আসি এবং আমি আসবো। যতবার আপনি আমাকে তাড়াবেন ততবারই আপনি আপনার কাছে পাবে। আপনার আমাকে হেংলা, ছেচড়া, ঘাড়ত্যাড়া যা কিছু মনে হতে পারে আমার তাতে কিছু না! কিন্তু মনে রাখবেন, আপনি যার থেকে পালাতে চাইবেন সেই আপনাকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরবে। এটাই প্রকৃতির নিয়ম।’
‘উফফফ আপনি যাচ্ছেন না কেন? যান বলছি!’

বিউটি এখনো রেগে আছে, একটা মানুষ এতক্ষণ কিভাবে রেগে থাকতে পারে? সায়র বিউটির রাগের তোয়াক্কা করলো। সে এক পা ও নড়লো না। বরং হঠাৎই বিনা নিমন্ত্রিত ভাবে বিউটির হাত নিজের হাতের মুঠোই চেপে ধরলো। বিউটি অবাক হয়ে তাকালো নিজের হাতের দিকে এবং সায়রের দিকে।

সায়র তাকে টানতে টানতে বিউটির রুমে নিয়ে গেলো। বিউটিকে খাটে বসালো। বিউটি হতবুদ্ধির ন্যায় বসলো নিজের খাটে। যেমন ভাবে সায়র বসালো সেভাবেই, নড়লো না এক বিন্দুও। সে নিজের বাক হাঁরিয়ে তখনও সায়রের স্পর্শ করা হাতে তাকিয়ে আছে। সায়র রুমের বাইরে গিয়ে ফলের বাটি ভর্তি নানান রকমের ফল নিয়ে এলো।

আসার সময়ই সে সন্দিপ্তার হাতে ফল দিয়ে বলেছিলো সব গুলো কে’টে রাখতে৷ সে বিউটির সামনে ফলের বাটি ধরে বললো, ‘শুনলাম আপনি এই অসুস্থ অবস্থাতেও খাচ্ছেন না ঠিক করে? তাই বাধ্য হয়ে আমাকে আসতে হলো। এইযে এতো অসুস্থ তারপর কেঁচোর মতো শুকনা লিকলিকে শরীর, হাড় হাড্ডি ছাড়া চোখে কিছু পড়েনা। এই শরীরে এতো জোর পেলেন কি করে? কুস্তি টুস্তি শেখেন নাকি? তা না-হলে এতো জোর হয় কি করে এমন শরীরে?’

‘আপনি কে?’
সায়র চোখ পিটপিট করে অদ্ভুত ভাবে তাকালো।
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘মানে?’
‘মানে টা খুব সহজ। আপনি কে আমার টেক কেয়ার করার?’
ফোস করে সায়র নিঃশ্বাস ফেললো। সে ভাবলো কি না কি।

‘আমি অনেক কিছু। ষোলো তারিখে আপনি আমার অর্ধাঙ্গিনী হবেন। সেই অর্থে এখন থেকেই আপনার উপর আমার অধিকার বলেন আর জোর খাটানো, সবকিছুই আমার আছে।
‘নাহ নেই। আপনি আমার কেউ-ই নন এখনো অব্দি।বের হোন আমার বাড়ি থেকে!’
‘উঁহু এখনি না। আগে ফল গুলো সবটা আমার সামনে শেষ করুন তাহলে যাবো।’

‘আমি আপনার আনা ফল খাবো না। শুধু ফল কেন আমি আপনার আনা কিচ্ছুটি মুখেও তুলবো না।’
‘আচ্ছা তাই? তাহলে আপনি চাচ্ছেন আমি থেকে যায়? আরে আগে বলবেন তো।’
কথা শেষ করে সায়র বিউটির বিছানায় ধাম করে শুয়ে পরলো। বিউটি একেবারে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো। রাগান্বিত হয়ে বললো,

‘আপনার সাহস তো কম না? আপনি আমার বিছানায় আমার অনুমতি ছাড়া শুয়েছেন। এই উঠুন! উঠুন বলছি!’
সায়র তার কথা তো শুনলোই না বরং আরও সুন্দর করে বালিশ টেনে নিজের মাথার নিচে দিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলো। বিউটি আরও ক্ষেপে গেলো। রাগে গজগজ করতে করতে গিয়ে সায়রের মাথার নিচ থেকে বালিশ সরিয়ে দিলো। সায়র তবুও নড়লো না। বিউটির রাগ তখন আকাশচুম্বী। আশে পাশে খুঁজেও যখন পেলো না বিউটি, দেখলো বিছানা ঝাড়ু পাশেই। বিছানা ঝাড়ু দিয়ে সপাটে দিলো বাড়ী। হকচকিয়ে উঠলো সায়র। হড়বড়িয়ে উঠতে উঠতে বললো, ‘আরে আরে করছেন কি? ঝা’ড়ু মা’র’ছেন কেন? কি আশ্চর্য!’

‘আশ্চর্য? আপনি আশ্চর্য? বের হোন আমার রুম থেকে।’
সায়র বিউটির থেকে পিঠ বাঁচানোর চেষ্টা করলো। বিউটি আরও একটা জোরেশোরে বাড়ী দিলো৷ লাফিয়ে উঠলো সায়র।
‘আপনিই তো বললেন আমি যেনো থাকি! আর আপনিই ঝাড়ু মে’রে তাড়াচ্ছেন?’
‘বেশ করেছি। আপনি বের হোন এক্ষুনি।’
‘আচ্ছা যাচ্ছি, যাচ্ছি। আপনি ঝা’ড়ু নিচে রাখুন আগে।’

বিউটি ঝা’ড়ু নিচে নামালো। সায়র বিউটির দিকে তাকিয়ে দেখলো বিউটির গাল, নাক, লাল হয়ে গেছে। রেগে গেলে বোধহয় বিউটির নাক, আর গাল লাল হয় এভাবে? এক্কেবারে টমেটর মতো। তার মনটা চাইছে গাল দুটো টি’পে দিতে। সায়র ভদ্র ছেলের মতো খাট থেকে নামলো। বিউটি রাগে ক্ষোভে সাপের মতো হিসহিস করছিলো। সায়র রুম থেকে বেরোনোর আগে বিউটির টসটসে লাল হয়ে যাওয়া গাল দুটো টেনে দিতে ভুললো না। গাল টেনে দিয়েই এক দৌঁড়ে পালালো। এবং বললো,

‘আপনার জন্য ফল গুলো এনেছিলাম। খাবেন কিন্তু! আপনার হবু বরের দিব্বি!’
বিউটি তখনও আশ্চর্য হয়ে ঝাড়ু হাতে দাঁড়িয়ে আছে। একটু আগে এটা কি হলো? সায়র তার গাল স্পর্শ করেছে। ক্ষোভে ফে’টে পরলো বিউটি। হাতের ঝাড়ুটা সমস্ত শক্তির সঙ্গে ছুড়ে মারলো। রাগ কমাতে হবে। ছবি আঁকা ছাড়া রাগ কমবে না তার। সে পেন্সিল, কাগজ নিয়ে বসলো।

বৃষ্টিতে ভেজা সুপ্রিয়র একটা মুখের ছবি আঁকতে চাইলো। সবই ঠিক ছিলো তবে চোখের দিকে তাকাতেই সে লক্ষ্য করলো সেদিনের মতো আজকেও সে একই ভুল করেছে। সে সুপ্রিয়র চোখের জায়গায় সায়রের চোখ এঁকে ফেলেছে। রাগে দুমড়ে মুচড়ে ফেললো কাগজ খানা।

দুই মাথার চুল টেনে ধরে টেবিলের সমস্ত জিনিস নিচে ফেলে দিলো। ঝনঝন করে আওয়াজ হলো। ফলের বাটি টা তুলে বাইরে ছুড়লো সে। শুধু যে চোখ অঁঙ্কন ভুল করেছে তাই নয়, আজও সে সায়রের উপস্থিতিতে তার সুপ্রিয় ভাইকে ভুলেছে। টপটপ করে চোখের পানি পরছে বিউটির। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে সে।

ধপ করে বসে পরলো সেখানেই। সন্দিপ্তা, মারিয়াম, শাহানা বেগম আর হাশেম আলী মেয়ের রুম থেকে শব্দ পেয়ে ছুটে এলেন। বিউটিকে উম্মাদের মতো আচরণ করতে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো তাঁরা। শাহানা মেয়ের কাছে গিয়ে মাথায় হাত রেখে আদুরে গলায় শুধালেন,

‘কি হয়েছে বিউটি? এমন করছিস কেন? এমন পাগলের মতো কাঁদছিস কেন? কোথায় কষ্ট হচ্ছে মা বল?’
বিউটি মায়ের দিকে তাকালো না৷ হাউমাউ করে কাঁদছিলো সে। এই মুহুর্তে বার বার মনে হচ্ছে বাবার শেষ কথাটা। সুপ্রিয়র র’ক্তা’ক্ত জামা…এইটুকু বলতেই সায়র এসে উপস্থিত হয় দরজায়। এরপর আর শোনা হয়নি। তার বাবা কথা বলা থামিয়েছে তখনই।

শাহানা মেয়ের থেকে কোনো আশানুরূপ উত্তর না পেয়ে উঠে দাঁড়ালেন। হাশেম আলী বুঝতে পারলেন না কেন এমন করছে বিউটি। এমন কি হলো যে তার মেয়ে এভাবে কাঁদছে?
‘বিউটি বোন আমার, বলো কি হয়েছে? সায়র চলে গেলো বলে খারাপ লাগছে?’
‘ভাবি প্লিজ, ঐ সায়র নামের লোকটার নাম আমার সামনে নেবে না।’

সন্দিপ্তা অবাক হলো। দুই দিন পর যার সঙ্গে বিয়ে তার নাম-ই শুনতে পারছে না বিউটি? কিন্তু সায়র তো হাসি খুশি মুখ করেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো। বিউটির এই অবস্থা দেখে মারিয়াম চোখ দিয়ে ইশারা করে বাকি সবাইকে চলে যেতে বললো এখান থেকে। সবাই চলে গেলো। হাশেম আলী মেয়ের মনের অবস্থা ধরতে চেয়েও পারলেন না।
সবাই চলে গেলে বিউটির কাছে বসলো মারিয়াম।

‘কি হয়েছে বিউটি?’
বিউটি ফোপাঁতে ফোপাঁতে তার বাবার সঙ্গে কথোপকথন সম্পুর্ন টা বললো। হিচকি হিচকি তুলছে সমান তালে বিউটি। এভাবে তাকে কখনোই কাঁদতে দেখেনি মারিয়াম। সে বিউটির হাত ধরে বললো,

‘দেখ, হতেই তো পারে ঘটনা কিছু অন্য৷ হইতো ওঁদের কারোরই কিছু হয়নি। তুই শুধু শুধু ভয় পাচ্ছিস।’
‘যাকে ঘিরে আমার সব ভাবনা, সমস্ত চিন্তাধারা, আমার হৃদয়ের যার বসবাস, যার অস্তিত্ব ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারি না, ছোট বেলা থেকে যাকে ছাড়া কাউকেই ভাবিনি আজ তার যদি কিছু একটা হয়েছিলো শুনতে পারি আমার অনুভূতি ঠিক কেমন হবে একবার ভাব!’

‘প্লিজ তুই এভাবে কাঁদবি না। এবারে আমাদের অন্য কিছু ভাবতে হবে।’
বিউটি লাল চোখে তাকালো মারিয়ামের দিকে। বললো, ‘কি বলতে চাইছিস ক্লিয়ার করে বল!’

‘দেখ, একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে আমার মনে। মিনহাজ স্যার এতো সব কিছু জানলেন কিভাবে? এতো নিখুঁত ভাবে কিভাবে অভিনয় করলেন তিনি? যদি তোর সন্দেহ সত্যি হয় তবে মিনহাজ স্যারকে এসব কথা কেউ একজন বলেছে। তার মানে সুপ্রিয় ভাইকে তারা চেনে বা তার কাছ থেকে কেউ এসব শুনেছে। তারা খুবই কাছের সুপ্রিয় ভাইয়ের। সব যদি মিলিয়ে দেখতে যায় তবে আমার বিশ্বাস মিনহাজ স্যার সুপ্রিয় ভাইকে চেনেন।’

বিউটি চোখ মুছে নিলো। বললো,
‘এই কথা শোনার পর আমার একটা আইডিয়া এসেছে। আমাকে এবারে প্ল্যান অনুযায়ী আগাতে হবে। আর সেদিন মিনহাজ স্যারের বোনের অস্বাভাবিক আচরণ আমাকে এখন খুব ভাবাচ্ছে।’
‘কি?’

‘আমার ডান হাতে জন্মদাগ আছে তুই আর আমার পরিবার ছাড়া কেউ-ই জানে না তবে রাহেলা আপু জানলেন কিভাবে?’
‘তাই তো? এটা তো ভেবে দেখিনি।’
‘এই কদিনের ঘটনার পর আমি যা ভাবছি তুইও কি তাই ভাবছিস? এই ব্যাপারে তুই ছাড়া কেউ-ই আমাকে সাহায্য করতে পারবে না।’

‘আমি সব সময় তোর সঙ্গে ছাঁয়ার মতো থাকবো।এবারে শোন, এভাবে কাঁদিস না। আমার বিশ্বাস তোর সুপ্রিয় ভাইয়ের কিছু হয়নি। যদি এমন কিছু হয় তবে যে তোর ভালোবাসা, এতোদিনের অপেক্ষার অবসান কখনোই হবে না। সব যে অবস্বাদে ঘিরে যাবে। আল্লাহ্ তায়ালা তোকে এভাবে নিরাশ করবেন না।’

সে আমার সুকেশিনী পর্ব ১২

বিউটি মারিয়ামকে জড়িয়ে ধরলো। এই মেয়েটা না থাকলে আজ সে বোধহয় পা’গ’ল হয়ে যেতো। এই যে এতো কথা সে কার সঙ্গে বলতো এই মেয়েটা তার পাশা না থাকলে?

সে আমার সুকেশিনী পর্ব ১৪