প্রিয়দর্শিনী পর্ব ৩১

প্রিয়দর্শিনী পর্ব ৩১
প্রজ্ঞা জামান তৃণ

ফজরের আজান দিয়েছে কিছুক্ষণ আগে। দর্শিনী আবিদের বুকে বিড়াল ছানার ন‍্যায় ঘুমাচ্ছে। আবিদের ঘুম ভেঙ্গে গেছে অনেকক্ষণ। সে ঘুম থেকে উঠে দর্শিনীকে বুকে জড়িয়ে পলকহীন দেখতে থাকে। দর্শিনীর ফর্সা মুখে, গলায়, বুকে আবিদের দেওয়া ভালোবাসার স্পর্শ রয়েছে। ফর্সা লম্বাটে মুখটায় লাল আভা ছড়িয়ে পড়েছে। আবিদ স্পর্শগুলো আলতো হাতে ছুঁয়ে দেয়। দর্শিনীর ঘুম হালকা হয়ে আসে। সে কয়েক মিনিট তাকিয়ে আবার চোখ বন্ধ করে নেয়। আবিদ মৃদু হেসে তার কপালে ওষ্ঠাধর ছুঁয়ে দেয়, কতো আদুরে তার সুদর্শিনী বউ।

‘বউ, অনেক ঘুমিয়েছো উঠে পড়ো এখন।’
‘উমম একটু পরে উঠবো, আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরী!’
দর্শিনীর ঘুমো ঘুমো কন্ঠে আবিদ মুগ্ধ হয়। আবিদ তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
‘শুধু আবিদ বলো জান।’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আবিদের আদর মাখা কন্ঠে মুহূর্তেই দর্শিনীর ঘুম উরে যায়। কিন্তু আবিদকে বুঝতে দেয়না। সে মৃদু লজ্জা পেয়ে আবিদকে আরো জড়িয়ে নেয়। আবিদ বলে,
‘কী হলো বউ, শুধু আবিদ বলো।’
দর্শিনী ইচ্ছে করে চোখ বন্ধ করে আছে। মুখে তার হাসির সুক্ষ্ম রেখা। আবিদ দর্শিনীর লাল ঠোঁটে বৃদ্ধা আঙ্গুল দিয়ে স্লাইড করে বলে,

‘বলবা না? অ‍্যাঁই তুমি কী লজ্জা পাচ্ছো?’
দর্শিনী কিছু বলবে তার আগেই আবিদ তার ঠোঁট দিয়ে দর্শিনীর নরম কোমল ঠোঁট আঁকড়ে ধরে। দর্শিনীর বাঁধা দেওয়ার মতো অনুভূতি নেই। আবিদের স্পর্শ সে গভীরভাবে অনুভব করছে। মিনিট দুয়েকপর আবিদ ঠোঁটে মৃদু কামড় দিয়ে ছেড়ে দেয়। দর্শিনী চোখ বন্ধ করে ব‍্যাথা সহ‍্য করে নেয়। আবিদ তাকে তাড়া দিয়ে বলে,
‘চলো শাওয়ার নিবে, তারপর আমরা একসঙ্গে নামাজ পড়বো।’

‘একটু পরে উঠি প্লীজ?’
‘উহুম এখুনি উঠবে।’ বলেই দর্শিনীকে কোলে তুলে ওয়াশরুমের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। অতঃপর দুজনে একসঙ্গে শাওয়ার নিয়ে বের হয়। দর্শিনীর হাঁটতে একটু সমস্যা হচ্ছিলো। তাই আবিদ তাকে কোলে করে রুমে নিয়ে আসে। আবিদ দর্শিনীকে শাড়ি পড়তে সাহায্য করে। পরবর্তীতে দুজনে একসঙ্গে নামাজ আদায় করে বেলকনিতে যায়। বিয়েরপর প্রথম একসঙ্গে সুন্দর সকালটা দুজনে মিলে উপভোগ করছে।

সকাল আটটা বাজছে। আবিদ দর্শিনী ঘুম থেকে উঠেছে। নামাজ পড়ে তারা আরেকবার ঘুমিয়েছিল। তারপরেই দুজনে সবার সঙ্গে নাস্তা করার জন‍্য নিচে নামে। চৌধুরী ভিলাতে দর্শিনীর প্রথম দিন। এজন্য দর্শিনীকে আজ সবার জন‍্য যেকোন ডিশ রান্না করে খাওয়াতে হবে। অনুসা বেগম, পুস্পিতা দুজনে দর্শিনীকে নিয়ে রান্নাঘরে যায়। দর্শিনী মাথায় কাপড় দিয়ে রান্নার জন‍্য প্রস্তুত। আজ সে পায়েস রান্না করবে সবার জন‍্য। আজকে খাবার মেনুতে পরোটা, মাংস, পায়েস, সুজির হালুয়া রয়েছে। দর্শিনী রান্নায় অতো পারদর্শী না তবুও মোটামুটি রান্না জানে। এদিকে দর্শিনীকে সাহায্য করার জন‍্য অনুসা বেগম, পুস্পিতা রয়েছে।

আদিবা ঘুম থেকে উঠে ফেসবুক চেক করে। নিহাল এখনো ফেন্ড রিকুয়েস্ট একসেপ্ট করেনি। মুহূর্তেই আদিবার মনটা খারাপ হয়ে যায়। ফলোয়ার হয়ে থাকতে আদিবার কষ্ট হলেও সে মানিয়ে নিতে পারবে। আদিবা স্ট্রং গার্ল। সে দ্রুত ফ্রেশ হয়ে নেয়। তারপর নাস্তা করার জন‍্য নিচে নামে। আসফি বাদে ডাইনিং টেবিলে সবাই উপস্থিত রয়েছে। আদিবা আবিদের পাশে গিয়ে বসে।

রান্না শেষে দর্শিনী পুস্পিতা সবার জন‍্য খাবার পরিবেশন করে। সব রান্না দর্শিনী করেছে বাকিরা সবকিছু এগিয়ে দিয়ে সাহায্য করেছে। খাবার সার্ভ করা হলে অনুসা বেগম দর্শিনী পুস্পিতাকে একসঙ্গে খেতে বসতে বলে। সবাই খেতে বসেছে এমন সময় আসফির আগমন ঘটে। বাহিরে থেকে এসেছে সে। চোখমুখ লাল, চুল উস্কখুস্ক। সবাই আসফিকে এই অবস্থায় দেখে আহম্মক হয়ে বসে আছে।

শাহরিয়ার চৌধুরী চাইলে ছেলেকে বকে দিতে পারতেন কিন্তু এতো মেহমানদের মধ‍্যে নিজেকে সংযত করে নেন। দর্শিনী আসফির দিকে তাকিয়ে নজর সরিয়ে মাথানিচু করে। ভয়ংকর দেখাচ্ছে তাকে। দর্শিনীর আসফির প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নেই আর। আসফিও দর্শিনীর দিকে একবার তাকিয়ে নিজের রুমে চলে যায়। আবিদ নির্বাক নিশ্চুপ! তবে ভিতরে মৃদু রাগ জমে আছে। দর্শিনীর সঙ্গে করা অন‍্যায়ের জন‍্য আসফিকে শাস্তি দিবে সে। যেন ভবিষ্যতে আসফি দুঃসাহস দেখাতে না পারে।

চৌধুরী ভিলা অভিজাত‍্যপূর্ণ ভাবে সুসজ্জিত। শাহরিয়ার চৌধুরী, আবিদ, আরহান সবকিছুর দেখা শোনা করতে ব‍্যাস্ত। পার্লার থেকে দুটো মেয়ে এসেছে দর্শিনীকে সাজানোর জন‍্য। পুস্পিতা, আদিবা, দর্শিনী অন‍্যান‍্য আত্মীয়স্বজন সবাই রেডি হচ্ছে। কনে পক্ষের সবাই ইতিমধ্যে চৌধুরী ভিলার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। এজন্য আরহান আবিদকে রেডি হতে পাঠিয়ে দেয়। দর্শিনীকে লাইট পিংক কালারের লেহেঙ্গা পড়ানো হয়েছে।

সঙ্গে পার্টি মেকআপ। তাকে বরাবরের মতো অপ্সরা লাগছে। এদিকে আবিদও লাইট পিংক পান্জাবি পড়েছে, গলার কাছে হালকা কাজ করা। আবিদ দর্শিনী দুজনে আবারো বর কনে সাজে তৈরি। চৌধুরী ভিলায় লোক সমাগম বেড়েছে। ইতিমধ্যেই কনের পক্ষের লোকজন চলে এসেছে। আবিদ দর্শিনীকে রিসিপশন যেখানে হবে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়। বর কনের জন‍্য স্টেজ সাজিয়ে রাখা হয়েছে।

সেখানে দুজনকে বসানো হয়। আশরাফ মুহতাসিম সহ কনে পক্ষের সবাই উপস্থিত হয় সেখানে। দুইপক্ষের আত্মীয় স্বজনদের নিয়ে পরিপূর্ণ চৌধুরী ভিলা। দর্শিনীর বাবা-মা, বোন, দুলাভাই সবাইকে দেখে খুশিতে কান্না করার মতো অবস্থা। প্রজ্জ্বলিনী বোনকে দেখে স্টেজে উঠে জড়িয়ে ধরে। উজান আবিদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কুশল বিনিময় করে।

আশরাফ সাহেব আর প্রিয়মা বেগম মেয়ে, জামাইয়ের সঙ্গে কুলশ বিনিময় করে। একে একে সব আত্মীয় স্বজন নানান উপহার সামগ্রী আবিদ দর্শিনীর হাতে তুলে দেয়। ফটোগ্রাফাররা সবাই বিয়ের সবকিছু ক‍্যামেরা বন্দি করতে ব‍্যাস্ত। দর্শিনীর ফেন্ড দিয়া, নাদিম, হৃদিতা, আহনাফ সবাই এসেছে। দর্শিনী আনন্দিত সবাইকে একসঙ্গে দেখে। বিয়ের সময় বন্ধুবান্ধবকে পাশে পেলে প্রতিটা মেয়ে আনন্দে আত্মহার হয়ে যায়।

রিসিপশনের অনুষ্ঠান চলমান। আসফি রুম থেকে এখনো বের হয়নি। অনেকেই আবিদের ছোট ভাইয়ের খোঁজ করেছে। এজন্য শাহরিয়ার সাহেব আসফিকে ভদ্রতা বজায় রাখতে অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বলেন। আসফি না চাইতেও অনিচ্ছাকৃত শাওয়ার নিয়ে রেডি হয়ে অনুষ্ঠানের জন‍্য এগিয়ে যায়। এদিকে নিহালকে মায়ের চাপে পড়ে আবিদ দর্শিনীর রিসিপশন এটেন্ড করতে হয়েছে।

বেচারী দর্শিনীকে আবিদের পাশে দেখলেই সুক্ষ্ম ব‍্যাথা অনুভব করছে। হসপিটালের ডিউটির উছিলা দিয়েও লাভ হয়নি নিহালের। রেহানা বেগম জোর করেই তাকে এনেছে। আদিবা নিহালকে দেখে খুশি হয়েছে। সে একবার ভাবলো নিহালের সঙ্গে কথা বলে জিগ্যেস করবে ফেন্ড রিকুয়েস্ট কেনো একসেপ্ট করেনি। কিন্তু লজ্জা রাগে সে লক্ষ‍্যে পৌঁছাতে পারছেনা। নিহালের উপর মৃদু রাগ হয়েছে রিকুয়েস্ট একসেপ্ট করেনি দেখে। এজন্য মনের বিরুদ্ধে গিয়ে আদিবা নিহালের পাশে দাঁড়িয়ে বলে,

‘আসসালামু আলাইকুম। আমি আদিবা সম্পর্কে আপনার রিলেটিভস। আপনাকে রিকুয়েস্ট পাঠিয়েছিলাম আপনি রিকুয়েস্ট একসেপ্ট করলেন না তো।’
আদিবার শীতল শান্ত কন্ঠস্বর। মেরুন রঙের লেহেঙ্গা পরিহিত আদিবাকে পাশে দেখে নিহাল ভড়কে যায়। আদিবাকে সে এইমুর্হূতে এক্সপেক্ট করেনি। উজ্জ্বল শ‍্যামবর্ণের আদিবাকে মেরুন রঙে সুন্দর লাগছে। নিহাল তাকে আপাদমস্তক দেখে চোখ ফিরিয়ে নেয়।

সে ডাক্তার হিসাবে ব‍্যাস্ত মানুষ। সোসাল মিডিয়া থাকলেও সেখানে খুব বেশি এক্টিভ হয়না। কালকে আদিবার রিকুয়েস্ট দেখলে সে এজ অ‍্যা রিলেটিভস বা পরিচিত ভেবে অবশ্যই একসেপ্ট করতো। কিন্তু অনলাইনে এক্টিভ ছিলনা নিহাল। এজন্যই একসেপ্ট করতে পারেনি। সে আদিবার উদ্দেশ্যে বলে,
‘সরি, আসলে এক্টিভ ছিলাম না এজন্য একসেপ্ট করা হয়নি। আপনার আইডির নামটা বলুন আমি একসেপ্ট করে নিচ্ছি।’

‘আদিবা জান্নাত!’
নিহাল ফোন বের করে ডাটা অন করতে অসংখ্য নোটিফিকেশন আসতে থাকে। সে অনেকক্ষণ খুঁজে আদিবার আইডিটা বের করে একসেপ্ট করে নেয়। আদিবা নিহালের সঙ্গে ফেসবুক ফেন্ড হতে পেরে প্রচন্ড খুশি। সে নিহালকে মিষ্টি হেসে ধন্যবাদ জানায়। ভদ্রতা বজায় রাখতে তারা বেশকিছু ক্ষণ কথা বলে। তারপর দুজনে অন‍্যদিকে চলে যায়।

দুপুরে চৌধুরী ভিলায় অনুষ্ঠান শেষ হয়। আবিদ দর্শিনীকে আজ মুহতাসিম ভিলায় যেতে হবে। আশরাফ সাহেব মেয়ে জামাইকে নিয়ে যাওয়ার জন‍্য ফুল দ্বারা সুসজ্জিত গাড়ি এনেছেন। অনুষ্ঠান শেষ হতেই দুইপক্ষের অনেক আত্মীয় স্বজন সেখান থেকেই বিদায় নেয়। এবার আবিদ দর্শিনীর বিদায়ের পালা। দর্শিনী প্রচন্ড খুশি বাড়িতে যাবে বলে। এদিকে আবিদ খুশি হয় দর্শিনীকে প্রাণোচ্ছল প্রাণোবন্ত দেখে।

চৌধুরী পরিবারের সবার সঙ্গে কুশল বিনিময় করে মেয়ে জামাইকে নিয়ে রওনা হোন আশরাফ সাহেব। আসফির এসব আদিখ‍্যেতা পছন্দ হয়নি বলে নিজের রুমে চলে যায়। বাবার অনুরোধ রাখতে ফর্মালিটি মেইন্টেন করে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিল সে। যতবারই আবিদ দর্শিনীকে দেখেছে ততবার আলাদা বিতৃষ্ণা তৈরি হয়েছে। আবিদের উপর সে ভিষণভাবে ইর্ষান্বিত।

প্রিয়দর্শিনী পর্ব ৩০

মুহতাসিম ভিলায় আবিদের জামাই হিসাবে প্রথম আগমন ঘটেছে। এজন্য খুব সুন্দর করে স্বাগতম জানানো হয় আবিদ দর্শিনীকে। আবিদ সবার আপ‍্যায়নে বরাবরের মতো মুগ্ধ। এদিকে রেহানা বেগম বোনের অনুরোধে থেকে গেছেন। কিন্তু নিহাল মায়ের জন‍্য অপেক্ষা না করে অনেক আগেই চৌধুরী ভিলা থেকে চলে গেছে। আদিবা শেষবারের জন‍্য তাকে দেখতে পায়নি।

প্রিয়দর্শিনী পর্ব ৩২