প্রিয়দর্শিনী পর্ব ৪২

প্রিয়দর্শিনী পর্ব ৪২
প্রজ্ঞা জামান তৃণ

চৌধুরী ভিলাতে আজকের সকালটা অন‍্যরকম সুন্দর। নাতিশীতোষ্ণ পরিবেশে সবাই মিলে বাগানে পিকনিক করবে। পিকনিকে রান্নাবান্নার দায়িত্ব আজ সম্পূর্ণ ছেলেদের হাতে। ব‍্যাপারটা নিয়ে দর্শিনী খুব এক্সাইটেড! অনেক আগে প্রিয়দর্শিনী যখন দাদু বাড়িতে গিয়েছিল তখন এমন ফ‍্যামেলী পিকনিক দেখেছিল।

পরবর্তীতে দ্বিতীয়বার আর সুযোগ হয়নি। প্রিয়দর্শিনী দাদুকে ভালোবাসে ঠিকই, কিন্তু দাদু বাড়িতে খুব কমই গেছে। তার দাদি বেঁচে থাকাকালীন তাদেরকে আশরাফ সাহেব তাদেরকে বাসায় নিয়ে আসতেন। এজন্যই তেমন প্রভাব পড়েনি দু’বোনের মধ‍্যে। তবে দর্শিনীর ইচ্ছে আছে আবিদকে নিয়ে তার দাদার বাড়িতে যাওয়ার। দর্শিনী প্রথমবার স্বামীর বাড়িতে এমন পিকনিক করবে। এজন্যই আনন্দটা দ্বিগুন মনে হচ্ছে তার।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

সকালে আবিদ দর্শিনীকে জড়িয়ে শুয়ে ছিল। অনেক আগেই ঘুম ভেঙ্গে গেছে দুজনের। মূলত দর্শিনীই তার ঘুমের বারোটা বাজিয়েছে। পরবর্তীতে আর ঘুমাইনি আবিদ। আজকে যেহেতু দর্শিনী প্রচন্ড খুশি! বউয়ের খুশির ঝলকানিতে ঈষদুষ্ণ হাসে আবিদ। হুট করেই দর্শিনীর গলায় মুখ গুঁজে মিষ্টি স্মেল নিতে থাকে। আবিদ এমন আচরণ মাঝে মধ্যেই করে; এটা নতুন নয় দর্শিনীর কাছে! কালকে রাতের কথা ভেবে দর্শিনী মৃদু লজ্জা পেয়ে আবিদকে ছেড়ে উঠে যেতে চায়।

আবিদ একটু আপত্তি করে পরবর্তীতে দর্শিনীর লজ্জা পাওয়া দেখে ছেড়ে দেয়। তার ঠোঁটে এখনো মনোমুগ্ধকর হাসি। সচারচর তার হাসিটা সকলের অগোচরে থাকে, কিন্তু দর্শিনীর কাছে সবসময় দৃশ‍্যমান। আবিদের এমন সুক্ষ্ণ হাসিতে দর্শিনী লজ্জা পায়। সে আবিদের নজর এড়িয়ে দ্রুত ওয়াশরুমে চলে যায়। অন‍্যদিকে আবিদও ফ্রেশ হয়ে গার্ডেন এড়িয়ায় চলে আসে।

তার এখন জগিং করা প্রয়োজন। সুদর্শিনী বউয়ের জন‍্য তাকে আরো বেশি স্বাস্থ্য সচেতন থাকতে হবে। এমনিতেই কাল রাতে দর্শিনী তাকে বুড়ো হয়ে যাচ্ছে বলে ফেলেছে। যদিও মজা করেছে বলেছে, তবুও কী দুঃসাহস! বত্রিশ বছর বয়সী এমন সুদর্শন স্বামীকে কেউ বুড়ো কীভাবে বলতে পারে? আবিদ জানেনা তবে কাল রাতেই দর্শিনীকে প্রমাণ করে দিয়েছে সে কতোটা স্টেবল, স্ট্রেন্থফুল। আবিদের ঠোঁটে সুক্ষ্ণ হাসির রেখা দেখা যায়।

সকালের মনোমুগ্ধকর পরিবেশটা আবিদের বরাবরই ভালো লাগে। টি-শার্ট টাউজার পরিহিত অবস্থায় জগিং শেষে প্রাণভরা সতেজ নিঃশ্বাস টেনে নিলো আবিদ। বাগানের এতো সব রঙিন ফুল ফলাদির মধ‍্যে যে কারো ভালো লাগবে স্বাভাবিক। আবিদ কিছুক্ষণ দৌঁড়াদৌঁড়ি করে লোহার একটা বেঞ্চে আরাম করে বসে। দর্শিনী তখন ট্রে’তে করে সকালের ব্রেকফাস্ট নিয়ে আসে।

আজকে দুজনেই শীতোষ্ণ সতেজ পরিবেশে বেঞ্চে বসে ব্রেকফাস্ট করবে। আগে সবসময় আবিদ ব্রেকফাস্ট এমন শান্তিময় পরিবেশে করতো। প্রকৃতির মাঝে স্বপ্নের প্রেয়সীনিকে, মানে দর্শিনীকে অনুভব করতে চাইতো। তাদের বাড়ির কাজের মহিলা বয়স্ক সুফিয়া বেগম এবং তার স্বামী ইমান আবদুল্লাহ দুজনেই চৌধুরী বাড়িতে অনেক আগে থেকে কাজ করে। ইমাম আবদুল্লাহকে আবিদ সম্মান করে চাচা বলতো। আবিদ যখন ব‍্যায়াম করার জন‍্য গার্ডেনে থাকতো তখন ইমান চাচাই তার জন‍্য প্রায় সময় ব্রেকফাস্ট নিয়ে আসতো। আবিদ তখন নিরিবিলিতে ব্রেকফাস্ট করতো। অনেক সময় শাহরিয়ার চৌধুরী আবিদকে সঙ্গ দিতেন। মূলত তাদের জন‍্যই বাগানের দিকটায় টেবিলের ব‍্যবস্থা করা হয়েছে।

দর্শিনী এসে আবিদের পাশে ট্রে’টা রেখে নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে আবিদের কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছে দেয়। আবিদ বেঞ্চে বসে থেকে দর্শিনীর কোমড় জড়িয়ে মায়াভরা দৃষ্টিতে তাকে দেখতে থাকে। পুরাই ফিল্মি স্টাইল! আসফি তখন নিজের রুমের ব‍্যালকনিতে ছিল। সবার ব‍্যালকনি থেকে গার্ডেন এড়িয়া সরাসরি চোখে পড়ার মতো ছিল। মূলত শাহরিয়ার চৌধুরী গার্ডেনের সৌন্দর্যটুকু অনুভব করার জন‍্য এভাবেই ডিজাইন করেছিলেন। আসফি ব‍্যালকনি থেকে দৃশ্যটা দেখে মলিন হাসলো। বুকের মধ‍্যে কোথাও একটা সুক্ষ্ণ ব‍্যথা অনুভব করলো। নাহ, এখানে থাকা ঠিক নয়। আসফি ততক্ষণাৎ রুমে চলে যায়।

আবিদকে জুসের গ্লাসটা বাড়িয়ে দেয় দর্শিনী। দুজনে বেঞ্চে বসে নানান কথাবার্তা বলতে থাকে। ঠিক এমন সময়ে শবনম ফুফির আগমন ঘটে। মূলত বাগানটা তার হাতেই গড়া। এজন্য দেশে ফিরেই তিনি বাগান পরিদর্শন করেছিলেন। বাগানের এমন স্নিগ্ধ, সুন্দর, সতেজ রূপ দেখে তিনি বুঝে যায় আমেরিকা যাওয়ার পর সবাই ভালোই যত্ন নিয়েছে বাগানের।

আবিদের মতো শবনম ফুপিরও নিয়মিত বাগান পরিদর্শন করার অভ‍্যাস আছে। এজন্যই তিনি এখানে আসলেন। হঠাৎ-ই বেঞ্চের উপর আবিদ দর্শিনীকে বসে থাকতে দেখে তিনি বিব্রত হলেন। তাদের দেখার আগে ফিরে যাবেন বলে ঠিক করেন শবনম ফুপি। কিন্তু হঠাৎ-ই আবিদের নজরে পড়ে যান। আবিদ ফুপিআম্মুকে ডেকে ওঠে,
‘ফুপিআম্মু, চলে যাচ্ছো কেনো?’

শবনম ফুপি অনিচ্ছাকৃত থেমে যান। আবিদের ডাকে বিস্মাভূত হয়ে বললেন,
‘এমনিই! বাগান দেখতে এসেছিলাম। দেখা শেষ রুমে যাবো, আবিদ!’
আবিদ শবনম ফুপিকে ইশারায় তার কাছে আসতে বলে। দর্শিনী দু’জনকে স্পেস দিতে ব্রেকফাস্টের ট্রে’টা নিয়ে বাসার ভেতরে চলে যায়। শবনম ফুপি লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে এগিয়ে যায়। আবিদের পাশে না বসলে ছেলেটা থামবেনা। তাই বেঞ্চে আবিদের পাশে গিয়ে বসেন। আবিদ তখন বলে,

‘তোমাকে আগের মতো হাস‍্যজ্জ্বল দেখিনা, ফুপিআম্মু। আমার খুব খারাপ লাগে তোমাকে এভাবে দেখতে।’
‘কে বলল আমি আগের মতো হাস‍্যজ্জ্বল নই? আগের থেকে কম, তবে দেখো তোমার ফুপিআম্মুর জৌলুস কিন্তু এখনো কমেনি।’
শবনম চৌধুরী মেকি হেসে বললেন। আবিদ ফুপির দিকে তাকিয়ে মলিন হাসল। হঠাৎ-ই শবনম চৌধুরীর কাঁধে মাথা রেখে বলে,

‘একটা অমানুষের জন‍্য নিজের জীবন এভাবে শেষ করে দিচ্ছো? আমাদের ভালোবাসার কী কোন দাম নেই? কেনো ঐ লোকটা তোমার কাছে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পায়? আমি যদি কখনো জানতে পারি লোকটি কে; তাহলে নিজ হাতে খু’ন করব। তোমার সঙ্গে করা অন‍্যায়ের প্রতিশোধ নিবো। তুমি আমাকে লোকটির পরিচয় বলো। এই পৃথিবীতে অমানুষের বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই।

‘আবিদ….!’
শবনম চৌধুরী সহসা আবিদের কথায় চমকে ওঠেন। এমন ভয়ংকর কথা আবিদের মুখে শুনে তিনি মৃদু ঢোক গিলে ফেলেন। অজান্তেই আবিদ নিজের শ্বশুরের প্রতি নিদারুণ ক্রো’ধ পুষে রেখেছে অথচ তার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। শবনম চৌধুরী হয়তো আশরাফ সাহেবের প্রতি রেগে আছেন। হয়তো মৃদুমন্দ ঘৃ’ণা করেন। আশরাফ সাহেবের বিশ্বাসঘাতকতা এখনো তার মনে আঁচড় কেঁ’টে রয়েছে। তাই বলে তিনি কখনো আশরাফ সাহেবের ক্ষ’তি চান না। এটাকেই হয়তো নিঃস্বার্থ ভালোবাসা বলে।

‘আমাদের ভুল কোথায় জানো, আবিদ? আমরা কখনো কারো দৃষ্টিকোণ থেকে ভেবে দেখিনা। এজন্যই মানুষকে ভুল ভাবে জাজ করে ফেলি! আমি কোনকিছু মনে রাখিনি। আমার এই অবস্থার জন‍্য কেউ দায়ী নয়। তুমি অযথা ভুল ধারণা পুষে রেখেছো। তোমার এসব ভুলে যাওয়া উচিত! তোমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি জিনিস প্রিয়দর্শিনী, ক‍্যারিয়ার! বাকি অন‍্যকিছু নিয়ে ভাবতে যেওনা, আবিদ।
আবিদ ফুপিআম্মুর কঠিন কথায় দমে যায়। ফুপিআম্মুর অপছন্দ এমন কাজ সে করতে চায়না। আবিদ নিঃরস কন্ঠে বলে,

‘আমার কাছে তুমি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, ফুপিআম্মু। তুমি কী সারাজীবন এভাবেই থাকবে?’
‘এটাই তো আমার নিয়তি, আবিদ। এভাবেই বেশ ভালো আছি। লাইফে দ্বিতীয়বার এক্সপেক্টেশন রাখিনা আমি!’
আবিদ দৃঢ়তার সঙ্গে বলে,

‘এটা কারো জীবন হতে পারেনা!’
‘মানিয়ে নিতে হয়, আবিদ! আমি তো মানিয়ে নিয়েছি।’

প্রিয়দর্শিনী পর্ব ৪১

[ নোট ~ আবিদের বয়স বত্রিশ। আমি আগের পর্বে ভুলে তেত্রিশ লিখেছি। সবাই ভুলটা মানিয়ে নিয়েন! ] [ দুঃখিত দেরি করার জন‍্য এখন থেকে নিয়মিত হবো ]

প্রিয়দর্শিনী পর্ব ৪২ শেষ অংশ