প্রিয়দর্শিনী পর্ব ৯

প্রিয়দর্শিনী পর্ব ৯
প্রজ্ঞা জামান তৃণ

“এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবো, ভেতরে আসতে বলবেন না দর্শিনী?”
প্রিয়দর্শিনী আবিদকে এসময়, এখানে দেখবে কল্পনা করতে পারেনি! সে নির্বিকারভাবে চেয়ে রইল। প্রিয়দর্শিনীর নির্বিকার চেহারা দেখে আবিদের চোখমুখে সু’ক্ষ্ম হাসির বিচরণ। প্রিয়দর্শিনীর মাঝে অস্থিরতা দেখা যায়। তখনই আবিদের পাশ থেকে আদিবা হাত নাড়িয়ে বলে,

‘হাই দর্শিনী আপু। আমাদের সেদিন দেখা হলো তোমার সঙ্গে কথা বলতে পারিনি। ড‍্যাম!তোমার নামটা ভিষণ সুন্দর একদম তোমার মতো।’
প্রিয়দর্শিনী আদিবার দিকে তাকিয়ে দেখল, উজ্জ্বল ফর্সা প্রাণবন্ত হাস‍্যজ্জ্বল মিষ্টি মেয়ে। আদিবার চেহারার সঙ্গে আবিদের ছিটেঁফোটা মিল পাওয়া যায়। প্রিয়দর্শিনী জানে আদিবা আবিদের ছোট বোন। সেদিন শাহরিয়ার চৌধুরী পরিচয় করানোর সময় বলেছিলেন। আবিদের সামনে প্রশংসা পেয়ে প্রিয়দর্শিনী লজ্জায় আড়ষ্ঠ হয়ে যায়। প্রিয়দর্শিনী মুখে হাসির রেখা ফুটিয়ে দুজনের উদ্দেশ্যে বলে,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘ভেতরে আসুন।’
বতর্মানে ড্রয়িং রুমে সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরী। আবিদকে এখানে উপস্থিত দেখে আশরাফ মুহতাসিম খুশি হয়েছে। অন‍্যদিকে আবিদের গলা পেয়ে প্রিয়মা বেগম রান্নাঘর থেকে ছুটে আসেন। আবিদ সবাইকে সালাম দেয়। আদিবা হাতে থাকা মিষ্টির প‍্যাকেট, ফলমূল প্রিয়মা বেগমের হাতে দিয়ে, ভাইয়ের মতো ফর্মালিটি রক্ষার্থে সবাইকে সালাম করে। প্রিয়মা বেগম মিষ্টি হেসে সালামের জবাব দেয়।

আবিদ উজানকে দেখে হাতের মেলবন্ধন করে। আশরাফ মুহতাসিন ছাড়া কেউ জানতো আবিদ আসবে এজন্য সবাই বি’স্মিত। আবিদ ষার্টাধ্ব আহমেদ মুহতাসিনের পাশে গিয়ে বসে। উপরে উপরে আহমেদ মুহতাসিমের গম্ভীর থমেথমে মুখ ঠিকই, কিন্তু ভিতরে তিনি হাসছেন। কারণ এখানে আসার পর থেকে আবিদকে পরোক্ষ করছেন তিনি। আবিদ বেশ কয়েকবার প্রিয়দর্শিনীর দিকে তাকিয়েছে। আবিদ মৃদু স্বরে জিগ্যেস করে,

‘কেমন আছেন দাদু?’
আহমেদ মুহতাসিম আবিদকে লোক দেখানো উপেক্ষা করে, আদিবাকে ডেকে পাশে বসালেন। আবিদ অপ্রস্তুত হয়। এতো সুন্দর উপেক্ষা পেয়ে নিজেকে নির্বিকার রেখে প্রিয়দর্শিনীর দিকে প্রশ্নবিদ্ধ অবস্থায় তাকায়। প্রিয়দর্শিনী আবিদের দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে নিজের মনে বলল,”এইতো শুরু হয়ে গেলো দাদুর পরীক্ষা। ম‍্যাজিস্ট্রেট সাহেব একটু সাবধান!” আদিবা প্রফুল্ল হয়ে আহমেদ মুহতাসিমের পাশে বসে। আহমেদ মুহতাসিম বলেন,

‘কেমন আছে মিষ্টি দাদুভাইটা? আমাকে চিনতে পারছো? আমার কিন্তু মনে আছে তোমাকে!’
‘ভিষণ ভালো। আমারও তোমাকে মনে আছে। কালকে যখন শুনলাম প্রিয় আপু অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তখনই ঠিক করি ভাইয়ার সঙ্গে দেখা করতে আসবো। আলহামদুলিল্লাহ্ প্রিয় আপুকে সুস্থ দেখে ভিষণ ভালো লাগছে।’
আহমেদ মুহতাসিম হাস‍্যজ্জ্বল মেয়েটির মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। আদিবা মিষ্টি হেসে আহমেদ মুহতাসিমকে বলে,
‘তুমি কেমন আছো দাদু? এখনো কি মিষ্টি দেখতে তুমি ক্রাশ খেয়ে গেলাম হিহি।’

সবাই আদিবার কথায় হোহো করে হেসে দেয়। আহমেদ মুহতাসিম বলে,
‘এইতো আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো দাদুভাই।’
বাড়ির সকলে আবিদ আদিবার উপস্থিতিতে খুশি হলেও প্রজ্জ্বলিনী খুশি হতে পারেনি। আবিদের হঠাৎ আগমন, বাড়ির সকলের মুখে হাসি তাকে ভাবিয়ে তুলছে। তার কাছে প্রিয়দর্শিনীর আচরণও উদ্ভট লাগছ। বিশেষ করে আবিদ আসার পর থেকে অন‍্যরকম প্রিয়দর্শিনীকে দেখাচ্ছে। প্রিয়দর্শিনী কেমন নার্ভাস, লজ্জা মিশ্রিত দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে।

প্রজ্জ্বলিনীর কাছে বিষয়টি স্বাভাবিক লাগেনি। না লাগারই কথা এসব বোঝার জন‍্য প্রজ্জ্বলিনী অন্তত ছোট নয়। এসব অনুভূতির সঙ্গে সে আগে থেকে পরিচিত। প্রজ্জ্বলিনী মনে মনে ভাবে বেশি বাড়াবাড়ি হওয়ার আগে প্রিয়দর্শিনীকে বোঝাতে হবে, যে আবিদ ভালো নয় তার জন‍্য মোটেও যোগ্য নয়।

চৌধুরী বাড়িতে,
ডাইনিং টেবিলে পিনপতন নিরবতা চলছে। সবাই নির্বিকারভাবে একে অপরের দিকে চেয়ে আছে। আবিদ একবার সবাইকে লক্ষ‍্য করে আদিবাকে বলে,
‘খাওয়া হয়ে গেলে চুপচাপ উপরে চলে যাবে।’

আদিবা ভাইয়ের উপর কিঞ্চিৎ বিরক্ত হয়। আবিদ বিশেষ বিশেষ আলোচনার সময় তাকে পাঠিয়ে দেয়। প্রচন্ড অভিমান হয় আদিবার। আজ ছোট বলে কেউ তাকে পাত্তা দেয়না। আদিবা অনুরোধ করে বলে উঠে,
‘কেনো আমি থাকিনা প্লীজ্! কি এমন কথা যে আমি থাকতে পারবো না।’

আবিদ বোনের দিকে স্বাভাবিক চোখে তাকায়। আদিবা এখনও ছোট তার সামনে কোন ধরনের আলোচনা পছন্দ করেনা সে। আদিবা ভয় পেয়ে যায়। আবিদের তী’ক্ষ্ম চাহনীর চেয়ে শীতল চাহনী বেশি ভয়াবহ। আবিদ এমনিতে বোনকে প্রচন্ড ভালোবাসে। কিন্তু কথা না শুনলে রাগ করে। আদিবা ভাইকে স্পেস দিয়ে হাত ধুয়ে সুরসুর করে উপরে যায়। ড্রয়িং রুমে সবাই উৎসুক হয়ে আছে। আবিদ মৃদু ‘উহুম’ শব্দ করে বলে,

‘প্রিয়দর্শিনী বিয়েতে রাজি।’
শাহরিয়ার চৌধুরী এবং অনুসা বেগমের মুখে অকসাৎ হাসি ফুটে উঠল। বিয়েতে হঠাৎ ‘না’ করার কারণে দুজনেই প্রিয়দর্শিনীর উপর অস’ন্তো’ষ ছিল। হয়তো আবিদ কষ্ট পাবে ভেবে। কিন্তু এখন সুখবর শুনে খানিকটা নিশ্চিন্ত। আসফির গতিবিধি লক্ষ্য না করে পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হতে পারছেনা তারা। আসফি বাহিরে নরমাল দেখালেও ভিতরে প্রলয়ের পূর্বাভাস। আসফি আশা করেছিল প্রিয়দর্শিনী ভাইকে নয় তাকে পছন্দ করবে। কিন্তু প্রিয়দর্শিনীর অকসাৎ বিয়েতে রাজি হয়ে যাওয়া সে মেনে নিতে পারছে না। আসফি নির্বিকার কিন্তু ভেতরে ক্রোধে ফেটে পড়ছে। আসফির ভিতরের সত্তা ক্রোধে বশিভূত হয়ে বলে উঠে,

‘প্রিয়দর্শিনী কাজটা মোটেও ঠিক করেনি। এখন একটা উপায় রয়েছে যে করে হোক বিয়েটা আটকাতে প্রিয়দর্শিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। আর যদি তাতেও কাজ না হয় প্রিয়দর্শিনীকে ভুগতে হবে।’
আবিদ আসফির দিকে সু’ক্ষ্ম নজরে চেয়ে আছে। ছেলেটা কেমন যেন অবাস্তবিক। আসফির ভিতরে কি চলছে বোঝা যাচ্ছে না কিন্তু মতিগতি সুবিধার লাগছে না আবিদের কাছে।

আবিদের ধারণা যদি সত্যি হয় আসফি কোন প্রবলেম ক্রিয়েট করতে পারে। এমনটা হলে আবিদ আর যাই করুক আসফিকে ক্ষমা করবে না। আসফি থমথমে মুখে টেবিল থেকে উঠে যায়। সবাই ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে। আবিদের ঈগলের ন‍্যায় দৃষ্টি বিপদ আশঙ্কা করছে। আবিদকে মোকাবেলার জন‍্য প্রস্তুত থাকতে হবে। উপস্থিত সবাই এই ভয়টাই পাচ্ছিলো। পুস্পিতা, আরহান সিচুয়েশনটা স্বাভাবিক করতে সবার দিকে চেয়ে বলল,

‘আল্লাহ্! কি বলছো সত্যি? এটাতো আনন্দের খবর।’
শাহরিয়ার চৌধুরী বললেন,
‘উনারা আর কি বলেছেন?’
আবিদ নির্বিকারভাবে বলল,

‘বেশিকিছু নয় উনারা আগে থেকে এমনটা চাইছিল মাঝখানে দর্শিনীর সময় প্রয়োজন ছিল। বিয়ে তো সারাজীবনের জন‍্য তাই তাড়াহুড়ো করে সিদ্ধান্ত নিতে চায়নি। পরবর্তীতে দর্শিনীকে আশরাফ মুহতাসিম আঙ্কেল জিগ্যেস করলে বাবার কথাতে নিদ্বির্ধায় রাজি হয়ে যায়। আশরাফ মুহতাসিম আঙ্কেল যত দ্রুত সম্ভব দিন তারিখ ঠিক করে জানাতে বলেছে। সুবিধা অনুযায়ী একদিন গিয়ে বাগদান সেরে,বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করবেন বলে জানিয়েছে।’
আবিদ পুরো কথাটা নির্বিঘ্নে বলে সকলের পানে চাইল। শাহরিয়ার চৌধুরী, অনুসা বেগমের দিকে একবার তাকিয়ে খুশি মনে বললেন,

‘বেশ! আগামী শুক্রবার সবার জন‍্য ভালো হবে। তাদেরকে জানিয়ে দেও আগামী শুক্রবারে বাগদান সারতে যাবো ইনশাআল্লাহ্।’
আরহান চিন্তিত কন্ঠে বলে,
‘বাবা সবই তো বুঝলাম কিন্তু আসফি? আসফির বিষয়টি হেলাফেলা করোনা। তোমরা ওকে একটু বুঝিয়ে বলো সবটা মেনে নিলে ওর জন‍্যই সুবিধা হবে।’

আবিদের ভিতরে সত্তা নির্বিঘ্নে বলে,
‘ওকে নিয়ে ভরসা নেই। চুপচাপ বসে থাকার মতো ছেলে নয়।আসফি যদি কোন অভদ্র আচরণ করে আমি তাকে ক্ষমা করবো না। আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরীর ডিকশনারীতে ক্ষমা নামে কোন শব্দ নেই। এখন থেকে আমাকে এ ব‍্যাপারে সচেতন হতে হবে।’

আবিদ আজ উজান এবং আশরাফ মুহতাসিমের সঙ্গে জুম্মার নামাজ পড়েছে। জুম্মার নামাজ শেষে খাওয়া দাওয়া করে তবেই ছেড়েছিল আশরাফ মুহতাসিম। অবশ্য অনেক আগেই যেতে চেয়েছিল আবিদ, কিন্তু আহমেদ মুহতাসিম তাকে নিষেধ করায় না করতে পারেনি। কাজেই দ্বিধান্বিত হয়ে এইবারের জুম্মার নামাজটা পরিবার ছাড়া পড়েছে। চৌধুরী বাড়িতে প্রতিটি ছেলে সদস্য একসঙ্গে জুম্মার নামাজ পড়ে আসছে। আবিদের ক্ষেত্রে এইবার একটু বেতিক্রম হয়েছে। আবিদ অবশ্য সবটাই জানিয়েছিল শাহরিয়ার চৌধুরীকে।

প্রিয়দর্শিনী প্রচন্ড অসস্থি অনুভব করছে। আজকে বেশকিছু ঘটনা তার অগোচরে ঘটেছে, যেগুলো সে জানতে চায়। অনেকক্ষণ ধরে ডায়াল লিস্টে আবিদের নাম্বারটা ঘুরেফিরে দেখছে। প্রিয়দর্শিনীর কি আবিদের নাম্বারে ফোন দেওয়া উচিত,নাকি না? এই নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দে রয়েছে। তার অবচেতন মন জানতে চায় আবিদ কি এমন বলল যে সবাই এক কথায় রাজি।

ষার্টাধ্ব আহমেদ মুহতাসিম যাওয়ার আগে, আবিদকে নিয়ে হাটতে গার্ডেন এরিয়ায় গেছিলো। সেখানে তাদের মধ‍্যে কথা হয়েছে। আবিদ কি আহমেদ মুহতাসিমের পরীক্ষায় জিতে গেল? আহমেদ মুহতাসিম আবিদকে এতো দ্রুত ছেড়ে দিবে ভাবতে পারেনি প্রিয়দর্শিনী। আলোচনার মধ‍্যসময়ে অবশ‍্য উজান আশরাফ মুহতাসিম দুজনেই যোগ দিয়েছিল। কিন্তু তাদের মধ‍্যে কি নিয়ে কথা হয়েছে সবার অজানা রয়ে গেছে।

প্রিয়দর্শিনী পর্ব ৮

প্রিয়দর্শিনীর এসব ভাবনার মাঝেই পরিচিত নাম্বার থেকে ফোন আসে। একবার, দুবার, চারবার প্রিয়দর্শিনী রিসিভ করবে নাকি করবে না ভাবতে ফোনটা কেটে যায়। সেকেন্ডের মধ‍্যে আবারো ফোন আসলে প্রিয়দর্শিনী কাঁপাকাঁপা হাতে রিসিভ করে। ওপাশ থেকে হঠাৎ পুরুষালী কন্ঠে ধমক পরে। প্রিয়দর্শিনী চোখ বন্ধ করে, ফোনটা কান থেকে দুরে সরিয়ে নেয়। ধমকটা একটু বেশি জোরে হয়ে গেল না?

প্রিয়দর্শিনী পর্ব ১০