প্রেমময়ী বর্ষণে তুই পর্ব ১২

প্রেমময়ী বর্ষণে তুই পর্ব ১২
লাবিবা ওয়াহিদ

-“রায়াফ তখন এগারো বছর বয়সী ছিলো। জেম্মা তখন গোপনে পরকীয়া চালিয়ে গেছে এক খ্রিস্টান লোকের সাথে। চিন্তা করতে পারছো? পরকীয়ার ছয় মাসের মধ্যেই জেম্মা সেই লোকটির সাথে পালিয়ে গেলো। একবারও চিন্তা করেনি তার ছোট ছেলেটির কথা। কতরাত রায়াফ মা, মা করে কান্না করেছে, বাবা আর দাদী ছাড়া তার পাশে কেউ ছিলো না। জেঠু রায়াফকে বুকে জড়িয়ে হুঁ হুঁ করে কাঁদতেন। সে যে সহ্য করতে পারতেন না ছেলের এই অবস্থা। রায়াফ একা হয়ে গেলো, কারো সাথে মিশতো না একমাত্র তার বাবা ছাড়া। দুই বছর বাদে জেঠুর বিজনেস আরও জমে গেলো, সেরা বিজনেস ম্যানদের তালিকায়ও চলে আসে।

তার বিজনেস চলাকালীন সময় সে বিজনেস নিয়ে এতোই ব্যস্ত থাকতো যে চেয়েও রায়াফকে সময় দিতে পারতো না। সেও ছোট্ট রায়াফ তখন ক্রিকেটের প্রতি আস্তে আস্তে দুর্বল হতে শুরু করে, অতঃপর ক্রিকেটটাকেই সে তার ধ্যান, জ্ঞান করে ফেললো। সেদিন রায়াফ বিপিএলে খেলছিলো, তখনো জাতীয় দলে সে যায়নি। ঢাকা থেকে খেলে জিতে বাসায় ফিরতেই শুনলো জেঠু ডেথ! তাকে কেউ খুন করে দিয়েছে। সে কেউ না “জেম্মা!” জেম্মা লোক লাগিয়ে তাকে খুন করেছে তাও কিছু সম্পত্তির লোভে। জেঠু সম্পত্তি দেয়নি দেখে… তখন বুঝে নাও এই ছেলেটার কী অবস্থা হয়েছিলো। এতো বড় বড় ধাক্কা রায়াফকে এক কঠিন মানুষে রূপান্তরিত করেছিলো। সে কারো সাথে মেশা একদমই পছন্দ করে না, প্রয়োজন ছাড়া অন্য কোনো কথার সাথে এই রায়াফ পরিচিত নয়। বিলিভ মি মন থেকে চাই আমার এই ভাইটা যেন তার এই আঁধার থেকে বেরিয়ে আসে, ওর তিলে তিলে শেষ হয়ে যাওয়াটা আমি একদমই সহ্য করতে পারছি না!”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আফনার চোখ বেয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পরছে। যেই মানুষটার সাথে তার এতো ঝগড়া-লড়াই সেই মানুষটার জীবনই এতটা বিষাদময়? আর সে কি না ভেবেছিলো এই মানুষটা অহংকারী? আমরা মাঝে মধ্যে ভুলে যাই কারো খারাপ বা চুপ থাকার পেছনেও একটা গল্প থাকে, আমরা তা পেছনের গল্পটি না জেনেই তাদের ভুল বুঝি, আজেবাজে পদক্ষেপ নেই। আফনা অনুতপ্তে মাথা নিচু করে ফেললো। তবে সে এইটুকুনি বেশ ভালো বুঝলো রায়াফ বেশ স্ট্রং একজন মানুষ। আফনা চোখ মুছে ফাহানের উদ্দেশ্যে বললো,

-“আপনি বাড়ি যান আমি ওনাকে বাড়ি নিয়ে যাবো!!”
ফাহান ঘাড় ঘুরিয়ে আফনার দিকে তাকালো।
-“ভরসা করতে পারেন আমায়!” আশ্বস্ত করে বললো আফনা।
ফাহান আর দাঁড়ালো না চলে গেলো। আফনা ধীরপায়ে রায়াফের কাছে গেলো। রায়াফের কাঁধে আলতো হাত রাখতেই রায়াফ পিছে ফিরে তাকালো। আফনাকে দেখে রায়াফ তৎক্ষনাৎ আফনাকে আঁকড়ে ধরলো আর আফনা চোখ বড় বড় করে ফেললো। বিষয়টা যেন আফনার মাথার উপর দিয়ে গেলো। আকস্মিক ঘটনায় তার মস্তিষ্ক যেন কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। ঠেলে যে সরিয়ে দিবে তাও পারছে না। এভাবেই বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেলো। রায়াফ আবার নিজেই আফনাকে ছেড়ে দূরে গিয়ে দাঁড়ালো। আফনা বিনাবাক্যে কিছু না বলেই দৌড়ে ঘাট থেকে উঠে গেলো।

আফনা চলে যেতেই রায়াফ একটি সুদীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো! আকাশের পানে তাকিয়ে মনে মনে বললো,
-“মনের প্রশান্তির জন্যে হলেও তোমায় চাই আফনা। তুমি-ই আমার এই সাদা-কালো জীবনকে রঙিন করতে পারো, সাহায্য করবে না?”
এভাবেই বিয়ে সময়গুলো পার হলো। নিহা এলো ইসহাকের বউ হয়ে। নিহাকে হাসিমুখে বরণ করলো ইসহাকের মা। আফনা ব্যতীত এখনো কেউ জানে না দুজনের মাঝে কোনো সম্পর্ক ছিলো! আফনা এখন রায়াফের প্রতি অনেকটাই সাবধান। সে এখন আর রায়াফকে অসম্মান করে না বরং শ্রদ্ধা করে। এমন শক্ত মানুষদের সে কখনোই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে না।
“বিবেকবান কখনো ভুল কাজে লিপ্ত হয় না।”

~লাবিবা ওয়াহিদ
আফনা চুপিচুপি রায়াফের রুমের সামনে এসে দাঁড়ায়। আগামীকালই সকলে ঢাকা চলে যাচ্ছে। আর হয়তো তাদের দেখা হবে না। কেন যেন আফনার বেশ খারাপ লাগছে। আফনা রায়াফের ঘরে কিছুটা উঁকি দিয়ে দেখলো রায়াফ তার লাগেজ গোছাচ্ছে। আর তার মহামান্য কুকুর বিছানার ঠিক মাঝখানে বসে জিহবা বের করে লেজ নাড়ছে। এছাড়া তার যেন কোনো কাজই নেই।
জিনি দরজার দিকে তাকিয়ে হাঁক ছাড়লো। আফনা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে সরে দাঁড়ালো। তখনই রায়াফ পিছে ফিরে আফনাকে সরে যেতে দেখে ফেললো। রায়াফ স্মিত হেসে বললো,

-“লুকানোর প্রয়োজন নেই। কিছু বলার থাকলে ইউ ক্যান সে।”
আফনা চোখ-মুখ খিঁচে ধীর পায়ে দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। আফনার মুখশ্রী দেখে রায়াফের মধ্যে শীতল হাওয়া ছেঁয়ে গেলো। তবে রায়াফ উপর দিয়ে স্বাভাবিক। আফনা চোখ মেলে আমতা আমতা করে বললো,
-“একচুয়ালি আজই তো শেষ রাত এখানে, তাই ভাবছি ছাদ থেকে ঘুরে আসবো। আপনি কী আমার সাথে আসবেন?”
-“কেন একা যেতে ভয় পাও!”

আফনা নিজের রাগ দমিয়ে রেখে বললো, “জ্বী না! আজ আকাশের বুকে চাঁদের দেখা মিলেছে সাথে পরিবেশটাও সুন্দর। আপনি যেন এরকম পরিবেশ মিস না করেন তাই আপনাকে বলেছি। গেলে আসেন নয়তো বসে থাকেন!”
বলেই আফনা ঘুরে যেতে নিবে ওমনি রায়াফ পিছু ডাকলো!
-“রেগে চলে যাওয়া লাগবে না, আমি আসছি।”
আফনা থেমে গেলো এবং তার ওষ্ঠজোড়া প্রসারিত করলো। রায়াফ লাগেজের চেইন লাগিয়ে জিনিকে নিয়ে বের হতে নিলে আফনা থামালো!

-“এই কুকুরটাকে না নিয়ে গেলে হয় না?”
“কুকুর” বলাতে জিনি আফনার দিকে তেড়ে আসতে নিলে রায়াফ থামালো। আফনা তো সেখানেই ভয়ে কাচুমাচু হয়ে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। এই কুকুর জাতকে আফনা আজীবন ভয় করে এসেছে। রায়াফ আফনার দিকে তাকিয়ে নম্র সুরে বললো,
-“ওর নাম জিনি তাই ভুলেও কুকুর বলবেন না। আমার জিনি পছন্দ করে না।”
-“কুকুরটা কী বিদেশী?”

রায়াফ মাথা নাড়ায় যার অর্থ “হ্যাঁ!” রায়াফ জিনিকে রেখেই আফনার সঙ্গে ছাদে চলে গেলো। ফেমাস অলরাউন্ডার আফনার পাশে ভাবতেই আফনার ভেতরটা বারংবার কেমন কেমন করে উঠছে। সে কখনো কল্পনা করেনি এই মানুষটার সাথে তার লড়াই হবে, ঝগড়া হবে, পাশাপাশি হাঁটা হবে।
নিস্তব্ধ ছাদে পোকার ডাক এবং রাত জাগা পাখিরই গুনগুন কানে ভাসছে। ঘড়ির কাঁটায় হয়তো সাড়ে ১০টার বেশি বাজছে। বিশাল আকাশের বুকে থালা সমান চাঁদটা এদিকেই মুখ করে আছে। বাদলা দিনে চাঁদ খুব একটা দেখা যায় না। আফনা চাঁদের দিকে তাকিয়ে হাত চুলকাচ্ছে এবং রায়াফ আফনার দিকে একপলকে তাকিয়ে আছে। রায়াফ মনে মনে বললো,

-“গল্প-কবিতায় শুনতাম ছেলেরা তাদের প্রেমিকাকে জমিনের বুকের চাঁদের সাথে তুলনা করতো, তাকে আপন করে নিতো। এতদিন বিশ্বাস না করলেও আজ বাধ্য হচ্ছি, আমারই সামনে আল্লাহর দেয়া আরেক চাঁদ! তোমার এই চাঁদমুখী রূপ যে আমায়
কতো ঢেউয়ের ন্যায় ভাসাবে জানি না! তুমি কী বুঝবে আমায়, আদুরী!”
-“আচ্ছা তোমার নাম কী?”
রায়াফের এমন কথা শুনে আফনা চোখ বড় বড় করে রায়াফের দিকে তাকায়। কেমন ছেলে আজ অবধি নামটাই জানে না? তাহলে এতদিন কার সাথে লড়লো?”

প্রেমময়ী বর্ষণে তুই পর্ব ১১

-“কোথায় হারালে?”
-“নাম জানেন না?”
-“পুরো নাম জিজ্ঞেস করেছি!”
-“ওহ!” বলেই আফনা চাঁদের দিকে তাকালো। অতঃপর বললো,
-“আফনা লিলি!”
-“শাপলা পছন্দ করো?”
-“নাহ!”
-“তুমি তো লিলি, তো তুমি কেমন লিলি যে ন্যাশনাল লিলিকে লাইক করো না?”
-“লিসেন! আমি লিলি হলেও মানুষ, কোনো ফুল নই ওকে? আর সকল মানুষেরই ভিন্ন ভিন্ন পছন্দ রয়েছে, আমার বেলায় তো ব্যতিক্রম হবে না?”
-“তো তোমার কী ফুল পছন্দ শুনি?”
-“বেলী!”

রায়াফ মুগ্ধ হয়ে তার আদুরীর দিকে তাকালো। তখনই তার মনে হলো আজই সে তার আদুরীর সাথে থাকবে, আগামীকাল থেকে আলাদা! ভাবতেই রায়াফ মনমরা হয়ে গেলো। রায়াফের মনের ব্যথা যেন আকাশে ভেলার ন্যায় ভেসে বেড়ানো মেঘগুলি উপলব্ধি করলো, জোর তারা গর্জন দিয়ে উঠলো। আফনা কিছুটা চমকে রায়াফের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“আমি তাহলে ওই বাড়িতে যাই, মনে হচ্ছে বৃষ্টি নামবে!!”

বলেই দ্রুত সে স্থান ত্যাগ করলো আফনা। রায়াফ আফনার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,
-“এই প্রেমময়ী বর্ষণের শুভ্র ভোরে অতিথি পাখির ন্যায় আমায় জীবনে প্রবেশ করেছিলে তুমি, এই প্রেমময়ী বর্ষণেও যে শুধু তোমাকে চাই। আমার প্রেমময়ী বর্ষণে তুই, শুধুই তুই! তুমি বলো তো কী করে আমাদের গল্পের এতো জলদি সমাপ্তি ঘটাই? আমার জীবনের ইতি অবধি তোমায় চাই। ভালোবাসি, আদুরী!”

প্রেমময়ী বর্ষণে তুই পর্ব ১৩