প্রেমময়ী বর্ষণে তুই পর্ব ১১

প্রেমময়ী বর্ষণে তুই পর্ব ১১
লাবিবা ওয়াহিদ

সেদিন পানিতে চুবাচুবির পর ওরা আরও লেগেছে। আফনা যখন বুঝলো ওদের লড়াই দিনদিন আরও বেশি হচ্ছে তখনই আফনা সরে আসে। কারণ, সে এখানে লড়াই করতে নয় ভাইয়ের বিয়ে খেতে আসছে। একমাত্র বড় ভাইয়ের বিয়েতে বলে কথা আর কতো স্বপ্নও দেখেছে বিয়েতে মজা করার। সেসব তো আফনা জলে যেতে দিতে পারে না। তাই সে নিজেই চুপ মেরে গেছে। লড়াই করার জন্য বাকি জীবন পরে আছে কিন্তু ইসহাক বিয়ে তো মাসে মাসে করছে না?

এসব ভাবতে ভাবতেই আফনা রায়াফের রুমের সামনে চলে আসলো। দরজায় নক করার জন্য এগোতেই কারো সাথে দুম করে ধাক্কা খেলো। আফনা পরে যাওয়ার আগেই কেউ তার কোমড় জড়িয়ে বুকে আবদ্ধ করে ফেললো। আফনা কিছুক্ষণ চোখ-মুখ খিঁচে দাঁড়িয়ে রইলো। আর রায়াফ বেক্কলের মতো আফনার দিকে তাকিয়ে রইলো। আফনার মাথা রায়াফের বুকে ঠেকে আছে।রায়াফের মিশ্র অনুভূতি চারপাশ থেকে তাকে ঘিরে ধরেছে। এ কেমন প্রশান্তি রায়াফ বুঝতে পারছে না। মনে হচ্ছে যেন এই মেয়েটা তার বুকে মাথা রাখলেই তার সমস্ত সুখ দরজার চৌকাঠে এসে নাড়া দিচ্ছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আফনার ধ্যান ভাঙতেই সে ধাক্কা দিয়ে রায়াফকে সরিয়ে লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলো। আফনার কেন যেন দম আটকে আসছে। কখনো কোনো ছেলের এতো কাছে যায়নি আর আজ… কী হলো এটা? রায়াফ বৃষ্টিবিলাসীর দিকে তাকাতেই রায়াফের মাথা আরেকবার হ্যাঙ হয়ে গেলো। হলুদ লেহেঙ্গা, হালকা মেকআপ, চুল ছেড়ে দুপাশে এসে রাখা, মাঝে দিয়ে সিঁথি করে সেখানে একটি টিকলি ঝুলানো, বলা চলে অসম্ভব সুন্দর লাগছে বৃষ্টিবিলাসীকে। রায়াফের ধ্যানে ছেদ ঘটলো আফনার কঠিন কন্ঠে,

-“আপনার সাহস তো কম না আপনি আমায় টাচ করেন!!”
-“লিসেন! তোমার তো স্টুপিডকে টাচ করার কোনো প্রশ্নই উঠে না। আমি যদি না ধরতাম তাহলে তো কোমড় ভেঙ্গে পরে থাকতা!”
-“তো আপনি খাম্বার মতো আমার সামনে এসে দাঁড়ায় ছিলেন কেন? চোখে কী দেখেন না নাকি আকাশে তাকিয়ে হাঁটেন?”
-“আমি নাহয় দেখলাম না, তা তুমি চোখ কী স্টেজে রেখে আসছিলা? পাশ কেটে দাঁড়াতে পারলা না? আমার মতো ফেমাস মানুষকে দেখলে তো মেয়েদের টুকটাক ধাক্কা দেয়া লাগেই!” নিজের কলার কিছুটা ঝাকিয়ে বললো রায়াফ। মুখে তার দুষ্টু হাসি। অনেকদিন পর ঝগড়া করে তার যে কী আনন্দ হচ্ছে সে ভাষায় প্রকাশ করতে পারবে না!
-“এক্সকিউজ মি! মেয়েরা নয় ছেলেরা মেয়েদের গায়ে ঢলে পরে ওকে। আর আমি ওসব ছ্যাঁসড়া মানসিকতার মেয়ে নই, সো যা বলবেন ভেবে বলবেন!”

-“ভেবে বলার সময় নেই, এখন তুমি কি-জন্য এসেছো সেটা বলো!”
-“ওইতো…”
বলেই আফনা থেমে গেলো এবং চোখ বড় বড় করে রায়াফের দিকে তাকিয়ে রইলো। এতদিনে এই প্রথম আফনা রায়াফকে পাঞ্জাবিতে দেখলো। পার্পল পাঞ্জাবি, কালো পাজামা, চুল কোনোরকম আঁচড়ানো যার মধ্যে কিছু চুল কপালে এসে ঠেকেছে। এককথায় অপূর্ব লাগছে রায়াফকে। আফনা রায়াফকে দেখে মনে মনে ভাবলো,
-“স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছি কলি, ইরার ক্রাশ হিসেবে রায়াফ পারফেক্ট। আজ তাকে দেখে আমারই তো ক্রাশ খাওয়ার মতো অবস্থা। ছিঃ না না, কিসব ভাবছি আমি! রায়াফ সানভি সবার ক্রাশ হলেও নট মাইন! হে আল্লাহ আমার দৃষ্টি-ভঙ্গি হেফাজত করো এই মানবটির দিক থেকে!”

রায়াফ মুচকি মুচকি হাসছে আফনার এভাবে তাকানো দেখে। যাক এতদিনে সূর্য তার দিকে ফিরলো! রায়াফ সামান্য কেশে স-শব্দে বলে উঠলো,
-“আমি জানি আমি সুন্দর, এভাবে চোখ দিয়ে গিলে খাওয়ার কোনো মানে হয় না!”
রায়াফের কথায় আফনা গাল ফুলিয়ে বললো,
-“ঠ্যাকা পরে নাই আপনার মতো তালগাছের দিকে তাকিয়ে থাকার!” বলেই হনহন করে বেরিয়ে গেলো। আর রায়াফ সেখানে দাঁড়িয়েই নিশব্দে হাসলো।

ইসহাককে স্টেজে বসিয়ে হলুদ দেয়া হচ্ছে। মেয়েপক্ষের অনেকেই এসেছে। আফনা তো সকলের সাথে কথা বলতে ব্যস্ত আর দূর থেকে রায়াফ মুখে মাস্ক পরে আফনাকে দেখছে। আফনা যখন হাসিমুখে কথা বলে অন্যদিকে যাচ্ছিলো তখনই একটা ছেলে এসে আফনার পথ আটকালো। রায়াফ নেড়ে চেড়ে দাঁড়ালো এবং আফনার দিকে এগিয়ে গেলো। আফনা কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে বললো,
-“কিছু বলবেন?”
-“তুমি কী ছেলেপক্ষের?”
-“তো আমাকে কী রাস্তার ভিখারি মনে হচ্ছে?” দাঁতে দাঁত চেপে বললো আফনা! ছেলেটা মাথা চুলকে বললো,
-“সরি, তোমাদের মেয়েদের পোশাক দেখে বোঝার উচিত ছিলো তোমরা ছেলে পক্ষের। মেয়েরা তো হলুদ শাড়ি/লেহেঙ্গা পরেছে।”

-“এসব বাকওয়াজ ছাড়া প্রয়োজনীয় কিছু বলতে চাইলে বলুন নয়তো চোখের সামনে থেকে সরুন!”
ছেলেটার আশার বাতি নিমিষেই ফুঁস। সে বুঝতে পারেনি মেয়েটির ব্যবহার এমন হবে? আফনা ছেলেটার পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। আফনা চলে যেতেই রায়াফ ছেলেটির সামনে এসে দাঁড়ায়। ছেলেটি মাথা উঁচু করে রায়াফের দিকে তাকায়। রায়াফ কন্ঠে কঠোরতা নিয়ে বললো,
-“শি ইজ মাইন, তার আশেপাশে ঘেঁষার চেষ্টা পর্যন্ত করলে ইউ উইল ডাই!” বলেই রায়াফও অন্যদিকে চলে গেলো। ছেলেটি সেখানে বেক্কলের মতো দাঁড়িয়ে থেকে ভাবলো,

-“নির্ঘাত মেয়েটার বয়ফ্রেন্ড হবে। বাবাগো, দুটোই ডেঞ্জারাস! কে ঘেঁষে এই মেয়ের দিকে? না বাবা, নিজে বাঁচলে বাপের নাম!” ভেবেই রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছলো এবং অন্যদিকে চলে গেলো।
রায়াফ অন্যদিকে দাঁড়িয়ে নিশব্দে হাসলো। সে তার উত্তর পেয়ে গেছে। নিজের জিনিসের হেফাজত সে ভালোভাবেই করে।
এভাবেই হলুদের অনুষ্ঠান শেষ হলো। সকলে ক্লান্ত হয়ে যে যার বাড়িতে গিয়ে ঘুমিয়ে পরলো। পরেরদিন সকলেই দেরী করে ঘুম থেকে উঠলো। গতকাল ছেলেদের বাড়িতে হলুদের অনুষ্ঠান হলেও আজ হবে মেয়েদের বাড়িতে। আগামীকাল বিয়ে। তাই এই বাড়ির তেমন কোনো কাজ নেই। সন্ধ্যার পরে এ-বড়ি থেকে কয়েকজন যাবে। নাস্তা সারতে সারতেই যোহরের আযান দিয়ে দেয়। আফনা সুখের ঢেঁকুর তুলে ডাইনিং টেবিল থেকে উঠতেই দেখলো ইসহাক পরিপাটি হয়ে বের হচ্ছে। আফনা ইসহাকের পথ আটকে বললো,

-“কিরেহ, শুক্রবার ছাড়া তো নামাজে এতো পরিপাটি হয়ে যাস না? আজ কী হলো?”
-“নামাজের পর মিলাদ হবে।”
-“মিলাদ? কিসের মিলাদ?”
-“খেলোয়াড় রায়াফের বাবার মৃত্যুবার্ষিকী আজ!”
আফনা যেন সেখানেই জমে গেলো। তার মানে কী রায়াফের বাবা নেই? আফনা নির্বাক হয়ে বললো,
-“ওনার বাবা মারা গেছে?”

প্রেমময়ী বর্ষণে তুই পর্ব ১০

ইসহাক মাথা নাড়িয়ে চলে গেলো। আফনার কেন যেন খারাপ লাগছে। তাই সে গোসল সেরে নামাজ পড়ে এতিমখানার দিকে চলে গেলো। কেন যেন এখন বাচ্চাগুলোর সাথে সময় কাটাতে ইচ্ছে করছে।
সেখানে গিয়ে আফনা আরও অবাক হলো। রায়াফ পরিপাটি হয়ে বাচ্চাদের জামা-কাপড় সহ অনেককিছু বিতরণ করছে। রায়াফকে সাহায্য করছে দুজন গার্ড এবং এতিমখানার দায়িত্বে থাকা একজন মহিলা। বাচ্চাগুলোর হাসিটা জাস্ট দেখার মতো। আফনা গেটের সাথে হেলান দিয়ে চুপচাপ দেখছে। তার মাথায় এখনো ঘোমটা আছে। রায়াফ সব বিতরণ করে সকলের আড়ালে চোখের কোণ মুছে নিলো। বিষয়টি সকলের দৃষ্টি এড়ালেও আফনার দৃষ্টি এড়ায়নি কারণ, সে একমনে রায়াফকেই দেখছিলো। রায়াফ গার্ডদের কিছু বুঝিয়ে দিয়ে হনহন করে আফনার পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেলো। রায়াফ এভাবে বের হচ্ছে দেখে ফাহানও রায়াফের পিছে ছুটলো। গেট দিয়ে বের হতেই ফাহান আফনাকে খেয়াল করে দাঁড়িয়ে গেলো এবং বললো,

-“আফনা, তুমি এখানে?”
-“উনি এভাবে চলে গেলেন কেন?”
ফাহান কোনোরকম উত্তর না দিয়ে রায়াফের পিছে ছুটলো। আফনাও কিছু না ভেবে ফাহানের পিছে ছুটলো।
রায়াফ একমনে দূরের কৃষ্ণচূড়ার দিকে তাকিয়ে আছে আর ফাহান, আফনা তার থেকে কিছুটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে। আফনা ফাহানের উদ্দেশ্যে বললো,
-“উনি কেন কখনী কোনো শোতে তার ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড সম্পর্কে বলতেন না?”
ফাহান কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, “কারণ, রায়াফ চায় না তার সম্পর্কে কেউ জেনে তার উপর দয়া দেখাক!”

-“মানে?” অবাক হয়ে বললো আফনা। ফাহান আফনার দিকে একপলক তাকিয়ে বললো,
-“রায়াফ এতিম!”
আফনা স্তব্ধ হয়ে যায় এমন একটি কথা শুনে। সে মোটেই এমন একটা কথা কল্পনায়ও চিন্তা করতে পারেনি।
-“তার মানে ওনার বাবা-মা দুজনেই মৃত?”
-“নাহ। ওর মা আরেকজনের সংসার করতে ব্যস্ত। তার যে একটা ছেলে আছে সে কোনোদিনও খবর নেয়নি। ইভেন আমার জেঠুর মৃত্যুর কারণ আমারই জেম্মা ওরফে রায়াফের মা!”

প্রেমময়ী বর্ষণে তুই পর্ব ১২