প্রেমময়ী বর্ষণে তুই পর্ব ১০

প্রেমময়ী বর্ষণে তুই পর্ব ১০
লাবিবা ওয়াহিদ

আজ রায়াফ সাড়ে ৪টার আগেই ঘুম থেকে উঠে বুকে হাত গুঁজে বসে আছে। এই কয়েকদিন সাড়ে চারটায় আফনা তাকে সেইদিনের মতোই ঘুম থেকে জাগিয়েছে। ব্যাপারটা আসলেই বিরক্তিকর। তাই আজ রায়াফ নিজেই উঠে বসে আছে। কিন্তু সাড়ে চারটার বেশি বেজে ফজরের আযান অবধি দিয়ে দিলো, আফনার খবর নেই। রায়াফ কিঞ্চিৎ ভ্রু কুচকালো। আজ আফনা এলো না কেন? রায়াফ আফনার কথা ভাবতে ভাবতে ওয়াশরুমে চলে গেলো। এভাবে দুইদিন কেটে গেলো।

আফনা তাকে জ্বালাতন করে না ইনফেক্ট রায়াফের আশেপাশেও ঘেঁষে না। রায়াফ কেন যেন বারবার আফনার বিরক্তগুলো চাইছে, কিন্তু কেন? রায়াফকে আফনা বিরক্ত করছে না, এতে তো তার খুশি হওয়ার কথা। তাও কেন সে মানতে পারছে না? আজ হলুদের প্রোগ্রাম। রায়াফ মুখে মাস্ক পরে হলুদের ডেকোরেশন দেখছে। রায়াফের আসার মূল কারণ ডেকোরেশন নয়, আফনা। রায়াফ আশেপাশে আফনাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। গত ২দিন এই মেয়েটাকে না দেখে থেকেছে। রায়াফ জানে না মেয়েটার প্রতি তার দুর্বলতা ঠিক কোথায়? জানতেও চায় না শুধু একপলক আফনাকে দেখতে চায়।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তৃষ্ণার্ত আঁখিপল্লব শুধু আফনাকেই খুঁজছে। দখিনা হাওয়ার মতো আফনা রায়াফের সামনে আবির্ভূত হলো। আফনা আর কলি হাসতে হাসতে হাতে ফুলে ডালা নিয়ে স্টেজের দিকে যাচ্ছে। আফনার এই মনকাড়া হাসি দেখে রায়াফ সেখানেই জমে গেলো। মিনিট পাঁচেকের মতো থেকে রায়াফ পুকুরের ঘাটে চলে গেলো। এই জায়গাটা রায়াফের ভিষণ প্রিয়। তবে সেদিনের পর থেকে এখন চোখ-কান খোলা রেখেই সে ঘাটের সিঁড়িতে বসে। গ্রামে আসার প্রথম দিকটা বিরক্তি লাগলেও কয়েকটা দিন তার ভিষণ ভালো যাচ্ছে। ভালো যাওয়ার কারণটা হয়তো আফনা, নয়তো আশেপাশের মানুষগুলোর বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ!

এসবই একপলকে সে পুকুরের অপরপ্রান্তে তাকিয়ে রয়েছে, সেখানে ইয়া বড় একটা কৃষ্ণচূড়া ফুলের গাছ। কী সুন্দর লাগছে দেখতে যেন আমার দেশের পতাকাকেই গাছটি স্মরণ করিয়ে দেয়। সবুজ পাতার ভাঁজে ভাঁজে রক্তিম কৃষ্ণচূড়ার মিলনমেলা! বাতাসের তালে তালে উড়ছে যেন বৃষ্টির পূর্বাভাস। রায়াফের মস্তিষ্কে আবারও সেই গানটি উঁকি দিলো। রায়াফ দেরী না করে ফোন বের করে গানটি প্লে করে আবারও পকেটে ফোনটি ঢুকিয়ে নিলো।

“কিছু কথার পিঠে কথা..
তুমি ছুঁয়ে দিলে মুখরতা।
হাসি বিনিময় চোখে চোখে,
মনে মনে রয় বেকুলতা!”
এই ৪টি লাইন আজ মনের গহীন হতে অনুভব করলো রায়াফ। সে চোখ বুজে বাঁকা হাসি দিলো। আফনার বাঁদরামি ভেবে সে বড্ড আনন্দ পাচ্ছে আবার এসব হারিয়ে সামান্য কষ্টও হচ্ছে। তখনই নামলো বৃষ্টি। রায়াফ চোখ মেলে আকাশের পানে তাকালো। বৃষ্টির ফোঁটা তার মুখশ্রী ভিঁজিয়ে দিচ্ছে। আজ বৃষ্টিতে ভিঁজতে তার ভীষণ ভালো লাগছে। তখনই কেউ জোরে বলে উঠলো,

-“ওয়াও বৃষ্টি! আদু, কলি ভিঁজতে চাইলে জলদি আয়!”
পরিচিত কন্ঠস্বর পেয়ে রায়াফ ঘাড় ঘুরিয়ে উপরে তাকালো। আফনা দৌড়ে, লাফিয়ে বৃষ্টিতে ভিঁজছে। রায়াফ নিজের অজান্তেই হেসে উঠলো। মেয়েটা আসলেই পাগলি, সবসময় বাচ্চামো। রায়াফ মন ভরে আফনার বৃষ্টিতে ভেঁজা দেখলো। নিজেও যে ভিঁজে চুপ চুপা হয়ে গেছে সেদিকে তার খেয়াল নেই। রায়াফের এখন চিৎকার করে বলতে মন চাইছে, কেন এই বর্ষণ ক্ষণে ক্ষণে আসতে পারে না? কেন জীবনের বেদনা গুলোকে ধুঁয়ে দিয়ে জীবনটা রাঙিয়ে দেয় না? কেন এই বৃষ্টিবিলাসীর সাথে এই বর্ষণে এতটা তৃপ্তি পায়? কেন বর্ষণ? পারবো কী, এই বৃষ্টিবিলাসীর মতো নিজের জীবনকে নানান রঙে রাঙিয়ে তুলতে?

কিছুক্ষণ বাদে বৃষ্টি বন্ধ হয়ে গেলো। দুজনেই ভিঁজে কাকভেঁজা হয়ে গেছে। তবে আফনার দিকে ভালোভাবে খেয়াল করতেই রায়াফ চোখ সরিয়ে নিলো। বৃষ্টিতে আফনার নাজেহাল অবস্থা হয়ে গেলো। আফনা ততক্ষণে তার ওড়নাটা ভালোভাবে গায়ে জড়িয়ে নিলো। রায়াফ কোণা চোখে আফনার দিকে তাকিয়ে দেখলো ঠিকাছে কি না। হ্যাঁ! রায়াফ আশেপাশে তাকালো, নাহ কেউ নেই। রায়াফ হাফ ছেড়ে বাঁচলো।

বিকালের দিকে রায়াফ এতিমখানার উদ্দেশ্যে বের হলো। পকেটে দু’হাত গুঁজে এতিমখানায় গিয়ে দেখলো আফনা সেখানে বাচ্চাদের সাথে খেলছে এবং খিলখিলিয়ে হাসছে। আফনাকে দেখে রায়াফ ভেতরে প্রবেশ করলো না, সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। রায়াফ বেশ অবাক হলো এই ভেবে, কিছুক্ষণ বাদে ইসহাকের হলুদের অনুষ্ঠান, সেখানে সাজগোছ করতে না বসে মেয়েটা এতিমখানার এই বাচ্চাগুলোকে সময় দিচ্ছে? রায়াফের ভাবনায় ছেদ ঘটলো আফনার কথায়,

-“আজ আমার ভাইয়ের হলুদের অনুষ্ঠান তোমরা আসবে তো?”
-“আমাদের সবার তো সুন্দর জামা নাই বুবু, কেমনে জামু?”
আফনা ম্লান হেসে বলে,”তোমাদের অন্তর কিন্তু আয়নার মতো স্বচ্ছ। তাই পোশাকে কী আসে যায়? তোমাদের স্বচ্ছ অন্তর যে সব পোশাককেই হার মানায়। পোশাক দ্বারা কাউকে জাজ করা বোকামি ছাড়া কিছু না।”
-“তোমার কথা সব মাথার উপর দিয়া গেছে বুবু।”
আফনা এবারও হাসলো। মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
-“নতুন জামা দিলে আসবে তো?”

কয়েকটা বাচ্চা মাথা নাড়ালো। আফনা মুচকি হেসে উঠে দাঁড়ালো। আফনা সকলকে বিদায় দেয়ার আগেই রায়াফ লুকিয়ে পরলো। তার ঠোঁটে হাসি লেগে আছে। আফনা ওদের বিদায় জানিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেলো। আফনার পিছে রায়াফও গেলো। রায়াফ জানতে চায় আফনা এইমুহূর্তে ঠিক কী করতে চাইছে। রায়াফ আফনার পিছু নিতে নিতে বাসা পর্যন্ত চলে আসলো।
আফনা তার ঘরে এসে তার লাগেজ থেকে মিনি ব্যাংকটা বের করলো। মিনি ব্যাংকটায় তার ঘড়ি কেনার টাকা ছিলো। আফনার বরাবরই দামী ব্র‍্যান্ডেড ঘড়ি পরার ইচ্ছে ছিলো। ব্যান্ডেড ঘড়ির দাম কম তো নয়। তাও প্রায় তিন হাজারের মতো জমিয়েছিলো। যেই ঘড়িটা পছন্দ ছিলো সেটা সাড়ে চার হাজারের মতো দাম ছিলো। আফনা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে টাকাগুলো হাতে নিলো। তখনই তার মনে হলো ইসহাকের বাসর থেকে তো সে টাকা কামাতে পারবে তাই ভেবেই নিজেকে সামান্য সান্ত্বনা দিলো। তখনই আদনান রুম প্রবেশ করলো। আফনার হাতে টাকা আর ব্যাংক দেখে আদনানের বুঝতে বাকি রইলো না টাকাগুলো আফনা ব্যাংক থেকে বের করেছে। আদনান অবাক হয়ে বললো,

-“ব্যাংক থেকে টাকাগুলো বের করেছিস?”
-“হ্যাঁ! এতিমখানার কয়েকটা বাচ্চার জন্য জামা কিনবো!”
-“তাই বলে নিজের উইশ…”
-“আরে ধুর, টাকা গেলে আবার আসবে। তুই থাক আমি যাই ব্যবস্থা করে আসি!”
বলেই আফনা রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। আড়ালে এবারও সবটা শুনলো রায়াফ। কিসের উইশের কথা বললো ছেলেটা? আদনান রুম থেকে বের হতেই রায়াফ আদনানকে ডাকলো। আদনান রায়াফকে দেখে খুব খুশি হলো।
-“আরে ভাইয়া আপনি?”
-“হু আমি। তোমার আপু কোথায় গেছে?”
নিমিষেই আদনানের হাসিমুখটা উধাও হয়ে গেলো।

প্রেমময়ী বর্ষণে তুই পর্ব ৯

-“এতিমখানার বাচ্চাদের জন্য জামা কিনতে গিয়েছে। জানেন ভাইয়া আপুর ওই ব্র‍্যান্ডেড ঘড়ির খুব সখ ছিলো, সেটা কেনার জন্য না খেয়ে খেয়ে টাকা জমিয়েছে। আজ সেই টাকা দিয়ে ওদের জামা কিনে দিচ্ছে৷ আপু এমন কেন?”
রায়াফ নির্বাক হয়ে আদনানের কথাগুলো শুনলো। আদনান যে বকবক করে সব বলে দিয়েছে সেদিকে তার খেয়ালই নেই। অতঃপর রায়াফের সাথে গল্প জুড়তে যেতেই রায়াফ সিঁড়ির দিকে লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে গেলো।
সন্ধ্যার পর বিকট শব্দে গানবাজনা শুরু হয়ে গেলো। শুরু হলো বাচ্চাদের মাতামাতি। এতিমখানার বাচ্চাগুলোও এসেছে। সকলের গায়ে নতুন জামা, কয়েকজনের পরিহিত জামা আফনার কিনে দেয়া। আফনা দূর থেকে বাচ্চাগুলোর হাসি দেখে অনেকটা শান্তি পেলো। তার ঘড়ির কথা ভুলে রেডি হতে চলে গেলো।
আফনা রেডি হয়ে বের হতেই আফনার মা আফনাকে ডাকলো। আফনা তার হলুদ লেহেঙ্গার ওড়না ঠিক করতে করতে মায়ের দিকে চলে গেলো।

-“হু বলো কি বলবা?”
-“ফাহানের কোন বন্ধু আছে না সে তো আসলো না, ওরে গিয়ে দেখ তো কোনো সমস্যা হয়েছে কিনা!”
আফনা বিরক্তি নিয়ে মায়ের দিকে তাকালো। বাসার কয়েকজন বাদে আর কেউই জানে না রায়াফের সম্পর্কে এমনকি আফনার মা-ও না। আফনার মা জানলে যে কী হতো তাই ভাবছে আফনা। আফনা বিরক্তি নিয়ে বলে,
-“আর কাউকে পাও নাই ওনার খোঁজ নিতে? আমি কী ওই ছেলের সেবা করতে আসছি?”
-“এমন করে বলিস কেন? কাউকে আশেপাশে পেলাম না তাই তোকে বললাম। এখন কথা না বাড়িয়ে যা বলছি তা কর গিয়ে, এখনই অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যাবে!”
আফনা তার মাকে ভেংচি কেটে তার দাদীর বাড়ির দিকে চলে গেলো।

প্রেমময়ী বর্ষণে তুই পর্ব ১১