প্রেমসাগরের উত্তাল ঢেউ পর্ব ২ || লেখিকা-লাবিবা নুসরত

প্রেমসাগরের উত্তাল ঢেউ পর্ব ২
লেখিকা-লাবিবা নুসরত

প্রাচীর সামনে এখন আয়ুসের বাবা দাঁড়িয়ে আছেন। আলতাফ হোসেন। হঠাৎ ওনাকে এখানে দেখে যতটা না অবাক হয়েছে সবাই তার থেকে বেশি কষ্ট হচ্ছে প্রাচীর। বিয়ে ভেঙেছে প্রায় ছয় মাস। এতোদিনে সে একবারও আসে নি। প্রাচী ভেবেছে হয়তো উনিও ভুল বুঝে রাগ করে আছেন। তাহলে আজ আসার মানে কি? মিসেস লারা ওনার সামনে গিয়ে দাড়ালেন। আলতাফ মাথা নিচু করে রেখেছেন। মিসেস লারা তাকে সরাসরি বললেন,
“আপনি এখানে কেন? আচ্ছা আমার মেয়েটাকে এতো কষ্ট দিয়েও কি শান্তি হয় নি আপনাদের? আর কি চান?”
আলতাফ মাথা নিচু রেখেই বললেন,

“আমি জানি একটা ভুল করে ফেলেছি। আর আমার ছেলেও ভুল করেছে। আসলে প্রাচীকে আমরা অপমান করেছি। কিন্তু এখন তো আয়ুসের বিয়ে। তো সব ভুলে যদি আপ্নারা আমার দাওয়াত গ্রহন করতেন!”
প্রহর এগিয়ে এসে বলে,
“আপ্নারা আমার বোনকে আর কতো কষ্ট দিবেন বলে ঠিক করেছেন? প্রথমে পাঁচ মাস আগে হঠাৎ করেই বিয়েটা ভেঙে দিলেন। এখন আবার নিজের ছেলের সাথে আমাদেরই পরিবারের একজনের বিয়ে দিচ্ছেন। আচ্ছা, সব মানলাম। দাওয়াত দিতে এসেছেন কোন সাহসে? বিন্দুমাত্র লজ্জা বোধ কি নেই আপনাদের?”
আলতাফ হোসেন মাথা একটু উঁচু করে বললেন,
“আমাকে মাফ করে দিবেন। আর প্রাচী মা এদিকে আসো একটু।”
প্রাচী রোবটের ন্যায় সামনে এসে দাড়ালো। আলতাফ তাকে বললেন,
“আমাকে পারলে মাফ করে দিও। একমাত্র ছেলে তো আমার। ও বিয়েটা করতে চায় নি। তাই আমি ওকে আর জোর করি নি।”

মিসেস লারা এই লোকের কথা খুবই অবাক। নিজের একমাত্র ছেলের কথায় একটা মেয়েকে এতো কষ্ট দিতেও দ্বিধা বোধ করছেন না! ইনি মানুষ না অন্য কিছু?
মিসেস লারা~”আপনার ছেলের বিয়ে করার খুব শখ৷ তাই তো বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পাঁচ মাসের মাথায় আবারও বিয়ে করছে। যাইহোক ওই ছেলে কি করলো না করলো তা নিয়ে আমার কোনো মাথা ব্যাথা নেই৷ আমরা দাওয়াত গ্রহন করতে পারলাম না। মাফ করবেন।”
আলতাফ~”আপনারা কিন্তু ভুল বুঝছেন। আমি সেভাবে কিছু…”
আলতাফ কিছু বলার আগে প্রহর বলল,
“আমরা বুঝতে পেরেছি আপনার ছেলে আমার বোনকে অনেক ভালোবাসতো। তাই তো অবিস্বাস করে বিয়ে ভেঙে দিয়ে নতুন জীবন শুরু করছে।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

প্রাচী এতো সময় নিরব দর্শক ছিল। সে এসব আর নিতে পারছে না। আলতাফকে সে বলে,
“আঙ্কেল প্লিজ এখান থেকে যান। আমি অনেক কষ্টে আছি। এসব আর আমি নিতে পারছি না। যান প্লিজ!”
আলতাফ চলে গেলেন। প্রাচী নিজের রুমে চলে গেলো। প্রহর আর লারা গেলেন না। তারা ভাবলেন কিছুক্ষন একা থাকতে দেয়া উচিৎ ওকে। তাহলে হয়তো ভালো লাগবে।
তারা দুজন আবারও সোফায় এসে বসলো। লারা প্রচন্ড রেগে আছেন৷ তিনি প্রহরকে বললেন,
“আজ তোর বাবা বাসায় নেই বলে। না হলে যা হতো!”

প্রহর~”মা আমি তোমাকে আগেই বলেছিলাম যে ছেলেটাকে আমার সুবিধার মনে হয় না। এরপরেও তোমরা আমার কথা শোনো নি। আর আরোহি এটা কিভাবে করলো? ও তো আমাদের রক্তের! আমার কি মনে হচ্ছে জানো? আয়ুস আর আরোহির মধ্যে আগে থেকেই সম্পর্ক ছিল। না হলে এতো জলদি কিভাবে সব হবে?”
মিসেস লারা প্রহরের কথায় তাল মিলিয়ে বলেন,
“হুম আমারও এখন তাই মনে হচ্ছে। মানছি আমাদের মধ্যে ভালো সম্পর্ক নেই। কিন্তু এটা করার কোনো কারন ছিল না। তোর বাবা বলছিল যে প্রাচীর বিয়েতেই সব ঠিক করে ফেলবে। ওনাকেও দাওয়াত দেয়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু এখন দেখ! কি হয়ে গেলো! আমার মেয়েটা কিছুতেই ভুলতে পারছে না! এতো কষ্ট জীবনে কোনোদিন পায় নি ও!”

প্রহর~”মা তুমি চিন্তা করো না। আমি ওকে যতটা পারি বোঝাবো।”
মিসেস লারা~”তুই এখন ওর কাছে যা। একা রাখতে মন সায় দেয় না।”
প্রহর মিসেস লারার কথা মতো প্রাচীর ঘরে আসে। প্রাচী বিয়ের কার্ডটা ধরে কান্না করে যাচ্ছে। প্রহর কার্ডটা হাত থেকে নিয়ে পাশে থাকা ছোট ডাস্টবিনে ফেলে দেয়। প্রহরের এমন কান্ডে প্রাচী অবাক হয়ে বলে,
“কি করলি আপুনি?”
প্রহর~”ওটা নিয়ে কি সবাইকে দেখিয়ে বেরাবি নাকি? ডাস্টবিনেই পরে থাক। এখন শোন। কান্না কেন করছিস?”
প্রাচী~”আপুনি আমার কষ্ট হচ্ছে খুব। এসব আর নিতে পারছি না। আর কতো সইতে হবে বলতে পারো? জীবনের প্রথম ভালোবাসা কিভাবে ভুলবো?”
প্রহর প্রাচীকে নিয়ে সোফায় বসিয়ে দেয়। দুই বাহুতে হাত রেখে বলে,
“যেদিন একটা রাজপুত্র আসবে! আর সে পুরো দুনিয়াকে ভুলে যাবে শুধু তোর জন্য! দেখিস সেদিন আর বেশি দূরে নেই।”

প্রাচী~”আপুই এটা বাস্তব! কোনো রূপকথার গল্প না।”
প্রহর~”তোকে দেখার পর সেই রাজপুত্রের কাছে সবকিছুই রূপকথার মতো স্নিগ্ধ হয়ে যাবে।”
প্রাচী বোনের কথার কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না। সে তো ভেবেই নিয়েছে যে আয়ুসকে ভুলতে পারবে না। প্রহর প্রাচীকে চুপ থাকতে দেখে বেশ বিরক্ত হলো। বোনটা সব বোঝে। তো এটা কেন বোঝে না যে খারাপ সময়ের পরেই ভালো সময় আসবে!
প্রাচীকে এইসেই কথা বলে যাচ্ছে প্রহর। সেই সময় কেউ দরজায় কড়া নারল।
“আসতে পারি শালিকা?”
প্রহর আর প্রাচী দুজনেই সেইদিকে তাকালো। ফারহান এসেছে। সে ভিতরে ঢুকে বলল,
“কি কথা হচ্ছিল হুম?”
প্রাচী চুপ করে আছে। প্রহর বলল,
“বোকার মতো কান্না করে যাচ্ছে ও। আচ্ছা তুমি বলো ও কেন বুঝছে না যে আসল দোষী ভালো থাকতে পারলে ও কেন পারবে না?”

ফারহান প্রহরকে বলে,
“উহু প্রহর,একটু ভুল বললে তুমি। তোমার এই কথার সাথে একমত হতে পারলাম না!”
প্রহর মুখ বাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কেন কি ভুল বলেছি আমি? শুনি একটু!”
ফারহান~”আমার শালিকা কিন্তু মন থেকে ভালোবেসেছিল। আর ওই ছেলে কি যেন নাম? ওহ হ্যাঁ আয়ুস! ও মন থেকে বাসে নি। শুধু মোহ ছিল। যা এখন আরেকটা মেয়ের উপরে পরেছে। তাই আমার শালিকার কষ্ট বেশি হচ্ছে। কিন্তু এই মেয়ে শোনো?”
প্রাচীর দিকে তাকিয়ে ফারহান বলে,

“এখন কিন্তু এসব নিয়ে পরে থাকলে হবে না। জীবনটাই একটা ট্রাজেডি! কতো ঘূর্ণিপাকে পরতে হবে হিসেব নেই৷ একেকটা খারাপ সংবাদের সাথে হাজারটা ভালো সংবাদ পাবে। এখন ডিসিশন তোমার যে,কোনটা জরিয়ে থাকতে চাও!”
প্রাচী~”কেন?? কোনো ভালো সংবাদ আছে শুনি? আজকে সকালে নিজেক ভালোবাসার মানুষের বিয়ের কার্ড পেলাম। তাও দিয়ে গেলো তার হবু বউ। এরপর আবার আয়ুসের বাবা এসে দাওয়াত দিয়ে গেলো! আর কি সংবাদ পাবো?”
ফারহান~”সেটা বলবো। আগে আমার শ্বশুর মশাই আসুক বাসায়। এখন জামাই আদর কি পাবো না? নাকি পুরোনো হয়ে গিয়েছি? কোথায় যেন শুনেছিলাম শ্বশুরবাড়ি রসের হাড়ি! কিন্তু রস দূরের কথা হাড়িও পেলাম না! কি কষ্ট! এটার কাছে বাকি সব কষ্ট, দু:খ,বেদনা ফিকে!”

ফারহানের কথা শুনে কষ্টের মাঝেও প্রাচী হেসে দেয়। ফারহান মানুষটাই এমন! সবাইকে হাসাতে পারে। এটা তার একটা প্লাস পয়েন্ট। প্রাচীর এটা ভেবে ভালো লাগছে যে বোনটা তার মতো ভুল করে নি। ফারহানের সাথে প্রহরের নয় মাসের প্রেম ছিল। এরপর বিয়ে হয়৷ অনেক ভালো বাসে সে প্রহরকে। এক কথায় তার জীবন। প্রাচী তাদের দাম্পত্য জীবন দেখে ভাবতো যে তার আর আয়ুশের এমন একটা সংসার হবে। এখন সেসব মনে করলে রাগ হয় আবার হাসিও পায়। নিজের উপর হাসি পায়। নিজের ভাগ্যের উপর হাসি পায়!

প্রেমসাগরের উত্তাল ঢেউ পর্ব ১

রাতের খাবার শেষ করে সবাই ড্রয়িংরুমে বসে আছে। ফারহান আর প্রহর আজ যায় নি৷ মিস্টার ইজাজ শুধু একবার ফারহানকে শক্ত গলায় বলেছে যে আজ যেতে হবে না। ব্যাস! আর কিছু বলার সাহস পায় নি। তবে সে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার জন্য সবাইকে ড্রয়িংরুমে ডেকেছে। কেউ বুঝতে পারছে না ফারহান কি বলবে। কোনো ভালো খবর? কারন কোনো খারাপ খবর নেয়ার অবস্থায় কেউ নেই৷ বাইরে দিয়ে মিস্টার ইজাজ এবং মিসেস লারা নিজেদের শক্ত দেখাচ্ছে। কিন্তু ভিতরে ভিতরে কষ্ট থেকেই যায় তাদের।
মিস্টার ইজাজ ফারহানকে বলেন,

“কি বলবে তুমি?”
ফারহান আমতা আমতা করে বলে,
“আসলে…কিভাবে যে বলি?”
মিস্টার ইজাজ ~”বলো?”
এরপর ফারহান এমন একটা কথা বলে যা শুনে সবাই হা হয়ে যায়!

প্রেমসাগরের উত্তাল ঢেউ পর্ব ৩