প্রেমসাগরের উত্তাল ঢেউ পর্ব ৩ || লেখিকা-লাবিবা নুসরত

প্রেমসাগরের উত্তাল ঢেউ পর্ব ৩
লেখিকা-লাবিবা নুসরত

ফারহান সবাইকে জানায় যে প্রহর প্রেগন্যান্ট। সবাই ফারহানের কথায় হা হয়ে যায়। প্রাচীর সব কষ্ট কিছুক্ষণের জন্য দূর হয়ে যায়। সে বলে উঠে,
“সত্যি?? ইসসস আমার একটা চ্যাম্প পার্টনার হবে!”
মিস্টার ইজাজ ফারহানকে বললেন,
“ফারহান সব কথা পরে। আগে চলো মসজিদে গিয়ে নফল নামাজ পড়ি!”
ফারহান~”বাবা বাসায় পড়া যেতে পারে? আপনি হেঁটে এতো দূর যাবেন? নাকি গাড়ি নিয়ে? আমি আসলে আজকে গাড়ি আনি নি।”

মিস্টার ইজাজ ~”মসজিদ কাছেই৷ আর নামাজ সেখানে পড়লেই ভালো। চলো জলদি।”
তারা আর দেরি না করে চলে গেলেন। মিসেস লারা রাইমাকে বলল,
“রাইমা জলদি মিষ্টি আনো!”
সে ফ্রিজ থেকে মিষ্টি এনে টেবিলে রাখে। প্রাচী প্রহরকে সবার আগে খাইয়ে দেয়। প্রহর এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না। আসলে কিছুদিন ধরে তার শরির ভালো যাচ্ছিল না। তাই গতকাল ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল। প্রহর যেতে চায় নি ফারহান জোর করে নিয়ে গিয়েছিল।
নামাজ পড়ে কিছুক্ষণ পরে ফারহান আর মিস্টার ইজাজ বাসায় আসেন।
সবাই একসাথে রাতের খাবার শেষ করেন। সবাই বেশ খুশি খুশি। এই দু:সময়ে একটা ভালো খবর অন্তত পেয়েছে।
মিস্টার ইজাজ ফারহানকে বললেন,

“তোমার মা-বাবা জানে?”
ফারহান~”হুম জানিয়েছিলাম। তারা কালই আসবে।”
ইজাজ~”আচ্ছা ভালো। লারা এখন কিন্তু মেয়ের বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে বুঝেছো?”
মিসেস লারা~”এমন ভাবে বলছো তুমি যেন আমি কিছুই জানি না! তোমার এই দুই মেয়েকে বড় করেছি একা হুহ।”
ইজাজ~”আরে সেটা তো জানি। একটু না বললে কেমন দেখা যায় বলো?”
ফারহান~”বাবা? আমি ভাবছিলাম যে আরোহি নামের ওই মেয়েটার কথা। সরি, সবাইকে মনে করিয়ে দিলাম এই খুশির সময়। বাট এটা তো ফেলে রাখা যায় না। ঝামেলা যত তারাতাড়ি সম্ভব শেষ করতে হবে!”
মিস্টার ইজাজ~”জানোই তো, আমার ভাই জমিজমা নিয়ে আমার সাথে ঝামেলা করে। আল্লাহর রহমতে আমার যা আছে তা অনেক। ওইসব তো আমি চাই না। কিন্তু ও এমন করে যেন আমরা ওই শত্রু! ভেবেছিলাম প্রাচীর বিয়েতে দাওয়াত দিব৷ আর সব ঝামেলা মিটিয়ে ফেলবো।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মিসেস লারা~”কিন্তু তারা যা করেছে? সেটা নিয়ে কি বলবে তুমি?”
ইজাজ~”দেখো দোষ তো তাদের মেয়ে করেছে। তারা তো নির্দোষও হতে পারে!”
লারা~”এখন কি তুমি তাদের সুকন্যার বিয়েতে যাওয়ার প্ল্যান করছো? আমার মেয়ের থেকে এখন তোমার ভাই বেশি দরকারি হয়ে গেলো? এই বাড়িতে যেদিন এসেছি সেদিন থেকে অনেক কিছু সহ্য করেছি। কিন্তু এবার আমার মেয়েকে তারা কষ্ট দিয়েছে। বিয়েটা পরে করলে কি হতো শুনি? আবার আরোহি বিয়ের কার্ড দিয়ে যায়। এরপর আয়ুসের বাবা এসে কার্ড দিয়ে যায়! আর কতো কিছু সহ্য করতে হবে প্রাচীকে? ওকে কি মানুষ বলে গন্য হয় না?”
মিস্টার ইজাজ অবাক হয়ে বললেন,
“আলতাফ সাহেব এসেছিলেন? কখন?”
প্রহর~”আজ বিকালে। তুমি বাইরে গিয়েছিলে।”
প্রাচীর এসব ভালো লাগছে না। ঘুরেফিরে সেই একই কথা! ওই একই ঘটনা! সে চুপচাপ হাত ধুয়ে উঠে যায়। সবাই প্রাচী যাওয়ার পরে চুপ হয়ে যায়। তারা বুঝতে পেরেছে যে প্রাচী এই কথাগুলোতে কষ্ট পেয়েছে।

নিজের ঘরে শুয়ে আছে প্রাচী। সন্ধার দিকে প্রহরের প্র‍্যাগন্যান্সনির কথা শুনে সব কষ্ট কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে গিয়েছিল। রাতের আঁধারে সেই কষ্ট এসে বাসা বেঁধেছে তার মনে। এই রাতগুলোই সবথেকে বেশি কষ্টকর মনে হয় প্রাচীর কাছে। সে নিজেকে সামলাতে পারে না। আজও এমনটাই হয়েছে। একমনে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে সে। খোলা জানালা দিয়ে বাইরের রাতের আকাশ দেখা যাচ্ছে। ঘড়িতে তখন প্রায় সারে বারোটার কাছাকাছি।

অনেকদিন হলো ফোনটা ভালোমতো ধরা হয় না। ফেইসবুকে শেষ পাঁচ মাস আগে লগ ইন করেছিল। আজ অনেকদিন পরে প্রাচী ফোনটা ভালো মতো ধরলো। আজকে শুধু একজনই কল করেছে। আর সে হলো প্রাচীর ফ্রেন্ড। খুব ভালো ফ্রেন্ড না হলেও মাঝে মাঝে কথা হতো। মেয়েটার নাম আরিয়া। একমাত্র ওই জানতো যে প্রাচীর বিয়ে ঠিক হয়েছিল। আসলে বেশি কাউকে জানানোর টাইম পায় নি। আর ভার্সিটি লাইফের এই একটাই ফ্রেন্ড আছে তার। খুবই ঘরকোনা মেয়ে সে।

প্রাচী ভাবলো এতো রাতে কল করা ঠিক হবে না। তাছাড়া শুধু একবার কল করেছে। জরুরি কিছু বোধহয় না। সে এবার ফেইসবুকে লগ ইন করলো। কয়েকটা মেসেজ এসেছে মাত্র। এই ফেইসবুক জিনিসটা প্রাচীর ভালো লাগে না। এখানে একদমই এক্টিভ থাকে না সে। শুধু যুগের সাথে তাল মেলাতেই ব্যাবহার করা। ভার্চুয়াল লাইফ থেকে রিয়েল লাইফটা বেশি প্রয়োজনীয় বলে মনে করে সে। কিছুক্ষণ ফেইসবুক স্ক্রল করার পর একটা পোস্ট তার সামনে এলো। আরোহির রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস। সেখানে আয়ুসকে মেনশন করে লিখা এংগেইজড! এটা দেখার পর চোখ বেয়ে নিজের অজান্তেই জল গরিয়ে পরলো প্রাচীর। এই ব্যাপারটা ভুলবে কিভাবে সে? যতবার এসব থেকে নিজেকে দূরে রাখতে চেয়ে ঠিক ততবার আরও কাছে এসে পরেছে। ফোনটা সুইচ অফ করে পাশে রেখে দিয়ে হাটুগেরে কান্না করতে লাগলো প্রাচী। একই সাথে মনে পরে গেলো সেই সোনালী রঙের দিন গুলোর কথা! কতোটাই না খুশি ছিল সে!

_______________আট মাস আগে_____________
সুন্দর করে সেজে কোথাও যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে প্রাচী। প্রাচীর রুমেই বসে ছিল প্রহর। বেরাতে এসেছে। প্রাচীকে সাজতে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
“কিরে? এতো সেজে কোথায় যাচ্ছিস তুই?”
প্রাচী মুখটা বাকা করে বলে,
“একটু শাড়ি পড়েছি আর চোখে কাজল দিয়েছি। তাতেই তোর মনে হচ্ছে আমি এতো সেজেছি? তুই বিয়ের দিন কেমন সেজেছিলি রে? হুহ! আমাকে নিয়েই পারিস। একটা ইনোসেন্ট বোন পেয়েছিস দেখে এমন করতে হবে? একটু সাজতেও পারবো না তোর জন্য!”
প্রহর চোখ গুলো বড় করে বলে,

“তুই ইনোসেন্ট? আল্লাহ! যাইহোক এখন ঝামেলা করার মুড নেই। বল কোথায় যাওয়া হচ্ছে হুম?”
প্রাচী প্রহরের একদম কাছে এসে বসে। লজ্জা মাখা মুখ নিয়ে বলে,
“আপুনি শোন! আমাদের ভার্সিটির প্রাক্তন স্টুডেন্ট আয়ুস। আমার না ওকে অনেক পছন্দ! আজ একটা অনুষ্ঠান আছে৷ সেটায় দেখি ও আসে কিনা। তাহলে আমি বলে দিব।”
প্রহর অবাক হয়ে বলল,
“তলে তলে এতো কিছু চলে? ছেলে কি করে? ওর ব্যাপারে কিছু জানিস?”
প্রাচী~”শুনেছি আমি। নাম আয়ুস শরীফ। ওর বাবা একজন সরকারি কর্মকর্তা। আর আয়ুস নিজে একটা জব করে। এর থেকে বেশি কিছু জানি না! বাট আমি ভালোবাসি।”
প্রহর~”হঠাৎ করে ভালোবাসা হয়ে গেলো নাকি? ফারহানের সাথে সম্পর্কে যেতে এক বছর লেগেছিল। এরপর নয় মাস প্রেম। আর তোর ব্যাপারটা বুঝলাম না?”

প্রাচী~”আমি প্রথম ওকে রাস্তায় একটা বুড়ো মহিলাকে সাহায্য করতে দেখেছিলাম। এরপর ভার্সিটিতে আমাদের বিদায় অনুষ্ঠানেও দেখেছি। আস্তে আস্তে কিভাবে যে ভালোবেসে ফেললাম!”
দুই বোন কথা বলছিল এরমধ্যেই মিসেস লারা চলে আসেন। প্রাচীকে দেখে বলেন,
“ওহ তুই তো দেখি শাড়ি পড়েই আছিস। ভালো। তা পড়েই বসে থাক৷ ঠিক আছে?”
প্রাচী ভ্রু কুচকে বলল,
“বসে থাকবো মানে?”
মিসেস লারা~”মানে হলো পাত্র পক্ষ তোকে দেখতে আসবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে ওরা।”
প্রাচী অবাক হয়ে গেলো মায়ের কথা শুনে। পাত্র পক্ষ আসবে মানে! জানা নেই শোনা নেই হুট করে দেখতে চলে আসবে? প্রাচী বলে,

“মা এসবের মানে কি? আমি বিয়ে করবো না! আর আমাকে না জানিয়ে আদিম কালের মতো বিয়ে ঠিক করে ফেললে?”
মিসেস লারা বিরক্ত হয়ে বললেন,
“আমি কি জানতাম নাকি? আজ সকালেই তোর বাবা বলেছে। আর সে এটাও বলেছে যে ছেলে তোর পছন্দ হলে তবেই বিয়ে। এখন ঝামেলা করিস না মা। আমি যাই। ওদিকে আবার কাজ আছে। রান্না বাকি।”
মিসেস লারা চলে গেলেন। প্রাচী মুখ ভারি করে বসে পরলো।
“দেখেছিস আপুনি? কার এমন সহ্য হয় বলতো?”
প্রহর~”আহা! প্রাচী! মন খারাপ করছিস কেন?”
প্রাচী~”তো কি এখন আমি নাচবো?”
প্রহর~”আমি বলেছি? আর দেখতে আসবে শুধু। বিয়ে তো আর হয়ে যাচ্ছে না। তুই বলে দিবি ছেলে তোর পছন্দ না ব্যাস!”
প্রহরের কথা শুনে প্রাচী কোনো উত্তর দিল না। বরং আগের মতোই মুখটা গোমরা করে বসে রইলো। চোখের কোনে পানি জমেছে। আয়ুসকে কি তবে আর বলা হবে না ভালোবাসার কথা!

প্রেমসাগরের উত্তাল ঢেউ পর্ব ২

পাত্র পক্ষের সামনে বসে আছে প্রাচী৷ মুখটা আগের মতোই ভার। আর মন ভরা কষ্ট। ছেলের দিকে তাকাতেও ইচ্ছা করছে না। তাক দেখতে নাকি দুজন এসেছে। ছেলে আর তার বাবা। প্রাচী মনে মনে ইচ্ছা মতো ছেলেটাকে ধোলাই দিচ্ছে। এখন এখানে থাকতেও ইচ্ছা করছে না। আবার উঠে যেতেও পারছে না। হঠাৎ প্রহর বলল,
“কিরে প্রাচী? সামনে তাকিয়ে ছেলের মুখ না দেখলে কিভাবে হবে?”
সবাই তাকে বলল ছেলের দিকে তাকাতে। তাই বাধ্য হয়ে অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সে সামনে তাকালো। আর তাকাতেই দেখলো একটা ছেলে মুখে ক্যাবলা মার্কা হাসি দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে!

চলবে ইনশাআল্লাহ,,,,,,,,,,,,,,,

(আজ থেকে অতিত পর্ব শুরু। আগামী কয়েক পর্ব অতিত নিয়ে হবে)
বি.দ্র.কয়েকজন বলছেন যে গল্পের চরিত্রের নাম দিয়ে সমস্যা। প্রাচী, প্রহর এটা নিয়েই বেশি। প্রথমত প্রহর নাম। এটা নাকি ছেলেদের নাম হয়ে গিয়েছে। আর এরপর প্রহর নামটা নাকি একদম নেই! আমি অনেক শুনেছি এই নাম। আর প্রাচী নামতো মেয়েরই হয়। অন্তত আমার জানা মতে। একটা নাম কিছুটা ছেলেদের মতো হয়েছে। সেটা হলো “প্রহর”। এই একটা নাম যে মেয়ের সেটা তো মুখস্থ হয়ে যাওয়ার কথা তাই না??
আশা করি বুঝতে পেরেছেন আমি ইউনিক নাম নেয়ার চেষ্টা করেছি।
সবাই ভালো থাকবেন। আর গল্পের বিষয়ে কোনো প্রশ্ন থাকলে করতে পারেন।

প্রেমসাগরের উত্তাল ঢেউ পর্ব ৪