ফেরারি প্রেম পর্ব ১২

ফেরারি প্রেম পর্ব ১২
নিশাত জাহান নিশি

“আরে ঐযে একদিন আমাকে হেল্প করেছিলেন। কয়েকটা গু’ণ্ডা ছেলের হাত থেকে আমাকে বাঁচিয়ে ছিলেন!”
গভীর চিন্তায় ডুব দিলো সুহাসিনী। অতিব মনোযোগের সহিত সে অতীত ঘাটতে লাগল। তার স্মৃতি ধারণ ক্ষমতায় যতটুকুনি স্মরণে আছে সে এর আগে কখনও নীহারিকাকে দেখেনি! না কখনও কোনো গু’ন্ডা ছেলেদের হাত থেকে তাকে বাঁচিয়েছে। মাথায় হৈ হট্টগোল লেগে গেল সুহাসিনীর। এদিকে নীহারিকার কথাও সে ফেলতে পারছেনা! কী এক মহা জ্বালা।

চোখে ছলছল জল নিয়ে নীহারিকা কেবল অসুস্থ সুহাসিনীকে দেখছে! পুরো দেহ তার সাদা চাদরে ঢাকা। ছবিতে দেখা সুহাসিনীর সাথে বাস্তবে দেখা সুহাসিনীর কোনো মিল-ই খুঁজে পাচ্ছেনা সে! মোলায়েম দেখতে চকচকে ফর্সা ত্বকটা এখন কুচকুচে কালো বর্ণ ধারণ করেছে! শরীরের সাথে সাথে মুখের কিছু কিছু অংশও কুচকে গেছে! নীহারিকার মানতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে যে এটাই সুহাসিনী। বাইরের একটা থার্ড পার্সন হয়ে সুহাসিনীর জন্য তার এতটা কষ্ট হচ্ছে না জানি রূপল আর সুহাসিনীর পরিবারের তার জন্য কতটা কষ্ট হচ্ছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মাথায় প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে সুহাসিনী এখনও চেষ্টা করছে নীহারিকাকে মনে করার। তবে কিছুতেই যেন কিছু মনে পড়ছেনা তার। সুহাসিনীর এই ধরাশায়ী অবস্থা দেখে নীহারিকা গলা ঝাকালো। কয়েক দফা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে নিজেকে সামলে নিলো। সুহাসিনীর দিকে খানিক এগিয়ে এসে ধীর গলায় বলল,

“থাক না আপু। মাথায় এত প্রেশার দিতে হবেনা। এই ঘটনাটা আরও কয়েক বছর আগে ঘটেছে তো তাই হয়ত কোনোভাবে এই ঘটনাটা আপনার মাথা থেকে বেরিয়ে গেছে। তবে কী জানেন? আপনাকে আমার এখনও মনে আছে। অনেক কষ্টে আপনার ঠিকানাটা জোগাড় করে আপনার সাথে দেখা করতে আসা। আপনি যদি আমার সাথে একটু কথা বলতেন। আমার ভালো লাগত।”

সুহাসিনী তার নিছক ভাবনাচিন্তা থেকে বেরিয়ে এলো। ছোটো ছোটো চোখে সে নীহারিকার দিকে তাকালো। মিহি গলায় বলল,
“দেখছই তো আমি কতটা অসুস্থ? কথা বলতে বড্ড বেগ পেতে হয় আমার। তবুও আমি চেষ্টা করব তোমার ভালো লাগাকে প্রাধান্য দেওয়ার!”
অমনি নীহারিকা বেশ কৌতূহল নিয়ে সুহাসিনীর দিকে প্রশ্ন ছুড়ল,

“আচ্ছা আপু আপনি এত অসুস্থ হলেন কীভাবে? কে করেছে আপনার এই অবস্থা?”
নীহারিকার কঠিন প্রশ্নে হিমশিম খেয়ে গেল সুহাসিনী। আমতা আমতা গলায় সে প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলল,
“আমি কিন্তু তোমাকে এখনও চিনতে পারিনি। তোমার আসল পরিচয়টা বলবে প্লিজ? না-কী কেউ তোমাকে পাঠিয়েছে?”
আর এক মুহূর্ত দেরী না করে সুহাসিনীর সন্দেহ আটকাতে নীহারিকা বেডের পাশে চেয়ার টেনে বসল। সুহাসিনীর ডান হাতটা মোলায়েমভাবে ধরে সে জোরপূর্বক হেসে বলল,

“আরে না না আপু। আমাকে আবার কে পাঠাবে? আমি সত্যিই নিজ থেকে আপনাকে দেখতে এসেছি। জানেন কত খুঁজেছি আপনাকে? শুধু আপনাকে একটি বার থ্যাংকস বলার জন্য। তাছাড়া আপনি এত ভয় পাচ্ছেন কেন আপু? আপনার কী এমন কোনো শত্রু আছে যাকে আপনি ভয় পাচ্ছেন? ভাবছেন সে আপনার ক্ষতি করার জন্য আমাকে পাঠিয়েছে?”
মুহূর্তেই সুহাসিনী বেশ ঘাবড়ে ওঠা গলায় বলল,
“না না। আমার কোনো শত্রু নেই! তবে তোমাকে দেখে আমার খুব অস্বস্তি হচ্ছে! প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড।”
গম্ভীর মুখভঙ্গি নিয়ে নীহারিকা বলল,

“তাহলে কী আমি চলে যাব আপু?
নীহারিকার বিষন্ন মুখের দিকে তাকিয়ে সুহাসিনী কেমন যেন গলে গেল। না চাইতেও সে আদুরে গলায় বলল,
“আচ্ছা থাকো। তবে আমার পার্সোনাল বিষয় নিয়ে কিছু জানতে চেয়ো না প্লিজ।”
“আচ্ছা ঠিক আছে। আপনার সেই বোনের মেয়েটা কোথায় আপু? কী যেন নাম ছিল তার?”
“হৃদি?”

“হ্যাঁ হৃদি। কেমন আছে সে?”
“ভালো আছে। আমার দুনিয়া সে।”
“তোমার তো একটা বয়ফ্রেন্ড ছিল তাইনা? সে এখন কোথায়?”
অমনি হাসিখুশি মুখখানি চুপসে গেল সুহাসিনীর। বিষন্নতার কালো মেঘ ছেঁয়ে গেল দু’চোখে। দৃষ্টি নামিয়ে সে ভরাট গলায় বলল,

“তার সাথে এখন আর আমার কোনো সম্পর্ক নেই! এ বিষয়ে কোনোকিছু জিজ্ঞেস না করলেই আমি খুশি হব।”
“তোমার সাথে কথা বলে খুব ভালো লাগল আপু। আজ তবে উঠি?”
“তুমি কী রাগ করলে?”
“না আপু৷ আসলে আমার একটু তাড়া আছে। কাল ঠিক এই সময়ে আবার আসব কেমন?”

সুহাসিনীর থেকে বিদায় নিয়ে নীহারিকা এনজিও থেকে বের হয়ে গেল। যাওয়ার সময় সুহাসিনীর মাথায় অনেক প্রশ্ন ভিড়িয়ে দিয়ে গেল নীহারিকা! কে এই নীহারিকা? যে তার বোন জি এবং রূপল সম্পর্কেও সব জানে? তার সাথে কী এতই ক্লোজ ছিল সুহাসিনী? তার সব ব্যক্তিগত ব্যাপারও মেয়েটিকে জানিয়েছিল?
নীহারিকার উদ্দেশ্যই যেন ছিল সুহাসিনীকে তার প্রতি কৌতূহলী করে তোলা! তাকে জানার আগ্রহকে দ্বিগুন বাড়িয়ে তোলা। তবেই তো নীহারিকা পারবে সুহাসিনীর মনের ভেতর ঢুকতে! লুকিয়ে রাখা সব রহস্যকে টেনে বের করতে।
গেইটের বাইরে বের হতে অমনি রূপল ছুটে এলো নীহারিকার দিকে। উদ্বেগী গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,

“কী বলল সে? আমার সাথে দেখা করতে রাজি?”
“এই বিষয়ে কোনো কথা বলিনি এখনও।”
“মানে? তাহলে তোমাকে পাঠিয়েছিলাম কেন?”
“একদিনের পরিচয়েই তো সব কথা বলা যায়না। সময় দিতে হয়।”
“কী বলতে চাইছ তুমি হ্যাঁ? আর কত সময় লাগবে তোমার?”
“কী আশ্চর্য! আপনি বুঝতে চাইছেন না কেন? একটা মেয়ে এত সহজেই কী পারে কারো সাথে এতটা ফ্রি হতে? তাছাড়া আমি যতটুকু বুঝতে পেরেছি সুহাসিনী আপনার বিষয়টা এড়িয়ে চলতে চায়। খোলসাভাবে কিছু বলতে চায়না। তাই আমিও তেমন ফোর্স করিনি। আমরা যখন একটু ফ্রি হব তখন সুহাসিনী নিজ থেকেই আপনার ব্যাপারে সব খুলে বলবে। সেই বিশ্বাস আমার আছে।”

“তাহলে কত সময় লাগবে তোমার?”
“তা তো বলতে পারছিনা।”
“ধ্যাত! তোমার কাছে হেল্প চাওয়াটাই আমার ভুল হয়েছে!”
বলেই রূপল তিরিক্ষিপূর্ণ মেজাজ নিয়ে জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো। নীহারিকাকে একা ফেলে রেখে সে বাইক নিয়ে কোথায় যেন মিলিয়ে গেল। রূপলের উগ্রতায় নীহারিকা বড্ড কষ্ট পেল! মন খারাপ করে সে পায়ে হেঁটেই বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো।

ঘড়িতে তখন রাত নয়টা। নীহারিকা পড়ার টেবিলে বসে গল্পের বই পড়ছিল। অমনি সে তার রুমে দ্বিতীয় কারো উপস্থিতি টের পেল। ঝট করে নীহারিকা পিছু ঘুরে তাকালো। বিধ্বস্ত অবস্থায় রূপলকে দেখামাত্রই সে আঁতকে উঠল! ক্লান্ত, অবসন্ন, অগোছালো রূপল যেন শক্তির অভাবে ঢুলেঢুলে পড়ছিল। ছুটে এসে নীহারিকা রূপলের মুখোমুখি দাঁড়ালো। তড়িৎ বেগে প্রশ্ন ছুড়ল,

“কী হয়েছে আপনার? এমন নিস্তেজ দেখাচ্ছে কেন আপনাকে?”
নাক টেনে রূপল মাথা নুইয়ে নিলো। প্রত্যত্তুরে নীহারিকাকে বলল,
“সরি!”
“সরি ফর হোয়াই?”
“সকালের ব্যবহারের জন্য।”
“সারাদিন পাড় হয়ে এখন আপনার মনে হলো আমাকে সরি বলা উচিৎ?”

“আসলে আমার মাথা ঠিক নেই। কী করছি না করছি কিছুই বুঝতে পারছিনা। সত্যি বলতে আমি আর পারছিনা সুহাসিনীকে ছাড়া থাকতে। দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার।”
তব্ধ শ্বাস ফেলল নীহারিকা। শান্ত গলায় রূপলকে বলল,
“আপনি এত ভেঙে পড়ছেন কেন রূপল? সুহাসিনী যদি আপনার ভাগ্যে থাকে তো যেকোনো পরিস্থিতিতেই সে আপনার হবে। স্বয়ং সুহাসিনীও এই সম্পর্কটাকে ভাঙতে পারবে না।”

“ধৈর্যে আর কুলাচ্ছেনা। কী করব বলুন?”
“মাথা ঠাণ্ডা রাখুন। দেখবেন সব ঠিক হয়ে গেছে।”
“আচ্ছা থাকুন। আমি যাই।”
নীহারিকাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই রূপল বাড়ি থেকে প্রস্থান নিলো। রূপলের যাওয়ার পথে তাকিয়ে নীহারিকা অস্থির শ্বাস ফেলে বলল,

“কী অদ্ভুত মানুষ। দু’দণ্ডের জন্যও এক জায়গায় থামেনা। অথচ এক নারীর ভালোবাসায় আসক্ত হয়ে গোটা জীবনটাকেই থামিয়ে রেখেছে!”
এরমধ্যেই নীহারিকার ফোন বেজে উঠল। তড়িঘড়ি করে নীহারিকা কলটি তুলতেই ঐ পাশ থেকে নাজনীন বেগম নীহারিকাকে বললেন,
“নীহা আমি তোমার আন্টি বলছিলাম। রূপল কী তোমাদের বাসায় এসেছে?”
“এসেছিল আন্টি। এখন আবার চলে গেছে।”
“আমার একটা হেল্প করতে পারবে মা?”
“কী হেল্প আন্টি?”

“রূপলের জন্য একটা মেয়ে দেখেছিলাম। কিন্তু রূপল কিছুতেই মেয়েটার সাথে দেখা করতে চাইছেনা। তুমি কী পারবে তাকে একটু রাজি করাতে? এখন যেহেতু তোমার সাথে রূপলের ভালো সম্পর্ক তাই তোমার কাছে প্রস্তাবটা রাখা।”
হতবাক হয়ে গেল নীহারিকা! অধীর গলায় প্রশ্ন বলল,
“আন্টি আপনি কী সুহাসিনীর ব্যাপারে কিছুই জানেন না?”
“ওহ্। তুমিও সব জেনে গেছ?”

ফেরারি প্রেম পর্ব ১১

“আন্টি প্লিজ এমনটা করবেন না। দুজন ভালোবাসার মানুষকে এভাবে আলাদা করবেন না।”
“আমি আমার ছেলেকে সুখী দেখতে চাই আর কিছুই না। তুমি আমার হেল্প করতে পারবে কী-না বলো?”

ফেরারি প্রেম পর্ব ১৩