হৃদমাঝারে তুমি পর্ব ৬

হৃদমাঝারে তুমি পর্ব ৬
সাইয়ারা মম

যদিও ঘটা করে আয়োজন করা হবে না তারপরও যেহেতু সমাজে নেহাল আর আরফান একটা উচ্চ পদে আছে তাই আয়োজন তো একটু হবেই।রেবেকার বাড়িতে এখনই আত্মীয় আসা শুরু করে দিয়েছে।পিয়াস তো সব সময়ই নেহালদের বাড়ির বাসিন্দা।রেবেকা একা সব কিছু সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে।তাই পিয়াসের মাও ওদের বাসায় এসেছে।তিনি আর রেবেকা রান্নাঘর সামাল দিচ্ছে আর সারভেন্ট গুলো ঘরের অন্য কাজগুলো করছে।পিয়াস সোফায় বসে ফোন দেখছে।ওর মা রান্নাঘর থেকে চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে বলে

-বুঝলে ভাবি মেয়ে যে একটা কী পূণ্যের জিনিস তা বুঝবে না।আর ছেলে (বলে এক নজর পিয়াসের দিকে তাকিয়ে) ছেলে হলো অকর্মার ঢেকি
পিয়াস ওর মায়ের কন্ঠে ছেলেদের বিরোধিতা শুনে ফোন রেখে দিল।কান খাড়া করে শুনতে লাগল ওর মা কি বলে
-মেয়েটা আমার দেশে থাকতে আমাকে কাজে কতই না সাহায্য করত।বিদেশে চলে যাওয়ার পরে দেখো আমি কত একা হয়ে পড়েছি
-কেন ভাবি পিয়াস তো আছেই
পিয়াসের কথা শুনে ওর মা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-ছেলে হয়েছে বলে কি মাথা কিনে নিয়েছে?মানুষ ছেলেদের এত বেশি পছন্দ করে কারণ বুড়ো বয়সে তাদের যাতে দেখাশোনা করতে পারে।আর আমার নবাবজাদাকে দেখো সারাদিন পায়ের ওপরে পা তুলে ফোন চালায়
পিয়াস আস্তে করে সোফা থেকে উঠে দাড়ালো।তারপর একপা একপা করে সরে যেতে লাগল।কিন্তু মায়ের চোখ কি ফাকি দেওয়া যায়!
-এই কোথায় যাচ্ছিস? এইদিকে আয়, এই দিকে আয়।
পিয়াস যা বোঝার বুঝে গেছে।শেষ,,,,,,, ও এবার শেষ।মুখটা বিরষ করে রান্না ঘরে এগিয়ে গেল।বলল

-কি মা?ডাকলে কেনো?
-নে এই তরকারিটা ধুয়ে দে
ওর মুখটা এতটুকু হয়ে গেল।যে বয়সে এক ভাইয়ের বিয় হচ্ছে সেখানে তাকে এখন তরকারি ধুতে হবে?
-আরে ভাবি ওকে ধুতে বলছো কেন?লতাকে ডাকি ও করবে এসব।
-তুমি চুপ করোতো ভাবি।তোমার আশকারা পেয়ে ও দিন দিন মাথায় উঠছে।যতদিন না দিবা বাড়ি ফিরছে ততদিন ও আমাকে সাহায্য করবে।খুব বড় গলায় বলে
আমি ছেলে,,,,,,আমার অধিকার বেশি।

-তা ভাবি নেহাল আরফানের সাথে ওর বিয়েটা দিয়ে দিলেই পারো।তোমার ঘরেও একজন মানুষ থাকে আর পিয়াসও ঘরে থাকে।
রেবেকার কথা শুনে পিয়াস এর ঠোট চওড়া হয়ে গেল।চকচকে দাত গুলো বের হলো।মনে হয় যেন ক্লোজ আপের এড দিতেছে।রেবেকার পেছনে গিয়ে তার আচল ধরে বলল
-বড়মা একমাত্র তুমিই আমাকে বুঝো।জানো মাকে বি,,,,,,,,
বলে ওর মায়ের দিকে তাকাতেই কথা বন্ধ হয়ে গেল

-বড়মা তো বুঝবেই।বড়মায়ের ছেলেরা তো তাকে সব দেয়। আর নিজের দিকে তাকা।বলেছি নেহালের সাথে বিসিএস টা দে।নাহ্ উনি তা দেবে না।উনি কি করবে,,,,,,,উনি ছবি তুলবে।হয় দেখবে রাস্তায় বসে বিড়ালের ছবি তুলবে না হয় বাগানো বসে পোকার ছবি তুলবে।কি হয়েছে টা কি ফটোগ্রাফার হয়ে?
তোকে কেউ ছবি তুলতে নিষেধ করেছে?তুই তুলবি কিন্তু বিসিএস দিলে কি হতো?দেখ নেহাল এখন একটি ভার্সিটির টিচার আর তুই

-আহ ভাবি।এখন এসব কথা রাখো।ভাইদের বিয়ে,আনন্দ করতে দাও।পিয়াস যা তো নেহালের কাছে যা।
পিয়াস প্রথম দিকে সিরিয়াস ভাবে নেয় নি বিষয় টা।কিন্তু ওর মা শেষদিকে কড়া কথা বলায় মনটা খারাপ হয়ে গেল। আচ্ছা সরকারি চাকরি ই কী সব?বিসিএস ও দিতে পারত আর দিলে ওর চান্স ও হতো।কিন্তু তখন কী আর ফটোগ্রাফিটাকে অতটা গুরুত্ব দিতো?ও তো এইটাকে প্রফেশন হিসেবে নিতে চায়। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল যে করেই হোক ও ওর প্রফেশনটাকে আয়ত্ত করবেই।ফোনটা বের করল গুগলে সার্চ করতে যে কীভাবে ভালো ফটোগ্রাফার হওয়া যায়।কিন্তু ডাটা অন করতেই নোটিফিকেশন আসল
বিদিশা চৌধুরি একসেপ্টেড ইওর ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট।মেসেন্জারে গিয়ে দেখল

-এই যে ইংরেজী ষাঁড় বিয়ের শপিং কখন করবেন?
-কেন কেন?
-না ছেলে পক্ষ তো মেয়ে পক্ষের শপিং করে দেয় তাই জিজ্ঞেস করলাম
-ইস কী লোভী মেয়ে
-হাহ্ ভয় দেখিয়ে লাভ নাই।শপিং এ আসেন তারপর দেখাবো ভয় কাকে বলে?
এরকম কথা বলতে বলতে আধাঘন্টা কেটে গেল।ফোনের চার্জ লো হওয়ার ফলে ফোন চার্জে দিল।তারপর তার হঠাৎ মনে হলো যে সে গুগলে সার্চ দেওয়ার জন্য ফোন হাতে নিয়েছিল।

পিহুদের বাড়িতে আত্মীয়তে ভরে গেছে।তুলির নানাবাড়ি থেকেই এসেছে গোটা দশেক। আন্ডা বাচ্চা সবাই সারাদিন চেঁচামেচি করে।হঠাৎ করেই তুলির মায়ের ব্যবহার পাল্টে গেল।মিহুকে দিয়ে রান্না করাটা বাদ দিল।মিহু অবাকের ওপরে অবাক।চাচি এত ভালো হলো কবে থেকে।আজকে বাড়ির সবাই মেহেদী পড়বে।পরসু ছোট করে নিজেরা গায়ে হলুদ করবে।তারপরের দিন বিয়ে।মিহুর এসব নিয়ে মাথা ব্যাথা নেই।তবে তাকে দেওয়া হয়েছে মেহমানদের দায়িত্ব।
সন্ধ্যার পরে বিপাশার জোরাজুরিতে মিহু সবাইকে মেহেদী পরাচ্ছে।তুলি ওর হাত থেকে পরতে নারাজ।কারণ ও পার্লার থেকে পরবে।পিহু তার বোনের হাত থেকে মেহেদী পড়ে নিচ্ছে।বিদিশা মিহুর মেহেদী পড়ানোর কয়েকটা ছবি নীলুকে পাঠালো।

নীলু ভাইয়ের জন্য কয়েকটা পাঞ্জাবি সেলেক্ট করেছে।হঠাৎ বিদিশার মেসেজ দেখল।দেখে আরফানের ঘরে গেল। আরফান তার প্রডাক্টের জন্য ফাইল রেডি করছে।নীলু দরজা নক করে বলল
-ভাইয়া আসবো?
-তুই আবার কবে থেকে দরজা নক করতে শুরু করলি।আয় ভেতরে।
-আর কয়েকদিন পরে তোমার বৌ আসবে ঘরে তখন তো আমার পারমিশন নিয়েই ঢুকতে হবে তাই না?

-তোর জন্য আমার রুমে ঢুকতে পারমিশন নেওয়া লাগবে না।কি জন্য এসেছিস বল
নীলু আরাম করে সোফায় বসল।তারপর বলল
-ভাইয়া আমার আইডিতে প্রবলেম হচ্ছে।বিদিশার সাথে একটু কথা বলতে হবে।তোমার ফোনটা দাও
-এটা কি বলে নিতে হয়?তুই নিয়ে নিলেই তো হয়।
-ফোনের পাসওয়ার্ড কী
আরফান একটু হেসে বলল-নীলু
নীলু বিদিশাকে ফ্রেন্ড বানিয়ে ভিডিও কল করল।তারপর ব্যালকনিতে গিয়ে অনেক্ষণ কথা বলল।কথা শেষে ফোনটা আরফানের পাশে রেখে চলে গেল।কিচ্ছুক্ষণ পরে আরফান ফারিশকে ফোন দেওয়ার জন্য ফোন হাতে নিতেই দেখে এখনো ভিডিও কল চালু

-নীলুও না কি যে করে
বলে ফোনটা কাটতেই যাবে কিন্তু কোনোকিছু দেখে ও ভিডিও কলটা দেখতে লাগল।বিপাশা যখনই মিহুকে বলল- আপু নাও নীলুর সাথে কথা বলো
তখনই আরফান ওর ক্যামেরা অফ করে দিল।মিহু হাসি মুখে ফোনটা নিল।তারপর নীলুকে সালাম দিয়ে বলল
-এই যে নীল পরি কেমন আছো?ঐ দিনতো আমাকে বোকা বানিয়ে চলে গেলে।তারপর তো আর কোনো খবরই নাই।
আরফান কিছু বলছে না।শুধু মিহুকে দেখছে,কিন্তু কেন সেটা বুঝতে পারছে না।বাসায় বসে আছে তবুও মাথায় ঘোমটা।এক কথায় মিহুকে দেখতে আসলেই সুন্দর লাগছে।

-এই নীলু শোনো তুমি নাকি মেহেদী দেওয়া দেখতে চেয়েছিলে তাহলে এখন দেখো।আমি আমার কাজিনকে পরিয়ে দিচ্ছি।কল কেটো না কিন্তু ঠিক আছে।
মিহু যতক্ষণ পর্যন্ত মেহেদী দিচ্ছিল ততক্ষণ ই ও মিহুকে দেখছিল।হঠাৎ করেই ফারিশের ফোন আসায় কলটা কেটে দিয়ে ফারিশের সাথে কথা বলতে লাগল
-শা*লা কোথায় মরে গিয়েছিস?বিয়ের কথা শুনে কি এখন সব ভুলে গিয়েছিস
বিয়ের কথা শুনে আরফানের স্মৃতিতে মিহুর অবয়ব ভেসে উঠল।

-আবার কোথায় গিয়েছিস?
-না কোথাও না।বল কি বলবি
-কি বলবি মানে?তুই না সন্ধ্যার সময় বলেছিলি যে ফাইলটা রেডি হলে আমাকে ঐটার একটা স্ক্যান কপি পাঠাবি?
-হুম।তা রেডি করতে সময় লাগবে না?
-কতক্ষণ সময় লাগবে?রাত দশটা তো বেজে গেলো
আরফানের চক্ষু চড়কগাছ।যেখানে ও টাইম টু টাইম কাজ করে সেখানে সে এত দেরি করে ফেলল কীভাবে?মিহুকে দেখতে দেখতে এত সময় চলে গেল?

-আর আধা ঘন্টা পরে দিচ্ছি
-ওকে
রাত এগারোটা বেজে বিশ মিনিট। আরফান ভাবছে সে কি পাগল হলো?যেখানে সে নীলু ছাড়া অন্য কোনো মেয়েকে সহ্য করতে পারে না সেখানে মিহুকে দেখে কীভাবে কয়েকঘন্টা কাটিয়ে দিল?আসলে এই মেয়ের মাঝে আছে কী?
আরফানের মায়ের সাথে আকবরের বিয়ে হয়েছিল পারিবারিক ভাবেই।তাদের সংসার ভালোই চলছিল। আরফান হওয়ার দশ বছর পরে নীলু ওর মায়ের গর্ভে আসে।

অনেক খুশি ছিল আরফান।কিন্তু একটা ঘটনা সব শেষ করে দেয়।যখন আরফানের মাকে দাফন করা হয় তখন থেকেই আরফান চুপচাপ হয়ে যায়।সে জানে এতে রেবেকার কোনো দোষ নেই কিন্তু তার অবদান কোনোকিছুতে কমতি নয়।সে যদি ঐদিন না আসতো তাহলে আরফানের মা বেঁচে থাকত।কিন্তু যে নাটের গুরু অর্থাৎ আরফানের বাবা তিনি তার পাপের শাস্তি পেয়েছেন। আসলে তিনি নদী পথে কোনো একটা এলাকায় যাচ্ছিলেন কিন্তু ঝড়ের কারণে নদীতে ডুবে যান।তবে ওনার ডেডবডি পাওয়া যায় নি। আরফান তাকে নিয়ে আফসোস করে না।এসব কিছু ভেবে সে মনে মনে মাকে বলে

-মা আমি জানিনা সামনে কি হতে যাচ্ছে।কিন্তু আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন।তাই আমি সব কিছু মানাতে চাই।
পরেরদিন বিকেলে একটা ঝামেলা বেঁধেছে।পাত্র পক্ষ থেকে সব কিছু দিয়ে যাওয়া হয়েছে ।সব কিছু দুই সেট একটা পিহুর জন্য।কিন্তু সমস্যা বেঁধেছে গিয়ে তুলির ঘরে না পাঠিয়ে পাঠানো হয়েছে মিহুর ঘরে।বিষয় টা রেবেকা জানতে পেরে নীলুকে জিজ্ঞেস করলো

-নীলু এরকমটা কেন করলে?তোমারতো তুলিকে পছন্দ হয়েছে।তাই না?
-মামণি আমিতো একবারো বলিনি তুলি আপুকে আমার পছন্দ হয়েছে।আমার তো মিহু আপুকে পছন্দ হয়েছে।
-কিন্তু মা দেখো আমরা তো কথা দিয়ে ফেলেছি তুলিকে এবাড়ির বৌ বানাবো।আর তাছাড়া তুলি আর মিহুর মধ্যে তো তেমন কোনো পার্থক্য নেই।

-মামণি তুমি মিহু আপুকে দেখোনি তাই একথা বলছো
-হ্যাঁ দেখিনি কিন্তু শুনেছি পিহুর জমজ বোন।তাহলে তো পিহুর মতোই হবে
-না মামণি আমি মিহু আপুকেই ভাবি হিসেবে চাই।
রেবেকা নীলুর জেদের কাছে হেরে গিয়ে বলল
-আচ্ছা বেশ মানলাম কিন্তু মিহু কি রাজি হবে?
-মা মিহু রাজি আছে।

-নেহাল তুই কীভাবে জানলি?
-একটু আগে পিহু ফোন দিয়ে বলল মিহুর নাকি এই বিয়েতে আপত্তি নাই।
মিহু ঘর অন্ধকার করে বসে আছে।তাহলে দাদু রেস্টুরেন্টে বসে এই কথাই বলেছিল যে ‘যদি দাদু তোমাকে একজনের হাতে তুলে দিতে চায় তবে কি তোমার কোনো আপত্তি থাকবে

-না দাদু।তোমার ইচ্ছাই আমার সব
-তাহলে যদি কোনো বিয়ের প্রস্তাব আসে চোখ বন্ধ করে হ্যাঁ বলে দিবে।সেটা যেই হোক না কেন। আর কোনো কিচ্ছু কাউকে বলবেও না জিজ্ঞেস ও করবে না।ঠিক আছে?
-হুম

হৃদমাঝারে তুমি পর্ব ৫

এসব কিছু দাদু বলার পরেও মিহুর মনে হলো ও ভুল কাজ করছে।তুলির জিনিস ও কেড়ে নিচ্ছে।আচ্ছা ও কি ভুল করে বসল নাতো?ও কি সঠিক কাজ করল?মানুষ তো এখনই ওকে কটু কথা শুনাচ্ছে।বলছে বোনের জামাইয়ের দিকে নজর দেয় কি খারাপ মেয়ে।
সামনে কি হতে চলেছে?আরফান কি মেনে নিবে ওকে?তিনি কি এই বিয়ে মানবেন?কি হবে আগামীতে?

হৃদমাঝারে তুমি পর্ব ৭