ফেরারি প্রেম পর্ব ৩৩

ফেরারি প্রেম পর্ব ৩৩
নিশাত জাহান নিশি

“কিন্তু এত রাতে আমার স্কুটি ওখানে গেল কীভাবে?”
শুনশান রাস্তার এদিক ওদিক তাকালো রূপল। চারিদিকে সূক্ষ্ণ দৃষ্টি তার। পরিবেশটা বড্ড ধোঁয়াশায় ঘেরা! নিমিষেই মনে ভয় ধরিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। সামান্য পাতা পড়ার শব্দও যেন রূপলের ভেতরটাকে নাড়িয়ে দিচ্ছে! এই ভীতিকর পরিস্থিতিতেও রূপল নিজেকে যথেষ্ট শান্ত এবং স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করল। কঠিনভাবে নিজেকে ধাতস্থ করে সে ফোনের অপর প্রান্তে থাকা নীহারিকাকে নিশ্চল গলায় বলল,

“তা তো আপনি জানেন। আমি কীভাবে জানব?”
তৎক্ষণাৎ হুড়মুড়িয়ে বিছানা থেকে ওঠে গেল নীহারিকা। ব্যতিব্যস্ত গলায় রূপলকে বলল,
“আপনি ওখানেই ওয়েট করুন। আমি আসছি!”
“হোয়াট? আর ইউ ক্রেজি নীহারিকা? আপনি এই মাঝরাতে এত গভীর নির্জন জায়গায় আসবেন?”
“হ্যাঁ আসব! কারণ, আমার জানতে হবে স্কুটিটি ওখানে গেল কীভাবে। আমার জানামতে তো স্কুটিটি ওখানে যাওয়ার কথা নয়।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“প্লিজ ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড নীহারিকা৷ আপনি এখানে একা আসতে পারবেন না। আমার নিজেরই এই পরিবেশটা কেমন খাপছাড়া মনে হচ্ছে। গাঁ ছমছম করছে। আর আপনি তো মেয়ে মানুষ! ঘাবড়ে যাবেন বেশী।”
“মেয়ে মানুষ বলে কী সাহস থাকতে পারবে না? আমি এলে বরং আপনার ভয়টা কমবে! দুজনে মিলে বিষয়টাকে হ্যান্ডেল করতে পারব। এতে বরং আমাদের সুবিধাই হবে।”

নীহারিকার ঘাড়ত্যাড়ামোতে বিরক্ত হলো রূপল! তবুও সেই রাগকে রূপল কিঞ্চিৎ দমিয়ে এনে শান্ত সুরে বলল,
“আচ্ছা আমি এগিয়ে আসছি। আপনি আসুন। তবে এর আগে আপনাকে একটা কাজ করতে হবে।”
কৌতূহলী গলায় নীহারিকা প্রশ্ন ছুড়ল,
“কী কাজ?’

“একটু চেক করে আসতে হবে পিয়াসা তার রুমে আছে কী-না!”
অবাক হলো নীহারিকা। তব্ধিত গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,
“এত রাতে আমি ভাবির রুমে যাব?”
“হ্যাঁ যাবেন। কাম অন ফার্স্ট।”

“ভাইয়া এখন রুমে মিস্টার রূপল। তাদের ব্যক্তিগত সময়ে গিয়ে তাদের বিরক্ত করব?”
“হ্যাঁ করবেন! বিরক্ত করা থেকে যদি ভালো কিছু হয় তবে বিরক্ত করাই ভালো।”
নীহারিকা বেশ বুঝতে পারছে রূপল ঠিক কোন ভয়টা পাচ্ছে! তবে রূপলের সাথে একমত হতে পারছেনা নীহারিকা! তার মাইন্ডে অন্যকিছু ঘুরছে। যা সে ছাড়া পৃথিবীর কেউ জানেনা! নিছক ভাবনা চিন্তা থেকে বের হয়ে এলো নীহারিকা। রূপলের প্রস্তাবে সায় জানিয়ে বলল,

“ওকে যাচ্ছি।”
কলটি কেটে নীহারিকা তড়িঘড়ি করে তার রুম থেকে বের হলো। দ্রুত পায়ে হেঁটে সে নিহালের বেডরুমের সামনে দাড়ালো। ইতস্তত নিয়ে সে দরজায় কড়া নাড়তে বাধ্য হলো। অমনি নিহাল এবং পিয়াসা তাদের ঝগড়া থামিয়ে আকস্মিক দৃষ্টিতে দরজার দিকে তাকালো! অস্বস্তিকর গলায় নীহারিকা বলল,
“ভাইয়া আছো?”

এত রাতে তার ঘরের দরজায় নীহারিকার গলার আওয়াজ পেয়ে নিহাল বেশ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে উঠল। নীহারিকার খারাপ কিছু হলো কী-না সেই ভেবে নিহাল ছুটে এসে দরজা খুলে দিলো। চিন্তিত নীহারিকাকে দেখামাত্রই নিহাল হাসফাস গলায় বলল,
“এই কী হয়েছে তোর? শরীর খারাপ করল না-কী?”
ভেতরে অস্থিরতা কাজ করলেও নীহারিকা এই মুহূর্তে নিহালকে তার শান্ত রূপটা দেখালো। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করল। কারণ সে বুঝতে পারছিল মাঝরাতে তার হঠাৎ আগমনে তার ভাই বেশ ঘাবড়ে গেছে। তাই সে তার ভাইকে শান্তনা দেওয়ার জন্য জোরপূর্বক হেসে বলল,

“না ভাইয়া কিছু হয়নি। শরীর স্বাস্থ্য সব ঠিকই আছে আমার। আসলে একটা খারাপ স্বপ্ন দেখেছিলাম তো, তাই ভাবলাম তোমাকে আর ভাবিকে একটা নজর দেখে যাই!”
স্বস্তির শ্বাস ফেলল নিহাল। নীহারিকার মাথায় আদুরে হাত বুলালো। নিবিড় স্বরে বলল,
“জানিস? তোকে হঠাৎ এই সময়ে দেখে ভাইয়া কতটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম? ভাবলাম কী না কী হলো তোর। যাক, তুই ভালো আছিস শুনে এখন অনেকটা রিলাক্স লাগছে। আচ্ছা রুমে আয়। তোর ভাবি আর আমি ঘুমানোর প্রস্তুতিই নিচ্ছিলাম।”
অমনি নীহারিকা অস্থির হয়ে উঠল। দ্রুত গলায় তার ভাইকে বলল,

“না না ভাইয়া। রুমে যাবনা আর। তোমাকে এক নজর দেখে নিয়েছি এতেই আমার শান্তি। ভাবি নিশ্চয়ই ঘুমে কাতর হয়ে আছে। তোমাদের ব্যক্তিগত সময়ে এসে তোমাদের বিরক্ত করলাম ভাইয়া! যাও ভাবিকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। গুড নাইট।”
কথাগুলো অনর্গল বলেই নীহারিকা তার রুমের দিকে গতিপথ নির্ধারণ করল। নিহালকে কিছু বলার সময় এবং সুযোগ কোনোটিই দিলোনা সে।

নীহারিকা তার রুমে প্রবেশ করতেই নিহাল তার রুমের দরজা আটকে দিলো। নিহাল তার রুমের দরজা বন্ধ করার সাথে সাথেই নীহারিকা তার রুম থেকে বের হয়ে দৌড়ে বাড়ির সদর দরজায় চলে এলো! নিঃশব্দে বাড়ির সদর দরজাটি খুলে সে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। বাইরে থেকে দরজার খিল আটকে দিয়ে গেল। মনে মনে আয়াতুল কুরসী পড়তে পড়তে সে বাড়ির গেইট পেরিয়ে হাতের ডান দিকের রাস্তাটির পাশ ধরে হাঁটতে শুরু করল।

মাথায় বিশাল এক ঘোমটা তার। ভয় এবং অতিরিক্ত সাহস দুটিই কাজ করছিল তার মধ্যে! সঙ্গে কৌতূহল। এই তিনের সংমিশ্রণে অবস্থা তার বেহাল। কঠিন এক প্রশ্ন তার মাথায় ঘুরপাত খেতে লাগল। স্কুটিটি একা ঐ গভীর নির্জনে গেল কীভাবে? বিগত পাঁচ মাস ধরে তো স্কুটিটি সে ছুঁয়েও দেখেনি! যত সম্ভব এই স্কুটিটি থেকে দূরে থেকেছে সে! গ্যারেজের শেষ প্রান্তে রেখেছে স্কুটিটিকে। সবার ধরা ছোঁয়ার বাইরে। তাহলে সবার দৃষ্টি এড়িয়ে স্কুটিটি ওখানে গেল কীভাবে?

মনে অজস্র প্রশ্ন নিয়ে নীহারিকা এক প্রকার দৌড়াতে লাগল। গাঁ থেকে টপটপ করে ঘাম ঝরছিল তার। রাতের নিকষ কালো অন্ধকারটা যেন ক্রমশ গ্রাস করছিল তাকে! ভয়কে দ্বিগুন তাতিয়ে দিচ্ছিল। এই নিশাচর রাতে এলাকার ভেতরের দোকান পাটও সব বন্ধ। জনমানবের আনাগোনা নেই বললেই চলে। তবে মাঝেমাঝে কয়েকটা বড়ো গাড়ি এসে নির্জীব রাস্তাটিকে সচল করে তুলছে। সাথে তার মনকেও একটুখানি সাহস যুগিয়ে দিচ্ছে।

এভাবে প্রায় মিনিট কয়েক দৌঁড়ানোর পর হঠাৎ চলতি পথে রূপলের সাথে দেখা মিলল নীহারিকার। প্রাণ ফিরে পেল নীহারিকা। রূপল বাইকে করেই নীহারিকাকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য আসছিল। নির্জন রাস্তায় নীহারিকা ভয় পাবে তাই। রূপলকে দেখা মাত্রই নীহারিকা থামল। সশব্দে রূপলকে ডেকে বলল,
“মিস্টার রূপল? থামুন।”

কর্ণকুহরে নীহারিকার গলার স্বর প্রতিধ্বনিত হওয়া মাত্রই রূপল বাইকটি থামালো। পাশ ফিরে নীহারিকার দিকে তাকালো। দ্রুত পায়ে হেঁটে এসে নীহারিকা রূপলের বাইকে ওঠে বসল। হাঁপানো গলায় বলল,
“চলুন।”
দ্রুত বাইকটা ঘুরিয়ে নিলো রূপল। পুনরায় বাইকটি স্টার্ট করে আগ্রহী গলায় নীহারিকার দিকে প্রশ্ন ছুড়ল,
“চেইক করেছিলেন? পিয়াসা তার ঘরে আছে কী-না?”
ক্রমাগত কয়েক দফা শ্বাস ফেলল নীহারিকা। অস্থির গলায় বলল,

“আছে।”
স্বস্তির শ্বাস ফেলল রূপল! সন্দেহ কেটে গেল তার। কপালের ভাজগুলোও মলিন হয়ে এলো। মনে মনে বিড়বিড় করে বলল,
“থ্যাংকস গড। জোর বাঁচা বাঁচিয়ে দিলে আজ। ভেবেছিলাম পিয়াসা হয়ত বাড়ি থেকে পালিয়েছে! কারণ, স্কুটি তো পিয়াসাও চালাতে পারে। দুষ্টু বুদ্ধি তার মাথায় চেপে বসলে সে যা খুশি তাই করতে পারে। আমার বোনকে তো আমি বেশ ভালোভাবেই চিনি! যখন যা মন চায় তাই করবে। ব্রেন খাটিয়ে ভাববে না যে সে যা করছে তা ঠিক করছে না-কী ভুল করছে।”

রূপল তার নিজ খেয়াল থেকে বেরিয়ে এসে নীহারিকার দিকে মনোযোগ দিলো। উপলব্ধি করল নীহারিকা কিছুক্ষণ পর পর কেবল রুদ্ধশ্বাস ফেলছে। গভীর ভয় এবং দুঃশ্চিতা থেকে এভাবে শ্বাস ফালানোটাই স্বাভাবিক। তবে নীহারিকার এই অত্যধিক ভয়ের কারণ বুঝতে পারছেনা রূপল। তাই গলা ঝাঁকিয়ে নীহারিকার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করল। নীহারিকার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বলল,

“আচ্ছা গ্যারেজে সবার গাড়ি ঠিকঠাক আছে তো? আই মিন জিজুর গাড়ি?”
“আপনি কী ভাবছেন চোর ঢুকেছিল আমাদের গ্যারেজে?’
“অভেয়সলি! চোর নয়ত কী? আপনাআপনি তো আর স্কুটিটা গ্যারেজ থেকে হেঁটে আসবে না এখানে তাইনা?”

নিরুত্তর নীহারিকা! আপাতত চুপ থাকাকেই সে গুরুত্বপূর্ণ মনে করল। নীহারিকার মৌনতা যদিও রূপলকে রাগিয়ে দিচ্ছিল তার ইগু হার্ট করছিল তবুও সে চুপ রইল। নীহারিকাকে পাত্তা দিতে চাইল না! কিছুদূর যেতেই সেই নির্জন ভয়াবহ জায়গায় নীহারিকার স্কুটিটির দেখা মিলল। সঙ্গে সঙ্গেই রূপল বাইক থামিয়ে দিলো। গম্ভীর গলায় নিশ্চুপ নীহারিকাকে বলল,
“নামুন। ঐ যে আপনার স্কুটি।”

ইতোমধ্যেই নীহারিকা বাইক থেকে নেমে গেল। স্কুটিটির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সে আচমকা ভয়ে কাঁপতে লাগল! সূক্ষ্ম চোখ দ্বারা স্কুটিটিকে আগা গোঁড়া পর্যবেক্ষণ করে সে কম্পিত হাতে যেইনা স্কুটিটিকে ধরতে গেল অমনি সে অস্থিরতা থেকে মাথা ঘুরিয়ে ধপ করে পিচ ঢালা রাস্তায় পরে গেল! সঙ্গে সঙ্গেই জ্ঞান হারালো সে। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে রূপল একই জায়গায় দাড়িয়ে রইল৷ নীহারিকার আচানক কাণ্ডকীর্তি তার মাথার উপর দিয়ে গেল!

হতবাক হয়ে ছুটে এসে রূপল নীহারিকাকে ধরল। যদিও নীহারিকাকে ছুঁতে অস্বস্তি হচ্ছিল তার তবুও সে তাকে না ছুঁয়ে থাকতে পারলনা। এছাড়া তো আর কোনো উপায়ও নেই। নীহারিকার মাথাটিকে সে তার হাঁটুতে রেখে যেইনা নীহারিকার মুখের দিকে তাকালো অমনি লক্ষ্য করল নীহারিকার মাথা কেটে র’ক্ত পরছে! উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল রূপল। চোখেমুখে ফুটে উঠল দারুন অস্থিরতার ছাপ। নীহারিকার গালে চাপর মেরে সে শুকনো গলায় বলল,

“হেই নীহারিকা? চোখ খুলুন? কী হয়েছে আপনার?”
কোনো প্রতিক্রিয়া নেই নীহারিকার! অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে সে। পূর্বের তুলনায় অধিক ঘাবড়ে গেল রূপল। আশেপাশে তাকিয়ে দেখল অন্ধকারের গভীরতা যেন ক্রমশ বাড়ছে! এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি সে একা সামাল দিতে পারবেনা! রাস্তায় গাড়ির ঘোড়ার বিচরণ থাকলেও না হয় ব্যাপারটা একা সামলে নেওয়া যেত। কোনো একটা গাড়িতে করে নীহারিকাকে নিয়ে বাড়ি অবধি পৌঁছে যাওয়া যেত কিন্তু একা বাইকে করে তো নীহারিকাকে নিয়ে বাড়ি অবধি পৌছানো যাবেনা। উপায় বুদ্ধি খুঁজে না পেয়ে রূপল নিহালকে কল করতে বাধ্য হলো!

জানালার থাই গ্লাস ভেদ করে সূর্যের প্রখর আলো নীহারিকার চোখেমুখে পরল। অমনি নীহারিকা ধড়িফড়িয়ে ঘুম ভেঙে উঠল। অর্ধখোলা চোখে সে আশেপাশে তাকিয়ে যকটুকু আন্দাজ করতে পারল আপাতত সে তার রুমেই আছে! তবে মাথাটা কেমন যেন ভার হয়ে আছে তার। তোলাই যাচ্ছেনা যেন। পাশেই বসে আছে তার মা মারজিনা বেগম। উদ্বিগ্ন দৃষ্টি উনার নীহারিকার দিকে। আবেগআপ্লুত হয়ে তিনি মেয়ের মাথায় হাত বুলালেন। ভরাট গলায় বললেন,

ফেরারি প্রেম পর্ব ৩২

“কাল রাতে তোর কী হয়েছিল মা? স্কুটিটা দেখে তুই এত ভয়ে পেয়ে গিয়েছিল কেন? কত শখের এই স্কুটিটা তোর বল? বিগত চার পাঁচ মাস ধরেই দেখছি স্কুটিটাকে তুই ধরেও দেখছিস না! কী হয়েছে তোর বল তো?”

ফেরারি প্রেম পর্ব ৩৪