ফেরারি প্রেম পর্ব ৫

ফেরারি প্রেম পর্ব ৫
নিশাত জাহান নিশি

“হায় আল্লাহ্! এই বান্দায় আবার বিয়ে করল কবে? এত বড়ো বাচ্চাও আছে তার? অথচ আমরা এই বিষয়ে কিছুই জানতাম না! না-কী চাচা, মামা টাইপ কিছু হবে?”
মনে মনে কথাগুলো আওড়ে নীহারিকা মেয়েটির দিকে হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে তার ডান হাতের তর্জনী আঙুল দ্বারা খোঁচা দিলো রূপলকে! প্রথম খোঁচায় যদিও রূপলের টনক নড়েনি। তবে দ্বিতীয় খোঁচায় রূপল তার জায়গা থেকে খানিক নড়েচড়ে বসল। চরম বিরক্তিবোধ করে সে তেজী গলায় বলল,

“আরে কী হয়েছেটা কী? এভাবে খোঁচাখোঁচি করছেন কেন?”
ঘোরে ডুবে নীহারিকা হঠাৎ তার মুখ ফসকে বলে ফেলল,
“আরে আপনার মেয়ে আপনাকে ডাকছে!”
অমনি রূপলের ভ্রম ফিরল! দুঃশ্চিতায় সে প্রায় ভুলেই গিয়েছিল সে এখন কোথায় আছে। তাই খুব বেশী একটা মনোযোগ দিয়ে এদিক ওদিক লক্ষ্য করা হয়নি তার। মুহূর্তেই হকচকিয়ে ওঠে রূপল তার সেই চিরচেনা স্কুলের গেইটটির দিকে তাকালো। হাসিমুখে তার দিকে এগিয়ে আসা মেয়েটিকে এক ঝলক প্রদর্শন করা মাত্রই রূপল দিন দুনিয়া ভুলে ছুটে গেল সেই মেয়েটির কাছে! উচ্ছ্বসিত হয়ে সে হাঁটু মুড়ে বসল মেয়েটির সামনে। প্রফুল্ল হেসে মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরে বলল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“আমার সোনা বাচ্চা! কতদিন পর আমার মেয়েটাকে দেখলাম।”
মেয়েটিও রূপলকে জড়িয়ে ধরল। একরাশ অভিযোগের ঝুড়ি নিয়ে বলল,
“এই দুইদিন ধরে তুমি কোথায় ছিলে বাবা? আমার কথা কী তোমার একবারও মনে পড়েনি?”
অমনি পাশ থেকে মেয়েটির মা মেয়েটিকে মিষ্টি স্বরে বুঝিয়ে বলল,
“তোমাকে তো বলেছিলাম মা। তোমার বাবা এই কয়েকদিন একটু ব্যস্ত থাকবে। তবুও কেন বাবাকে এসব কুয়েশ্চন করে বিরক্ত করছ বলো তো?”

বেশ অভিমান নিয়ে মেয়েটি রূপলের দু’গালে হাত রেখে প্রশ্ন ছুড়ল,
“আমি কী তোমাকে সত্যিই বিরত্ত করি বাবা?” (বিরক্ত)
অমনি রূপল অতি আহ্লাদি হয়ে মেয়েটির দুই গালে দুটি চুমু খেয়ে দিলো। বেশ আদুরে গলায় বলল,
“না মা! তুমি কখনও আমাকে বিরত্ত করো নি! তোমার মা তো একটু বেশী বেশীই বুঝে! তাই মুখ ফসকে বলে ফেলে আর-কী।”

রূপলের কথায় বেশ রেগে গেল সবিতা! রাগী গলায় সে রূপলকে বলল,
“খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছে কিন্তু রূপল!”
প্রত্যত্তুরে রূপল একগাল হেসে বলল,
“কাম অন সবিতা। রাগো দেখেই এত বেশী করে রাগাই তোমাকে।”
চাপা হেসে সবিতা বলল,
“আচ্ছা এখন বলো ঐখানের কী খবর? বিয়ে শাদি সব ঠিকঠাকভাবে মিটল তো?”
অমনি রূপল তার ফুরফুরে ভাবমূর্তি পাল্টে রগচটা গলায় বলল,

“না!”
“কেন? কী হয়েছে?”
সবিতার মুখের উপর রূপল তীব্র ক্ষোভ ঝেড়ে বলল,
“তোমার স্বামী কী কখনও আমাদের শান্তি দিয়েছে?”
অমনি সবিতা বেশ উত্তেজিত হয়ে রূপলকে শুধালো,
“কী করেছে সাফোয়ান?”
অমনি ছোট্টো হৃদি তার বাবার নাম তার মায়ের মুখ থেকে শুনে বেশ আগ্রহের দৃষ্টিতে তার মায়ের মুখের দিকে তাকালো। রূপল বিষয়টা লক্ষ্য করে প্রসঙ্গ পাল্টে সবিতাকে বলল,
“আচ্ছা রাতে দেখা করছি। এখন হৃদিকে নিয়ে তুমি বাড়ি যাও।”
পিছু ঘুরে রূপল যেইনা বাইকের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো অমনি সবিতা রূপলকে পেছন থেকে ডাকল। কেমন যেন ভরাট গলায় বলল,

“সুহাসিনীর সাথে দেখা হয়েছে?”
থমকে দাঁড়ালো রূপল! চোখ জোড়া বুজে নিজের রাগকে শান্ত করল। মলিন চাহনিতে পিছু ঘুরে সবিতার দিকে তাকালো। হেয় হেসে বলল,
“এই ছয়মাসে কী সে একবারও আমার সাথে দেখা করতে চেয়েছে সবিতা? তুমিও যে কী বলোনা!”
একরাশ বিষন্নতা নিয়ে মাথাটা নুইয়ে নিলো সবিতা। রূপলকে শান্তনা দেওয়ার মত কোনো ভাষাই জানা নেই তার! দীর্ঘশ্বাস ফেলল রূপল। ভেতরে ভেতরে চাপা কষ্ট নিয়ে সে আবারও সামনের দিকে হাঁটা ধরল। বাইকে এখনও চুপটি করে বসে আছে নীহারিকা। ঘোর যেন তার এখনও কাটছেই না! কেমন যেন উদাসীন হয়ে গেছে সে।

বাইকে বসে রূপল বাইকটা সঙ্গে সঙ্গে স্টার্ট করে দিলো। এতক্ষণে জ্যামও প্রায় ছেড়ে দিলো৷ লুকিং গ্লাসের সাহায্যে নীহারিকা আড়চোখে কেবল রূপলের দিকে তাকাচ্ছে। গভীর বিষাদের ছাপ রূপলের সমস্ত মুখমণ্ডলে লেপ্টে আছে! মনে হচ্ছে যেন বড়ো কোনো আঘাত নিয়ে এই মাত্র ফিরে এসেছে সে। ফর্সা মুখটাও কেমন চুপসে গেছে। বিড়ম্বনায় ভুগতে লাগল নীহারিকা। প্রশ্ন করতে গিয়েও থেমে গেল! কৌতূহল বেশিক্ষণ চেপে রাখতে না পেরে নীহারিকা এবার রূপলের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বলল,

“আচ্ছা বাচ্চাটি কে ছিল মিস্টার রূপল?”
অমনি রূপল গম্ভীর গলায় প্রত্যুত্তরে বলল,
“ফ্রেন্ডের মেয়ে!”
“কিন্তু বাচ্চাটি আপনাকে বাবা ডাকছিল কেন?”
“আমি তাকে বাবার মতই আদর করি তাই!”
“কেন? তার কী নিজের বাবা নেই?”
“আছে।”

কিয়ৎক্ষণ চুপ করে রইল নীহারিকা। মৌনতা ভেঙে অতঃপর হালকা হেসে বলল,
“যাক। বাচ্চাদের প্রতি আপনার ভালোবাসা দেখে ভালো লাগল!”
রূপল হা বা না কিছুই বলল না। ভাবলেশহীন ভাবে বাইক চালাতে লাগল৷ গভীর চিন্তায় সংযুক্ত হলো নীহারিকা! মনে মনে আওড়ে বলল,

“আচ্ছা এই লোকটী কী জন্মগতভাবেই এমন গম্ভীর না-কী অন্য কোনো বিশেষ কারণে এমন গম্ভীর হয়ে আছে? যদিও আপাতত তার মাথায় অনেক দুঃশ্চিন্তা ঘুরছে। তবুও কেন জানিনা আমার মনে হচ্ছে লোকটা ভেতরে ভেতরে গভীর কোনো কষ্ট চেপে রেখেছে! বিশেষ করে ঐ মহিলা এবং বাচ্চাটির সাথে দেখা করে আসার পর থেকেই তার গম্ভীর ভাবটা যেন পূর্বের তুলনায় আরও বেড়ে গেছে! তাহলে কী মিস্টার রূপল আমাকে যা বললেন সব মিথ্যে বললেন? তারা একে অপরের বন্ধ নন বরং অন্যকিছু?”
মাথার ভেতর এমন অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খেলেও নীহারিকা এই মুহূর্তে চুপ রইল! রূপলের ভাবসাব খুব একটা সুবিধাজনক মনে হচ্ছেনা তার কাছে। তাই হাতে ধরে বিপদ টেনে আনতে চাইছেনা সে! পরে না হয় আস্তেধীরে সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে নেওয়া যাবে।

রাত আটটা বাজতেই পিয়াসাকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হলো! ভয়ে চিৎকার করছিল পিয়াসা। বার বার জেদ ধরে রূপলকে এবং তার মা-বাবাকে বলছিল অপারেশন করবে না সে! যদি অপারেশন থিয়েটার থেকে আর কখনও ফিরে না আসে সেই ভয়ে! শেষ পর্যন্ত নিহাল পারল পিয়াসাকে থামাতে! কান্নারত পিয়াসার মাথায় সে শান্তনার হাত বুলিয়ে বলল,

“কেন পাগলামি করছ পিয়াসা? এখন যদি তুমি অপারেশনটা না করাও তাহলে তো ভবিষ্যতে এমনিতেও তোমাকে ম’র’তে হবে! এরচেয়ে আরও খারাপ ভাবে ম’র’তে হবে। তারচেয়ে কী ভালো নয় বরং আগে থেকে একবার ঝুঁকি নিয়ে মৃ’ত্যুকে জয় করে নেওয়া? নতুন বিয়ে হলো আমাদের বলো? এখনও আমাদের একসাথে সংসার করা বাকী। আরও কত ছোটো বড়ো স্বপ্ন পূরণ করার বাকী।”
নিহালের অশ্রুভেজা চোখের দিকে তাকিয়ে পিয়াসা না চাইতেও কেমন যেন শান্ত হয়ে এলো! নিহালের হাত দুটি চেপে ধরে চোখের জল ছেড়ে দিলো। পাশ থেকে শান্ত মেজাজে নিহালের মা এবং বাবা এসে পিয়াসার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো! নিহালের মা বেশ স্নিগ্ধ গলায় পিয়াসাকে বলল,

“দোয়া করি মা। সুস্থভাবে তুমি আমাদের কাছে ফিরে এসো। আর পারলে আমাদের ক্ষমা করে দিও মা। তোমার একটু বোকামির জন্য আজ কত গুলো সম্পর্কে ছেদ ধরছিল। তোমাকে এবং তোমার পরিবারকেও অনেক অপমানিত হতে হচ্ছিল। ভাগ্যিস এখন সব পরিষ্কার হয়ে গেছে। নীহারিকা আমাদের সব বলেছে মা। তুমি আসলেই নির্দোষ। কোনো ষড়যন্ত্রের শিকার তোমরা। যাই হোক, এই বিষয় নিয়ে আমরা পরে কথা বলব। এখন উপর ওয়ালার কাছে শুধু একটাই প্রার্থনা, আল্লাহ্ যেন তোমাকে আমানে আছানে আমাদের কাছে ফিরিয়ে দেন।”

সবার দোয়া মাথায় নিয়ে পিয়াসা অপারেশন থিয়েটারে ঢুকল। শুরু হয়ে গেল অ’স্ত্রো’পা’চার। মনে ভয় নিয়ে সবাই অপারেশন থিয়েটারের সামনে পায়চারি করছে। পিয়াসার মা এবং বাবা শুধু আল্লাহ্কে ডাকছেন। তাদের মেয়ে যেন সুস্থ স্বাভাবিকভাবে তাদের কাছে ফিরে আসে সেই আশায়। নিহাল বেশ ধৈর্য্য নিয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে! হয়ত তার মনে মনে জানা আছে পিয়াসা সুস্থভাবেই তার কাছে ফিরে আসবে!

ভয় এবং উত্তেজনা সামলাতে না পেরে রূপল পকেট থেকে একটি সি’গা’রেট বের করল। হসপিটালের করিডরে দাঁড়িয়ে সিগারেটটি ধরাতে গিয়েও রূপল হঠাৎ থেমে গেল। মনে পড়ে গেল এটি একটা হসপিটাল। তাড়াহুড়ো করে রূপল সিগারেটটি হাতে নিয়েই হসপিটাল থেকে বের হয়ে গেল। বাইরে থেকে সিগারেটটি খেয়ে আসবে তাই। পকেট থেকে সিগারেট বের করার সময় অসতর্ক বশত রূপলের পকেট থেকে একটি পাসপোর্ট সাইজের ছবি পড়ে গেল! দূর থেকে দাঁড়িয়ে নীহারিকা সব দেখছিল। রূপল যাওয়ার পর পরই ছুটে এসে নীহারিকা ছবিটি ফ্লোর থেকে উঠালো। ছবিটির দিকে একবার তাকিয়ে সে মুখটা হা করে ফেলল! গলায় মুগ্ধতা এনে বলল,
“মাশাআল্লাহ্! এ মেয়ে না পরী? কে হয় এই মেয়েটি মিস্টার রূপলের?”

রাতের খাবার খাওয়ানোর পর মিসেস চারুলতা সেন সুহাসিনীর এঁটো ঠোঁট দুটি মুছে দিলেন। ব্যস্ত হয়ে তিনি এঁটো থালা নিয়ে সুহাসিনীর পাশ থেকে উঠতেই ছোটো ছোটো গলায় সুহাসিনী মিসেস চারুলতা সেনকে বলল,
“মেইন গেটটা ভালোভাবে লাগিয়ে এসেছেন তো ম্যাম?”
ভাবশূণ্য হয়ে মিসেস চারুলতা সেন সুহাসিনীর দিকে তাকালেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

ফেরারি প্রেম পর্ব ৪

“রূপলের থেকে আর কতদিন এভাবে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াবে সুহাসিনী? সত্যি বলতে রূপলের মুখের দিকে তাকাতে পারিনা আমি। কী অবস্থা হয়েছে ছেলেটার!”
অশ্রুসজল চোখেও হেয় হাসল সুহাসিনী! বিদ্রুপের স্বরে বলল,
“একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে ম্যাম! সব কষ্ট সয়ে যাবে। এই কঙ্কালের মত পো’ড়া দেহ নিয়ে আমি রূপলকে কীভাবে গ্রহণ করি বলুন?”

ফেরারি প্রেম পর্ব ৬