এ শহরে তুমি নেমে এসো পর্ব ১৬

এ শহরে তুমি নেমে এসো পর্ব ১৬
ইফা আমহৃদ

“বংশের চুলকানি একবার ব্যবহারেই খ/ত/ম। মাত্র দশ টাকায়। মাত্র দশ টাকা। চুলকানি মলম, ইঁদুর মা/রা/র মলম।”
মনে মনে উচ্চারণ করে পিয়াস ভাইয়ের কান্ড দেখছি। কিছুদিন আগে বক্সিং চ্যাম্পিয়ন প্রতিযোগিতায় বেলেন্ডার না দিয়ে মাইক দিলে। দুদিনের জন্য ভাড়া নিতাম।
অপূর্ব ভাইয়ের পোশাক পরিধান করার পর নাজেহাল অবস্থা হলো পিয়াস ভাইয়ের। চুলকানির জন্য শান্তিতে দু দন্ড বসতে পারছেন না। ছুটে গেলেন ওয়াশরুমে। দরজা খোলা রেখেই পানি ঢাললেন। মুখ টিপে হাসছি আমি। তিস্তার আপুর দৃষ্টি এড়ালো না। হাত ধরে বারান্দায় নিয়ে গেলেন। সন্দিহান গলায় বলেন, “পিয়াসের সাথে কী করেছিস তুই? সত্যি বলবি কিন্তু।”

গাঁ ছাড়া ভাব নিয়ে বললাম, “আমি পিয়াসের সাথে কিছু করি নি। আমি শরবতের সাথে করেছি, ওয়াশরুমের মেঝের সাথে করেছি, অপূর্ব ভাইয়ের পোশাকের সাথে করেছি। এখন যদি পিয়াস মাঝখানে ঢুকে পরে, তাতে আমার করণীয় কী?”
তিস্তা আপু মাথায় হাত দিয়ে উল্টো ঘুরে রইলেন। ব্যস্ত রাস্তা দিয়ে গাড়ি দ্রুত গতিতে ছুটে চলেছে। তিস্তা আপুর সময় ঠিক একই গতিতে ছুটছে। বিচলিত হয়ে বলেন, “বুঝার চেষ্টা কর আরু। এখানে প্রয়াস আর না পিয়াস। কারো দোষ নেই। দোষ সব আমার ভাগ্যের। আমি সুজনকে ভালোবেসে ভুল করেছি।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ভ্রু নাচিয়ে কপাল কুঁচকে বললাম, “তোমার জন্য পিয়াসকে এমন নাকানিচোবানি খাইয়েছি, কে বলেছে? সে আমার ময়না পাখির গলা চে/পে ধরেছিল। তার শাস্তি পেয়েছে।”
“কে শাস্তিটা দিয়েছে শুনি?” দুহাত বুকে গুঁজে বললেন অপূর্ব ভাই। সৌজন্য হাসি দিয়ে তিস্তা আপুর হাত টেনে ধরলাম। পেছনে লুকিয়ে গেলাম। বিরাগী হয়ে বললাম, “তিস্তা আপু, তোমার ভাইয়ের থেকে আমাকে বাঁচাও।”

“তিস্তা ঘরে যা। প্রয়াসের কী লাগবে দেখ।” তিস্তা আপু মাথা নেড়ে ঘরে গেলেন। আমিও বড়ো বড়ো কদম ফেললাম। বিলম্বে হাতটা অপূর্ব ভাইয়ের হাতে দখল হলো। বারান্দার দরজাটা ঠাস করে বন্ধ করে দিলেন। রেলিং-এ হাত রেখে বলেন, “চৌদ্দ তলা থেকে একটা বল পড়লে কয়েক টুকরো হয়ে যাবে, মানুষ পড়লে কী হবে নিশ্চয়ই বোঝাতে হবে না। অতিথি বাড়িতে এলে তার সাথে এমন আচরণ করা কোথায় শিখেছিস?”

‘অপূর্ব ভাই আমার ও তিস্তা আপুর কথা শুনেছে’ – বুঝতে বাকি রইল না। হাতটা ছাড়িয়ে কোমরে হাতে দিলাম। অন্যহাতে নাক ঢলে বললাম, “অন্যের বাড়িতে গিয়ে এমন ব্যবহার সে কোথায় শিখেছে।”
“পিয়াস তো বড়ো হয়।”
“কিন্তু আমার বেয়াই হয়। বেয়াই বেয়ানের দুষ্টু সম্পর্কের মাঝে তৃতীয় ব্যক্তির ঢুকতে নেই।” বলেই দরজা খুলে বেরিয়ে এলাম। অপূর্ব ভাই আমার গমন পথের দিকে তাকিয়ে আছে এতে সন্দেহ নেই। আমিও একটু কোমর দুলিয়ে হাঁটতে লাগলাম।

একটা ঘরে পিয়াস আর প্রয়াস ভাই ঘুমিয়েছেন। অন্যঘরে নানা ভাই, অপূর্ব ভাই ও তিয়াস ভাই। মেয়েরা ড্রয়িং রুমের মেঝেতে বিছানা করে শুয়েছে।
চোখে আলো পড়তেই ঘুম বিদায় নিল আমার। পরপর তিনবার হাঁচি দিয়ে চোখ পরিষ্কার করে উঠে বসলাম। মেঝেতে শোবার দরুন ঠান্ডা লেগেছে। গলা চুলকাচ্ছে। গলা চুলকে সামনে হাত আনতেই নজর বন্দি হলো কিছু চুল। পাত্তা না দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। ওড়না ঝাড়া দিতেই একগাদা চুল নিচে পড়ল। অবুঝ দৃষ্টিতে চুলগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলাম। কিছুক্ষণের জন্য থমকে গেলাম। কাঁপা কাঁপা হাতটা কাঁধে রাখতেই হতভম্ব হলাম। আচম্কা বাম চোখ থেকে একফোঁটা অশ্রু কাঁধে ঝরল। বিলম্ব হলো গলায় স্বর আসতে। কাঁপা কাঁপা ওষ্ঠদ্বয় নাড়িয়ে দিলাম এক চিৎকার, “মামি..

গ্ৰাম থেকে দুই মামি ঢাকায় এসেছেন। উভয়েই রান্না রেখে ছুটে এলেন। তুর শেফালী ঘুমিয়ে ছিল পাশে। অকস্মাৎ ঘটা ঘটনায় উঠে বসল তারা। বড়ো মামি বলেন,
“কী হয়েছে আরু? চিৎকার দিলি কেন? দুঃস্বপ্ন দেখেছি?”
দু’হাতে চুলগুলো মুঠো করে কেঁদে দিলাম। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বললাম, “আমার চুল কোথায় মামি? কোমরের নিচে ছড়িয়ে থাকা চুলগুলো মাটিতে কেন গড়াগড়ি করছে?”
আমার কথা অনুসরণ করে তাজ্জব বনে গেল সবাই। ছোটো মামি বলেন, “রান্না ঘরে যাওয়ার আগেও সব ঠিক দেখেছিলাম। হঠাৎ এমন কীভাবে হলো?”

বড়ো মামি আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “লক্ষি মা আমার। শান্ত হ।”
অপূর্ব ভাই চেম্বারে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলেন। চুলে হাত চালাতে চালাতে বললেন, “কী হয়েছে এখানে? সাতসকালে চিৎকার করছিস কেন আরু?”
অতিরিক্ত কান্নার ফলে হেঁচকি উঠে গেল। চোখমুখ লাল হয়ে গেছে। কথা বলতে পারলাম না। বড়ো মামি চিন্তিত ভঙ্গিতে বলেন, “দেখ না, একটু আগেও দেখলাম মেয়েটার চুলগুলো ঠিক আছে। এখন দেখছি কে/টে পড়ে আছে। (ছোট মামিকে উদ্দেশ্যে করে বলেন) সবজি ভাজি পুড়ে যাবে, তুই রান্নাঘরে যা।”

“ওকে তৈরি করে দাও। দেখি কান্না থামাতে পারি কি-না।” বলেই অপূর্ব ভাই ঘরে চলে গেলেন। ‘এতগুলো ব্রাশ দেখে বুঝতে পারল না আমার ব্রাশ কোনটা?’ – যার দরুন শেফালী ব্রাশদানীটা খুলে নিয়ে এলো। মামি টুথপেস্ট নিয়ে বললেন, “তোর ব্রাশ কোনটা?”

“একটাতে দিলেই হবে। কালকে সবুজটা দিয়ে ব্রাশ করেছি, আজকে লালটা দাও। আমার চুল না লাগিয়ে দিলে কিন্তু আমার কান্না থামবে না।” মামি কথা বাড়ালেন না। সংক্ষেপে বললেন, ‘ ঠিক আছে।’
পরিপাটি হয়ে অপূর্ব ভাইয়ের সাথে বের হলাম চেম্বারের উদ্দেশ্যে। নিত্যদিনের ন্যায় আজকেও রিকশায় চড়ে গেলাম। আগের দিনগুলোর মতো অট্টালিকা ভেঙে পড়ার মতো ভয় নেই। শরীরে একটু তেজ বিরাজ করছে। পুরোপুরি শাপলা চত্বরে গেলাম না। একটা বড়ো রেস্তোরাঁ দেখে রিকশা থামালেন। ভাড়া মিটিয়ে রেস্তোরাঁর ভেতরে গেলাম। অতিপরিচিত এক রেস্তোরাঁ।বিটিভির ধারাবাহিককে অনেকবার দেখেছি।
মুখোমুখি বসে মেনু কার্ড সামনে রেখে বললেন, “দেখ, কী খাবি?”

“চুল লাগবে আমার।”
“চুল খেলে পেটে প্যাঁচ লেগে ম/রবি। চুল ছাড়া কী খাবি সেটা বল।”
অপূর্ব ভাই ওয়েটার ডেকে পরটা ও সবজি ভাজি অর্ডার করলেন। পাশের চেয়ার টেনে বসলেন। মাথার ঘোমটা খুলে বললেন, “তোকে তো সেই লাগছে আরু। পিয়াসকে দুটো ধন্যবাদ দেওয়া উচিত।”
ভ্রু কুঁচকে বললাম, “তারমানে আপনি জানেন, এটা পিঁয়াজু করেছে?”
“শেফালীকে মিষ্টি কুমড়ার ফালি, তুরকে তুর পাহাড়, তিস্তাকে বিচ্ছু নদী, তিয়াসকে তিন হাস। এখন পিয়াসকে পিঁয়াজু। আমার নাম ঠিক করিস নি।”

“মামি আপনার এমন নাম রেখেছে, ভেঙাবো কীভাবে?”
ওয়েটার খাবার নিয়ে হাজির হলো। অপূর্ব ভাই সবজি মিশিয়ে পরটার টুকরো মুখে তুলে দিলেন। মুখ ফিরিয়ে নিলাম। আলতো করে গাল চেপে মুখে দিলেন। অতঃপর নিজে পরটার টুকরো মুখে দিয়ে বললেন, “এজন্য আমি বলেছি বড়দের সাথে না লাগতে। গতরাতেও বুঝাতে চাইলাম। তুই কি বললি বেয়াই বেয়ান।”
তার বারণে তখন মন সায় না দিলেও এখন আফসোস লাগছে। দ্বিতীয়বারের মতো পূর্বের ভুলটি করলাম না। মৃদু স্বরে বললাম, “স্যরি।”

অপূর্ব ভাই অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে হাসলেন। টোল পড়া গালের হাসিটা মারাত্মক লাগল বুকে। নাকে ফুলের সুবাস পৌঁছে গেল। আজ পঞ্জিকায় পহেলা ফাল্গুনের উপস্থিতি।
বাতাসে বহিছে প্রেম, নয়নে লাগিল নেশা!
কারা যে কোকিল পিছে/ বসন্ত এসে গেছে!
টিস্যু পেপার দিয়ে মুখ মুছে দিলেন। হাতটা শক্ত করে ধরে বললেন, “চল। একটু বসন্তের ছোঁয়ায় দুজনে বিলীন হয়ে যায়। দু’হাতে বই কুড়াবো।”

পিচের রাস্তা দিয়ে হেটে চলেছি অজানায়। একটি হাত অপূর্ব ভাইয়ের হাতে বন্দি।‌ অপর হাতটা দিয়ে দৃঢ় ধরলাম। মাথাটা কাঁধে হেলান দিয়ে বললাম, “শাড়ি পরলে ভালো লাগতো না? হাতে দু মুঠো কাঁচের চুড়ি। আমাদের সাথে সাথে রিনিঝিনি শব্দে বাজতে থাকতো।”
নীরব থেকে মোলায়েম কণ্ঠে বলে, “মন্দ হতো না।”

এ শহরে তুমি নেমে এসো পর্ব ১৫

অট্টালিকার বারান্দায় গাঁদা ফুলের সমারোহ। পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় কয়েকটা পাপড়ি মাথার পড়ল। অপূর্ব ভাই ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে ছন্দ তুলে বললেন, “রঙ্গবতী।”

এ শহরে তুমি নেমে এসো পর্ব ১৭