এ শহরে তুমি নেমে এসো পর্ব ১৭

এ শহরে তুমি নেমে এসো পর্ব ১৭
ইফা আমহৃদ

অপূর্ব ভাই ও আমি শপিং মলের বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। সময় দেখতে দেখতে অপেক্ষা করছি পরিবারের সবার জন্য। কিছুক্ষণ সময় অতিবাহিত হওয়ার পর কয়েকটা সিএনজি এসে থামল। একে একে বেরিয়ে এলো সবাই। বাদ যায়নি পিয়াসও। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালাম।
‘দুলহান ফ্যাশন’ লেখা একটি দোকানের ভেতরে প্রবেশ করলাম। একের পর এক শাড়ি দেখিয়ে চলেছে কর্মীরা। তিস্তা আপুর মুখ ভার বিধায় পাত্তা দিচ্ছে না সেই সব। মনের কোণে সুজন ভাই বিরাজমান। মামিরা তিস্তা আপুর শাড়ি গায়ে জড়িয়ে নিজেরাই পছন্দ করে চলেছে। তুর অপূর্ব ভাইয়ের হাত ধরে বলে,

“ভাইয়া। আমার একটা শাড়ি নেই। একটা নিবো।”
“জীবনেও তো শাড়ি পড়তে দেখলাম না। নিয়ে সেই আলমারিতে তুলে রাখবি।”
শেফালী অপূর্ব ভাইয়ের ফোনে গেমস খেলছিল। দূর থেকে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে ছুটে আসে। উত্তেজিত হয়ে বলে,
“অপূর্ব ভাই আমিও একটা শাড়ি নেই। তুর আপনার বোন বলে কি শুধু ওকেই দিবেন?”‌ বলেই শেফালী অপূর্ব ভাইয়ের অন্য হাতটি জড়িয়ে ধরে। অপূর্ব ভাই সম্মতি দিয়ে জানায়, “তিস্তা থেকে শুরু করে বাড়ির সবার জন্য শপিং-এর টাকা আমি দিচ্ছি। ইচ্ছে মতো করে নে।’
ওরা সবাই ছুটে গেল।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আমাকে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেললেন। পর মুহুর্তে ভ্রু নাচিয়ে ইশারায় বলেন, “তোর শাড়ি লাগবে না? কিনে নে।”
সাজিয়ে রাখা একটা সাদা শাড়ি তার নজরবন্দি হলো। মাঝে মাঝে মতির কাজ। শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে দিয়ে বলেন, “বিয়ের দিন এটা পরিস, সুন্দর লাগবে।”
বিরক্ত হলাম আমি। সবাই রঙ বেরঙের পোশাক পড়বে আর আমি বিধবার মতো সাদা পরে ঘুরঘুর করব কেন? আশ্চর্য! তেজ নিয়ে বললাম, “পারব না। বিয়ের দিন আমার কত কাজ জানেন? গেট ধরতে হবে, জুতা লুকাতে হবে, প্রয়াস ভাইয়ের খাবারে ভাগ বসাতে হবে। আমি বিধবা ভাতা পেতে চাইনা।”

“সাদা মানে শান্তি। মনে শান্তি এনে দেয়। ইচ্ছে শক্তি বাড়ায়। সাদা শাড়ির সাথে নীল ব্লাউজ পরবি। দূর থেকে দেখে মনে হবে, এক টুকরো শুভ্র নীলাভ মেঘ।
যা, পরে দেখ। ভালো লাগে কি-না?” নতজানু হয়ে মিরে রইলাম। অপূর্ব ভাই চলে গেলেন। শাড়িটা নিয়ে ট্রায়াল রুম খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। দুইটা ট্রায়াল রুম খুঁজে পেলাম। দুটোই আমাদের দখলে। তিস্তা আপু, শেফালী, তুর ও মামিদের দখলে একটা‌। অন্যটা প্রয়াস ভাইয়ের দখলে। কিছুক্ষণ খোঁজার পর আরেকটা ট্রায়াল রুম খুঁজে পেলাম। ব্লাউজের হুকের সাথে কাঁধের ছোটো চুলগুলো প্যাঁচিয়ে গেল। দু’হাতে ধরে ছাড়ানোর আপ্রাণ প্রচেষ্টা করেও ছাড়াতে পারলাম না। টানাটানির এক পর্যায়ে পিঠে আঁচড় লাগল। উপায়হীন হয়ে দরজা খুলে উঁকি দিলাম। ব্যতিব্যস্ত হয়ে গেলাম। তুরকে দেখতে পেলাম। তুরকে উদ্দেশ্য করে বললাম, “একটু ভেতরে আয়। চুলগুলো ছাড়িয়ে দিয়ে যা।”

“পারব না। শেফালীকে বল।” পরক্ষণেই কড়া গলায় ধমক দিয়ে বললাম, “শেফালীকে দেখতে পেলে তোকে বলতাম। তাড়াতাড়ি আয়।”
ভেংচি দিয়ে তুর চলে গেল। বিয়ের মরসুম হওয়ার দরুন ভিড় লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ফাঁকা দেখলে যখন তখন ছুটে আসবে ট্রায়াল নিতে। দরজাটা আস্তে ভিরিয়ে আয়নাতে তাকালাম। অপূর্ব ভাই পার্লার থেকে হেয়ার স্টাইল করেছেন। দেখতে স্টাইলিশ আরু লাগছে। তৎক্ষণাৎ গম্ভীর কণ্ঠ শুনতে পেলাম,

“আরু, কী হয়েছে? তুর বলল তুই ডাকছিস।”
“শেফুকে পাঠান একটু।”
“খুঁজে পেলাম না কোথাও, হয়তো অন্য কোনো ট্রায়াল রুমে। আমাকে বল, কী সমস্যা?”
“হুকটায় চুল প্যাঁচিয়ে গেছে। খুলতে পারছি না।”
“দরজা খোল। আমি দেখছি।”
“আপনি?”

“হম। আশেপাশে কাউকে দেখছি না। কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবি। ট্রাস্ট মি। চোখ বন্ধ করে সাহায্য করব।”
গভীর ভাবনায় লিপ্ত হয়ে দরজা খুলে দিলাম। ভেতরে ঢুকে দরজাটা ভিরিয়ে দিলেন অপূর্ব ভাই। চোখ বন্ধ করে নিলাম। কাঁধে স্পর্শ লাগতেই কেঁপে উঠলাম আমি। সরে দাঁড়ালাম। আচম্কা চোখ খুলে ফেললাম। আঙুল উঁচিয়ে চুল ছাড়াতে লাগলেন। আয়না থেকে দেখে চলেছি অপূর্ব ভাইয়ের সুক্ষ্ম হাতের কাজগুলো। শুভ্র রঙের শাড়িতে মন্দ লাগছে না।
সবাই শপিংয়ে জমে উঠল। আমি তাদের ভারি ব্যাগ বহন করলাম। প্রয়াস ভাই সবাইকে উপহার দিলেন। আমাকে দিলেন না। মন খারাপ নিয়ে অন্যপাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। বাবাকে খুব মনে পড়ছে। কোথায় তিনি? আমার ভাই থাকলে আমাকেও উপহার দিতো। চোখ দুটো মুছে বললাম, “মামি আর কতক্ষণ লাগবে তোমাদের?”

বড়ো মামি কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলেন, “মেয়ের বিয়ে বলে কথা, মনমতো কিনব না? তুই বাড়িতে থেকে যেতি।”
বাক্যটি না করে একপাশে চুপটি করে দাঁড়ালাম। চার ঘণ্টা পেরিয়ে গেল। এখনো অনেক কিছু রয়েছে। অপূর্ব ভাই বিরক্ত হয়ে বলেন, “হয়েছে এবার তো বাড়িতে চলো। ক্ষুধায় পেটে নাচছে।”
“একটা রেস্তোরাঁ আছে না এখানে? আসার সময় দেখলাম। সেখানে চল, খেয়ে আবার কিনব।”
অপূর্ব ভাই সবাইকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। মাথাটা ঝিমঝিম করছে আমার। প্রয়াস ভাইকে দায়িত্ব রেখে আমাকে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলেন।

বাড়ির অদূরে সিএনজি থামতেই কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল আমার। ধোঁয়ায় আকাশ কালো হয়ে গেছে। বাড়ির চারপাশে ভিড়। কত মানুষের হাহাকার। শেফালী ও তুরকে রেখে ছুটে গেলাম আমি। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে কাজে ব্যস্ত হয়েছে। পানি দিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। শেফালী উত্তেজিত হয়ে বলে, “কত তলায় আগুন লেগেছে আরু, ফ্লাটে আমাদের জামা কাপড় আছে। পু/ড়ে যাবে।”

তুর বলে, “তোর ময়না পাখিটা কোথায় আরু? বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় আমি ওকে খাঁচায় দেখেছিলাম।”
হিতাহিত জ্ঞান হারিয়েছে গেল আমার। ময়নাকে একবার হারিয়েছি আর হারাতে পারব না। ‘ময়না’ বলে চিৎকার করে ছুটে গেলাম। আমাকে এসে ধরল ফায়ার সার্ভিসের নারী কর্মীরা। বলেন, “কত তলায় থাকেন আপনি ম্যাম?”
কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম, “চৌদ্দ তলায়।”

“উপরে যাবেন না ম্যাম। আঠার তলায় আগুন লেগেছে। ষোলো তলা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। আপনি যাবেন না।”
হাতটা ছাড়াতে ছাড়াতে বললাম, “আমার ময়না আঁটকে পড়েছে। আমাকে যেতেই হবে। প্লীজ ছাড়ুন।”
“ম্যাম, বোঝার চেষ্টা করুন। আগুন অতিদ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। আমরা আপনার ময়নাকে ছাড়ানোর চেষ্টা করব। কিন্তু আপনাকে ছাড়তে পারব না।”

অবজ্ঞা করে ঘনঘন নিঃশ্বাস নিলাম। আশেপাশে পাশে দৃষ্টি গভীর করে সর্বশক্তি দিয়ে ছুটে গেলাম। উপরের উঠার সাথে সাথে অক্সিজেনের মাত্রা ক্রমশ কমে আসছে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। কালো ধোঁয়া নির্গত হচ্ছে। দৌড়ে বারো তলা পর্যন্ত উঠে মাটিতে বসে পড়লাম। লিফট শব্দটির সাথে অপরিচিত আমি। বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন থাকায় আরও আগে অসম্ভব এর ব্যবহার। রেলিং-এ হাত রেখে মাথা ঠেকিয়ে দিলাম। শরীরে শক্তি নেই। পেছনে পেছনে দু’জন কর্মী এসেছে।

পুনরায় দৌড় শুরু করলাম। ফ্লাটের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থমকে গেলাম। বড়ো একটা তালা ঝুলছে। চাবি অপূর্ব ভাইয়ের কাছে। হাত দিয়ে জোরে আঘাত করলাম। হিতে বিপরীত হলো। হাতে ব্যথা পেলাম। দরজায় আঘাত করতে করতে দরজার সাথে মাথা ঠেকালাম। কর্মীদের দেখতে পেলাম না। দু’জন কর্মীকে না দেখে কেঁদে অস্ফুট স্বরে বললাম, “আপনাদের পায়ে পড়ি বোন। আমার ময়না পাখিকে মুক্ত করে দিন। তার মৃ/ত্যুর জন্য আমাকে দায়ি করবেন না।”

এ শহরে তুমি নেমে এসো পর্ব ১৬

মেঝে তখন গরম হয়ে গেছে। সব কিছু ঘোলাটে। চোখে ঝাপসা দেখছি। টকটকে লাল হয়ে গেছে। অক্সিজেনের মাত্রা হ্রাস পেয়ে জ্ঞান হারালাম আমি। পরবর্তী দৃশ্য মনে নেই।

এ শহরে তুমি নেমে এসো পর্ব ১৮