এ শহরে তুমি নেমে এসো পর্ব ১৮

এ শহরে তুমি নেমে এসো পর্ব ১৮
ইফা আমহৃদ

শক্তহীন ডান হাতটায় স্যালাইনের ক্যানেল চলছে গত দুইদিন ধরে। খাবার গলা দিয়ে নামার চান্স নেই বললেই চলে। মাঝে মাঝে দুই এক সেকেন্ডের জন্য চোখের পাতা খুললে তিন সেকেন্ডের মাথায় চোখজোড়া আঁধারে তলিয়ে যায়। চোখজোড়া নিদ্রায় তলিয়ে যেতে ব্যস্ত। দুইদিন অর্থাৎ আটচল্লিশ ঘণ্টা সময় লাগল নিদ্রাকে বিদায় দিয়ে স্বজ্ঞানে ফিরতে। নিভু নিভু চোখে তাকিয়ে মিনিট দুই সময় মাথার উপর থাকা সিলিং ফ্যানের দিকে পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম।

অপূর্ব ভাই জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছেন। সামনে বসে আছেন সাদা পোশাক পরিহিতা এক নারী। নিঃসন্দেহে নার্স। শহরের নামকরা হাসপাতালে ভর্তি আমি। বামহাতে মোটা ব্যান্ডেজ দেখে কিছুক্ষণ সময় লাগল ঘটনা উপলব্ধি করতে। মনে হলো কিছুক্ষণ আগেই সবকিছু ঘটেছে। উত্তেজিত হয়ে চারপাশে খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। আমার ময়না পাখি কোথায়? সে কি নেই? আমি হাসপাতালে এলাম কীভাবে? ‘বেঁচে আছি’ বর্ণ দুটি কঠিন ঠেকল। আশেপাশে তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে বললাম,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“ময়না কোথায় তুই?”
আমার বলা শব্দগুলো আমি নিজেই শুনতে পেলাম না। দ্রুত পা রাখলাম মাটিতে। ক্লান্ত শরীর। মাথা ঘুরছে যার দরুন সবকিছু ঘোলাটে। ধোঁয়াতে আবৃত। নার্স মেয়েটা আমাকে লক্ষ্য করে। ধরার প্রচেষ্টা করছেন। অপূর্ব ভাইকে ডেকে বলেন, “স্যার, শুনছেন। প্যাসেন্ট উঠে গেছে।”
অপূর্ব ভাই তেজহীন শরীর নিয়ে এগিয়ে আসেন। আমার ডান হাতটা শক্ত করে ধরে থাকেন, যাতে ক্যানেল-এ কোনোরূপ রক্ত না উঠে। বে-সুরেলা গলায় বলেন, “শান্ত হ, আমি আছি। ভয় পাস না।”

মৃদু স্বরে বললাম, “আমার ময়না? ও কেমন আছে?”
অপূর্ব ভাই শুনতে পেলেন না। ঠোঁট জোড়ার দিকে সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ভ্র কুঁচকে বলেন, “আবার বল।”
“ম-য়-না কোথায়?” শব্দহীন স্বর। হাত ধরে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বলেন, “ময়না, এদিকে আয়।”
ময়না তার ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে এসে উড়তে লাগল। ছোটো ছোটো লাগছে। পশম নেই। তাপে পু/ড়ে গেছে। নেত্রযুগল পল্লবে ঢাকা পড়েছে। নোনা জল জমেছে।

আস্তে ধিরে গাল গড়িয়ে ঝরল। ময়না উড়ে এসে নাকের উপর বসল। কাঁদলে নাকটা আমার লাল টকটকে হয়ে যায়। ময়না তার ডানা দুটো দিয়ে আমার মুখমণ্ডল ঢেকে দিল। সর্বদা আমাকে কাঁদতে দেখলে এমন করে ময়না। কপালে ঠোকর দিয়ে বলে, “আরুপাখি, কাঁদে না। আরুপাখি কাঁদে না।”
“তোর কোনো ক্ষতি হয়নি তো ময়না? তোকে কে ছাড়িয়ে এনেছে?” আমার প্রশ্নে ময়না প্রত্যুত্তর করল না। অপূর্ব ভাই আগ বাড়িয়ে বলেন, “চাবি তো আমার কাছে। আমি ছাড়া কে ছাড়াবে? আমার উছিলায় আল্লাহ দুইবার বাঁচিয়ে দিয়েছে। (প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন) কেমন লাগছে এখন?
মাথা নেড়ে মৃদু স্বরে বললাম, “ভালো।”

নার্স মেয়েটা আমাদের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হিসাব মেলানোর চেষ্টা করলেন। সন্দিহান গলায় বলেন, “স্যার, পেসেন্ট কী বলছে আমি বুঝতে পারছি না। আপনি পারছেন। হাউ কিউট, আপনি লিপ রিপিট করতে পারেন?”
অপূর্ব ভাইকে কেমন অন্যমনস্ক দেখা যাচ্ছে। যাওয়ার আগে ছোটো করে বললেন ‘আজ রাতের বাসে আমরা গ্ৰামে ফিরছি।’ অপূর্ব ভাইয়ের থমথমে গলায় ভীত হলাম আমি। ‘তুর, শেফালী, তিয়াস ভাই, তিস্তা আপু কিংবা মামি’ – কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। আমার বিপদের সময় দূরে থাকার মতো মানুষ নয় বড়ো মামি। নিজের ভেতরের জবাব খুঁজে পেলাম না।

ভালো একটা ঢিলে ঢালা পোশাক পরতে সাহায্য করল নার্স। এক বাটি স্যুপ খেয়ে তৈরি হলাম। অপূর্ব ভাই ততক্ষণে ফিরে এসেছেন। আমাকে হাসপাতাল থেকে ডিস্চাজ করেছেন। ব্যান্ডেজ করা পা। নার্সকে শুষ্ক ধন্যবাদ দিয়ে আমাকে পাঁজাকোলা করে নিলেন। ময়না পাখি অপূর্ব ভাইয়ের কাঁধে বসেছে। হাসপাতালের সবাই আমাদের দেখছে। আমি লজ্জায় নত হয়ে ছিলাম। নিচে নামতেই বাস দেখতে পেলাম। বাসের সামনের সিটে বসালেন আমায়। পাশে তিনি। কিছু খাবার নিয়ে নিয়েছেন। সবকিছু অসহনীয় লাগছে আমার। মনে হচ্ছে আমার থেকে বড়োসড়ো কিছু লুকিয়ে রাখা হয়েছে। সন্দিহান গলায় ফিসফিস করে বললাম, “অপূর্ব ভাই, আমার শরীরটা ভালো লাগছে না। কালকে গেলে হয় না?”
ময়না পাখি টা কোলে বসে বলে, “একটু দেরি করে গেলে তুই চরম আফসোস করবি আরুপাখি। তোর অগোচরে অনেক কিছু ঘটেছে।”

অপূর্ব ভাই আমার পা জোড়া নিজের কোলে নিয়েন। আমি সরিয়ে রাখার চেষ্টা করতেই বললেন, “রাখ, ভালো লাগবে। একবার ভেবেছিলাম, অ্যাম্ভুলেন্সে করে যাবো। তোর তো অ্যাম্ভুলেন্সের সাইলেন্ট শুনলে ভয় করে। তাই গেলাম না।
এখন তোর স্বর একটু শুনতে পারছি। জ্ঞান ফেরার পর একটুও শুনি নি।”
বাস গতিশীল হলো। ঢাকার ব্যস্ত শহর পেরিয়ে ছুটল গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। জানালা থেকে উঁকি দিয়ে শহরকে জানালাম বিদায়। কখনো আসা হবে কি-না জানা নেই।

বাসস্টপে এসে বাস থামল রাত নয়টায়। অপূর্ব ভাইয়ের বুকের সাথে হেলে একটু ঘুম পড়েছিলাম। অপূর্ব ভাই ডেকে ঘুম ভাঙালেন। তবে বেশ আদুরে ও বিষাদে ভরা গলা, “আরু, আমরা পৌঁছে গেছি উঠ।”
ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে বললাম, “চলুন।” অপূর্ব ভাই পুনরায় আমাকে কোলে তুলে চললেন। বাসস্টপ জনবহুল স্থান। সারারাত ভিড় থাকে।

টঙ দোকানের সামনে ভিড় লক্ষ্য করা যায়। টুলে বসে চা খাচ্ছে যাত্রীরা। পরবর্তী বাস ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে যাবে। অপূর্ব ভাই টুলের উপর রেখে বললেন, “তুই বস, আমি দেখছি ভ্যান পাওয়া যায় কি-না?”
মাথা নেড়ে সম্মতি দিলাম। অপূর্ব ভাই চলে গেলেন। টঙ দোকানদার চা বানাতে বানাতে বলেন, “চেয়ারম্যান বাড়িতে যেই বোন ছিল না? মৃধা বাড়িতে বিয়ে দিছিল? সে-তো প্যারালাইড হয়েছিল অনেক আগে। গত দুইদিন হাসপাতালে ভর্তি ছিল। আজ শুনলাম…

বাক্য শেষ না করেই থেমে গেলেন।
আমাকে চেনা না থাকলেও অপূর্ব ভাইকে চেনেন। অপূর্ব ভাইকে উদ্দেশ্যে করে বললেন, “অপু বাড়ির কী খবর? মা/রা গেল দুপুরে। তুমি এলে রাতে। দুদিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি। আগে আসবা না।”
অপূর্ব ভাই ঠোঁট চেপে আকাশের দিকে তাকালেন। আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “আরু, আমার ফুফাতো বোন। হাসপাতালে ভর্তি ছিল গত দু’দিন। সবাই চলে আসলেও আমি আসতে পারি নি ওর জন্য।”
“তাড়াতাড়ি যাও, শেষ দেখা দেখতে পারো কিনা দেখো।”

ভ্যান চালক এসেছেন আগেই। অপূর্ব ভাইয়ের সাহায্যে ভ্যানে চললাম। গ্ৰামীণ ছোঁয়া আমার দেহে প্রবাহিত হয়েছে। ক্ষণে ক্ষণে কাঁপিয়ে দিচ্ছে লোম কূপ। এ আমার অচেনা গ্ৰাম। বুকের ভেতরে হাহা করে উঠছে।
বাড়ির সামনে এসে থামল ভ্যান গাড়ি‌। আমাকে কোলে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেন অপূর্ব ভাই। বাড়িতে এতো ভিড় দেখে কেঁপে উঠছি আমি। টঙ দোকানের লোকজনের কথা কি সত্যি হতে চলেছে? ‘চেয়ারম্যান বাড়ির লোক’ আমার মামার বাড়িকে বলে।

নানি মা আঁচল চেপে ঢুকরে কাঁদছেন। মামারা প্রাণহীন হয়ে বসে আছে। নানা ভাই নানি মাকে দিলেন, “কেঁদো না, এতে পারুল কষ্ট পাবে। অপু তো এখনো এলো না। মেয়েটাকে কতক্ষণ এভাবে রাখব?”
নানি মা উত্তেজিত হয়ে বলেন, “অপু আসলে আরুকে রেখে আসবে? গোসল দিয়ে দা/ফ/নের ব্যবস্থা করো।”
আমাকে সবার সামনে নামিয়ে দিলেন। চার মামি এসে ঘিরে ধরলেন আমায়। তাদের চোখে পানি থাকলেও ঝরছে না। বোনের রুহুর কষ্ট হবে বলে কাঁদা নিষেধ মামাদের।

এ শহরে তুমি নেমে এসো পর্ব ১৭

মামির আঁচল টেনে বললাম, “মামি সবাই এমন করছে কেন? দেখো না বাড়িতে কত ভিড়, কী হয়েছে গো?”
নানা ভাই নরম গলায় বলে, “সামনে তোর মা। শেষবারের মতো দেখে নে।”
বলেই ইশারা করলেন সামনে। হোগলায় সাদা কাপড়ে পেঁচিয়ে শায়িত আছেন একজন। পৃথিবীটা এক মুহুর্তের জন্য থমকে গেল আমার। হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে গেলাম। মৃদু হাওয়াতে উড়ে গেল চাদর। গলার স্বরটা হঠাৎ করেই উধাও হয়ে গেল। চোখেরা অনশন শুরু করেছে। মাথাটা ঘুরে নিস্তেজ হয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়লাম আমি।

এ শহরে তুমি নেমে এসো পর্ব ১৯