বর্ষণের সেই রাতে সিজন ২ পর্ব ১২

বর্ষণের সেই রাতে সিজন ২ পর্ব ১২
লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

অনিমা আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে মনে মনে হাজারও গালি দিচ্ছে তাকে। ঠান্ডায় কুঁকড়ে দাঁড়িয়ে আছে। অনিমাকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আদ্রিয়ান ভ্রু কুচকে তাকাল। বিরক্তি নিয়ে বলল,
” এভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আশি বছরের বুড়ির মত দাঁড়িয়ে না থেকে রুমে গিয়ে চেঞ্জ কর। যাও।”

অনিমা কথা না বাড়িয়ে দ্রুত ওর জন্যে বরাদ্দ রুমটাতে চলে এল। কাবার্ড থেকে ড্রেস নিয়ে ওয়াসরুমে চলে গেল ফ্রেশ হতে। বেশ অনেকটা সময় নিয়ে ভালোভাবে ফ্রেশ হয়ে বেড়িয়ে এল। বেড়িয়ে এসে দেখে আদ্রিয়ান ওর বিছানায় হাত ভাজ করে বসে আছে। অনিমা নিজের পোশাক একটু ঠিকঠাক করে দাঁড়াল। আদ্রিয়ান চোখের ইশারা করে টি-টেবিলের দিকে দেখিয়ে বলল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

” রাতে তো কিছু খান নি। এবার খাবারটা খেয়ে আমাকে একটু রেহাই দিন।”
অনিমা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অাদ্রিয়ানের দিকে। ও কিছু খায়নি লোকটা কীকরে জানল? আর ও না খেলেই বা তার কী? অনিমাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভ্রু নাচিয়ে বলল,
” হোয়াট? সার্ভেন্টরা বলল খাওনি তাই জেনেছি। আমি নিজে থেকে জানতে চাই নি। আমার এত ফালতু ইন্টারেস্ট নেই। তাও আবার তোমার ওপর।”

অনিমা এবারও ভীষণ রাগ হল। এভাবে কথা বলে কেন লোকটা? ও কী বলেছে কিছু? সবসময় শুধু ওকে অপমান করে, খোঁচা মেরে কথা বলবে। নিজেকে কী মনে করে? মিস্টার ওয়ার্লড? ও না হয় কয়েকটা দিন একটু মিস বিহেভ করেছিল, ভুলভাল বলে ফেলেছিল তাই বলে লোকটা এভাবে ওর থেকে বদলা নেবে? অনিমা মুখটা ছোট করে বলল,
” আমার খিদে নেই খাবোনা আমি। নিয়ে যান আপনি আপনার খাবার।”
আদ্রিয়ান উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
” কতদিন না খেয়ে থাকবে? আজ হোক বা কাল হোক আমার খাবারই খেতে পারব।”
অনিমা নিচু কন্ঠে বলল,
” আমি কাল সকালে চলে যাব।”

আদ্রিয়ানের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। রাগে হাত মুঠো করে ফেলল। এরকম রাগ ওর খুব কমই হয় যতটা এখন এই মুহূর্তে হচ্ছে। মেয়েটা ওর নিজের কেউ হলে এতক্ষণে তিনচারটা থাপ্পড় মেরে দিত। কিছুক্ষণ শক্ত চোখে অনিমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
” ওও আমি এবার বুঝতে পেরেছি যে আসার পর থেকে কেন তোমার মুড অফ। অভ্রর জন্যে ওই ছেলেগুলো তোমার সাথে কিছু করতে পারেনি তাই খারাপ লাগছে? এইজন্যই চলে যেতে চাইছ? যেটা আজ রাতে হয়নি, সেটা যাতে কাল রাতে হয়?”

অনিমা কান্নামিশ্রিত চোখে তাকিয়ে আছে আদ্রিয়ানের দিকে। এক্ষুনি চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পরবে। আদ্রিয়ান অনিমার দিকে একটু এগিয়ে গিয়ে ধমকের সুরে বলল,
” কান্না করলে সত্যি থাপ্পড়-টাপ্পড় মেরে দেব কিন্তু। কী? শুনতে খুব খারাপ লাগছে?”
” আপনি কিন্তু বারবার আমার চরিত্র নিয়ে কথা বলছেন। এধরণের কথায় মানে বোঝেন আপনি? একটা মেয়ে সম্পর্কে এতটা বাজে কথা কীকরে বলছেন।”
আদ্রিয়ান এবার অনিমার সামনে এসে ওর দিকে ঝুঁকে বলল,
” এটা আমার বাড়ি, আমার জায়গা। আমার যা ইচ্ছা আমি তাই বলব। তোমার ভালো না লাগলে আমি কী করতে পারি?”

অনিমা বুঝতে পারছে এই লোকটার সাথে কথা বলার কোন মানেই নেই। আসলে সব ওর কপালেরই দোষ। নিজের যেহেতু কোন জায়গা নেই তাই ওকে এসব সহ্য করেই বেঁচে থাকতে হবে। রাস্তায় ওইসব অমানুষদের থাবায় পরে নিজের সম্মান হারিয়ে মরার থেকে এখানে আদ্রিয়ানের এসব কথা শুনে পরে থাকাও ভালো। তাই কোনরকম তর্ক না করে চুপচাপ মাথা নিচু বিছানায় বসে পরল। তারপর ধীর কন্ঠে বলল,
” আপনি নিয়ে যান আমি আজ এখন আর খাবোনা।”

আদ্রিয়ান সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে দেখছে অনিমাকে। এরপর বাইরে বেড়িয়ে গেল। আরেকবারও বলল না খেতে। বেড়িয়ে চলে গেল। আদ্রিয়ান যাওয়ার দিকে তাকিয়ে চোখের জল ছেড়ে দিল ও। বিছানায় উঠে হেলান দিয়ে দুই হাটু গুটিয়ে বসে হাটুতে মুখ গুজে দিল ও। ওর মনে পরে গেল, ও না খেতে চাইলে ওর আব্বু কত যত্ন করে মেখে নিজের হাতে খাইয়ে দিল ওকে।একটু পরপর ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠছে। কিচ্ছু ভালো লাগছেনা। হঠাৎ করেই ডুকরে কেঁদে দিয়ে বলল,

” আব্বু কোথায় তুমি? দেখো এখানে তোমার রাজকুমারীকে সবাই কষ্ট দেয়, সবাই কাঁদায়, কেউ ভালোবাসেনা, কেউ না। প্লিজ ফিরে এসোনা আব্বু, প্লিজ।”
মাথায় কারো হাতের ছোঁয়া পেয়ে চমকে উঠল অনিমা। মাথা তুলে তাকিয়ে দেখে আদ্রিয়ান বসে আছে। অনিমা দ্রুত চোখ মুছে ফেলল। যদি সত্যি থাপ্পড় মারে। অনিমাকে অবাক করে দিয়ে আদ্রিয়ান পকেট থেকে রুমাল বের করে যত্ন করে চোখের জলগুলো মুছে দিলো। অনিমা খেয়াল করল আদ্রিয়ানের ডানহাত ভেজা। তারমানে কী হাত ধুতে গেছিল? আদ্রিয়ান টি-টেবিল থেকে খাবারের প্লেটটা নিয়ে এক লোকমা হাতে নিয়ে অনিমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,

” হা করো?”
অনিমা বোকার মত তাকিয়ে আছে আদ্রিয়ানের দিকে। আদ্রিয়ান একটু ধমকের সুরে বলল,
” হা করতে বলেছি।”
অনিমা একটু ভয় পেয়ে হা করল। আদ্রিয়ান অনিমার মুখে খাবার দিয়ে দিল। আদ্রিয়ান অনিমাকে নিজের হাতে খাইয়ে দিচ্ছে। অনিমা শুধু আদ্রিয়ানকে অবাক দৃষ্টিতে দেখছে আর আনমনে খাচ্ছে। আর আদ্রিয়ানের সেসবে কোন খেয়াল নেই। ও একমনে খাইয়ে চলেছে অনিমাকে। খাওনো শেষে জলটাও নিজের হাতে খাইয়ে দিল। নিজের হাতেই অনিমার মুখ মুছে দিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল,

“চুপচাপ ঘুমিয়ে পর।”
অনিমা কৌতুহলী কন্ঠে বলল,
” আপনি কীকরে জানলেন আমার সাথে কী হয়েছিল?”
” যেই সুন্দর অবস্থা করে বাড়ি ফিরেছ যে কেউ বুঝবে। আর আজ না হওয়া অঘটন টা যদি ঘটিয়ে ফেলার ইচ্ছা না থাকে তাহলে বাড়ি থেকে যাওয়ার কথা মাথায় এনোনা। আর যদি খুব বেশি শখ থাকে আবার এসবের শিকার হওয়ার দেন ইউ ক্যান গো। ”
অনিমা এবার একটু অভিমন মিশ্রিত কন্ঠে বলল,

” আপনি এভাবে কেন কথা বলেন আমার সাথে? কই বাকিদের সাথেতো এভাবে কথা বলেন না? কথায় কথায় এভাবে হার্ট করা কী খুব প্রয়োজন?”
আদ্রিয়ান অনিমার চোখে চোখ রেখে বলল,
” কারণ অন্যরা আমায় সুযোগসন্ধানী বলেনা, আমি সামনে এলেই এমন বিহেভ করেনা যেরকম একজন রেপিস্ট সামনে এলে করে। তারা আমাকে হিংস্র পশু ভাবেনা তাই দেখলে ভয়ে গুটিয়েও জায়না। আমি জাস্ট একদিন তোমার সাথে এভাবে কথা বলছি বলেছি বলে তুমি হার্ট হলে? অথচ একয়েকদিন যাবত তুমি আমার সাথে যেই ব্যবহারগুলো করেছে সেগুলো কী ছিল?”
অনিমা নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। আদ্রিয়ান একটু চুপ থেকে আবার বলল,

” তুমি মেয়ে বলে তোমার যেমন সম্মান, আত্মসম্মান আছে। ঠিক তেমন আমারও আছে। এরকম নয় যে ছেলে বলে আমার এসব নেই। ছেলে আমি অপমানবোধ হবেনা সেটা ভাবার কোন কারণ নেই। আমি তোমাকে ঐসব কথা বলাতে যেমন তুমি হার্ট হয়েছো তোমার আত্মসম্মানে লেগেছে ঠিক সেরকমই তুমি যখন আমাকে একবার বলার প্রয়োজন মনে না করেই রুম চেঞ্জ করে ফেললে তখন আমিও হার্ট হয়েছি, চার চারটা দিন আমার বেডরুমে সুরক্ষিত থাকার পরেও ঐদিন ঐ ছোট্ট ঘটনার জন্যে আমি তোমার আশেপাশে এলেই যখন ভয়ে গুটিয়ে যেতে ঠিক যেভাবে কোন রেপিস্ট বা হিংস্র জন্তু সামনে গেলে হয়, তখন আমারও আত্মসম্মানে লেগেছে।

বর্ষণের সেই রাতে সিজন ২ পর্ব ১১

কাঁধে হাত রাখায় যখন ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে দিলে তখন? আজ রাতে কফি করতে যাচ্ছিলাম কিচেনে, তোমার রুমের দরজা খোলা ছিল যখন পাস করছিলাম তখন দেখলাম ঠান্ডায় কাঁপছিলে তাই তোমার গায়ে চাদরটা দিয়ে দিতে এসছিলাম। মানুষ তো তাই মুখ ঘুরিয়ে যেতে পারিনি। কিন্তু তুমি ধাক্কা দিলে তো দিলেই তারসাথে কী বললে? ‘যখন তখন আমাকে এভাবে টাচ করবেন না?’ সিরিয়াসলি? কথাটার মানে বোঝ তুমি? তখন আমি অপমানবোধ করিনি? এবার বল অপমান কে কাকে বেশি করেছে?”
অনিমা মাথা নিচু করে আছে। সত্যিই এতক্ষণতো এতোটা গভীরভাবে ভাবেনি। সত্যিই ব্যাপারটা খুবই বাজে হয়েছে। অনিমা কিছু বলবে তার আগেই আদ্রিয়ান বলল,

” যাক গে। অনেক রাত হয়েছে। শুয়ে পরো।খানিকবাদে ভোরও হয়ে যাবে। কাল সকাল সকাল আমার আবার কাজ আছে। একটু না ঘুমালে কাজ করতে পারব না। ”
অনিমা শুয়ে পরল। নিজে চাদর জরানোর আগেই আদ্রিয়ান ওর গায়ে চাদর দিয়ে দিল। এরপর কিছু না বলেই দরজা চাপিয়ে দিয়ে চলে গেল নিজের রুমে। অনিমা শুয়ে শুয়ে ভাবছে যে মাত্র কিছুক্ষণের জন্যে বেড়িয়েছিল ও।

তাতেই ঐ হায়নাগুলো ওকে একা পেয়ে সুযোগ নেওয়াল চেষ্টা করেছে। ছাড় দেয়নি। কিন্তু ওপরদিকে একটা ছেলের বেডরুমে চারটা রাত কাটানোর পরেও তো ছেলেটা এমন কিছুই করেনি। এমনতো না যে চাইলে করতে পারত না। চাইলেই পারত। সেখানে শুধু শুধুই ও একদিন লোকটার সাথে মিসবিহেভ করেছে। সত্যিই তো আজ একটা দিন একটু খারাপ কথা বলাতেই যদি ওর এতটা কষ্ট হয়ে থাকে, আত্মসম্মানে লেগে থাকে সেখানে ঐ ছেলেটাকে তো ও কয়েকদিন যাবত অপমান করছে। হ্যাঁ হয় মুখে খুব বেশি কিছু বলেনি কিন্তু আচরণ দিয়ে তো অপমান করেছে। যেখানে ছেলেটা নিঃস্বার্থভাবে ওর দেখাশোনা করে যাচ্ছে। কালকেই আদ্রিয়ানের সাথে কথা বলে সবটা ঠিক করে নিতে হবে। একটা ‘সরি’ তো ডিসার্ব করে সে।

বর্ষণের সেই রাতে সিজন ২ পর্ব ১৩