বর্ষণের সেই রাতে সিজন ২ পর্ব ২৭

বর্ষণের সেই রাতে সিজন ২ পর্ব ২৭
লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

আদ্রিয়ানের প্রতিটা বাক্যে অনিমা লজ্জায় এতোটাই কুঁকড়ে যাচ্ছে যে এখনও চোখ খুলে তাকাতেই পারছেনা। আদ্রিয়ান অনিমার চুল থেকে নাক সরিয়ে অনিমার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
” এভাবে লজ্জা পেওনা লজ্জাবতী। তোমার লজ্জায় লাল হয়ে যাওয়া মুখটা দেখে কিন্তু আমার নিজেকে সামলে রাখতে ভীষন কষ্ট হয়।”

কথাটা বলে অনিমার মুখের দিকে তাকিয়ে হালকা করে ফু দিল। অনিমা চোখ আরো খিচে বন্ধ করে ফেলল। আদ্রিয়ান মুচকি হেসে বলল,
” পরে কিছু করে ফেললে আবার ক্যারেক্টারলেস উপাধি দিয়ে দেবে। যদিও তোমার কাছে হাজারবার ক্যারেক্টারলেস হতে পারি।”
অনিমা চোখ খুলে তাকাল আদ্রিয়ানের দিকে তারপর আবার চোখ নামিয়ে নিল। লজ্জা লাগছে ভীষণ ওর। আদ্রিয়ান বলল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

” আর হ্যাঁ কফিটা কিন্তু খেয়েছি আর মগটাও কিন্তু ভাঙিনি। যদি তুমি সত্যিই ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে দাও? তোমার চোখের জল কীকরে সহ্য করব হুম? আর তাছাড়াও তোমার ওপর রেগে থাকতে পারিনা আমি। এটাকে আমার বদঅভ্যাস বলতে পারো। কিন্তু তোমার প্রতি রাগ বা অভিমান আসতে চায়না আমার। অন্যকিছু আসতে চায়। বলব কী?”
অনিমা মাথা নিচু রেখেই ‘না’ বোধক মাথা নাড়াল। ওর যে আদ্রিয়ানের কথাগুলোতে ভীষণ লজ্জা লাগছে।

” বলেদে ভাই আমার বলে দে। পেটের মধ্যে আর কত রাখবি বলত? এবার বলেদে।”
কারো মুখে একথা শুনে অনিমা আর আদ্রিয়ান দুজনেই একে ওপরের থেকে দূরে সরে দাঁড়াল।জাবিন দাঁত বার করে হাসছে। ও পেছনে হাত নিয়ে দুলতে দুলতে এসে ভ্রু নাচিয়ে বলল,
” আহা, কত প্রেম। প্রেম আজ আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে পরেছে। এ প্রেমের জয় হোক।”
আদ্রিয়ান একটু গলা ঝেড়ে বিরক্তি নিয়ে বলল,

” তোর মত কাবাবের হাড্ডিরা যতদিন দুনিয়াতে আছে প্রেমের আর জয় হবেনা।”
কথাটা শুনে জাবিনের মুখের হাসি উধাও হয়ে গেল। ও মুখ কালো করে বলল,
” এভাবে অপমান? আমি এখন কাবাবে হাড্ডি হয়ে গেলাম? নাহ, এ অপমান মানা যায় না। আমি অনশন কর। হুহ।”
আদ্রিয়ান হেসে বলল,

” তুই করবি অনশন? তাহলেই হয়েছে। প্রতি দুই ঘন্টা অন্তর অন্তর তো কিছু না কিছু খেয়েই চলেছিস। রাক্ষুসী একটা। তোর যার সাথে বিয়ে হবে তাকে নিয়ে যথেষ্ট চিন্তিত আমি। বেচারা তোকে খাবার খাওনোর জন্যেই বাপ দাদার সম্পত্তি বেঁচে ফেলতে হবে। বাকি সব বাদ দিলাম।”
” তুই এভাবে বলতে পারলি?”
” বলবনা। যদি তুই নিজের ভাই আর ভাবীর রোমান্সের মধ্যে কাবাব হয়ে না আসিস।”
আদ্রিয়ানের এমন লাগামহীন কথা শুনে অনিমা আর দাঁড়াল না লজ্জা পেয়ে চলে গেল ওখান থেকে। ভাই বোন দুটোই বেহায়া। নাহলে এতো লাগামহীন কথা বলে?

রিক পার্টি অফিসে নিজের কেবিনে বসে কিছু কাগজ দেখছে। তবে ওর এসবে একদমই মন নেই। কোনকালেই এসব রাজনৈতিক কাজ ভালো লাগেনা ওর। কিন্তু বাধ্য হয়েই করতে হচ্ছে। বিরক্তি কী জিনিস সেটা এখন হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছে ও। ফোনের আওয়াজে বিরক্তি আরও বৃদ্ধি পেল ওর। স্ক্রিনে তাকিয়ে আদ্রিয়ানের নাম দেখে বিরক্তি কিছুটা কাটল। রিসিভ করে বলল,

” হ্যাঁ বল হঠাৎ ফোন?”
” ইদানীং খুব ব্যস্ত আছিস বলে মনে হচ্ছে?”
” হ্যাঁ। সামনে ইলেকশন, এসব নিয়ে ব্যস্ত আরকি।”
আদ্রিয়ান বিরক্তি নিয়ে বলল,
” এতোবছর কষ্ট করে ডাক্তারি পড়ে এরপর রাজনীতি করার লজিকটা আমি এখনও বুঝছিনা।”
রিক ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল,
” এসব ছাড়। কিছু বলবি?
“আদিবের বিয়ে এই পনেরো তারিখ। তুই আসবি?”
” তোর বন্ধু আদিব?”
” হুম।”
রিক একটু ভেবে বলল,

” আচ্ছা দেখছি। এখনও শিওর নই তবে আসলেও একেবারে বিয়ের দিনই আসব।”
” হুম দেখ। আসলে সবার মাঝে তোরও ভালো লাগবে।”
আরও কিছুক্ষণ টুকিটাকি কথা বলে ফোনটা রেখে দিল রিক। লম্বা একটা শ্বাস ফেলে ভাবতে লাগল অনিমা কোথায় যেতে পারে? ও এতো সোর্স লাগিয়ে খুঁজছে কোথাও তো পাওয়া উচিত। এভাবে তো ভ্যানিস হয়ে যেতে পারেনা একটা মেয়ে।

ঠিক পাশের রুমেই কবির শেখ আর রঞ্জিত চৌধুরী তাদের নিকৃষ্ট পরিকল্পনায় ব্যাস্ত। তাদের যেখানে যত অবৈধ কারবার আছে সবকিছুরই টাকা পয়সার হিসেব করছেন ওনারা। তবে মাদারের খোঁজ পেয়েছেন ওনারা। উনি সিলেট আছেন এখন। তবে ঠিক কোন জায়গায় আছে সেটা এখনও জানেনা। আর সেটা জানা ওনাদের জন্যেই ভীষণ জরুরি। ওনাদের বর্তমান পরিকল্পনা এগোতে হলে মাদারকে প্রয়োজন।

পাঁচদিন পরেই আদিবের বিয়ে। বিয়ের জন্যে যেই বাংলো ভাড়া করা হয়ে নিকট আত্মীয়রা সবাই এসে গেছে সেখানে। আদ্রিয়ানরাও ওই বাড়িতে চলে গেছে। যদিও এক সপ্তাহ পরে যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু আদিবের জোড়জুড়িতে এতো আগে চলে আসতে হল। সকলের কাছে অনিমার পরিচয় আদ্রিয়ানের ফুঁপাতো বোন হিসেবেই দেওয়া হয়েছে।

কারণ আমাদের সমাজে এক মেয়ের এভাবে কোন পরপুরুষের বাড়িতে থাকাকে ভালো চোখে দেখেনা। আর আদ্রিয়ান চায়না অনিমাকে কেউ কোনরকম কথা শোনাক বা অনিমা কারো কাছে ছোট হোক। গতকাল রাতে এসছে ওরা এখানে। আজ সকালে আদিবের ফুপির বাড়ি থেকেও তিনজন চলে এলো। ওর ফুপা, ফুপি আর তাদের ছেলে আরমান। আরমান এসে ফ্রেশ হয়ে বাইরে এসে দেখল ড্রয়িং রুমে তিনচারজন মেয়ে মিলে ফল কাটছে আর গল্প করছে। ওখানে জাবিন, অনিমা আর আদিবের দুজন কাজিন ছিল।

কিন্তু অনিমার দিকে আরমান বেশ অনেক্ষণ তাকিয়ে রইল। বলা বাহুল্য সেই দৃষ্টিতে খারাপ কিছু ছিলোনা। অনেক্ষণ যাবত আদ্রিয়ান অনিমাকে বিরক্ত করে যাচ্ছে। যেখানে যায় সেখানেই পেছন পেছন ঘুরঘুর করে বেড়াচ্ছে। অনিমা বেশ বিরক্তও হচ্ছে। অনিমা ছাদে কাপড় মেলে দিয়ে নিচে আসার সময় হঠাৎ কেউ ওর হাত টেনে ধরল। আর এটা আদ্রিয়ান ছাড়া আর কে হবে? অনিমা বিরক্ত হয়ে আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল,

” সমস্যা কী আপনার বলবেন? সকাল থেকে জ্বালিয়ে যাচ্ছেন। এভাবে ইরিটেড করার কোন মানে আছে?”
আদ্রিয়ান পাত্তা না দিয়ে মুচকি হেসে অনিমার হাত ধরে নিজের কাছে টেনে বলল,
” আজ একটু বেশিই সুন্দর লাগছে তোমাকে। তারওপর নেভিব্লু কুর্তি পরেছ। এই রং টাতে তোমাকে বেশ মানায়। তাই গার্ড দিচ্ছি যাতে কেউ নজর না দেয়। ঐ আরমান সকল থেকে তোমাকে কীভাবে জেন দেখছে। যেটা আমার একদম ভালো লাগেনি। আমার জিনিসে অন্যকারো নজর পরবে ব্যাপারটা আমার মোটেও পছন্দ না।”

” আমি জিনিস?”
” সবার ক্ষেত্রে না। শুধু আমার ক্ষেত্রে। বাকি সব দিক দিয়ে তুমি স্বাধীন। শুধু এই দিকটা বাদে। না কেউ তোমার দিকে নজর দিতে পারবে। আর না তুমি অন্য কারো দিকে নজর দেবে। বুঝলে?”
” যদি আমি দেই তো?”
” কেন কাউকে মনে ধরেছে?”
অনিমা আদ্রিয়ানকে জ্বালানোর জন্যে বলল,
” তা জানিনা। কিন্তু ইউ নো হোয়াট! ঐ আদিব ভাইয়ার ফুপির ছেলেটা আছেনা, আরমান। ওনাকে কিন্তু দেখতে বেশ ভালো। বলিউড স্টার।”

আদ্রিয়ান একটু রেগে গেল। চোখে রাগ থাকলেও মুখে রহস্যময় হাসি ফুটিয়ে অনিমার হাতটা হালকা চাপ দিয়ে ধরে বলল,
” বেশি সাহস ভালোনা জানপাখি। আমাকে তুমি এখনও পুরোটা চেনোনা।”
” হাত ছাড়ুন কাজ আছে নিচে।”
” কেন আরমানকে দেখতে ইচ্ছে করছে বুঝি?”
” হ্যাঁ।”
আদ্রিয়ান অনিমার হাতে আরেকটু চাপ দিয়ে ধরে বলল,

” আবার বলো?”
অনিমা মেকি হেসে বলল,
” আমিতো মজা করছিলাম। নিচে কাজ আছে। ছাড়ুন প্লিজ।”
” যদি না ছাড়ি?”
” আমি চেঁচাবো।”
” চেঁচাও।”
অনিমা এবার করুণ চেহারা করে বলল,
” প্লিজ।”

আদ্রিয়ান আর অনিমাকে বিরক্ত না করে ছেড়ে দিল। অনিমা প্রায় দৌড়েই নিচে চলে গেল সবার কাছে। নিরিবিলি জায়গায় থাকা মানেই আদ্রিয়ানের জ্বালাতন সহ্য করা
বিকেলে সবাই বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত। বিয়ে বাড়িতে তো হাজারটা কাজ থাকে। আদিবের দাদি নামক মানুষটা অন্যরকম। রশিক প্রকৃতির, কিন্তু কিছুকিছু ক্ষেত্রে আবার কেমন কঠিনও। অনিমাকে এরমধ্যেই নাতনির মত দেখতে শুরু করেছে। তবে এরমধ্যে দুবার বকাও খেয়ে ফেলেছে। আদ্রিয়ানের সাথে বেশ ভাব। যদিও তার কিছু কিছু কথায় আদ্রিয়ান নিজেও বিরক্ত হচ্ছে।
আদ্রিয়ান, আশিস আরও কজন মিলে ড্রয়িং রুমের সাইডেই কাজ করছিল। বড় একটা ঝুড়ি লাগবে তাই অনিমা আদ্রিয়ানকে উদ্দেশ্য করে চেঁচিয়ে বলল,

” আদ্রিয়ান এদিকে একটা ঝুড়ি লাগবে।”
ঠিক তখনই আদিবের দাদি রাগী গলায় হালকা ধমকে বলল,
” এই মেয়ে ও না তোমার বড় ভাই হয়? আদ্রিয়ান কী হ্যাঁ? ভাইয়া বলে ডাকতে পারছ না?”
অনিমা মাথা নিচু করে ফেলল। কেউ কিছু বলল না কারণ কাজিন ভাইকে তো স্বাভাবিকভাবে ভাইয়া বলেই ডাকার কথা। আদিব, আশিস, জাবিন ওরা মিটমিটিয়ে হেসে যাচ্ছে। আদ্রিয়ানের তো মনে মনে এই বুড়ির ওপর ভীষণ রাগ হচ্ছে। এখন নিজের হবু বউয়ের মুখে ভাইয়া ডাক শুনিয়ে ছাড়বে? এমন দুর্ভাগ্য কজনের হয়? অনিমা আর কী করবে অসহায় মুখ করে বলল,

” ভাইয়া? ঝুড়িটা দিয়ে যান।”
আদ্রিয়ান কিছু বলবে তার আগেই আরমান এসে একটা ঝুড়ি এনে অনিমার দিকে তাকিয়ে বলল,
” এই নাও তোমার ঝুড়ি।”
অনিমা জোরপূর্বক একটা হাসি দিয়ে বলল,
” থ্যাংক।”
আরমান হেসে বলল,
” মাই প্লেজার, বিউটি।”
ব্যাস! হয়ে গেল। দাদি যে আগুন লাগিয়েছে আরমান সুন্দর করে তার মধ্যে ঘি ঢেলে দিয়েছে। অনিমা একটা শুকনো ঢোক গিলে আদ্রিয়ানে দিকে তাকিয়ে দেখে আদ্রিয়ানের কোন পাত্তা নেই। সে নিজের মত কাজ করছে। আদিব ওরা পারছেনা এখন ঘর কাঁপিয়ে হাসতে। অনিমা আদ্রিয়ানের অবস্থা দেখে ভীষণ হাসি পাচ্ছে।

বর্ষণের সেই রাতে সিজন ২ পর্ব ২৬

সন্ধ্যার পর ড্রয়িংরুমে সবাই মিলে গল্প করছে। সবাই বলতে ইয়াং রাই। তাও ওরা নিজেরা। বাইরের কেউ নেই। আদ্রিয়ান তো বেশ ফুলে আছে বিকেল থেকেই। অনিমা আর কী করবে ও অসহায়ের মত বসে আছে। এসবে ওর কী দোষ? এরমধ্যেই একজন বলে উঠল,
” হোয়াটস আপ গাইস?”
সবাই সেদিকে তাকাল। লোকটাকে দেখে অাদ্রিয়ান, আদিব, আশিস তিনজনই অবাক হল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তিনজনেই ‘শালা’ বলে চেঁচিয়ে উঠল। তিনজনে গিয়েই জড়িয়ে ধরল ছেলেটাকে। আদ্রিয়ান বলল,

” তোর ফ্লাইট তো কাল ছিল তাইনা?”
” সারপ্রাইজ।”
আদ্রিয়ান সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। ওর নাম নাহিদ। ইউএসএ থেকে এলো আজ। আদিবের বিয়ের জন্যেই এসছে। এরকমটাই সবাই জানে। অনিমার সাথে পরিচয় করাবে তার আগেই নাহিদ বলল,
” ওয়েট! ওয়েট! লেট মি গেস। দিস ইজ ভাবী রাইট? অনিমা?”
আদ্রিয়ান নাহিদের কাধে হাত রেখে বলল,
” আরে বাহ। খুব জলদি চিনে ফেললি?”
” তোর মুখে ডেসক্রিপশন শুনতে শুনতে আমার মুখস্থ হয়ে গেছে। যাই হোক ভাবী আমি নাহিদ। সম্পর্কে আপনার দেবর হই। ”
অনিমা মুচকি হেসে বলল,
” ভালো আছেন?”
” আমি সবসময়ই ভালো থাকি।”

এরপর সবার সাথেই জমিয়ে আড্ডা দিল ও। নাহিদ ছেলেটা বেশ মিশুক। সবার সাথে কিছুক্ষণের মধ্যেই দারুণভাবে মিশে গেল। যেন সবাই ওর পূর্বপরিচিত। সবারই বেশ ভালো লেগেছে ওকে। আদ্রিয়ান সবার আড়ালে চোখের ইশারায় নাহিদকে কিছু বলল, নাহিদও কিছু ইশারা করে অনিমার দিকে একপলক তাকালো। আদ্রিয়ানের নাহিদকে এখানে আনার উদ্দেশ্য শুধু বিয়েটা না, অনিমাও। যেটা কেউ জানেনা।

বর্ষণের সেই রাতে সিজন ২ পর্ব ২৮