বাবুইপাখির অনুভূতি পর্ব ১২

বাবুইপাখির অনুভূতি পর্ব ১২
লেখিকা: তানজিল মীম

পরন্ত বিকেলের হাম হাম ঝর্ণা দেখা শেষ করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রায় সন্ধ্যা পেরিয়ে গিয়েছিল নীরব ওদের। সারা বিকালটা বেশ ভালোই কেটেছে সবার। একরাশ সিদ্ধতা, একরাশ মুগ্ধতা আর অভিরাম ভালো লাগার মাঝ দিয়েই চলে গেল সবার।’
ক্লান্ত মাখা শরীর নিয়ে ধপাস করে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো সোহান, শরীফ ও সুজন। আর এদের অবস্থা দেখে নীরব তার গলা থেকে ক্যামেরাটা খুঁলে টেবিলে উপর রেখে বললো,
‘ কিরে এইটুকুতেই হাঁপিয়ে গেলি?’
নীরবে কথা শুনে সোহান ক্লান্ত মাখা শরীর নিয়ে বললো,
‘ হাঁপাই নি দোস্ত জাস্ট ক্লান্ত লাগছে।’
উওরে নীরব মুচকি হেঁসে বললো,
‘ তা তো দেখতেই পাচ্ছি।’
বলেই চলে যায় সে ওয়াশরুমের দিকে।’ আর বাকি রইলো মেয়েরা তাঁরাও ক্লান্ত শরীর নিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে শুয়ে রইলো যে যার রুমে।’

রাত প্রায় তখন দশটার কাছাকাছি। যদিও শহরের হিসেবে এই সময়টাকে গভীর রাত বলা যায় না। কিন্তু গ্রামীণ মাটিতে যেন এর একদমই উল্টো। প্রায় সবাই বেশ ঘুমে মগ্ন তখন। হঠাৎ অথৈদের রুমের দরজা খুলে বাহিরে বের হলো অথৈ। এমনটা নয় সে ঘুমায় নি হুট করেই ঘুমটা ভেঙে যাওয়াতে রুম থেকে বের হয় অথৈ। এমনিতেও রাতের মৌসুম দেখতেও বেশ লাগে তার। অথৈ বারান্দার ধারে রেলিং এ হাত দিয়ে কিছুটা আরাম করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো চুপটি করে। বারান্দায় থাকা লাইটগুলো জ্বল জ্বল করছিল তখন, হয়তো এই লাইটগুলো সারারাতই জ্বালানো থাকে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

বেশ খানিকটা দীর্ঘ শ্বাস ফেললো অথৈ তারপর তাকালো সে আকাশের দিকে জোৎসা ভরা আলোতে প্রায় সবকিছুই দেখা যাচ্ছে আকাশটাও রয়েছে বেশ চুপচাপ কোনো তাঁরা নেই,হাল্কা হাল্কা মেঘেরা এসে হাতছানি দিচ্ছে আকাশ পানে হয়তো বৃষ্টি হবে আবার হয়তো হবে না। তবে অথৈ যতটা বুঝছে পারছে আকাশ দেখে আজ সারারাত আকাশে মেঘ থাকবে তবে বৃষ্টি না হওয়ার সম্ভাবনাটাই যেন বেশি। প্রকৃতির রূপ এটা কখন কোথায় কিভাবে বদলে যাবে এটা বোঝা বড়ই দায় এটা শুধু আল্লাহই ভালো জানেন। মানুষ তো শুধু আনুমানিক কিছু একটা বলে দেয় তবে এটা যে সবসময় ঠিক হবে এমনটা নয়।

কখনো কখনো মানুষের আনুমানিকতা টাই ঠিক হয় আবার কখনো কখনো হয় না। অথৈ তার চোখের চশমা খুলে ফেলেছে অনেক আগেই। বেশ ভালো লাগছে এখন যেন এই চশমাটার জন্য এই রাতের প্রকৃতি দেখতে তাঁর ব্যাঘাত ঘটেছিল। এমন সময় হঠাৎই এক দমকা হাওয়া আসলো পুরো বারান্দা জুড়ে, হাওয়াটা এতটাই তীব্র ছিল যে এক নিমিষেই গাছের পাতা আর ফুলের পাপড়িদের ঝড়ে ফেললো অনেক। সাথে ছিঁটকে আসলো কিছু ধুলো। হুট করে এমনটা হওয়াতে বেশ অপ্রস্তুত ছিল অথৈ যার ফলে কিছুটা ধুলো চলে যায় তাঁর চোখেও। চোখে কিছু গিয়েছে এটা বুঝতে পারার সাথে সাথে চোখে হাত দিয়ে ডলতে শুরু করলো অথৈ।’

এমন সময় সেখানে উপস্থিত হলো নীরব। আচমকা তাদের চালের উপর কিছু পরার শব্দ পেতেই ঘুম ভেঙে যায় তার আর-একবার ঘুম ভেঙে যাওয়া মানে আগামী দু থেকে তিন ঘন্টায় তার চোখে ঘুম নেই। নীরব দরজা খুলে বাহিরে বের হতেই তার থেকে বেশ খানিকটা দূরে অথৈকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বেশ অবাক হয় সে। তেমন কিছু না ভেবেই এগোতে থাকে নীরব অথৈ দিকে কারন সে বুঝতে পেরেছে অথৈ ঠিক নেই।’
‘ তুমি এখানে দাঁড়িয়ে কি করছো?’

হঠাৎই কারো কন্ঠ কানে আসতেই বেশ খানিকটা চমকে উঠলো অথৈ। তবে বেশি ঘাবড়ালো না কারন এমনটা নয় অথৈ ভয়েসটা আসলে কার এটা বুঝতে পারে নি। অথৈ বেশ বুঝতে পেরেছে এটা নীরবের গলা। অথৈ তার চোখ থেকে হাত সরিয়ে আস্তে আস্তে চোখ খুলে দেখতে চাইলো সামনে। কিন্তু চোখ খুলতেই হাল্কা জ্বালা -পোড়া অনুভব করতেই চটজলদি চোখ বন্ধ করে আবারো হাত দিয়ে চোখ ডলতে শুরু করলো সে। অথৈর কাজে নীরবের বুঝতে বাকি নেই অথৈ কেন ঠিক নেই। নীরব অথৈর দিকে আর একটু এগিয়ে এসে ওর হাত চেপে ধরে বললো,
‘ কুল ডাউন আমি দেখছি।’
বলেই অথৈর কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ওর চোখে ফুঁ দিতে লাগলো নীরব। নীরবের কাজে শুরুতে একটু চমকে গেলেও পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিলো অথৈ।’
অল্প কিছুক্ষনের মধ্যেই অথৈর চোখ ঠিক হয়ে গেল কিন্তু হাত দিয়ে ডলার কারনে হাল্কা লালচে বর্ন ধারণ করেছে অথৈর চোখ। নিজের চোখে হাল্কা আরাম ফিল হতেই অথৈই তার চোখের চশমাটা পড়ে নীরবের দিকে তাকিয়ে বললো,

‘ থ্যাংক ইউ।’
উওরে নীরবও মুচকি হেঁসে বললো,
‘ ইট’স ওকে! তা এত রাতে এখানে কি করছো ঘুমাও নি?’
নীরবের কথা শুনে অথৈ বেশ সরল কন্ঠে বললো,
‘ আসলে ঘুমাই নি বললে ভুল হবে হুট করেই ঘুম ভেঙে যায় তাই আরকি এখানে এসে দাঁড়িয়ে ছিলাম।’
‘ ওহ,
‘ হুম তা আপনি ঘুমান নি?’
‘ আমি, আমারও হুট করেই কিছু একটা পড়ার শব্দ পেতেই ঘুম ভেঙে যায়।’
‘ ওহ হয়তো তখন তীব্র বাতাসের কারণে গাছের ডাল ভেঙে পড়েছিল।’
‘ হতে পারে।’
‘ হুম।’

এরপর নেমে এলো দুজনের মাঝে নীরবতা। পাশাপাশি বারান্দায় নীরবে দাঁড়িয়ে রইলো দুজন। আকাশটা এখনও মেঘাছন্ন,হাল্কা হাল্কা বাতাস বইছে চারপাশে, বাতাসে গাছের পাতাগুলো নড়ছেও বারংবার। অথৈর ইচ্ছে করছিল এখনই সে বলে দিক আহির কথাটা কিন্তু আবার বললো না কে জানে হয়তো এমনটা করলে আহি রেগে যাবে। কিছুক্ষন নীরবতায় কাটিয়ে বলে উঠল অথৈ,
‘ এখন তবে ঘুমাতে যাচ্ছি আপনিও যান,রাত তো অনেক হয়েছে?’
উওরে নীরবও অথৈর দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে বললো,
‘ হুম।’

উওরে অথৈও আর কিছু বললো না নিজের চোখের চশমাটা একবার ঠিক করে হাউসি দিতে দিতে চলে গেল নিজের রুমের দিকে। বিছানায় তখন মীরা গভীর ঘুম মগ্ন অথৈ বেশি কিছু না ভেবে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে শুয়ে পড়লো মীরার পাশ দিয়ে।’
অন্যদিকে অথৈই যেতেই নীরব আবারো তাকালো আকাশের দিকে। মুগ্ধ করা মেঘাছন্ন আকাশ, পাশেই গ্রানযুক্ত মুগ্ধ করা ফুলের সুবাস। পুরো বারান্দা জুড়েই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ফুলের পাপড়ি, জোরে এক নিশ্বাস ফেললো নীরব বেশ ভালো লাগছে তার তবে ঘুম আসছে না। নীরব কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে তার পাশ দিয়েই দিলো ছিল একটা দোলনা,দোলনাটাতেই ফুলের পাপড়িতে ভর্তি, নীরব বেশি কিছু না ভেবে দোলনার এক সাইডের পাপড়িগুলো হাত দিয়ে সরিয়ে বসে পড়লো দোলনায়। কেন যেন এই মুহূর্তে অথৈকে নিয়ে ভাবতে ইচ্ছে করছে তার?’

ঘড়ির কাঁটায় প্রায় এগারোটা বেজে আটান্ন মিনিট ওই বলতে গেলে প্রায় বারোটা বেজে গেছে। রাত অনেক হলেও চোখে ঘুম নেই আদ্রিয়ানের। এর দুটো কারন এক তার দুঃস্বপ্ন আর দুই আশেপাশে প্রচুর জীবজন্তু ডাকছে যেমন শেয়াল,পেঁচা। বিছানায় চুপচাপ শুয়ে শুয়ে মোবাইলে গেম খেলছে সে আজ সারারাত হয়তো না ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিবে সে। কিন্তু না বেশ বিরক্ত লাগছে আদ্রিয়ানের আদ্রিয়ান তার মোবাইলটাকে বিছানার ওপর ছুঁড়ে ফেলে শোয়া থেকে উঠে বসলো, তারপর চোখ মুখ কিছুক্ষন চেপে ধরে ড্রয়ার থেকে একটা টেবলেট বের করে খেয়ে নিলো সে। কিছুক্ষন যেতে না যেতেই চোখে এসে ভর করলো তার ঘুম নামক প্রশান্তি। কারণ ঘুমের ঔষধ খেয়েছে যে আদ্রিয়ান। আদ্রিয়ান নীরবে তার গা এলিয়ে দিলো বিছানায়। তারপর বিছানার পাশে থাকা সুইচ টিপে রুমের লাইট বন্ধ করে দিতেই পুরো রুম অন্ধকারে ভরে গেল। শুরুতে অন্ধকারে পুরো রুম টুইটুম্বর হলেও কিছুক্ষন যেতে না যেতেই রাতের জোৎসা ভরা আলো এসে ভর করলো আদ্রিয়ানের রুমে। বেলকনির ভিতর থেকে জানালার কার্নিশ বেয়ে সাদা পর্দা ভেদ করে আসছে বাতাস। দূর আকাশে থাকা চাঁদ মামাও আজ জ্বলছে ভিষণ। যদিও আকাশটা কতক্ষণ আগে মেঘে থাকা ছিল কিন্তু এখন মেঘকে আঁড়াল করে সূর্য্যের আলোতে আলোকিত হয়ে উঁকি মারছে চাঁদমামা। তাঁরা নেই আশেপাশে একটাও যেটা আছে সেটা হলো মস্ত বড় আকাশে একটা সুন্দর চাঁদ মামা।’

সকাল ৬ঃ০০টা..
নিজের রুমের দরজা খুলে বাহিরে বের হলো আহি। কাল রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়াতে সকালে তাড়াতাড়ি উঠেছে সে। আহি আশেপাশের চারদিকে চোখ বুলালো একবার পাখির কিচিরমিচির ডাকছে খুব। পাখিদের ডাক শুনে মুচকি হাসলো আহি,হঠাৎই রুমের ভিতর ঢুকতে যাবে এমন সময় চোখ যায় আহির নীরবের দিকে। নীরবকে দোলনায় ঘুমিয়ে থাকতে দেখে বেশ অবাক হয়ে এগিয়ে আসলো সে নীরবের দিকে। বুকে হাত জড়িয়ে ধরে চোখ চশমা পড়া অবস্থাতেই বেঘোরে ঘুমাচ্ছে নীরব। নীরবকে দেখেই একরাশ মুগ্ধতা এসে গ্রাস করলো আহিকে। আহি চুপচাপ নীরবের পাশ দিয়ে বসে পড়লো তারপর তাকিয়ে রইলো সে নীরবের মুখের দিকে। বুকে হাত দিয়েই উল্টো দিক ফিরে ঘুমিয়ে আছে নীরব আহি গালে হাত দিয়ে মনে মনে বললো,

‘ তোমায় যে কতটা ভালোবাসি আমি ঠিক বলে বোঝাতে পারবো না ভাইয়া,কিন্তু এই ভালোবাসার কথা বলতে ভীষণ ভয় লাগে আমার। আচ্ছা আমি তোমায় ভালোবাসি বললে তুমি কি রাগ করবে নাকি তুমিও আমায় ভালোবাসবে। জানো কতবার তোমায় ভালোবাসি বলতে গেছি কিন্তু যতই বারই গেছি ততবারই কিছু না কিছুর কারনে তোমায় বলতে পারি নি। বার বার এমন কেন হচ্ছে বলো তো,এই দেখো না তোমার জন্য লেখা চিঠি আমি আমার ড্রয়ারেই ফেলে এসেছি। বার বার এমন কেন হয় বলো তো? তবে যাই বলো তুমি কি দেখতে একদম কিউটের ডিব্বা, চশমা পড়লে তো তোমায় আরো কিউট লাগে।’ — কথাগুলো মনে মনে ভেবে হেঁসে উঠলো আহি। এরই মধ্যে নীরবের ঘুম ভেঙে যায় সামনেই আহিকে নিজের দিকে তাকিয়ে হাসতে দেখে বলে উঠল নীরব,

‘ কি ব্যাপার তুই হাসছিস কেন?’
আচমকা নীরবের কন্ঠ কানে আসতেই হকচকিয়ে উঠল আহি কিছুটা আমতা আমতা করে বললো সে,
‘ না মানে তুমি এখানে কেন ঘুমিয়ে আছো এটা আগে বলো?’
‘ সে তো কাল রাতে হুট করে ঘুম ভেঙে যাওয়ায় এখানে এসে বসে ছিলাম কখন ঘুমিয়ে পড়েছি বুঝতেই পারি নি।’
‘ ওহ আমিও তোমায় এখানে ঘুমাতে দেখে ডাকতে এসেছিলাম।’
‘ ওহ ঠিক আছে তাড়াতাড়ি রুমে গিয়ে ফ্রেশ হ আর বাকিদেরও ডাক নাস্তা সেরেই আমরা বের হবো।’
নীরবের কথা শুনে আহিও বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
‘ ঠিক আছে ভাইয়া।’
‘ হুম।’
উওরে আহি আর কিছু না বলে চলে যায় নিজের রুমের দিকে। আর নীরবও কিছুক্ষন আহির যাওয়ার পানে তাকিয়ে দেখে চলে যায় নিজের রুমের দিকে।’

বাবুইপাখির অনুভূতি পর্ব ১১

সকালের নাস্তা সেরে আট কি সাড়ে আটটার দিকে সবাই বেরিয়ে পড়ে ভ্রমণের উদ্দেশ্য। প্রথমে মাধবপুর লেক আর তার পরে চা বাগান। এই দুটোর মাঝখানে লান্স সেরে একবারে সন্ধ্যার দিকে রিসোর্টে ফিরবে সবাই তারপর কাল সকালে যে যার বাড়ির উদ্দেশ্যে যাবে। এমন চিন্তা ভাবনা নিয়েই রিসোর্ট থেকে বের হলো নীরব,আহি,অথৈ,রিনি,মীরা, সোহান, শরীফ আর সুজন।’ তার পর একসাথে হেঁটে রিসোর্ট থেকে বেরিয়ে বড় গাড়ি করে বের হলো সবাই মাধবপুর লেকের উদ্দেশ্যে।’

বাবুইপাখির অনুভূতি পর্ব ১৩