বাবুইপাখির অনুভূতি পর্ব ৩৩

বাবুইপাখির অনুভূতি পর্ব ৩৩
লেখিকা: তানজিল মীম

একটা বড় রেস্টুরেন্টের জানালার পাশ দিয়ে পাশাপাশি চেয়ারে বসে আছে আহি আর আদ্রিয়ান। কিছুক্ষন আগেই আদ্রিয়ান গাড়ি করে এখানে নিয়ে আসে আহিকে। আহি প্রথমে ভাবে নি আদ্রিয়ান তাঁকে এখানে নিয়ে আসবে। শুরুতে সে যেতে চায় নি কিন্তু পড়ে আদ্রিয়ানের জোরাজোরিতে আসতে হয় তাঁকে। আহির বাহিরের খাবার খুব একটা পছন্দ নয় এমনটা নয় সে একেবারেই পছন্দ করে না। করে অল্প স্বল্প। আদ্রিয়ান আহির দিকে মেনুকাটটা এগিয়ে দিয়ে বললো,

‘ কি খাবে বলো?’
আহি মেনুকাটের সব খাবারগুলো দেখলো সাথে খাবারের দামও দেখলো। খাবারের দাম দেখে তাঁর চোখ চড়ুইগাছ কারন এক একটা খাবারের দাম প্রায় ২ থেকে ৪ হাজারের উপরে। আহি দাম দেখেই বললো,
‘ এগুলোর তো অনেক দাম আমি এগুলো খাবো না।’
‘ আরে তুমি দাম দেখছো কেন খাবার কোনগুলো খাবে সেটা বলো?’
আহি মেনুকাটে আর একবার চোখ বুলিয়ে মেনুকাটটা আদ্রিয়ানের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে উঠল,
‘ না না আমি এসব খাবো না।’
আহির কাজে আদ্রিয়ান কিছুটা হতাশ হয়ে বললো,
‘ আরে তুমি এমন করছো কেন আচ্ছা তোমায় অর্ডার করতে হবে না আমি অর্ডার করে দিচ্ছি?’
বলেই কিছু ভালো ভালো খাবার অর্ডার করলো আদ্রিয়ান। ওয়েটারও আদ্রিয়ানের কথা মতো চলে যায় খাবার আনতে। কিছুক্ষনের মধ্যেই ওয়েটার সব খাবারগুলো এনে টেবিলে সাজিয়ে রাখে।’
আহি এওতো এওতো খাবার দেখে চোখ বড় বড় করে বলে উঠল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘ এত খাবার কে খাবে?’
‘ কেন তুমি?’
‘ আপনার কি আমাকে রাক্ষস মনে হয় যে এতোগুলা খাবার আমি খাবো।’
‘ আগে শুরু তো করো।’
এতটুকু বলে আদ্রিয়ান নিজের খাবার দেখে নিলো। শুরুতে সফট ড্রিংকস দিয়ে শুরু করলো দুজন। তারপর এঁকে এঁকে সব খাবারগুলো খেতে লাগলো আহি আর আদ্রিয়ান। আহি দুই তিনপদ খেয়েই আর পারছে না কারন খাবারগুলো খুব একটা পছন্দ হয় নি তাঁর। যেহেতু আদ্রিয়ান এসব খেতে অভ্যস্ত তাই খুব একটা সমস্যা হয় নি তাঁর।’
অতঃপর খাবার খেয়ে রেস্টুরেন্টের বিল মিটিয়ে দুজনেই বেরিয়ে পড়লো। রেস্টুরেন্টের বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে আদ্রিয়ান আর আহি। আহির মুখে তেমন কোনো কথা নেই। আদ্রিয়ান আহির মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,

‘ কি হলো মুড অফ হয়ে দাঁড়িয়ে আছো কেন খাবার পছন্দ হয় নি?’
‘ না বিষয়টা তেমন নয় এতগুলো টাকা খরচ করার কি ছিল তাঁর চেয়ে আমাদের ওখানে শাফিন চাচার হাজী বিরিয়ানি খেলেও ভালো হতো অল্প দামে অনেক পাওয়া যেত।’
‘ তোমার এত বড় দামি রেস্টুরেন্টের এতো এতো খাবার রেখে বিরিয়ানি খেতে ইচ্ছে করলো এটা আগে বলবে তো এখানেও বিরিয়ানি পাওয়া যায় খাবে?’
‘ না এখানের খাবার ভালো লাগে নি, অন্য এক সময় আপনাকে আমাদের ওখানের শাফিন চাচার হাতে রান্না করা বিরিয়ানি খাওয়াবো। দেখবেন কি মজা?’
‘ ঠিক আছে কোনো এক সময় যাবো এখন বাড়ি যাবে তো রাত কিন্তু প্রায় এগারোটার কাছাকাছি বেজে গেছে।’ (হাতের ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে)
ঘড়ির টাইমের কথা শুনতেই আহি চোখ বড় বড় করে বললো,
‘ কি এগারোটা বেজে গেছে তাড়াতাড়ি চলুন আজ মা গায়ে ঝাড়ু ভাংবে আমার।’
আহির কথা শুনে আদ্রিয়ান হাসতে হাসতে বললো,
‘ তাই?’
‘ তাই নয়তো কি আপনি জানেন না আমার মা কতটা ডেঞ্জারাস এমনিতেও রাত করে হসপিটাল থাকি বলেও তাঁর হাজার সমস্যা চলুন চলুন তাড়াতাড়ি যাওয়া যাক।’
বলেই এই প্রকার দৌড়ে গাড়িতে বসলো আহি। আহির কাজে আদ্রিয়ানও আর বেশি কিছু না ভেবে হাসতে হাসতে চলে যায় গাড়ির কাছে তারপর গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চললো তাঁরা নিজেদের গন্তব্যের দিকে।’

হসপিটালের ভিতরে দাঁড়িয়ে আছে রিনি আর রিনির মা বাবা সাথে সোহানের কিছু ফ্রেন্ড। সবার চোখে মুখেই দুশ্চিন্তার ছাপ,সোহানের মা তো অলরেডি কান্না কাটি শুরু করে দিয়েছে।’
কারন কিছুক্ষন আগেই বাসায় আসতে গিয়ে বাইক এক্সিডেন্ট করেছে সোহান। খুব গুরুতরভাবে মাথায় আর হাতে পায়ে ব্যাথা পেয়েছে সে। খুব শীঘ্রই অপারেশন করতে না পারলে সোহানকে বাঁচানো যাবে না।’
এরই মধ্যে গায়ে কমলা রঙের টিশার্ট সাথে সাদা শার্ট পড়ে হতভম্ব হয়ে দ্রুত ভিতরে ঢুকলো শুভ। কারন কিছুক্ষন আগেই সে জেনেছে কেউ একজন বাইক এক্সিডেন্ট করে হসপিটালে ভর্তি হয়েছে আর এক ঘন্টার মধ্যেই তাঁকে অপারেশন করাতে হবে। শুভ হলো একজন ডাক্তার। ৬ মাসই হয়েছে সে এখানে জয়েন্ট হয়েছে।’
এদিকে এরই মধ্যে রিনি ওদের সামনে আসলো আর একজন সাদা এপ্রোন পরিধিত ডাক্তার। যিনি বর্তমানে সোহানকে দেখছেন। ওনাকে দেখেই রিনিসহ রিনির বাবা মা এগিয়ে গিয়ে বললো,

‘ কেমন আছে আমার ছেলে ডক্টর?’
‘ দেখুন ওনার সিচুয়েশন খুবই কিটিকাল, এই মুহূর্তে শুধু এতটুকুই বলতে পারি টেনশন নিবেন না আল্লাহর ওপর ভরসা রাখুন। আর কিছুক্ষনের মধ্যেই ওনাকে অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হবে।’
ডাক্তারের কথা শুনে রিনির বাবা বলে উঠল,
‘ যত টাকার লাগবে নিন ডক্টর কিন্তু আমার ছেলেকে শুধু বাঁচিয়ে দিন?’
‘ দেখুন বাঁচা মরা সবই আল্লাহর হাতে আর ওনার যে অবস্থা তাতে বাঁচার চান্স খুবই কম, তবে টেনশন নিবেন না আমাদের এখানে সুযোগ্য একজন ডাক্তার আছে যিনি এইসব বিষয়ে খুবই ভালোভাবে হ্যান্ডেল করতে পারে। আমরা ফোন করেছি ওনাকে কিছুক্ষনের মধ্যেই হয়তো চলে আসবে..
বলতেই বলতেই সামনে দিক দিয়ে শুভকে নিজের দিকে আসতে দেখে বলে উঠলেন সেই ডাক্তার,
‘ ওই তো শুভ চলে এসেছে।’
‘শুভ’ নামটা কানে আসতেই কিছুটা অবাক হয়ে তাকালো রিনি সামনের ছেলেটির দিকে এই ডাক্তার শুভই ওই শুভ দেখেই চোখ ছানাবরা রিনির। ওই ভীতু মার্কা সহজ-সরল ছেলেটা একজন ডাক্তার। ভাবতেই কেমন লাগলো রিনির। আর সে কিনা সেদিন ভার্সিটি বসে এই ছেলেটার রাগের চোটে কলার চেপে ধরেছিল।’
রিনির ভাবনার মাঝেই শুভর সাথে কথা হয় রিনির বাবা মায়ের। শুভও বলে ফেলে,
‘ টেনশন নিবেন না আল্লাহ উপর ভরসা রাখুন সব ঠিক হয়ে যাবে।’
হঠাৎই শুভর চোখ যায় রিনির দিকে। এতক্ষণ সে খেয়াল করেনি রিনিকে। শুভ রিনিকে দেখে বলে উঠল,

‘ উনি,
শুভর কথা শুনে রিনির বাবা বলে উঠল,
‘ ও আমার ছোট মেয়ে মানে পেসেন্টের ছোট বোন।’
‘ ওহ।’
এতটুকু বলে শুভ চলে যায় ভিতরে তাঁকে তৈরি হতে হবে।’
অতঃপর কিছুক্ষনের মধ্যেই গায়ের পোশাক চেঞ্জ করে গায়ে ডাক্তারি পোশাক পড়ে হাতে মাস্ক নিয়ে বেরিয়ে আসলো শুভ। শুভকে দেখে জাস্ট হা হয়ে তাকিয়ে রইলো রিনি তাঁর এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না শুভ একজন ডাক্তার। তারপর কিছুক্ষনের মধ্যেই সোহানকে নিয়ে ঢোকা হলো অপারেশন থিয়েটারে। শুভ ভিতরে ঢোকার আগে একপলক রিনির দিকে তাকিয়ে চটজলদি মুখে মাস্ক পড়ে ঢুকে পড়লো ভিতরে। সবাই ঢুকতেই থিয়েটারের দরজা বন্ধ করে বাহিরের দেয়ালের উপরে জ্বালিয়ে দেওয়া হলো লাল বাতি।’
খুব টেনশন মাখা মুখ আর অস্থিরতা নিয়েই বসে আছে সবাই। রিনিরও কান্না পাচ্ছে ভিষন, ভাইটার হুট করে এমন কিছু হবে ভাবতে পারে নি রিনি। ভাইয়ের সাথে কাটানো ছোটবেলার মুহূর্তগুলোর কথা বার বার মনে পড়ছে তাঁর। রিনি বসে থাকতে না পেরে উঠে চলে যায় অন্যদিকে। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তাঁর।’

আহিদের বাড়ি সামনে এসে গাড়ি থামালো আদ্রিয়ান। আহিও হাসিমুখে আদ্রিয়ানকে বিদায় সাথে ধন্যবাদ জানিয়ে চলে যায় ভিতরে। আর আদ্রিয়ানও বেশিক্ষণ না দাঁড়িয়ে চলে যায় তাঁর নিজের বাড়ির দিকে। আজ তাঁর ভীষণ ভালো লাগছে। ইদানীং আহির সাথে সময় কাটাতে ভীষণ ভালো লাগে আদ্রিয়ানের। আনমনেই মুচকি হেঁসে বললো আদ্রিয়ান,
‘ আমি কি তবে আহিকে পছন্দ করতে শুরু করেছি?’
কথাটা মাথায় আসতেই কেমন একটু লাগলো আদ্রিয়ানের। নিজের কথা শুনে নিজেই যেন অবাক আদ্রিয়ান। পরক্ষণেই নিজের মাথাটা ঝাঁকিয়ে বললো আদ্রিয়ান,
‘ ধুর! কিসব উল্টো পাল্টা জিনিস ভাবছি আমি?’
বলেই আহিকে নিয়ে আর কিছু না ভেবে চললো আদ্রিয়ান গাড়ি নিয়ে।’
অন্যদিকে,
বাড়ির কলিং বাজাতেই আহির ফোনটা বেজে উঠল উপরে রিনির নাম্বার দেখে ফোনটা তুলে বললো আহি,

‘ হুম বল?’
উওরে অপরপাশে রিনির কান্না ভেঁজা কন্ঠের কথা শুনে থমকে গেল আহি। আহি হতাশা ভরা কন্ঠ নিয়ে বললো,
‘ তুই টেনশন করিস না আমি এক্ষুনি আসছি?’
এরই মধ্যে আহির মা এসে দরজা খুলে দিল আহিকে কিছু বলবে তাঁর আগেই আহি বলে উঠল,
‘ তোমার কথা পড়ে শুনবো মা, সোহান ভাইয়ার এক্সিডেন্ট হয়েছে আমাকে এক্ষুনি যেতে হবে।’
‘ কি করে হলো?
‘ তোমায় সব পড়ে বলবো মা।’
বলেই দৌড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল আহি। আর আহির মা কিছু বলতে চেয়েও আর বলতে পারলো না।’

ঘড়ির কাঁটায় প্রায় একটার কাঁটায় ছুঁই ছুঁই। এখনো অপারেশন চলছে ভিতরে। ভয়ে হাত পা কাঁপছে সবার। যদিও সেটা কেউ বাহিরে বের করছে না সবাই নিজেকে সামলে নিয়ে শক্ত হয়ে বসে আছে। আর রিনিও সবার থেকে কিছুটা দূরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।’
এরই মধ্যে অপারেশন থিয়েটারের লাইট অফ হয়ে গেল। লাইট অফ হতেই সবাই একপ্রকার দৌড়ে দাঁড়ালো থিয়েটারের সামনে। না জানি ডাক্তার বেরিয়ে এসে কি বলবে তাদের।’
বলতে না বলতেই ধীরে ধীরে বের হলো শুভসহ বাকি সবাই। খুব যত্নসহকারেই পুরো কাজটা করেছে তাঁরা। সবার মুখে সাকসেসফুল হওয়ার হাসি। রিনির মা শুভর সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
‘ কেমন আছে আমার ছেলেটা বাবা?’
শুভ মুচকি হেঁসে রিনির মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ সব ঠিক আছে পেসেন্ট এখন বিপদমুক্ত। কাল সকালেই আপনারা ওনার সাথে দেখা করতে পারবেন।’

‘ থ্যাংক ইউ ডাক্তার। (রিনির বাবা)
‘ ইট’স ওকে আঙ্কেল।’
বলেই চলে যায় শুভ। এবার আর রিনির দিকে তাকায় নি শুভ। শুভর কথা শুনে রিনির কান্না ভেঁজা মুখে হাসি ফুটে উঠলো। এমন সময় সেখানে উপস্থিত হলো আহি। রিনিসহ সবাইকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললো সে,
‘ রিনি?’
আহির কন্ঠ কানে আসতেই রিনি তাকালো আহির দিকে তারপর ওর সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
‘ দোস্ত তুই এসেছিস?’
‘ হুম কেমন আছে সোহান ভাইয়া?’
‘ হুম ভালো। ডাক্তার বলেছে কাল সকালেই ভাইয়ার সাথে দেখা করা যাবে।’
এতক্ষণ পর যেন রিনির কথা শুনে সস্থির নিশ্বাস ফেললো আহি। রিনি আহির দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ জানিস ভাইয়ার অপারেশন কে করেছে?’
‘ হুম শুনবো তাঁর আগে মাকে একটা ফোন করে নেই বুঝলি, টেনশন করছে হয়তো?’
বলেই মোবাইল হাতে অন্য সাইডে চলে যায় আহি। আর রিনিও পাল্টা কিছু না বলে চলে যায় তাঁর মায়ের কাছে।’

বাবুইপাখির অনুভূতি পর্ব ৩২

সূর্যের কড়া রোদ্দুরের মাঝে জানালার পাশে কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে আছে অথৈ। হঠাৎই মনে পড়লো তাঁর কালকের দুপুরের কথা নীরবকে দেখেছে সে। চোখের সামনে ভেঁসে আসলো তাঁর সেই কালকের সাইকেল নিয়ে নীরবের পড়ে যাওয়ার দৃশ্য।সাথে ভার্সিটি বসে নীরব তাকে প্রপোজ করছে তাঁর দৃশ্য, আহির কান্না ভেঁজা চেহারার কথা ভাবতেই হকচকিয়ে উঠল অথৈ।’

বাবুইপাখির অনুভূতি পর্ব ৩৪

1 COMMENT

Comments are closed.