বিন্দু থেকে বৃত্ত পর্ব ৪৫

বিন্দু থেকে বৃত্ত পর্ব ৪৫
জাওয়াদ জামী

গভীর রাতে কুহুর ঘুম ভাঙ্গলে আবিষ্কার করল, তাহমিদ এখনও জেগে আছে। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠে বসে কুহু। অতঃপর ঘড়ির দিকে তাকায়।
” আপনি এখনও জেগে আছেন! রাত তিনটা বাজে, অথচ আপনি ঘুমাননি! এমন পাগলামো কেন করেন? দয়া করে এবার শুয়ে পরেন। ” কুহু তাহমিদের হাত ধরে শোয়াতে গেলেই, তাহমিদ কুহুর হাত ধরে ফেলে, এক হ্যাঁচকায় নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়।

” নি’ষ্ঠু’র বউ আমার। এখন আমি ঘুমালে তোমাকে আদর করবে কে! এতক্ষন তোমার জাগার অপেক্ষায় ছিলাম। এখন আমার সাথে তোমাকেও জাগতে হবে। কাল দুপুর পর্যন্ত ঘুমিয়ে রাতের ঘুম পুষিয়ে নিব। ” তাহমিদের কথা শুনে কুহুর বুক ধুকপুক করতে শুরু করে।
ও কিছু বলার জন্য মুখ খোলে। কিন্তু তাহমিদ ওকে কিছু বলার সুযোগ দেয়না।
সকালে বিছানা থেকে নামতেই কুহুর মাথায় চক্কর দেয়। পুরো শরীরে ব্যথারা রাজত্ব করছে। সেই সাথে একটু জ্বরের অস্তিত্বও টের পাচ্ছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে থাকে। নিজেকে ধাতস্থ হওয়ার সময় দেয়। এরপর উঠে ওয়াশরুমে ঢোকে।
ফজরের ওয়াক্ত সেই কখন শেষ হয়েছে। এখন কাযা নামায আদায় করতে হবে। এদিকে তাহমিদ বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। তার উঠার কোন নামই নেই। কুহু তাহমিদকে ডাকতে যেয়েও ডাকেনা। জায়নামাজ নিয়ে কাযা নামায আদায় করতে দাঁড়িয়ে যায়।

সকাল আটটা বেজে গেছে। কুহু বাইরে বেড়োতে ভিষণ লজ্জা পাচ্ছে। তাহমিদকে ডেকে লাভ হয়নি, সে জানিয়েছে ঘুম থেকে এখন কিছুতেই উঠবেনা। কিভাবে সবার সামনে যাবে সেই চিন্তাতেই ওর মাথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। ওকে এই অবস্থা থেকে নিস্তার দিতেই দরজায় নক করে সিক্তা। চিল্লাতে চিল্লাতে বলে দরজা খুলতে।
কুহু দরজা খুলে দিলে সিক্তা নাচতে নাচতে রুমে ঢোকে।
” এই-যে নতুন বউ, সকাল আটটা পার হয়ে গেছে অথচ তুই নিচে যাসনি, ঘটনা কি? দিদুন তোকে ডাকছে। এক্ষুনি নিচে চল। ”

” এই সিক্তা, ফুপা বাসায় আছে? আর আমার শ্বশুর বাবা? শোন ফুপা অফিসে না যাওয়া পর্যন্ত আমি নিচে যাবনা। আমার ভিষণ লজ্জা করছে। আর শোন বাবাকে মানে আমার শ্বশুর বাবাকে বাজারে পাঠিয়ে দে কিছু কিনতে। আর তোর মামাকেও পাঠাবি। তারা থাকলে আমি নিচে যেতে পারবনা। ”
” ওরে লজ্জাবতী রে। কবুল বলার সময় এই লজ্জা কোথায় ছিল! যখন ঢ্যাং ঢ্যাং করে কাকিমনির সাথে এই রুমে আসলি, তখন লজ্জা করেনি? কাল বিয়ে হয়েছে কিন্তু লজ্জা পাচ্ছে আজ! ”

” এই বুঁচি, শোন। তুই এই মেয়েকে নিয়ে যেয়ে নর্দমার পানিতে চুবিয়ে আন। এতে যদি তার লজ্জা পালায়। সেই কখন থেকে লজ্জা লজ্জা করে আমার মাথা খাচ্ছে। একবার নর্দমার পানি খেলে দেখবি সব লজ্জা পালাবে। ” তাহমিদ পাশ ফিরতে ফিরতে কথা বলে।
তাহমিদের কথা শুনে কুহুর নিচে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকেনা। মুখ কালো করে সিক্তার সাথে সুড়সুড় করে নিচে যায়।

” এই যে আমার মেয়ে এসে গেছে। এদিকে আয়, দেখত পায়েস খেতে কেমন হয়েছে। তোর জন্য আমি নিজের হাতে বানিয়েছি। ” কুহু রান্নাঘরে এসে দাঁড়াতেই তাহমিনা আক্তার হেসে বলেন।
কুহু একটা বাটিতে একটু পায়েস নিয়ে মুখে দেয়।
” অসাধারণ হয়েছে, মা। তোমার হাতের পায়েস সত্যিই অনেক মজার। অনেক ভালোবাসা মা, আমার জন্য কষ্ট করে পায়েস বানিয়েছ। ”

” আমার কোন কষ্ট হয়নি। আনন্দ নিয়ে আমার মেয়েটার জন্য পায়েস বানিয়েছি। আরেকটু নে। এরপর একটা পরোটা খা। পরে তোর শ্বশুর, ফুপা বাইরে থেকে আসলে তাদের সাথে আবার খাবি। ”
” বাবা, ফুপা কোথায় গিয়েছে, মা? ”
” আমার ছোট বেয়াই তার মেয়ের শ্বশুর বাড়ির জন্য বাজার করতে গেছে । তার সাথে গেছে তোর শ্বশুর আর ফুপা। ”
তাহমিনার কথার ধরন শুনে কুহু ফিক করে হেসে দেয়।

” আমি এখন কিছু খাবনা, মা। বাবারা আসুক, একবারে তাদের সাথেই খাব। কিন্তু তুমি রান্নাঘরে একা কেন! ফুপু কোথায়? আমাকে বল দেখি কি করতে হবে। ”
” তোর ফুপু বোধহয় ছাদে গেছে। এখনই এসে যাবে। আর তোর কিছু করতে হবেনা। আমার পাশে বসে থাক তাহলেই হবে। ”
” শুধু শুধু বসে থাকতে ভালো লাগে! কিছু একটা কাজ দাও। আমি করে দিচ্ছি। ”
” তোকে কিছু করতে হবেনা। তারচেয়ে বরং আমার সাথে গল্প কর। ”

” সোনা মা, ঘুম থেকে উঠেছিস। অনেক বেলা হয়েছে কিছু খেয়ে নে। এখন থেকে নিজের ইচ্ছেমত খাবার খাবি। আগেরমত যেন ডেকে খাওয়াতে না হয়। শ্বশুর-শ্বশুড়িকে খেতে দিবি। দিদুনের দিকে নজর রাখবি। এখন আর তুই এই বাড়ির মেহমান নেই। এই বাড়ির বউ হয়েছিস। নিজের পাশাপাশি সবার খেয়াল রাখতে শিখতে হবে। ” তাহমিনা আক্তারের কথার মাঝেই আফরোজা নাজনীন এসে কুহুতে কথাগুলো বললেন।

” ওকে কিছু শেখাতে হবেনা, ভাবি। আপনার মত ফুপু যে মেয়ের আছে তাকে কিছুই শেখাতে হয়না। শুধু শুধু মেয়েটাকে ভয় দেখাচ্ছেন। ওর এখন এসব কিছুই করতে হবেনা। আগে পড়াশোনা শেষ করুক তারপর সবাইকে সামলাবে। এখন আপাতত আমার ছেলেটাকে সামলাক। আর কিছুই চাইনা আমি। ”

” সোনা মা, তোর শ্বাশুড়ির কথা মাথায় নিবিনা একদম। পড়াশোনার পাশাপাশি সংসারের দিকেও নজর দিতে হবে। তাছাড়া দেখবি তাহমিনা তোকে অলস বানিয়ে দিচ্ছে। আচ্ছা শোন, তাহমিদ কিছু বলেছে তোকে? রা’গ করেছে তোর ওপর? গতকাল সবুজের ওপর খুব রে’গে’ছি’ল। আমার ভয়ই হচ্ছিল ওর রাগ তোর ওপর না দেখায়। ”
” উনি আমাকে সেই বিষয়ে কিছুই বলেননি। আমিই বরং কথা তুলেছিলাম। কিন্তু সে আমার কথা শুনতেই চায়নি। একদম ঠান্ডাভাবে আমাকে সেসব কথা বলতে নিষেধ করেছে। ”

” তাহমিনা, আমার ভিষণ চিন্তা হচ্ছে। তাহমিদের রা’গ সম্পর্কে আমরা জানি। সেকি মনে মনে কিছু পরিকল্পনা করছে! সবুজকে ছেড়ে দেয়ার ছেলে ও নয়। যতই ওর বড় চাচ্চু ওকে বোঝাক। তার কথা যে তাহমিদ আমলে নেয়নি সেটা আমি কালই বুঝতে পেরেছি। ”

” এই চিন্তা আমিও করছি, ভাবি। ও ঘুম থেকে উঠলেই আমি কথা বলব ওর সাথে। যে করে হোক ওকে বুঝাতেই হবে। ”
ড্রয়িংরুমে সানাউল রাশেদিনের কথা শুনতে পেয়ে তাদের আলোচনা থেমে যায়। আফরোজা নাজনীন রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে ড্রয়িংরুমে যান।
দুপুরের খাবার পর কায়েস বিদায় নেয়। ছেলেকে নিয়ে রওনা দেয় ফুলতলার পথে। কুহু বাবার যাওয়ার সময় কেঁদে ফেলে। শিহাবও কাঁদছে। ওর ইচ্ছে নেই আজকে যাওয়ার। কিন্তু বাবাকে একা যেতে দেয়ার সাহস নেই ওর। তাই বাবার সাথে অনিচ্ছায় ওকেও যেতে হল।

কায়েস বাড়িতে ফিরে দেখল সবুজ এখনও সেখানেই আছে। সবুজকে দেখেই তার মাথায় র’ক্ত চড়ে যায়। এদিকে রাত দশটার মত বেজে গেছে। তাই এত রাতে সে কোন ঝামেলা চায়না বলে, সবুজকে কিছুই বলেনা।
দৃষ্টি বাবার কাছে থেকে জানতে চায়, ফুপু কেন যেতে বলেছিল?

কায়েস জানায়, কুহুর বিয়ের জন্য যেতে হয়েছিল। গতকালই তাহমিদের সাথে কুহুর বিয়ে হয়েছে। কায়েস কথা বলতে বলতে সবুজের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখে। সে ভালোভাবে খেয়াল করল, কুহুর বিয়ের কথা শুনেই সবুজের চোখমুখে একটা হিং’স্র’তা ফুটে ওঠে, তা আবার মুহুর্তেই মিলিয়ে যায়। সবুজের এই আচরণই কায়েস বুঝে নেয়, এই ছেলেটার মনে পাপ আছে।

কুহুর বিয়ের কথা শুনে দৃষ্টি খুব খুশি হয়। আবার আফসোস করে, একটামাত্র বোনের বিয়েতে থাকতে পারলনা দেখে। শিউলির মুখে কোন কথা নেই। কুহুর এতবড় বাড়িতে বিয়ে হয়েছে শুনে তার একটু হিং’সা হয়।
শিহাব বোনকে দেখায় তাহমিদ ওকে কতকিছু কিনে দিয়েছে।

পরদিন সকালে খাবার পর দৃষ্টি বাবার কাছে থেকে বিদায় নেয়। ওরা এখনই বেড়িয়ে পরবে। দৃষ্টি আজকাল বাবাকে না দেখে থাকতে পারেনা। বিয়ের আগে এই টান কখনোই অনুভব করেনি।
” আব্বু, তুমি একদিনও আমার শ্বশুর বাড়িতে গেলেনা। আম্মুকেও যেতে দিলেনা। একদিন তোমরা সবাই মিলে সেখানে যেও। ”

” আমরা কখনোই সেখানে যাবনা, মা। তোর মন খারাপ করলে তুই একা চলে আসবি। তোর বাবার বাড়িতে আসতে হলে কাউকে লাগবেনা। আমাকে ফোন করলেই আমি সিএনজি পাঠিয়ে দিব। আমি আগেও বলেছি, এখনও বলছি তুই ঐ বাড়িতে থাক এটা আমি চাইনা। তুই লেখাপড়া করলে একটা যোগ্য ছেলের হাতে তোকে তুলে দিতে পারতাম। তবে যদি মনে করিস চলে আসবি, তবে আমাকে জানাস। যা ব্যবস্থা করার আমি করব। ” কায়েস সরাসরি জানিয়ে দেয় সবুজকে তার পছন্দ নয়। এবং সবুজকে এখানে আসতে পরোক্ষভাবে নিষেধ করে।

সবুজ বুঝতে পারে কায়েস ওকে এই বাড়িতে আসতে মানা করল। ও রাগে ফুঁসতে থাকে।
দৃষ্টি বাবার কথা শুনে চোখের পানি ফেলে। আজ বাড়ি গেলে সবুজ এ নিয়ে বেশ অশান্তি করবে এটা বুঝতে পারছে।
শিউলি আক্তার স্তব্দ। এ কি বলছে তার স্বামী! মেয়ের জামাইকে আসতে নিষেধ করছে!
সেদিন থেকেই কায়েস গোপনে তার শুভাকাঙ্ক্ষী কয়েকজনকে সবুজের ব্যাপারে সকল তথ্য সংগ্রহ করতে বলে। তারাও রাজি হয়।

তাহমিদ, কুহু পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেছে। পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে চলছে তাদের দুষ্টু মিষ্টি খুনসুটি। তাহমিদ যতক্ষণ বাসায় থাকে ততক্ষণ কুহুকে এক সেকেন্ডের জন্যও কাছ ছাড়া করেনা।
তবে এরমাঝে একদিন ফ্রি ক্যাম্পিংয়ের জন্য তাহমিদ ঢাকার বাইরে গিয়েছিল। একদিন পরেই আবার ফিরে এসেছিল।
পঁচিশ দিন হলো কুহুর বিয়ের। তাহমিদ আজ মেডিকেলে যাবার সময় বলে গেছে, বিকেলে কুহুকে নিয়ে বেড়াতে যাবে। মেডিকেল থেকে এসে কুহুকে যেন তৈরি হয়ে থাকতে দেখে। তাহমিদের আসার আগেই কুহু তৈরি হয়ে নেয়। হালকা বাদামী শাড়ি পরেছে ও। শাড়ির সাথে ম্যাচিং করে হিজাব বাঁধবে। আলমিরা থেকে হিজাব বের করতেই একটা বক্সের দিকে চোখ যায়। যেটা বিয়ের পরদিন থেকেই দেখে আসছে। কিন্তু ভেতরে কি আছে তা দেখেনি। আজ কৌতুহলী হয়ে সেই বাক্সটা হাতে নিয়ে বিছানায় বসে।

বাক্সটা খুলেই কুহু হতবাক হয়ে যায়।
অনেকগুলো শুকিয়ে যাওয়া গোলাপ, রজনীগন্ধা, বেলি ফুল। তাহমিদের দেয়া সেই প্যাকেট যা কুহু সেই রাতে ছাদে তাহমিদকে ফিরিয়ে দিয়েছিল। কুহুর একটা পুরোনো ওড়না। চুলের কাঁটা। তবে এতকিছু আপাতত কুহুর চোখে পরছেনা। ওর চোখতো শুকনো ফুলগুলোর দিকে। এইগুলো সেইসব ফুল নয়, যেগুলো কলেজের সামনে প্রতিদিন অজানা কেউ ফুলওয়ালী মেয়েটাকে দিয়ে পাঠাত! সেসব ফুল রাগে কুহু ছুঁড়ে ফেলত!
আজ তাহমিদের বলা সেই কথা কুহুর পরছে। যে রাতে প্যাকেটটা ফিরিয়ে দিয়েছিল। তাহমিদ বলেছিল, একদিন তুমি এসবের জন্য অনুশোচনা করবে। আজ সত্যিই কুহুর অনুশোচনা হচ্ছে।

তাহমিদ বাসায় এসে ফ্রেস হয়েই কুহুকে নিয়ে বেরিয়ে যায়। অনেকবার বলার পরও খায়না। কুহু আজ বায়না ধরেছে রিক্সায় ঘুরবে। তাহমিদ বাধ্য হয়ে রিক্সা নিয়েছে। কুহু তাহমিদকে বলে ওর পুরোনো কলেজের সামনে যেয়ে ঝালমুড়ি খাবে। তাহমিদ কুহুর নির্দ্দেশ মত রিক্সাওয়ালাকে কলেজের সামনে নিতে বলে।
সেখানে পৌঁছেই কুহু এদিকওদিক তাকায়। তাহমিদ ভ্রু কুঁচকে কুহুর কান্ডকারখানা দেখছে।
একসময় কুহুর নজর যায় সেই ফুলওয়ালী মেয়েটা আসছে। মেয়েটা একটু এগিয়ে আসতেই কুহু ওকে হাতের ইশারায় কাছে ডাকে।

মেয়েটা কাছে আসলে কুহু তাহমিদকে বলে ফুল কিনে দিতে।
এদিকে সেই মেয়েটা পালাক্রমে দুজনের মুখের দিকে তাকাচ্ছে। সে খুব অবাক হয়েছে, এটা বোঝাই যাচ্ছে।
” তোমার কাছে প্রতিদিন এই ভাইয়াই ফুল পাঠাত আমাকে দেয়ার জন্য? ” কুহু মিটিমিটি হেসে মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করে।
মেয়েটি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়।

” এই ভাইয়াই বখাটে ছেলেদের পি’টি’য়ে’ছি’ল?”
মেয়েটি আবারও মাথা নাড়ায়।
তাহমিদ কিছু না বলে মেয়েটির কাছ থেকে সবগুলো ফুল কিনে নেয়।
” শোন ছোট্ট আপু, আগে লুকিয়ে তাকে ফুল দিতাম, আজ তার সামনেই তাকে ফুল কিনে দিচ্ছি। তাকে বলে দাও, আমি তাকে অনেক ভালোবাসি। এই ফুলগুলো একদিন শুকিয়ে যাবে, এদের ঘ্রান মিলিয়ে যাবে। কিন্তু আমার ভালোবাসা ফুরাবার নয়। ”

তাহমিদ ফুলের পেছনে অনেক টাকা খরচ করেছে জন্য কুহু আর দূরে কোথাও যায়না। কাছের একটা পার্কে বসে সারা বিকেল কাটিয়ে দেয়। মাগরিবের আজানের সময় ওরা বাড়ি ফিরে।
পরদিন দুপুরে কুহু ফুপুর কাছ থেকে শুনলো, সবুজকে কারা যেন খুব মে’রে’ছে। ওর দুই হাত, একটা পা মে’রে ভেঙে দি’য়ে’ছে পাঁজরের দুইটা হাড় ভেঙেছে। মাথা থেঁ’ত’লে দিয়েছে। অবস্থা গুরুতর হওয়ায় জেলা সদর হাসপাতাল থেকে ওকে রাজশাহী মেডিকেলে স্থানান্তর করা হয়েছে। কিন্তু কে বা কারা ওকে মে’রে’ছে তার কোন হদিস মেলেনি।

দৃষ্টি বাবার কাছে এসে হাউমাউ করে কাঁদছে। সবুজের চিকিৎসার জন্য অনেক টাকার প্রয়োজন। ওর শ্বশুর বারবার দৃষ্টিকে বলছে বাবার বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে আসতে। সেই সাথে এ-ও বলে দিয়েছে, টাকা নিয়ে গেলেই দৃষ্টি সবুজকে দেখতে পাবে। তার আগে নয়। দৃষ্টি বাবার কাছে এসে টাকা চাইলে কায়েস টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানায়।
শিউলি আক্তার কায়েসের কাছে অনেক অনুরোধ করেছে। তবুও কায়েস তার সিদ্ধান্তে অটল। বাধ্য হয়ে শিউলি আক্তার তার কাছে জমানো যে কয়েকটা টাকা ছিল, সেগুলো দৃষ্টিকে দেয়।
রাতে তাহমিদ বাসায় আসলে কুহু তাকে জানায় সবুজের কথা। কুহুর কথা শোনামাত্র তাহমিদ ওর দিকে চোখ গরম করে তাকায়।

” ঐ জা’নো’য়া’র’টা’র জন্য তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে! দেখতে যাবে তাকে? তাহলে চল নিয়ে যাই। নাকি ঢাকায় নিয়ে এসে তার চিকিৎসা করাব। আমাকে বল। সে অনুযায়ী কাজ করব আমি। ”
কুহু বুঝতে পারে তাহমিদ রেগে গেছে। তাই ওকে না ঘাঁটিয়ে বই নিয়ে বসে।
তাহমিদ পেছন থেকে জাপটে ধরে কুহুকে।

” বউ, আমাদের দুজনের মধ্যে কখনোই ঐ হা’রা’মী’টা’কে নিয়ে এসোনা। ওর কথা শুনলেই আমার মাথার ভেতর দা’উ’দা’উ করে আ’গু’ন জ্বলে উঠে। ও জাহান্নামে যাক। তাতে তোমার কি! যার যার কর্মফল সে সে পাবে। যতটুকু সময় আমি বাসায় থাকব, সে সময়টুকু শুধুই উপভোগ করবে। আমাকে বেশি বেশি ভালোবাসবে। তারথেকেও বেশি আমার ভালোবাসা নিবে। কোন বাজে মানুষের কথা মুখে এনে সময়টা কখনোই নষ্ট করবেনা বুঝলে? ”
কুহু বেশ বুঝতে পারছে লোকটা আজ রোমান্টিক মুডে আছে। আর তার রোমান্টিক মুড মানেই কুহুর পড়াশোনার বারোটা বাজবে।

সবুজের অবস্থার একটু উন্নতি হলে, তার মা জানায় ওর শ্বশুর বাড়ি থেকে কেউ দেখতে আসেনি। এমকি চিকিৎসার জন্য একটা টাকাও দেয়নি। সে ইচ্ছে করেই শিউলি আক্তার দৃষ্টিকে যে টাকা দিয়েছে তার কথা গোপন রাখে।
সবুজ মায়ের কথা শুনে গর্জে উঠে। ওর মনে পরে কিছুদিন আগেই কায়েস ওকে ফুলতলা যেতে নিষেধ করেছে।
” আমি আগে সুস্থ হই , মা। তারপর ওদের শিক্ষা দিব। ওরা আমাকে এখনও চিনেনা। সুস্থ হওয়ার পর ওদের চিনিয়ে দিব আমি কি। ”

” তোর বউয়ের সাহস কত দেখ, আমি হাজারবার বলার পরও সে তোকে দেখতে আসলনা। ” সবুজের মা মিথ্যা বলে দৃষ্টির নামে। অথচ দৃষ্টি সবুজকে দেখতে আসার জন্য পাগল হয়ে গেছে।
” ঐ হা’রা’ম’জা’দি’র তেজও আমি কমাতে জানি। তার বাপ মুখের ওপর নিষেধ করল আমাকে ঐ বাড়িতে না যেতে। কিন্তু সে কিছুই বলেনি, সেই কথা আমি ভুলিনি। আমার সেই অপমানের প্র’তি’শো’ধ আমি নিয়েই ছাড়ব। একবার খালি সুস্থ হই। ”

দৃষ্টি চেয়ারম্যান বাড়িতে একা একা ছটফট য।কেউই ওকে সবুজের কাছে নিয়ে যায়না। শিউলি যে দশ হাজার টাকা দিয়েছিল, তা সে ওর শ্বশুরের কাছে সেদিনই দিয়েছে, তবুও সে দৃষ্টিকে সবুজের কাছে যেতে দেয়নি।
দেখতে দেখতে কেটে গেছে দুইমাস। এরই মধ্যে কুহু আর তাহমিদ এসে ফুলতলা ঘুরে গেছে । ওরা সকালে এসে বিকেলেই ফিরে গেছে। কুহু থাকতে চাইলেও তাহমিদ থাকেনি। ওর একটাই কথা কুহুকে কখনো এখানে রাতে থাকতে দিবেনা।

সবুজও এরইমধ্যে সুস্থ হয়ে উঠেছে। ও বাড়িতে ফিরেই দৃষ্টির সাথে দুর্ব্যবহার শুরু করেছে। দৃষ্টির বাবা-মা কেন ওর কোন খোঁজ নেয়নি কিংবা চিকিৎসার টাকা দেয়নি, সেসব নিয়ে দৃষ্টিকে অত্যাচার করছে। দৃষ্টি অনেক বলেও কোন কাজ হয়নি।
কায়েস এই দুইমাসে সবুজের বিরুদ্ধে অনেক প্রমান সংগ্রহ করেছে। সে যে ছয় লাখ টাকা সবুজকে ব্যবসার জন্য দিয়েছিল তা সবুজ পুরোটাই জু’য়া খেলে, ম’দ খেয়ে উড়িয়েছে। এই খবরও পেয়েছে। এবং শিউলি আক্তারের গহনাও যে সবুজ চুরি করেছিল, সেই কথাও কায়েস জানতে পারে। সবুজের বিরুদ্ধে যতটুকু প্রমান সংগ্রহ করেছে, সেগুলো সবুজের আজীবন জেলে পঁচে ম’রা’র জন্য যথেষ্ট।

সেদিন বাড়িতে এসে কায়েস শিউলির কাছে তার গহনাগুলো দেখতে চায়। কিন্তু শিউলি দেখাতে পারেনা। কায়েসের ধমকে এবং তার রাগ দেখে শিউলি অবশেষে স্বীকার করে তার গহনাগুলো দৃষ্টিকে পরার জন্য দিয়েছিল। পরে সেগুলো হারিয়ে গেছে।

কায়েস এবার আর নিজেকে সামলাতে পারেনা। সপাটে কয়েকটা থা’প্প’ড় মারে শিউলির গালে।
শিউলির দাঁড়িয়ে থেকে থা’প্প’ড় হজম করা ছাড়া কোন পথ নেই।
রাত একটা বেজে গেছে অথচ সবুজ এখনও বাড়িতে ফিরেনি। দৃষ্টি বারবার দরজার দিকে তাকাচ্ছে।
দৃষ্টির অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে একসময় সবুজ বাড়িতে আসে। টালমাটাল অবস্থায় ঘরে ঢুকে।

তার অবস্থা দেখে দৃষ্টি বুঝতে পারে, সে ম’দ খেয়ে এসেছে। এবং তখনই জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল করে বসল দৃষ্টি।
” তুমি ম’দ খেয়ে বাড়িতে এসেছ? আমি তোমার জন্য সেই সন্ধ্যা থেকে অপেক্ষা করছি। কিছুদিন আগেও তুমি অসুস্থ ছিলে সেই চিন্তা করেছ? একটুও লজ্জা কি তোমার নেই? ” সবুজের সাথে চিৎকার করে বলতে থাকে দৃষ্টি।
” হা’রা’ম’জা’দি, কু’ত্তা’র বাচ্চা, তোর এতবড় সাহস, আমাকে ধমক দেস! আমি যা খুশি তাই করব, তুই বলার কে? আমি তোর বাপের টাকায় ম’দ খাই, যে তুই এত কথা বলবি? ” দৃষ্টির চুলের মুঠি ধরে, তলপেটে একটা লাথি দিয়ে বলে সবুজ।
ওর মত দশাসই মানুষের লাথি দৃষ্টি সহ্য করতে পারেনা। ছিটকে পরে যায় মেঝেতে। ব্যথায় নীল হয়ে যায় ওর ফর্সা মুখ। চোখ দিয়ে অনর্গল পানি ঝরতে থাকে।

দৃষ্টির চোখের পানি দেখেও সবুজের দয়া হয়না। মেঝেতে পরে থাকা দৃষ্টিকে এলোপাতাড়ি লা’থি মারতে থাকে।
” আর আমার কাছে কৈফিয়ত চাইতে আসবি? খু’ন হতে না চাইলে, আজ থেকে চুপ করে থাকবি। তোর ঐ হা’রা’মী বাপকে আমি পথে বসাব। আমাকে তার বাড়িতে যেতে নিষেধ করে! তার অ’হ’ঙ্কা’র যদি আমি পায়ে না পি’ষে’ছি তবে আমার নাম সবুজ না। ” কায়েসকে আরও অ’শ্রা’ব্য গালিগালাজ করতে থাকে সবুজ।
দৃষ্টি নিজের বাবার নামে এরূপ গালিগালাজ শুনে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে।

” তুমি আমাকে যা বলছ বল। কিন্তু আমার আব্বুকে নিয়ে একটাও বাজে কথা বলবেনা। তাহলে ভালো হবেনা বলে দিলাম। ” নিস্তেজ গলায় বলে দৃষ্টি।
” তোর বাপকে আরও গালি দিব। তুই কি করবি? তোর বাপের চৌদ্দ গোষ্ঠির ক্ষমতা নাই আমার মাথার একটা চুল ছেঁড়ার। শা’লী তোর বড় বোনকে মনে ধরেছিল। সেদিন রাতে তার দরজায়ও গেলাম, কিন্তু সেই শা’লী দরজা না খুলে, তার না’গ’র’কে ডেকে নিল। পরদিনই তোর বাপ ঢাকা যেয়ে না’গ’রে’র সাথে তার মেয়ের বিয়ে দিয়ে আসল। তোর বাপ কি মনে করেছে, এভাবে দূরে রাখলেই তার মেয়েকে আমি ছেড়ে দিব? ” আজ সবুজকে নেশায় পেয়েছে। নিজের অজান্তেই হড়বড়িয়ে সব কথা দৃষ্টিকে বলে দিচ্ছে। আর দৃষ্টি শুধু হতবাক হয়ে শুনছে।

” তুমি এত খারাপ! আপুর দিকে কুনজর দিয়েছ! আর আমি কিনা তোমাকে প্রান দিয়ে ভালবাসি! তোমাকে বিশ্বাস করি! তবে কি আম্মুর গহনা চুরি হয়নি? ” দৃষ্টির চোখেমুখে অবিশ্বাস।
” আমিই নিয়েছি তোর ডা’ই’নি মায়ের গহনা। মেয়েকে কয়েকদিনের জন্য গহনা পরতে দিছে। নিজের মেয়েকে গহনাগুলো দিতে তার কষ্ট হয়! শ’য়’তা’ন মহিলা। ”

” তোমার ঐ নোংরা মুখে আমার আম্মুকে শ’য়’তা’ন বলছ? তুমি তো নিজেই একটা শ’য়’তা’ন। তোমার বাপ শ’য়’তা’ন, তোমার মা শ’য়’তা’ন। এই বাড়িতে আসার পর থেকে আমাকে শান্তি দেয়নি। শ’য়’তা’নে’র ঘরে শ’য়’তা’ন জন্ম নিছে৷ ”
দৃষ্টির কথা শুনে সবুজের রাগ দ্বিগুণ বেড়ে যায়। দৃষ্টিকে একের পর এক লা’থি দিতে থাকে। সবুজের মার সহ্য করতে না পেরে একপর্যায়ে দৃষ্টি জ্ঞান হারায়।

যখন ওর জ্ঞান ফিরে, চারপাশে তখন ফজরের আজানের সুমধুর ধ্বনিতে মুখরিত। দৃষ্টির সমস্ত শরীরে ব্যথা। রক্তের চিকন রেখা দেখে বোঝা যাচ্ছে নাক-মুখ দিয়ে রক্ত ঝরেছে। জ্বরে শরীর পু’ড়ে যাচ্ছে।
বিছানায় তাকিয়ে দেখল সবুজ ঘুমে বিভোর। অনেক কষ্টে হাঁচড়েপাঁচড়ে উঠে দাঁড়ায় দৃষ্টি। আলনা থেকে বোরখা নিয়ে কোনমতে শরীরে ঢোকায়। পার্স থেকে একশো টাকার দুইটা নোট নেয়। এরপর ড্রেসিংটেবিলে থাকা ফোন হাতে নিয়ে ব্যথাতুর শরীরে বেরিয়ে আসে। হাঁটতে ভিষণ কষ্ট হচ্ছে। এদিক-ওদিক তাকিয়ে চুপিচুপি অতিক্রম করে চেয়ারম্যান বাড়ির সীমানা।

বিন্দু থেকে বৃত্ত পর্ব ৪৪

বিঃদ্রঃ গল্পের প্রয়োজনে কিছু স্ল্যাং ইউজ করা হয়েছে। এটা নিতান্তই গল্পের প্রয়োজনে করেছি। কেউ এটাকে খারাপভাবে নিবেননা।

বিন্দু থেকে বৃত্ত পর্ব ৪৬