বিপরীতে তুমি আমি পর্ব ১৩

বিপরীতে তুমি আমি পর্ব ১৩
সুমাইয়া ইসলাম

স্বামী! আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই। আপনি কি আমাকে বিয়ে করবেন?
কিরণের মুখে এমন উদ্ভট বিষম খেয়ে গেল অর্ণব। এলকোহলের প্রভাব সম্পূর্ণ কাটিয়ে ওঠতে অর্ণব বাড়ির কাজের সহকর্মী পুষ্পকে দিয়ে আরো এক গ্লাস লেবুর শরবত আনিয়েছে। সন্ধ্যায় এসে গোসলটাও সারতে পারে নি। কিরণ রুম ত্যাগ করতেই গোসল করে এসেছে। নেশাটাও কেটেছে। তবুও কোনো প্রকার ঝুকি নিতে রাজি নয় অর্ণব।

তাই আরো এক গ্লাস লেবুর শরবত আনিয়েছে। মাত্রই বিছানায় বসে ভেজা চুলগুলো এক হাত দিয়ে মুছতে মুছতেই আরেক হাত দিয়ে একটু একটু করতে শরবত গিলছে। সেই মুহুর্তেই কিরণের কন্ঠ হতে এমন কথা শুনে বিষম খেয়ে নাজেহাল অবস্থা। বাজে ভাবে বিষম খেয়েছে। ইতিমধ্যে নাকটাও লাল হয়ে এসেছে। অর্ণব কন্ঠের স্বর ধরে দরজার দিকে তাকালো। কিরণ তখনও ঘরের দরজার চৌকাঠের উপারে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

দু হাত দিয়ে দরজার কাঠ ধরে আছে। শরীর কেবল আধ অংশ দৃশ্যমান। তার ডাগর ডাগর চোখখানায় উক্ত প্রশ্নের উত্তরের তীব্র আশা পরিলক্ষিত হচ্ছে। কি অদ্ভুত আবদার! অর্ণবের কিরণকে কিছুটা অন্যরকম লাগলো। হয়তো নতুন কোনো পরিকল্পনা করছে। কিন্তু আবার কিরণের লাল চোখ ও নাট অন্য দিক ইঙ্গিত দিচ্ছে। হাতের তাওয়ালটা বিছানায় পড়ে গেল আপনাআপনি। গ্লাসটাও পাশের ছোট্ট টেবিলটায় রাখতেই কিরণ হুরমুড়িয়ে ডুকে পরলো ঘরে। নিজের সামনে হাতের পাঁচ আঙ্গুল টান টান করে বাঁধা স্বরূপ দেখিয়ে পুনরায় বলে ওঠল,

থামুন! এগোবেন না। আগে বিয়ে করে তারপর এগোবেন। না হলে আমি দারোয়ান ডাকবো।
কিরণের আচরণে অর্ণব এবার নিশ্চিত হলো কিরণ নেশা করেছে। বাকরুদ্ধ হয়ে কিছুক্ষণ দাড়িয়ে রইল অর্ণব। এ মেয়ে আর কি কি করতে পারে তা ভাবার চেষ্টা করছে। স্বামীকে নেশা করাতে ব্যর্থ হয়ে নিজেই নেশা করে এসেছে। সাংঘাতিক মেয়ে! অর্ণবের এ মুহুর্তে মন চাচ্ছে এ মেয়ের মস্তিষ্ক কি কি দিয়ে তৈরী তা খুলে খুলে দেখতে। পঁচিশ বছরের একজন প্রাপ্তবয়স্ক নারীর কর্মকান্ড কিনা আঠারো উনিশ বয়সী কিশোরির মতো? প্রেমিকা থেকে বউ হয়েছে তবুও যেন প্রেমিকাতেই আঁটকে রয়েছে।

কিরণ দাঁড়িয়ে থাকতে হিমশিম খাচ্ছে। যতবার টাল খেয়ে যাচ্ছে ততবার নিজে নিজে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েও যাচ্ছে। দু তিনবার সামলে নিলেও পরবর্তী বার আর সামলাতে না পেরে সামনে হেলে গেল। অর্ণব দ্রুত কিরণকে আঁকড়ে ধরলো। চোখের পলকে যেন হার্ট বিট একটু করে থেমে গিয়েছিল।

শ্বাসনালী থেকে বেড়িয়ে এল স্বস্তির নিঃস্বাস। অর্ণব কিরণের দিকে তাকালো। দু হাত দিয়ে তার কালো রঙ্গের গেঞ্জিটার বুকের দু পাশে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। ভয় পেয়ে গিয়েছে হয়তো। কিরণও মাথা উচু করে অর্ণবের দিকে তাকালো। ঘন ঘন চোখের পলক ফেলে হঠাৎই ঠোঁটে চওড়া এক হাসি দিল। অর্ণব কিরণের হাসিতে ভ্রু কুচকে ফেললো। কি চলছে মেয়েটার মাথায়? অর্ণব কিরণের কোমরটা আরেকটু চেপে ধরলো। আরো কাছে চলে এলো দুজনের মুখশ্রী। ভ্রু দুটো উঁচু করে জিজ্ঞাসা করলো,

কি হয়েছে? হাসছো কেন?
কিরণ সাথে সাথে সোজাসাপটা জবাব দিল,
আপনাকে না টমেটোর মতো লাগছে। না আপনাকে না, আপনার নাকটা। একদম আপেলের মতো। একটা কামর দেই?
কিরণের কন্ঠস্বর যেন পরিবর্তন হলো। বাচ্চাদের মতো চিকন ও আবদারি সুর। তার মাঝে উদ্ভট প্রশ্ন! একবার টমেটো তো একবার আপেল। অর্ণব ব্যপারটা উপভোগ করতে লাগলো। সাধারণ সময়ে কিরণ মোটেও তার নিজ সত্তাতে অর্ণবের সাথে কথা বলে না। এ সুযোগে না হয় তার প্রিয়তমাকে কিছু সময় কাছে পেলো। ফিরা দেখা হলো সেই আট বছরের পুরোনো কিরণকে। বাচ্চা বাচ্চা স্বভাবের কিশোরি কিরণ।

কথাগুলো ভেবেই অর্ণবের মুখে ফুটে উঠে হাসির আভাস। এক হাত দিয়ে কোমর জড়িয়ে অন্য হাত দিয়ে কিরণের সামনের চুলগুলো গুজে দিলো। কিরণও তৎক্ষণাৎ নিজের দু হাত অর্ণবের কাঁধর ওপর দিয়ে দিলো। পৌছাঁতে কষ্ট হচ্ছে। পায়ের পাতা উঁচু করে অর্ণবের পায়ের উপর দাঁড়ালো। কিরণের এ কান্ডে অর্ণবের হাসি পেলো। অর্ণবকে হাসতে দেখে কিরণ মুখটা চুপছে ফেললো। ঠোঁটটা বাকিয়ে বললো,

হাসবেন না একদম। আপনি জিরাফ বলে আমিও কি জিরাফ হবো নাকি? কোথায় এটু সাহায্য করবে তা না বাঁদরের মতো হাসছেন।
অর্ণব কিরণের কথা শুনে সত্যি সত্যি কোমর চেপে হালকা উঁচু করলো। কিন্তু তাতেও কিরণের অসুবিধা। চিল্লিয়ে ওঠলো,
আআআমার কোমর ভেঙে যাচ্ছে তো। ধরেছেন কেন?
ওমা! তুমিই না বললে তোমাকে সাহায্য করতে?

আমি মোটেও বলি নি। আপনি মিথ্যা বলবেন না। আচ্ছা বাদ! শুনুন না! আমি বিয়ে করবো।
অর্ণব কিরণের কপালে আলতো করে চুমু দিয়ে দিলো। নরম সুরে বললো,
কদিন আগেই না বিয়ে করলে। আবারো বিয়ে করবে?
কিরণ ক্রমাগত মাথা নেড়ে সম্মতি প্রকাশ করলো। পরক্ষণেই আবারো বললো,

বিয়ে হয়ে গিয়েছে তাহলে চুমু খাবো। ঠোঁট চুমু খাবো। আপনি তখন ভালো করে চুমু খেতেই দিলেন না।
অর্ণবের চোখ আপনা আপনি বড় হয়ে গেল। নেশার ঘরে এ মেয়ে কি রেখে কি বলছে? বলেই ক্ষান্ত নয়। গাল ফুলিয়ে অর্ণবের ঠোঁটের কাছে আঙ্গুল দিয়ে রীতিমতো খোঁচাচ্ছে। অর্ণব বুঝতে পারলো পরিস্থিতি হাতের বাহিরে চলে যেতে পারে। যেকোনো মুহুর্তে একটা অঘটন ঘটাতেও দ্বিধাবোধ করবে না। তার আগেই কিরণকে স্বাভাবিক করতে হবে। আর দেরি না কোলে করে কিরণকে খাটিয়ে বসিয়ে দিল। বসিয়ে শাসনের সুরে বললো,

এই পা যেন মাটিতে না পরে। আমি যাবো আর আসবো। ঠিক আছে?
অর্ণব দ্রুত পায়ে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো। কিরণও বাধ্য মেয়ের মতো বসে পরলো।
পাঁচ মিনিট পর অর্ণব নিজেই কড়া করে লেবুর শরবত নিয়ে এলো। শরবত বললে ভুল হবে। শুধু মাত্র লেবুর রস। পুরো এক গ্লাস।

ঘরে ডুকতেই দেখতে পেলো রুমময় অন্ধকার রাজত্ব করছে। দুবার কিরণকে ডেকে কোনো সাড়া শব্দ পেল না। চিন্তায় কপালে দুটো ভাজ পড়ে গেলো। বিলম্ব না করে দ্রুত লাইট জ্বালাতেই থ হয়ে গেল। হাতের ধরে রাখা গ্লাসটির বাঁধন আরো শক্ত হয়ে এলো। অনুভব করলো গলাটাও মুহুর্তেই শুকিয়ে এসেছে। রৌদ্রেরঝাঁজে গলায় বুঝি খরা নেমেছে। তৃষ্ণার্থ হয়ে এলো কন্ঠনালী। যুগ যুগের তৃষ্ণা জেগে ওঠলো। কতকালের যেন তৃষ্ণার্থী সে।

রফিকউল্লাহ খান নিজের চেম্বারে বসে আসেন। সামনেই বসে আছে তার সহকর্মী রেজওয়ান। বিভিন্ন কাজের কৈফত দিতে ব্যস্ত। সম্প্রতি একটা ব্যাগ অ*বৈধ দ্রব্য খুবই সফলভাবে পা*চার করেছে। আগের তুলনায় সিকিউরিটিও বাড়িয়ে দিয়েছে দ্বিগুণ। কোটি টাকা ক্ষতির পর এখন থেকে অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হচ্ছে। যতদিন না নীরব ঘাতকে চিহ্নিত করতে পারছে ততদিন প্রতিটা পদক্ষেপ গুণে গুণে ফেলতে হবে।

কাজের এলাকার সিসি টিভি নিয়ন্ত্রণে থাকা লোকগুলোর মাঝে নিজের লোক নিয়োগ করাতে হবে। নিজেদের ভুলগুলো নিজেদেরই আগে ধরতে হবে। তবেই না সংশোধন করা সম্ভব। রেজওয়ান বিগত সিসি টিভির ফুটেজের একটা কেসেট চালু করতেই হঠাৎ দরজায় শব্দ হলো। রফিকউল্লাহ এবং রেজওয়ান দুজনের দরজার দিকে তাকালো। তারপর রেজওয়ান রফিকউল্লাহর দিকে তাকাতেই তিনি ইশারা করলেন দরজা খুলার জন্য। হুকুম মতো রেজওয়ান দরজা খুলতেই এক যুবক এসে সালাম দিয়ে বললো,

স্যার! ছোট সাহেব আবার ঝামেলা করছেন। এবার ঝামেলা হয়েছে পরীক্ষার হলে।
রফিকউল্লাহর মুখমন্ডলে দেখা দিল চরম বিরক্তি। রেজওয়ান চোখ বন্ধ করে শ্বাস ফেললো। আজকের দিনের বাকি সময়টা খারাপ যাবে তার আগাম আভাস পেয়ে গেল। সারাদিন এবার বসের ঝারি এবং বকা খেয়ে দিন যাবে। এ মুহুর্তে ওর মন চাইছে আকাশের মাথাটা বারি দিয়ে ফা*টালে হয়তো শান্তি পেতো। রফিকউল্লাহ কন্ঠে ঘোর ফিরলো।
কার সাথে বাঁধিয়েছে?
একটা মেয়ের সাথে।

রফিকউল্লাহ এবার অবাক হলেন। অবাক হলো রেজওয়ান নিজেও। ছোট সাহেবের সাথে ঝামেলা করতে ছেলেরা যেখানে দশবার ভাবে সেখানে একটা মেয়ে এসে ঝামেলা করছে? রফিকউল্লাহ অবাক কন্ঠেই প্রশ্ন করলেন,
কে সেই মেয়ে? তোমার ছোট সাহেবের পরিচয় জানে?
তা জানি না স্যার। তবে মেয়ের সম্পর্কে সকল তথ্য নিয়ে এসেছি।

আকাশ একটা খাম রফিকউল্লাহর সামনে রাখলো। রেজওয়ান এগিয়ে এসে খামটা খুললো। সেখান থেকে সর্ব প্রথমেই একটা ছবি বেড়িয়ে এলো। ছবি দেখে আরেক দফা ঝটকা খেল সে। রফিকউল্লাহ দাড়িয়ে ছবিটা নিয়ে দেখলো। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে হঠাৎই অট্ট হাসিতে মেতে উঠলো। চার দেয়াল সে হাসি বারি খেয়ে পুনরায় ফিরে আসছে। প্রতিধ্বনিতে কি কুৎসিত শোনাচ্ছে সে আওয়াজ! নিজের চেয়ারে বসে রেজওয়ানের দিকে তাকিয়ে বললো,

বিপরীতে তুমি আমি পর্ব ১২

তোমাদের ছোট সাহেব তো আমার কাজ সহজ করে দিলো রেজওয়ান। এবার জমবে মজা। এক ঢিলে দু পাখি মরবে। মিষ্টার অর্ণব শাহরিয়ার! তোমার সামনের দিন নিকষ কালো! যতটা না আমার মন কালো তা থেকেও তিনগুণ অন্ধকারে ভরিয়ে দেব তোমার আগামীর দিন। আর তার শুরু হবে তোমার প্রাণের প্রিয়তমাকে দিয়েই। দুমরে মুচরে নর্দমায় ফেলে দেব তোকে আমি।

বিপরীতে তুমি আমি পর্ব ১৪