বিবর্ণ বৈশাখে রংধনু পর্ব ১৫

বিবর্ণ বৈশাখে রংধনু পর্ব ১৫
নুরুন্নাহার তিথী

আরহান তার বাবার মলিন মুখশ্রী অবলোকন করে মনে মনে হতাশ হলো। অবশেষে সে তার বাবার কথায় রাজি হয়েই গেল। আরহান নরম কণ্ঠে বলল,
“আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি খবর নাও। আমি মাস্টার্সের জন্য এপ্লাই করব। কিন্তু এক মাস অন্তত আমাকে এসব নিয়ে ঝামেলা দেওয়া যাবে না। এক মাস পর আমি ভর্তি হবো নতুন সেসন যখন শুরু হবে তখন। এই একমাস আমার স্বপ্নের পথে উড়তে দাও।”

আরহান চলে গেলে আজমল খান মলিন দৃষ্টিতে ছেলের চলে যাওয়া দেখলেন। ছেলের কণ্ঠের বিষাদ তাকে স্পর্শ করেছে ঠিক কিন্তু সে কী করবে! একটাই ছেলে তার। তার কাজগুলোকে আরও সামনে এগিয়ে নিতে ছেলেকেই তো লাগবে। আজমল খান দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের স্টাডি রুমে চলে যান।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সাফা রুম অন্ধকার করে বসে আছে। বারবার ফোনের স্ক্রিন অন করছে তারপর কিছু সময় পর আপনাআপনি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সাফার গালে অশ্রুধারার ছাঁপ। সে আপনমনে স্বগতোক্তি করে,
“কেন আরহান? কেন তুই আমায় ভালোবাসতে পারিস না? জাস্ট ফ্রেন্ডই ভেবে গেলি। আমি যে রাগ করে চলে এসেছি। একটা বারও কল করে জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজন বোধ করলি না? এতোটাই বিরিক্তিকর আমি? আমি যে দিন-রাত তোরই কথা ভাবি! একটু তো ভালোবেসে দেখ, আমি তোক তার তিনগুণ ফিরিয়ে দিব।”

আবারও নিরব কান্নায় ভেঙে পরে সে। কতোসময় এভাবে কাঁদল তার হিসেব নেই। তারপর রাত এগারোটার দিকে মায়ের ডাকে রুমের আলো জ্বালিয়ে হাত-মুখ ধোঁয়। সে কয়েকটা দিন ছুটি নিয়ে কোথাও ঘুরে আসার কথা ভাবল।

আরও কয়েকটা দিন পেরিয়ে গেছে। রুহানী প্রতিদিন ক্লাসে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে ক্লাসের সবাই জেনে গেছে রুহানী কথা বলতে পারে না। প্রিন্সিপ্যাল স্যার নিজে এসে বলে গেছেন, যাতে রুহানীর সাথে কেউ কোনো খারাপ আচরণ না করে। রুহানীর সাথে একটা মেয়ের সখ্যতা গড়ে উঠেছে। মেয়েটা রুহানীদের এড়িয়াতেই থাকে। মেয়েটা রুহানীর সাথেই ক্লাসে যায়। নাম তার কাজল।

আজ প্রচণ্ড গরম। প্রখর রোদের জন্য হাতের চামড়া পু*ড়ে যাওয়ার দশা! রুহানীর গাড়ি আজকে আগে আগে আসেনি। গাড়ির জন্য সে পাঁচ মিনিট যাবত কলেজের গেইটে অপেক্ষা করছে। সাথে কাজলও আছে। হঠাৎ পাশ থেকে গুটিকতক ছেলে রুহানীদের উদ্দেশ্যে বাক্য ছুড়ল,

“কী সুন্দরীরা? এই রোদের মধ্যে দাঁড়ায় আছো কেন?”(সিলেটি ভাষাকে বোঝার জন্য এভাবে লেখা)
রুহানী ও কাজল দুইজনেই বেশ ভয় পেয়ে যায়। কাজল এদেরকে চিনলেও রুহানী চিনে না। ওরা দুজনে সামনের দিকে চেয়ে আছে। কিন্তু ছেলেগুলো আবারও ডেকে ওঠল,
“ও সুন্দরীরা, এদিকে আসো। কতক্ষণ রোদের মধ্যে দাঁড়ায় থাকবা? আসো তোমাদের পৌঁছে দেই।”

রুহানী কেঁপে ওঠে। এক হাতে কাজলের হাত শক্ত করে ধরে রেখে আরেক হাতে ব্যাগ থেকে ফোন বের করে ড্রাইভার কতোদূর এলো জানতে কল করে কাজলের কানে দিল। কাজল ড্রাইভারের সাথে কথা বলে জানল আর দুই মিনিটের মতো লাগবে। রুহানী ও কাজল শুনতে পেল ছেলেগুলোর হাসি-তামাশা। দুইটা মিনিট কোনোরকমে পেরিয়ে গেলেই বাঁচে।
একটু পরেই ড্রাইভার এসে হাজির হলে রুহানীরা দ্রুত গাড়িতে উঠে পরে। গাড়িতে উঠে কাজল ভীত কণ্ঠে বলে,

“ওরা কিন্তু পিছু ছাড়বে না রুহি! আমাদের এক ব্যাচ সিনিয়র আপুর পেছনে হাত ধুঁয়ে পরেছিল। অনেক জ্বা*লিয়েছে। আমি তো এই কলেজ থেকেই এইচএসসি দিয়েছি তাই দেখেছি। তারপর ওদেরকে কয়েক মাসের জন্য সাসপেন্ড করেছিল। এখন তোর পেছনে পরেছে। সময় থাকতে আংকেলকে বলিস। তাহলে উনি অথারিটির সাথে কথা বলে রাখবে।”
রুহানী মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি দিল। তারপর কাজলকে কাজলের বাড়ির রাস্তায় ছেড়ে রুহানী গাড়িতে করে চলে গেল।

ফ্লাইটের আগে আরহান প্লেনের কাছে যাওয়ার জন্য গাড়িতে উঠে সাফাকে দেখে বেশ খুশি হলো। সে জিজ্ঞাসা করল,
“কী-রে? এতোদিন কোথায় ছিলি? ফোন করেছিলাম পাইনি। ওরা কেউই তোকে ফোনে পায়নি বলল। কী হয়েছিল?”
সাফা কয়েক সেকেন্ড পলক না ফেলে আরহানের দিকে চেয়ে রইল। আরহান ওর চোখের সামনে হাত নাড়ালে সাফার মুখাবয়বে কোনো পরিবর্তন লক্ষণীয় হলো না। কেমন ভাবলেশহীন মনোভাব তার।
আরহান আবার শুধায়,

“ঠিক আছিস তুই?”
“তা জেনে তুই কী করবি? আমার ফোন নট রিচেবল ছিল বলে কি একবারও আমার বাসায় গিয়ে খোঁজ নিয়েছিলি? নিসনি তো। রাইদা, তন্নি, রাফাত তো গিয়েছিল। আমি না থাকলেও মা ছিল। মা বলেছে।”
সাফার বলার পর আরহান বলে,
“ওরা তো গিয়েছে। তা শুনেছি। ওরা গিয়ে তোকে পায়নি। তোর অনুপুস্থিতিতে ওরা যাওয়া আর আমার যাওয়া তো একই কথা। তাই না?”
“হু।”

সাফা ছোটো করে জবাব দিয়ে চুপ করে গেল। আরহান তাকে ফ্রেন্ডের বাহিরে একটা শব্দও বেশি ভাবে না তা তার ধারনাতে চলে এসেছে। নিকষ কালো অম্বরে নিজের বিষাদময় নিঃশ্বাস ত্যগ করে মৌন রইল। যথাসময়ে দুজনে একই প্লেনে উঠার পর আরহান লক্ষ্য করল সাফা কেমন চুপচাপ হয়ে আছে। আরহান ভাবল, হয়তো রাগ করে আছে। তাই সাফাকে ডেকে বলল,
“দেখ, বাদ দে সেসব। আমার কাজ ছিল তাই যেতে পারিনি। এখন মন খারাপ করে থাকিস না।”
“হুম।”
ফ্লাইটের সময় হয়ে গেলে সকল ঘোষনা শেষে ওরা লন্ডনের উদ্দেশ্যে রওনা করে।

এগারো ঘণ্টা পর লন্ডন পৌঁছেছে আরহানরা। সবসময়ের মতো রেস্ট করতে হোটেলে নিজের রুমের চাবি নিয়ে রেস্ট করতে চলে গেছে আরহান। পেছন পেছন সাফা নিজের রুমের চাবি হাতে ধীরে ধীরে হাঁটছে। আরহান চোখের আড়াল হতেই সেও নিজের রুমে ঢুকে পরে।

পরেরদিন সকালে আরহানের বেশ বেলা করেই ঘুম ভাঙলো। উঠেই ফোনে সময় দেখে সাফার কোনো কল বা মেসেজ না দেখে বেশ অবাক হয়েছে। সাফার তো স্বভাব এটা। আরহান ভাবনা-চিন্তা রেখে ফ্রেশ হয়ে তৈরি হয়ে রুম লক করে বাইরে বেরোলো। হোটেল রিসিপশন থেকে জানতে পারল যে সাফা অনেক আগেই বেরিয়েছে। হঠাৎ সাফার ব্যাবহার আরহানের কাছে বেশ একটা সুবিধার লাগছে না। সেও সাফাকে খুঁজতে বের হলো।

বিকেলে রুহানী টেরেসে বসে প্র্যাকটিকেল খাতায় চিত্র আঁকছে। আর অদূরে বনি খেলছে। জাহানারা শেখ পাকোড়ার প্লেট হাতে রুহানীর পাশে এসে বসল। তিনি বললেন,
“নিজে আজমল ভাই এসেছেন।”
রুহানী জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইলে জাহানারা শেখ জবাব দেন,

“ওই কিছু কাজে। কথায় কথায় বললেন, তার ছেলে নাকি মাস্টার্সে ভর্তি হবে। পাইলটের জব ছেড়ে দিবে।”
রুহানী ইশারায় কারণ জিজ্ঞাসা করলে উত্তর আসে,
“বলেছে বাড়িতে তারা দুইজন থাকে। আর কতো ছেলে দেশ-বিদেশে ঘুরে বোরাবে? ছেলের বিয়ের কথাও ভাবছেন।”
রুহানী শেষোক্ত কথায় কিছু সময় নীরব চেয়ে থেকে আবারও নিজের কাজে মন দেয়। জাহানারা শেখ ওকে পাকোড়া খেতে বলে চলে যান।

আরহান সেই কাঙ্খিত জায়গাতেই সাফাকে পেয়ে গেল। লন্ডন টাওয়ারের পাশে টেমস নদীর তীরে বসে আছে সে। আরহান গিয়ে ওর পাশে বসে তাতেও সাফার কোনো হেলদোল নেই। কিছুটা সময় অতিবাহিত হওয়ার পর আরহান নিজ থেকেই জিজ্ঞাসা করল,
“কী হয়েছে তোর? আজকে আমাকে না ডেকে একা একা বেরিয়েছিস?”

সাফা এবার আরহানের দিকে ঘুরে বসল। অতঃপর আরহানের হাত দুটো ধরলো। আরহান একবার সাফার দিকে তাকায় তো একবার ধরে থাকা হাতের দিকে। সাফা কিছুটা সময় মৌন থেকে তারপর হুট করে বলে ওঠে,
“আই লাভ ইউ আরহান!”

বিবর্ণ বৈশাখে রংধনু পর্ব ১৪

সাফার কথা শুনে আরহান যেন আকাশ থেকে পরল! চট করে সাফার হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। কন্ঠে একরাশ বিস্ময় নিয়ে শুধালো,
“মানে!”

বিবর্ণ বৈশাখে রংধনু শেষ পর্ব