বিবর্ণ বৈশাখে রংধনু শেষ পর্ব 

বিবর্ণ বৈশাখে রংধনু শেষ পর্ব 
নুরুন্নাহার তিথী

সাফা ঠায় বসে থেকেই বলল,
“আমি তোকে অনেক আগে থেকে ভালোবাসি। তোর মা ও আমার বাবা কলিগ ছিলেন। তখন থেকেই আমার তোকে ভালো লাগে। তোর সাথে বয়সের গ্যাপ হওয়া সত্বেও তোর সাথে ফ্রেন্ডশিপ করা তারপর একসাথে চলাফেরা করা সবকিছু আমি তোর সাথে থাকার জন্য করেছি। চেয়েছিলাম ফ্রেন্ডশিপ থেকে ভালোবাসা হবে। আমি তোকে খুব ভালোবাসি আরহান।”

সাফা কথাগুলো বলা শেষ করে সেভাবেই আরহানের চোখের দিকে অবিচল চেয়ে আছে। আরহান নিজের চুল হালকা টেনে হাত দিয়ে মুখ মুছে নিজেকে শান্ত করার প্রয়াসে ব্যস্ত। তারপর অস্থির স্বরে বলে,
“দেখ, আমার তোর প্রতি তেমন কোনো ফিলিংস নেই। এজ অ্যা ফ্রেন্ড ঠিক আছে কিন্তু লাইফ পার্টনার! নো ওয়ে। এতোদিনের ফ্রেন্ডশিপ আমাদের, আজ তুই এসব বলছিস। যদি লুকানো কিছুও মনের মধ্যে থাকত তবে আমি মেনে নিতাম। কিন্তু হচ্ছে না। আমি এক সেকেন্ডও বেশি ভাবতে পারছি না। সরি ইয়ার। আমি চাই না তুই দুঃখ পাস। কিন্তু আমার হাতে যা আছে তা হলো তোর থেকে দূরত্ব বজায় রাখা। যাতে তুই মন থেকে এসব মুছে ফেলতে পারিস। অ্যাই অ্যাম রিয়ালি সরি।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আরহানের মুখ নিঃসৃত প্রতিটা শব্দ সাফার হৃদয়কে অগণিত চূর্ণ করে চলেছে। চোখের কোণ জুড়ে অবিরত অশ্রধারাকে বইতে দিয়ে মলিন হেসে আরহানের চোখে চোখ রেখে বলল,
“সরি আরহান। আমি একটু বেশিই ভেবে ফেলেছিলাম। এখন থেকে নিজের চিন্তাধারাতে কন্ট্রোল রাখব। ভালো থাকিস। আর তোকে আমার থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে হবে না, আমিই রাখব।”

সাফা তারপর আরহানের সামনে থেকে চলে যায়। যাওয়ার আগে আরহানকে মুচকি হাসি উপহার দিয়ে যায়। সাফার যাওয়ার পানে চেয়ে আরহান দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সে কেমন পা*ষাণের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে! একটাবারও তার মন বলল না, মেয়েটার চোখের জল মুছিয়ে দিতে। এই মূহুর্তে আরহান নিজের ভাবনা-চিন্তার উপরই ভীষণতর অবাক। এতোটা কঠোর সে তার ফ্রেন্ডের সাথে! তাও বেস্টফ্রেন্ডের সাথে! নিজের কাজেকর্মে প্রচণ্ড হতাশ ও বিরক্ত হয়ে বিপরীত দিকে হাঁটতে থাকল। একা একা ঘুরলে নিজেকে বুঝতে পারবে।

দেখতে দেখতে সময়ের ধারায় এক মাস পেরিয়ে গেছে। আরহান এমসি কলেজেই মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছে। অনার্স যেহেতু রসায়নবিদ্যাতে করেছিল, মাস্টার্সও সেটাতেই ভর্তি হয়েছে। আজ দ্বিতীয়দিন ভার্সিটিতে ক্লাসের জন্য এসেছে। প্রথমদিন ক্লাসের জন্য এসেছিল দুইদিন আগে। সে পাইলটের জবটা ছাড়েনি। তার ডিউটি রাতেই থাকে বেশি। আন্তর্জাতিক ফ্লাইট থাকলেই ক্লাস মিস হয়। আজমল খান নিজে এসে ছেলেকে মনের বিরুদ্ধে গিয়ে পাইলটের জব ছাড়তে নিষেধ করে গেছেন।

ক্লাস শেষে আরহান দ্রুত দিঘীর পাড়ে নিজের বাইকের কাছে গিয়ে বাইকে উঠে চাবি ঘোরানোর পর অদূরে তীরবর্তী শাপলার জন্য ব্যাকুল হওয়া রুহানীকে দেখতে পায়। পেছনে দাঁড়ানো কাজল বারবার রুহানীকে শাপলা তুলতে নিষেধ করছে। ভরা বর্ষা। দিঘীতে শাপলার সাথে তার আশেপাশে সা*প যে থাকবে না তা ভাবাও বোকামি। রুহানী কাণ্ডকারখানা দেখে আরহান মাথায় হাত দিয়ে হেসে ওদের দিকে এগিয়ে গেল। অতঃপর পেছনে দাঁড়িয়ে রুহানীকে ডেকে বলে ওঠল,

“রুহানী, উঠে এসো।”
হঠাৎ পরিচিত পুরুষ কণ্ঠ শুনে হকচকিয়ে পেছনে ফিরে তাকায়। আরহানকে দেখে ইশারায় “আপনি এখানে?” জিজ্ঞাসা করলে আরহান জবাবে বলে,
“এখানে মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছি।”
রুহানী হালকা হাসি বিনিময় করে আবারও শাপলা তোলার দিকে মনোনিবেশ করতে নিলে আরহান বাধা দেয়,
“তুমি উঠে এসো। আমি তুলে দিচ্ছি। যেভাবে আছো, তাতে পরে যেতে খানিক ব্যাবধান মাত্র। তুমি উঠে এসো।”
আরহানের সাথে কাজলও তাল মিলালো।

“হ্যাঁ রুহি উঠে আয়। এভাবে করতে থাকলে শাপলা কাছে আসার বদলে আরও দূরে চলে যাবে।”
রুহানী নাছোড়বান্দা। সে ইশারায় জেদ প্রকাশ করল। রুহানীর জেদ দেখে আরহান বাধ্য হয়ে এগিয়ে গিয়ে ওকে টেনে এনে কাজলের কাছে রেখে নিজেই শাপলা তুলতে ব্যাস্ত হয়ে পরল। আরহানের আচানক কাণ্ডে রুহানী বিমূঢ় হয়ে চাইল। কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে আরহানকে দেখে মুচকি হাসল। ছেলেটার সাথে যতোবার দেখা হয়েছে ততোবার তার জন্য কিছু না কিছুতো করেছেই। ছেলেটা যে বড্ড কেয়ারিং তা তাকে আর কারও বলার অপেক্ষা রাখে না।
প্রায় মিনিট পাঁচেক কসরত করে অবশেষে আরহান এক জোড়া শাপলা তুলতে সক্ষম হয়। তারপর রুহানীর কাছে এসে লম্বাশ্বাস ফেলে বলে,

“ফাইনালি! এই নাও তোমার শাপলা। খুশি?”
ফুল দুটো হাতে পেয়ে রুহানী ভীষণ আনন্দে প্রশস্ত হেসে ঘাড় নাড়ালো।
“এভাবে দিঘীর কর্নারে যাবে না। বর্ষাকাল। শাপলার পাতার নিচে সা*প থাকে। আমি একটার লে-জ দেখেছিও! বি কেয়ারফুল। এবার বাড়িতে যাও।”
রুহানী খুশিমনে সায় দিল। সে ইশারায় ধন্যবাদও জানিয়েছে। কাজল তাড়া দিয়ে বলে ওঠে,

”হাতে তো পেয়েছিস। এবার চল। ড্রাইভার সেই কখন চলে এসেছে।”
কাজল এবার আরহানের দিকে তাকিয়ে সৌজন্য সূচক বলে,
“থ্যাংকিউ ভাইয়া, আমাদের হেল্প করার জন্য।”
“ওয়েলকাম। তোমরা এবার বাড়িতে যাও।”
রুহানী ও কাজল গাড়ির কাছে যাওয়া ধরলে আরহানও নিজের বাইকের কাছে যায়। তারপর বাইক স্টার্ট করে চলে যায়।

আজ আরহানের ডোমেস্টিক ফ্লাইট আছে। ফ্লাইটটা বিকেলেই। ক্লাস করে দ্রুত ফ্লাইটের এক ঘণ্টা আগে এসে পৌঁছেছে। এসেই খবর পেয়েছে, আজও সাফা সিডিউল চেঞ্জ করেছে। এই একমাসে এই নিয়ে তিনবার হলো। আরহানের সাথে ফ্লাইট পরলেই সে কোনো না কোনো বাহানা করে চেঞ্জ করে দেয়। বন্ধুত্বের মধ্যেও কেমন দূরত্ব এসে গেছে। আরহান তপ্তশ্বাস ফেলে রাইদার থেকে খবর নিয়ে সাফা যেখানে আছে সেখানে যায়। সাফা কাজ করছিল। আরহান পেছন থেকে গম্ভীর স্বরে বলে ওঠে,

“কেন এমন করছিস সাফা?”
সাফা হাতের কাজ রেখে ঘুরে ভাবলেশহীন কণ্ঠে শুধায়,
“কী করছি?”
“বুঝতে পারছিস না? বারবার ফ্লাইটের সিডিউল কেন বদল করছিস?”
“দেখ, আমি নিজেকে অনেকটাই সামলে নিয়েছি। দুর্বলতা বাড়াতে চাই না। এছাড়া আর কিছু বলতে চাই না। প্লিজ বিরক্ত করিস না।”

সাফার কণ্ঠস্বরে এবার রূঢ়তা পরিলক্ষিত। আরহান হতাশ স্বরে বলে,
“আমি কি আমার বেস্টফ্রেন্ডকে ফেরত পাব না?”
কথাটা শুনে সাফা কয়েক সেকেন্ড পলকহীন আরহানের মুখপানে চেয়ে রইল। অতঃপর চোখের কার্নিশে জমে উঠা অশ্রুকণাকে আঙুলের সাহায্যে সরিয়ে নিয়ে বলল,

“পাবি। সময় যাক। এখন তুই যা। আমাকেও যেতে হবে।”
এই বলে সাফা নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে বেরিয়ে গেল। আরহান চোখ বুজে ঘন নিঃশ্বাস ফেলে নিজেও চলে গেল নিজের কাজে। সাফাকে সে আর কিছু বলবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। নিজের কাজ-পড়াশোনা এসব নিয়ে ভাববে।

সময়ের ক্রমবর্ধমানে আজ ইংরেজি বর্ষপঞ্জীতে আগষ্ট মাস। বাংলা বর্ষপঞ্জীতে শ্রাবণের শেষোর্ধ। আজ আকাশ থোকে শ্রাবষ বারিধারা ঝড়ে পরছে। রুহানী টেরেসের খোলা অংশে নূপুর পায়ে বৃষ্টিতে ভিজছে। তার খোলাচুলগুলো বৃষ্টির পানিতে নিজেদের ডানা লুকিয়ে চুপসে একত্রে মিশে আছে। সবুজ রঙে রাঙানো রুহানী আজ মনের অজান্তেই খুশি। আকাশও আজ পরিষ্কার। পরিষ্কার আকাশে শ্রাবণধারা মানে আকাশও তার খুশি প্রকাশ করছে।

একটু আগে আজমল খান এসেছিলেন। রহমত শেখের কাছে নিজের ছেলের জন্য রুহানীকে চেয়ে গেছেন। উনি নাকি লক্ষ্য করেছেন, আরহানা রুহানীর সাথে খুব মিশুক। রুহানীর নিরবতাও আরহানের জন্য কোনো কিছু না। আরহান প্রায়ই উনার ও আয়েশা খানমের সামনে মাঝেমধ্যেই হুট করে অন্য প্রসঙ্গের মধ্যে রুহানীর প্রসঙ্গ তুলে আনে। এতে আজমল খান ও আয়েশা খানম ভেবে নিয়েছেন, আরহান রুহানীকে পছন্দ করে। আজমল খানের এই প্রস্তাবে রহমত শেখের তো আপত্তি নেই। সে খুশি মনে রাজি হয়ে গিয়েছে।

আজমল খানি বাড়ি ফিরে আরহানকে ডেকে পাঠান। আরহান সবে ভার্সিটি থেকে ফিরেছে। আসার পথে বাইকের তেল ভরতে গিয়েছিল বলে একটু দেরি হয়েছে। আরহান তার বাবার ঘরে এসে দেখল সেখানে তার দাদীও উপস্থিত। আরহান জিজ্ঞাসা করে,
“কী ব্যাপার? তোমরা দুজনেই এখানে?”
”হ্যাঁ তোমাকে কিছু বলার আছে।”
আয়েশা খানমের কথার প্রত্যুত্তরে আরহান সায় দেয়।
“হ্যাঁ বলো।”
“রুহানীকে তোমার কেমন লাগে?”

বাবার প্রশ্নে আরহান সন্দিহান দৃষ্টিতে চাইল। তার জবাব দেওয়ার আগেই আয়েশা খানম বলে ওঠেন,
“আমরা জানি, রুহানী কথা বলতে পারে না। তাতে আমাদের কোনো সমস্যা নেই। মেয়েটা ভীষণ মিষ্টি। মাঝেমাঝেই বনিকে ও চাচিকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে এসে আমার গল্প শোনে।”
“আরে দাদী, আমি কখন বললাম যে রুহানী কথা বলতে পারে না বলে আমার প্রবলেম আছে! ও মুখে কথা না বললেও ওর মুখশ্রী কথা বলে। ওর মুখের আদলের প্রতিটা অঙ্গের যেন নিজস্ব ভাষা আছে। ওর হৃদয়ের স্বচ্ছতা এতোটা প্রাণবন্ত যে! মাঝেমধ্যেই কিছু অজানা রহস্য নিয়ে ভাবভঙ্গী প্রকাশ করে।”

আরহানের জবাব শুনে আজমল খান ও আয়েশা খানম একেঅপরের দিকে চেয়ে মুচকি হাসে। আজমল খান বলেন,
“তবে আজীবন সেই রহস্য উদঘাটন করার বন্দোবস্ত করে দেই?”
আরহান অবাক হলো। হতভম্ব, হতবিহ্বল দৃষ্টিতে নিজের বাবার দিকে চাইল। আজমল খান হালকা হেসে বলেন,
“সময় নাও। আমাদের কোনো তাড়া নেই। আমার ও তোমার দাদীর, রুহানীকে বেশ পছন্দ। তার হৃদয়ের স্বচ্ছতা আমাদেরও স্পর্শ করেছে।”

আরহান বিপরীতে কিছু বলতে পারল না। মৌন হয়েই উঠে গেল। তার হৃদয়ে কেমন এক অনুভূত হচ্ছে যার সাথে সে পরিচিত না। তৎক্ষণাৎ তার মানসপটে রুহানীর প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠল। হাস্যজ্জ্বল মেয়েটির চোখে যেন অদ্ভুত মায়া। আরহান হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির বাইরে গার্ডেনে গেল। তেজ বারিধারা এক লহমায় তাকে নিজেদের ভালোবাসায় সিক্ত করে দিয়েছে। তার বিবর্ণ বৈশাখে শ্রাবণের ছোঁয়ায় কি তবে রংধনু উঠতে শুরু করেছে?

১ম পরিচ্ছেদের সমাপ্তি..
দুঃখীত পাঠক মহল। গল্পটার রহস্য কিছুটা রেখে পরিচ্ছেদে সমাপ্ত করতে হলো। তবে শিঘ্রই ২য় পরিচ্ছেদ আসবে। আমার পরীক্ষা চলছে সেই সাথে ফোনেও প্রবলেম বলেছিলাম। তারউপর প্রথম বই! ত্রিমাতৃক চিন্তায় আমি কিছুদিন চাইছি। আপনারা কয়েকটা দিন অপেক্ষা করুন। ভালোবাসা পাঠকমহল।

বিবর্ণ বৈশাখে রংধনু পর্ব ১৫