বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ৫৯

বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ৫৯
তাসফিয়া হাসান তুরফা

বিয়েবাড়ির সকাল মানেই যেন অন্যরকম এক সকাল, তাড়াহুড়ো ব্যস্ততায় মিলিত এক সকাল। এখানেও ব্যতিক্রম নয়, রাতের বেলা গল্পগুজব করে মাঝরাতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলো সবাই যাতে সকালে উঠতে দেরি না হয়! উঠার পর থেকেই ছুটাছুটি চলছে। সকালে উঠেই সবাই প্ল্যান করতে লাগলো কে কে গেইট ধরবে, কে কি বলবে তা নিয়ে। সব ঠিকঠাক হতেই দুপুরের দিকেই রাইসাকে পার্লারে পাঠানো হলো। সন্ধ্যায় অনুষ্ঠান বলে কথা! আমিও একবার পার্লারে সাজতে চেয়েছিলাম, পরমুহূর্তেই কি মনে করে যেন বাসায় সাজার কথা ঠিক করলাম। শাড়ি পড়া শেষ করে রেডি হওয়ার শুরু করবো এমন সময় প্রিয়ার ফোন এলো। ফোন ধরতেই সে বললো,

—হ্যালো ভাবী, তুমি কি পার্লার গেছো রাইসা ভাবীর সাথে?
—নাহ তো। কেন? তুমি কোথায়?
—আমি বাসার এদিকে একটা পার্লারে যেতে চাইছি। মা জিজ্ঞেস করলো তোমার থেকে শুনতে। যদি না সেজে থাকো তবে তুমিও চলো এসো না আমার সাথে? একসাথে সেজে নিবো দুজন।
—আইডিয়াটা খারাপ নাহ। যাওয়া যায়। আমি শুধু শাড়িটা পড়েছি মাত্র আর কিছুই করিনি। তাহলে রিকশা নিয়ে আসছি একটু পর৷

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

—আচ্ছা, তাড়াতাড়ি এসো।
—কাকে আসতে বলছিস?
হঠাৎ করে ফোনের ওপাশে পূর্ণর গলা শুনে চমকে গেলাম। উনি এখানে কই থেকে এলেন?
একটু পরেই কানে এলো প্রিয়ার আওয়াজ,
—আরে বড় ভাইয়া, তুমি যে? তুরফা ভাবীর সাথেই কথা বলছিলাম। ভাবীকে পার্লারে আসতে বলছি আমার সাথে, একসাথে সাজতে যাবো।

—আমার চার্জারটা যে নিয়েছিলি ওটা নিতে এসেছিলাম। কোথায় তুরফা এখন? আমি তো একটা কাজে বাহিরে যাচ্ছি, তাহলে আমার গাড়িটা পাঠিয়ে দেই ওর জন্য। ড্রাইভার নিয়ে আসুক ওকে। আমি রিকশায় যাবোনি।
—তা দিতে পারো, কিন্তু ভাবী যে বললো রিকশায় আসবে।
—তোর ভাবী কি আমার চেয়ে বেশি বুঝে? ওকে বল আমি যা বলেছি সেটাই হবে।
—নেও বাবা, তোমরাই ঝগড়া করো। আমি তোমাদের এসবের মধ্যে নাই।
উনার হাতে ফোন দিয়ে প্রিয়া হয়তো অন্যদিকে গেলো। শুনতে পেলাম তার গম্ভীর আওয়াজ,

—রেডি হওনি কেন এখনো? আমি তো ভেবেছিলাম তোমরা মেয়েরা সকাল থেকেই সাজতে শুরু করবে আজকের দিনে। অথচ আমার বউ দুনিয়ার অলস।
—মোটেও নাহ। আমার আরও অনেক কাজ আছে, বুঝেছেন? এতকিছুর পরেও শাড়ি পড়েছি এত কম সময়ের মধ্যে। সাজগোজ শুরু করতে যাবো ঠিক সে সময় প্রিয়ার কল এলো নাহয় এতক্ষণে সাজাও শেষ হয়ে যেতো আমার!
উনি কোনো জবাব না দেওয়ায় কিছুক্ষণ পর আবার নিজেই বললাম,

—আর আপনি কেন গাড়ি পাঠাতে চাইছেন বলুন তো? ড্রাইভার আসতে আসতে তো আমি পৌঁছেই যাবো বাসায়, অতক্ষণ বসে থাকলে তো দেরি হয়ে যাবে আমাদের।
এবার মুখ খুললেন পূর্ণ। শান্ত গলায় তার সোজা জবাব,
—এতক্ষণ ভাবছিলাম তোমাকে দেখতে কেমন লাগছে! কিন্তু তোমার চিন্তাধারা দেখে অবাক না হয়ে পারলাম না। শাড়ি পড়ে তুমি একা আসতে চাও? আর আমি তোমাকে আসতে দিবো এটাও ভাবো?

—দেখুন আপনার এসব ফাইজলামি শুনার মুডে নেই আমি এখন, বুঝেছেন? দেরি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু। পরে আবার আপনিই খোটা দিবেন আমাকে দেরি করার জন্য।
—দেরি হবেনা। আমি প্রিয়াকে ইতোমধ্যে ড্রাইভারকে বলে দেওয়ার জন্য পাঠিয়েছি। ওর যেতেও সময় লাগবেনা, তোমার আসতেও সময় লাগবেনা। আর যাই হোক তোমাকে আমি একা আসতে দিবোনা। একটাই বউ আমার, রাস্তায় কেউ তুলে নিয়ে গেলে আমার কি হবে? অত রিস্ক আমি নিতে পারবোনা! এখন এটা নিয়ে আর কোন কথা হবেনা, বুঝেছো?
এমন সময় তার এসব আহ্লাদী কথাবার্তায় বিরক্তিতে মুখে কলুপ এটে রইলাম। এই লোকের সাথে এসব ব্যাপারে তর্ক করা মানেই দেয়ালের সাথে তর্ক করা! এর চেয়ে যা বলছে তা চুপচাপ শুনাই বুদ্ধিমানের কাজ। কিছুক্ষণ পর আমার জবাব না পেয়ে উনি বললেন,

—কোথায় গেলে? কথা বলছোনা কেন?
—এমনিই। আপনি না কোথাও যাবেন বলছিলেন? তার কি হলো?
—ওহ ড্যামিট! আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম। বিয়ের গাড়ি সাজানো প্রায় শেষের দিকে, ওখানেই যাচ্ছিলাম। তাছাড়া নিজেই আনতে যেতাম তোমায়। কিন্তু তাই বলে তুমি এভাবে কথার জালে আমাকে ফাসিয়ে আমার টাইম ওয়েস্ট করতে পারলে, তুর পাখি? আমার প্রতি একটুও মায়া হয়না?

—আমি? এই আপনিই তো এতক্ষণ ..
—তোমাকে তো সন্ধ্যায় দেখছি আমি। এখন রাখো ফোন। ডোন্ট ডিস্টার্ব মি!
অতঃপর আমায় কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই খুট করে কেটে দিলেন ফোন। নিরুপায় আমি চোখ-মুখ কুচকে অপেক্ষা করতে লাগলাম গাড়ি আসার!

সারি সারি মেহমানে ভরপুর কমিউনিটি সেন্টার। ইনভিটেশন কার্ড অনুযায়ী বিয়ের সময় শুরু হয়ে গেছে ইতোমধ্যেই! পার্লারে একসাথে রেডি হওয়ার পর প্রিয়াও আমার সাথে চলে এসেছে এখানে। স্টেজে বসে আছে বধুবেশী রাইসা, বেশ সুন্দর লাগছে ওকে দেখতে। ওর সাথে ছবি তুললাম আমরা দুজনে। প্রিয়া আমার সাথে এলেও বরপক্ষের বাকি সবাই গাড়ি নিয়ে পরে আসবেন প্রান্ত ভাইয়ার সাথে। তাই প্রিয়া ও আমি দুজন মিলে ঘুরে ঘুরে চারপাশ দেখছিলাম। আমি হাটতে হাটতে সামনে অগ্রসর হলেও পেছনে পড়ে রইলো প্রিয়া। পেছন ফিরে ওকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুচকে গেলো। পিছিয়ে ওর কাছে হেটে যেতেই তার দৃষ্টি অনুসরণ করে চোখে পড়লো রায়হান ভাইকে।

আমাদের চেয়ে একটু বড় বয়সী একটা মেয়ের সাথে বেশ হাস্যোজ্জ্বল ভাবে কথা বলছেন তিনি। সাধারণত শান্ত, চুপচাপ রায়হান ভাইকে এতটা হাসিখুশি দেখা যায়না। সন্দেহজনক বিষয় বটেই! পাশ ফিরে প্রিয়ার চোখের দিক তাকিয়ে ওর মনের অনুভূতি বুঝলাম বেশ। স্বাভাবিকভাবেই ভালোবাসার মানুষকে অন্য কারও সাথে এভাবে কথা বলতে দেখলে খারাপ লাগারই কথা! ওর কাধে হাত রাখতেই প্রিয়া ছলছল চোখে বললো,

—ওই মেয়েটা কে, ভাবী? তুমি চিনো?
—আমিও সঠিক বলতে পাচ্ছিনা, বোন। কে এটা যে এভাবে ভাইয়ার সাথে কথা বলছে?
—এটা উনার গার্লফ্রেন্ড না তো? এজন্যই বোধহয় এতদিন আমায় প্রপোজ করেন নি।
উদাসীন মুখে বললো প্রিয়া, ওর কণ্ঠে তাচ্ছিল্যের আভাস। ওকে কি বলে সান্তনা দিবো ভেবে পেলাম না তবুও মুখে বললাম,

—আরে এভাবে বলছো কেন? তার গার্লফ্রেন্ড থাকলে কি তোমাকে সময় দিতো এতদিন? আর যাই হোক রায়হান ভাই এমন মানুষ নয়। হবে কোন ফ্রেন্ড বা কাজিন হয়তো।
—আমি সব জানি। কিন্তু আসার পর থেকেই বিষয়টা খেয়াল করছি। প্রথমে তোমার মতো সাধারণ ফ্রেন্ড বা কাজিন মনে করে ইগ্নোর করছিলাম দুজনকে কিন্তু এখন বেশ কিছুক্ষণ থেকে ভালোভাবে লক্ষ্য করলে বুঝা যাচ্ছে তাদের সম্পর্কটা সাধারণ কাজিন বা ফ্রেন্ডের মতো নয়। অনেকক্ষণ থেকেই এভাবে চিপকে আছে মেয়েটা উনার সাথে! এসব কই থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসলো আমার কপালে! সংসার শুরু হওয়ার আগেই আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে!

প্রিয়ার কথায় হাসবো না কাদবো ভেবে পেলাম নাহ। তবে ওকে কিছু বলার আগেই আন্টি ডাকলেন আমায়। প্রিয়াকে ইশারা করে সেদিক চলে গেলাম। কিছু মেহমানদের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন আন্টি। তাদের সাথে ভাব বিনিময় করে চলে আসার পথে পূর্ণর মেসেজ এলো ফোনে,

—আমরা রওনা দিয়েছি। আসছি কিছুক্ষণের মধ্যেই। তোমায় দেখার জন্য আর তর সইছেনা, বউ।
তার মেসেজে ছোট্ট হাসির রেখা ফুটে উঠলো মুখে। লোকটা আসলেই অদ্ভুত। কখনো দুষ্টু, কখনো রাগী, কখনো গম্ভীর, তো আবার কখনো অস্থির! এ সামান্য ক্ষুদেবার্তাতে বড্ড অধৈর্য শুনালো তাকে! এসব ভেবে ফোন দেখতে দেখতে হেটে চলতেই সামান্য ধাক্কা খেলাম একজনের সাথে। মুখ তুলে তাকাতেই চোখে পড়লো এক ছেলে। চিনতে পারলাম না ঠিক, এবার অনেক মানুষকে দাওয়াত দেওয়ায় অনেক মেহমানই অচেনা। এই ছেলেটাও তাদের মতোই কেউ হবে হয়তো!
ভদ্রতার খাতিরে সরি বলে পাশ কাটিয়ে যেতেই ছেলেটির আওয়াজে থেমে গেলাম।

—এক্সকিউজ মি?
—জি?
—আপনি কোন পক্ষের? কনেপক্ষ না বরপক্ষ?
—যদি বলি দু পক্ষের-ই তাহলে?
—ওয়াও! ইন্টেরেস্টিং তো।
বাকা হেসে বললো ছেলেটি। ওর ভাব দেখে বিরক্ত লাগায় সেখান থেকে চলে যেতে নিলাম। এমন সময় ছেলেটা আবারো সামনে এসে পথ আটকে দাড়ালে ছোট ছোট চোখে তাকিয়ে বলেই ফেলি,

—এনি প্রবলেম? থামাচ্ছেন কেন এভাবে?
—সরি মিস.. আপনার নাম তো জানিনা। আপনার নামটা কি বলা যাবে? আমি রায়হানের ফ্রেন্ড তো। ওর বোনের বিয়ের অনুষ্ঠান তাই এসেছি। তবে এখানে কাউকে চিনিনা এজন্য আপনার সাথে পরিচিত হতে চাচ্ছিলাম।
—ওহ। কিন্তু আপনি কি পুরো বিয়েবাড়িতে পরিচিত হওয়ার জন্য আমাকেই পেলেন? অন্য কাউকে দেখুন। আমার আরও কাজ আছে। এক্সকিউজ মি?
তীক্ষ্ণ কণ্ঠের সরাসরি জবাবে তাকে থামিয়ে দিতেই পুনরায় আন্টির আওয়াজ কানে এলো,

—এই তুরফা, এদিকে আয় তো জলদি। বরপক্ষ এসে গেছে।
আন্টির কথায় লোকটার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দ্রুত কদমে এগিয়ে গেলাম গেটের দিকে। গেইট ধরার আয়োজন শুরু হয়ে যাবে কিছুক্ষণের মধ্যেই!

বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ৫৮

বরপক্ষের আগমনে সরগরম হয়ে উঠলো চারপাশ। হইচই কলরবে মুহুর্তেই মুখোরিত কমিউনিটি সেন্টার! চাপা পড়ে গেলো একজনের চাপা কণ্ঠস্বর,
—তুরফা? নাইস নেম। ইন্টেরেস্টিং!

বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ৬০