বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ১৯

বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ১৯
তাসফিয়া হাসান তুরফা

শরৎ এর মেঘগুলো উড়ে বেরাচ্ছে আপন গতিতে। গাড়ির জানালা দিয়ে আকাশের দিক চেয়ে চেয়ে মেঘের ছোটাছুটি দেখছিলাম আমি। আচমকাই মেঘমালা জড়ো হয়ে আচমকা ঝরে পড়লো ধরনীর বুকে! এই অসময়ে বৃষ্টি দেখে অবাক হলাম আমি।

প্রায় সাথে সাথেই মনে এলো পূর্ণ ভাইয়া তো বাহিরে গেছেন, আর উনি তো ছাতাও নিয়ে যাননি! ভিজে যাবেন তো!! এই লোকটাও না! কি দরকার ছিলো এই মাঝরাস্তায় থেমে গাড়ির বাইরে যাওয়ার? পূর্ণ ভাইয়ার সাথে সাথে বৃষ্টির উপরও রাগ হলো আমার!
কি দরকার ছিলো এ অসময়ে বৃষ্টি আসার? উনি গাড়িতে আসার পর বৃষ্টি এলেই হতো!

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

খানিক বাদে নিজের চিন্তাভাবনার উপর নিজেই বেশ অবাক হলাম আমি! বিয়ে হতে না হতেই পূর্ণ ভাইয়ার জন্য এত চিন্তা করছি? নিজের এহেন আচরণকে নিজেরই ধারণার বাইরে মনে হচ্ছে আমার। হয়তো “বিয়ে” নামক পবিত্র বন্ধনের এটাই শক্তি! দু’দিন আগেও যাকে নিয়ে কিছু ভাবিনি, এখন তার জন্য চিন্তায় ছটফট করছে মন! আমার চিন্তাভাবনার মধ্যেই গাড়িতে ফিরে এলেন পূর্ণ ভাইয়া। মেরুন পাঞ্জাবিটা এটুকুতেই বেশ ভিজে গেছে, চুল বেয়ে পানি পড়ছে উনার! ভিজে যেন প্রচন্ড বিরক্ত উনি!

তার হাতে একটা বাদামি রঙা প্যাকেট। সেদিকে কৌতুহলী দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম আমি। তবে উনি প্যাকেটটা কোলে রেখেই চুলে হাত দিয়ে মাথা ঝাকালেন বার কয়েক, তার চুল থেকে পানির ছিটেফোঁটা আমার গায়েও পড়লো। আমি চুপচাপ তাকে লক্ষ্য করছি।

উনি এক পলক চাইলেন আমার দিকে। তারপর হঠাৎ করেই আমার দিকে এগিয়ে এসে আমার শাড়ির আচল টেনে নিয়ে উনার মাথা মুছতে শুরু করলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় স্তব্ধ হয়ে গেলাম আমি! বুকের মধ্যে হাতুড়ি পিটছে যেন! পিটপিটিয়ে কোনরকম উনার কর্মকান্ড দেখে যাচ্ছি আমি।
উনি নিজের কাজ করতে করতে আমার দিকে না তাকিয়েই বললেন,

—এভাবে কি দেখছো?
—আ-আমি আপনাকে রুমাল দিচ্ছি, ওটা দিয়ে মাথা মুছেন। এটা আমার বিয়ের শাড়ি।
ইনিয়ে-বিনিয়ে বললাম আমি।
উনি থেমে ভ্রু কুচকে আমার দিকে এক মুহুর্ত তাকালেন, এরপর পুনরায় মাথা মুছে বললেন,

—বরই যদি না থাকে তবে বিয়ের শাড়ি দিয়ে কি করবে তুমি??
পূর্ণ ভাইয়ার মুখে এই প্রথম “বর” কথাটা শুনে একটা শিহরণ জাগলো মনে। একটি অচেনা অনুভূতিতে ছেয়ে গেলো আমার মন! তবে উনার না থাকার কথা শুনে কেন যেন খারাপ লাগলো আমার। এভাবে কেন বললেন উনি? আমি কি ওরকম কিছু বলেছি?
শুষ্ক মুখে বললাম,

—এটা আমার আম্মুর শাড়ি, এজন্যই বলছিলাম। অন্য কোন কিছু মিন করিনি আমি।
আমার কথায় পূর্ণ ভাইয়া থেমে গেলেন। সুন্দর করে শাড়ির আচলটি আমার কোলের উপর দিয়ে সরে গেলেন দূরে উনার জায়গায়। হাফ ছেড়ে যেন বাচলাম আমি! এতক্ষণ উনি কাছে থাকায় হৃদপিঞ্জর ছটফট করছিলো আমার। একটি স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম! একটু পর উনি বাদামী রং এর প্যাকেটটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,

—এটা নেও।
উৎসুক হাতে প্যাকেটটা নিয়ে খুললাম আমি। ভেতরে কি আছে বের করতেই দেখি চিকেন বিরিয়ানি আর সাথে একটি চামচ! বিরিয়ানি দেখে যেমন অবাক হলাম ঠিক তেমনি পেটের মধ্যে লুকিয়ে থাকা পুরনো ক্ষুধা নাড়াচাড়া দিয়ে উঠলো আমার! এমনিতেই বিরিয়ানি আমার খুব প্রিয়, এটা চোখের সামনে দেখে খাওয়ার লোভ সামলানো দুষ্কর হয়ে যাচ্ছে আমার জন্য! কিন্তু উনার সামনে খেতে লজ্জাও লাগছে। তাই বললাম,

—এটা কেন এনেছেন?
উনি সামনের দিকে তাকিয়েই গম্ভীর গলায় বললেন,
—বিরিয়ানি নিশ্চয়ই মানুষ খাওয়ার জন্যই আনে। খেতে দিয়েছি, চুপচাপ খাও।

উনার কথা শুনে যেমন চমকে গেলাম ঠিক তেমনি ভালো লাগাও ছেয়ে গেলো অন্তরে। লোকটা এই বৃষ্টির মধ্যে আমার জন্য খাবার আনলেন! অতোটাও খারাপ না উনি। আনমনে ভাবলাম। পরক্ষণেই মনে হলো আমি খাইনি এটা উনি কিভাবে জানেন? আমি তো উনাকে বলিনি। তাই জিজ্ঞেস করলাম,

—আচ্ছা, আপনি কিভাবে জানলেন আমার ক্ষুধা লেগেছে? আমি তো আপনাকে বলিনি।
আমার কৌতুহলী কণ্ঠ শুনে এবার উনি তাকালেন আমার দিকে। বললেন,
—বিয়ের সময় যেরকম চেহারা করে রেখছিলে দেখে মনে হচ্ছিলো যেকোন মুহুর্তে অজ্ঞান হয়ে যাবা। এক সপ্তাহ অনাহারে আছো এমন লাগছিলো তোমাকে দেখে। শুধু আমি কেন, যেকেউ বুঝবে!!

উনার কথা শুনে অবাক হলাম আমি, তার মানে উনি আমাকে লক্ষ্যও করেছিলেন বিয়ের সময়? কই আমি তো দেখলাম নাহ! আমি তো উনাকে সবসময় ব্যস্তই দেখেছি। উনি আবার লুকিয়ে লুকিয়ে কখন দেখলেন আমাকে কে জানে! একিসাথে ভীষণ লজ্জাও পেলাম। তাই বলে আমার চেহারা দেখে এতোই অনাহারী মনে হচ্ছিলো? ছি! লজ্জা লজ্জা!!
আমার চিন্তার মাঝেই উনার রাগী গলার ধমক শুনে কেপে উঠলাম আমি,

—খাচ্ছোনা কেন? বৃষ্টির মধ্যে কস্ট করে নিয়ে আসলাম, এখন না খেলে সত্যিই মাঝরাস্তায় ফেলে রেখে যাবো তোমাকে।
উনার কথা শুনে ভয়ে তাড়াতাড়ি খেতে শুরু করলাম। এমনিতেও ক্ষুধা লেগেছে তার মধ্যে রাস্তাও চিনিনা, পূর্ণ ভাইয়ার বিশ্বাস নেই। সত্যিই ফেলে রেখে যেতে পারেন। তাই চুপচাপ খেয়ে নেওয়াই ভালো। বিরিয়ানিটা খুব মজা। খেতে খেতেই ভাবলাম উনাকে একবার ধন্যবাদ দেওয়া উচিত। তাই বললাম,

—থ্যাংকস, ভাইয়া।
পূর্ণ ভাইয়া হঠাৎ গাড়ি ব্রেক করায় ভড়কে গেলাম আমি। গলায় বেজে গেলো খাবার। উনি আমার চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে তড়িঘড়ি করে পানি এগিয়ে দিলেন। পানি খেয়ে স্বাভাবিক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

—কি হলো, ভাইয়া? আবার গাড়ি থামালেন যে? আপনারও ক্ষুধা পেয়েছে? খাবার আনতে যাবেন আবার? আমার থেকে নিতে পারেন।
উনি হতাশ দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে বললেন,

—তুমি কি বললে আমায়??
তার কথায় ভ্রু কুচকে গেলো আমার। আমি আবার কি বলেছি এমন? তাই না বুঝে বললাম,
—কি বলেছি, ভাইয়া? আমি সত্যিই বুঝিনি।

—বুঝবে কিভাবে? তুমি তো স্টুপিড। তোমার না বুঝাটাই স্বাভাবিক। তুমি বুঝবে আমার এ আশাটা করাও বোকামি।
রাগী গলায় বললেন কথাটা। হয়তো আনমনেই কিছু ভুল বলেছি তাই আমি দুঃখী মুখ করে বললাম,
—সরি, ভাইয়া। প্লিজ আমাকে বলুন কি বলেছি। তাছাড়া আমি বুঝবো কিভাবে?
আমার কথায় যেন উনি খানিকটা নরম হলেন। ধীর গলায় বললেন,

—এত ভাইয়া ডাকছো কেন তুমি আমায়? আমি কি এখন তোমার ভাই লাগি?
এবার পূর্ণ ভাইয়ার কথা শুনে চোখ বড় বড় করে তাকালাম আমি। এই সামান্য একটা বিষয়ের জন্য উনি এমন রিয়েক্ট করছেন? লোকটা আসলেই অদ্ভুত!! আমতা আমতা করে বললাম,

—তাহলে কি বলে ডাকবো? নাম ধরে ডাকতে বলবেন না, কেমন যেন লাগে আমার। আপনি তো আমার চেয়ে অনেক বড়।
আমার কথা শুনে উনি একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর রাশভারি আওয়াজে বললেন,
—আর যাই ডাকো, ভাইয়া ডাকবেনা। এটা শুনতে আমার কেমন যেন লাগছে।

অতঃপর আবার গাড়ি চালানোতে মনোযোগ দিলেন। উনার কথায় চুপচাপ মাথা নাড়লাম আমি। ভাবতে লাগলাম কি বলে ডাকবো উনাকে? সিরিয়ালের নায়িকাদের মতো “ও গো শুনছো?” বলবো? একটু পর নিজের ভাবনায় নিজের মনেই হাসলাম আমি কিন্তু উনাকে এটা বলে ডাকা অসম্ভব আমার জন্য! লজ্জায় মরেই যাবো আমি! তাই এ কথাটা নিজের মাঝেই লুকিয়ে রাখলাম। তারপর পুনরায় খাওয়ায় মনোযোগ দিলাম।

বড়াব্বুর বাসায় পৌঁছাতেই সবাই হাসিমুখে বরণ করে নিলেন আমাদের। সবার কিছুক্ষণ গল্প-গুজব করে বড়াম্মু আমাকে ফ্রেশ হওয়ার জন্য পূর্ণ ভাইয়ার রুমে নিয়ে গেলেন। হাতে নতুন একটি কামিজ ধরিয়ে দিয়ে গোসলে পাঠালেন আমায়। সারাদিনের ধকল শেষে গোসল করে খুব আরাম লাগছে। আমি বের হতেই দেখি বড়াম্মু আমায় দেখে মুচকি হেসে এগিয়ে এলেন। বললেন,

—আমি জানি তুই শাড়ি পড়তে পারিস না ঠিকমতো। এজন্যই কামিজ দিয়েছি যাতে তোর সুবিধা হয়। তবে কাল সকালে কিন্তু শাড়ি পড়তে হবে মা তোকে, ট্রাই করে দেখিস। না পারলে আমাকে ডাকবি, ঠিকাছে?
বড়াম্মুর কথায় মাথা নেড়ে উষ্ম হাসি দিলাম আমি। একটু পরেই রুমে পূর্ণ আসবেন বলে উনি চলে গেলেন।

চুপচাপ বিছানায় বসে আছি। পূর্ণ আর আমি এক রুমে থাকবো ভেবেই আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। এই প্রথম কারো সাথে রুম শেয়ার করবো ভাবতেই লজ্জায় কুকড়ে যাচ্ছি আমি। একটু পর দরজা খোলার শব্দে মাথা তুলে তাকালাম।

বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ১৮

পূর্ণকে আসতে দেখে বুকের মাঝে ধুকপুকানি বেড়ে গেলো। দরজা লাগিয়ে রুমের এগিয়ে আসতে লাগলেন উনি। উনার এগিয়ে আসার সাথে আমার নিশ্বাসের তীব্রতা বাড়তে লাগলো…!!

বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ২০