বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ২১

বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ২১
তাসফিয়া হাসান তুরফা

রান্নাঘরের দরজায় উকি দিতেই চোখে পড়লো কাজ করছেন বড়াম্মু। উনার কাজে টুকিটাকি সাহায্য করছে রাইসা, আমি এগিয়ে গিয়ে যোগ দিলাম তাদের সাথে। আমাকে দেখে দুইজনই হাসিমুখে তাকালেন। আমিও হেসে বললাম,

—কি করছো তোমরা, বড়াম্মু?
—এইতো সকালবেলা বাড়ির মেয়েদের যা কাজ হয়। রান্না বসিয়ে দিলাম চুলায়। না খেয়ে তো অফিস যাবেনা কেউ।
—আমিও কিছু করি? আমি কিন্তু রান্না পারি।
ভাব নিয়ে বললাম আমি। আমার কথা শুনে রাইসা মাথা নাড়িয়ে সায় দিয়ে জানালো। এরপর বললো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

—হ্যাঁ, মা। ও ঠিক বলছে। তুরফার রান্না বেশ মজার। স্পেশালি ওর হাতের পায়েস। উফফ। তোমরা যেদিন আমাকে দেখতে এসেছিলে সেইদিনকার খাবারও আসলে তুরফাই বানিয়েছিলো। দাদি অযথা আমার নাম দিয়েছিল।

মাথা চুলকে বললো রাইসা। বুঝা গেলো নিজ দাদির কর্মকাণ্ডে ও বেশ লজ্জিত! ওর মুখ দেখে বেশ হাসি পেলো আমার, একিসাথে হাসি পেলো বড়াম্মুরও। আমরা দুজনেই একসাথে হেসে উঠলাম তাড়স্বরে!! আমাদের দুজনের হাসি দেখে ওই-ও হেসে ফেললো। হাসতে হাসতেই বড়াম্মু বললেন,

—তবে আর যাই বলিস না কেন, পায়েসটা দারুন মজার হয়েছিলো। খাবার শেষে এমন ডেজার্ট পেলে আর কি লাগে? আমার পূর্ণর মতো মানুষ খেয়ে বাসায় এসে প্রশংসা করেছিলো, তাহলে মানতেই হবে তুরফার রান্নার হাত চমৎকার!
বড়াম্মুর কথা শুনে চমকে গেলাম আমি! পূর্ণ ভাইয়া আমার রান্নার প্রশংসা করেছিলেন? ইশ মিস করে ফেলেছি আমি!! আজকেও আমি রান্না করলে কি তবে উনি প্রশংসা করবেন? মনে মনে ভাবলাম আমি। অতঃপর গল্পগুজব করতে করতেই আমরা তিনজন মিলেমিশে রান্না শেষ করলাম!!

খাবার টেবিলে বসে আছেন সবাই। আমি আর রাইসা মিলে সবাইকে খাবার সার্ভ করছি। একদিকে আন্টি আর প্রিয়া কথা বলছেন, অন্যদিকে বড়াব্বু আর পূর্ণ অফিসের কাজ নিয়ে আলোচনা করছেন, কাল একদিন বিয়ের জন্য অফিস মিস যাওয়ায় কি কি কাজ হয়েছে, কি বাকি আছে সেগুলো শুনে নিচ্ছেন পূর্ণ ভাইয়া।

লোকটার সবকিছুতেই এত সিরিয়াসনেস দেখতে দেখতে মেজাজ খারাপ হচ্ছে আমার। আর প্রান্ত ভাইয়া বসে বসে বাবা-বড়ভাই এর আলোচনা শুনছেন। উনি নতুন নতুন জয়েন করেছেন অফিসে তাই উনাকে নিয়মিত অফিস যাওয়ার জন্য, কাজ করার জন্য কড়া নির্দেশ দিচ্ছেন পূর্ণ। প্রান্ত ভাইয়া বেচারা কোন উপায় না পেয়ে চুপচাপ মাথা নাড়ছেন উনার কথায়।

আমি আর রাইসা আড়চোখে একে-অপরের দিকে চেয়ে আছি উনাদের কথা শুনে। রাইসা ঠিকি বলেছিলো পূর্ণ সত্যিই প্রান্ত ভাইয়াকেও নিজের মতো সিরিয়াস বানানোর ধান্দায় আছেন! আমি চোখের ইশারায় সান্তনা দিলাম বেচারিকে, ওই-ও চোখের ইশারায় আমাকে সান্তনা দিলো এমন বোরিং সিরিয়াস জামাই পাওয়ার জন্য!

সবাইকে সার্ভ করা শেষে আমরা দুজনও বসে পড়লাম টেবিলে। খাওয়া-দাওয়া শুরু হতেই সবাই রান্নার প্রশংসা করলো। আজকের রান্নাগুলো আসলেই খুব মজা হয়েছে। বড়াব্বু, প্রান্ত ভাইয়া খুব প্রশংসা করলেন খাবারের৷ এদিকে আমি যার প্রশংসা শুনার জন্য কস্ট করে রান্না করলাম উনার কোন খবরই নেই! জনাব একমনে এমনভাবে খাচ্ছেন যেন দশদিন ধরে অনশনে আছেন!! এদিকে খাওয়া প্রায় শেষের দিকে উনার। তার মানে প্রশংসা করার মুডে নেই উনি আজ! উনাকে দেখে হতাশ হয়ে নিজের খাওয়ায় মনোযোগ দিলাম আমি! তখনি শুনলাম পূর্ণ মুখ খুললেন।

—বাহ, রান্নাগুলো বেশ ভালো হয়েছে! এটা ওই পায়েস না যেটা সেদিন খেয়েছিলাম রাইসাদের বাসায়? তারপর রাইসার দিকে চেয়ে বললেন, আজকেও খুব ভালো হয়েছে পায়েসটা। গুড জব, রাইসা। তোমার রান্না আমার পছন্দ হয়েছে। ভালোই রাধতে জানো। ভাসুর হিসেবে নতুন বউকে তো আর খালি মুখে প্রশংসা তো করতে পারিনা৷ কি গিফট চাই বলো??

পূর্ণর কথা শুনে যেমন ভালো লাগলো তেমনি কস্টও লাগলো। ভালো লাগলো কারণ উনি বাহিরে থেকে কঠোর হলেও ভেতর থেকে আন্তরিক। নতুন বউকে খালি হাতে প্রশংসা করতে হয়না গিফট দিতে চাইছেন এটা উনার থেকে আশা করিনি আমি। ভালো লাগলো কথাটা উনার মুখ থেকে শুনে।

কিন্তু কস্ট লাগলো এটা ভেবে যে উনি একটা নতুন বউয়ের প্রশংসা করলেন ঠিক আছে, তবে বাসায় যে আরও একটা নতুন বউ আছে সেটা কি মাথায় নেই উনার? উনার নিজের বউও তো আছে এখানে। আমার কি প্রশংসা শুনতে ইচ্ছে হয়না? এসব ভেবে মনটা ছোট হয়ে গেলো আমার।
রাইসা গিফটের কথা শুনে খুশি হয়ে বললো,

—ধন্যবাদ ভাইয়া। আপনি বড় ভাই হিসেবে যে গিফটই দিবেন না কেন সেটাই চলবে আমার। তবে ভাইয়া আরেকটা কথা বলার ছিল।
—কি কথা? বলো।
ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলেন পূর্ণ।
—আজকের রান্নাটা আমি আর তুরফা দুজন মিলেই করেছি। সবজিটা আমি রান্না করেছি আর আপনি যে পায়েসের কথা বললেন ওটা তুরফা বানিয়েছে।

রাইসার কথা শুনে পূর্ণ ভাইয়া এক মুহুর্তের জন্য থমকে গেলেন। পায়েসটার শেষ অংশটুকু খাচ্ছিলেন উনি। কোনমতে চুপচাপ গিললেন সেটুক। উনার মুখ দেখে হাসি পেলো আমার। ভাবলাম এবার আমার প্রশংসা না করে কই যাবে চান্দু? এখন তো বুঝলেন যে না বুঝেই এই তুরফার প্রশংসা করেছেন একটু আগে।

তাই এবার সরাসরি উনার প্রশংসা শুনার আশায় আড়চোখে তাকালাম উনার দিকে। উনি এক পলক আমার দিকে তাকালেন কোমল দৃষ্টিতে, যে দৃষ্টির ভাষা আমি ঠিক পড়তে পারলাম নাহ! তবে আমার আশায় এক বালতি পানি ঢেলে দিয়ে উনি কথা ঘুরিয়ে বড়ব্বুর সাথে পুনরায় অফিসের আলোচনা করতে লাগলেন, বড়াম্মুর কোন ওষুধ লাগবে কি না সেটাও জিজ্ঞেস করলেন।

অভিমানী দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকিয়ে থাকলাম আমি। সবারই খেয়াল আছে উনার, শুধু আমারটাই নেই। যদি এমনই করা লাগতো তবে কেন বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলেন আমাকে? অযথা এভাবে ইগ্নোর করে মানুষকে কস্ট দেওয়ার তো কোন মানে হয়না! সত্যিই উনার সাথে আর কথা বলার ইচ্ছা হলোনা আমার। যদি উনি আমাকে সবার সামনে এভাবে ইগ্নোর করতে পারেন তবে আমিও উনাকে ইগ্নোর করতে পারবো। কি মনে করেন উনি নিজেকে? অভিমানে গ/জগজ করতে করতে নিজ মনে এসব ভাবলাম আমি। তারপর সবার সাথে খাওয়া শেষ করে চলে গেলাম রুমে।

চুপচাপ সোফায় বসে ফোন টিপছি রুমে বসে। পূর্ণ রুমে এসে রেডি হলেন, ল্যাপটপের ব্যাগ নিয়ে চলেও গেলেন। আমি একটাবারও তাকাইনি উনার দিকে। যেন উনি এই রুমে আসেনই নি এমনটা ভাব ধরে ফোন টিপেছি সারাটা সময়। উনাকে ইগ্নোর করে খুব শান্তি লাগছে এখন। অন্তরে এক প্রকার পৈ/শা/চিক আনন্দ লাভ করলাম যেন! এবার বুঝুক উনি কেউ ইগ্নোর করলে কেমন লাগে? হুহ!!
উনি অফিস চলে গেলে বড়াম্মু আর রাইসার সাথে গল্প করার জন্য বের হলাম রুম থেকে। এখন একটু ভালো লাগছে, গল্প করতে মজা লাগবে!

সারাটা দিন গল্প-গুজব করে ফুরফুরে মনে সন্ধ্যায় ঘরে ফিরলাম আমি! রুমে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই সাইড টেবিলে চোখ গেলো আমার। একটা বক্স রাখা ওখানে। ভ্রু কুচকে সেদিকে তাকালাম আমি। এটা আবার কখন এলো এখানে? কে-ই বা রাখলো? ভাবতে ভাবতেই খুলে ফেললাম বক্সটা।

রেশমি চুড়ির রিনিঝিনি আওয়াজে থমকে গেলো মন! ঠোঁটের কোণে বিস্তৃত হলো প্রশস্ত হাসি! চুড়ির প্রতি দূর্বলতা আমার ছোটবেলা থেকেই আছে! লাল টুকটুকে কাচের চুড়ি ছুয়ে দিতেই মনটা ভালো হয়ে গেলো আমার। তবে এটা কে এনেছে সেই প্রশ্ন এলো মনে। রুমে আমি আর পূর্ণ ছাড়া তো কেউ আসেনা তেমন। তবে কি পূর্ণ এনেছেন আমার জন্য?

উনি আমার জন্য চুড়ি এনেছেন ভাবতেই মন প্রফুল্ল হয়ে গেলো আমার! প্রায় সাথে সাথেই উনার শান্ত গলার আওয়াজ কানে এলো,

—যার রান্না সারাজীবনই খাবো তার প্রশংসা একদিন করে কি লাভ? ওটা না হয় অন্য কোনদিনের জন্য তোলা থাক!
পিছন ফিরতেই দেখি ওয়াশরুমের গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছেন উনি। মাত্র ফ্রেশ হয়ে বের হলেন! অতঃপর আমায় কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই হাত-মুখ মুছতে চলে গেলেন বারান্দায়।

বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ২০

এদিকে উনার কথা শুনে রীতিমতো হার্টবিট বেড়ে গেছে আমার! লোকটার আচরণ বড়ই অদ্ভুত! উনাকে বুঝতেই পারিনা ঠিকভাবে আমি!
“এই ভালো এই খারাপ” উক্তিটা যেন উনাকে উদ্দেশ্য করেই লিখা হয়েছিলো..!!

বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ২২