বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ২৩

বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ২৩
তাসফিয়া হাসান তুরফা

মুখ ফুলিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে আছি৷ আমার সামনে কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন পূর্ণ। এতক্ষণ ধরে ভেবেও আমি বুঝতে পারলাম না আসলে আমার কি করা উচিত এই মুহুর্তে। কেননা আমি তো ইচ্ছা করে উনাকে মারিনি, ভুলবশত লেগে গেছে তাই আমি কেন সরি বলতে যাবো অযথা! এজন্যই আর কোন কিছু না ভেবে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি তখন থেকে। কিন্তু আমার চুপ থাকাটা বোধহয় পূর্ণর ভালো লাগছেনা। আমাকে চুপ থাকতে দেখে পূর্ণ অস্থির কন্ঠে বললেন,

—কি হয়েছে? কথা বলছোনা কেন তুমি??
উনার কথা শুনে আড়চোখে তার দিকে তাকালাম। মনে মনে ভাবলাম আমার কথা বলা না বলায় উনার আবার কিছু আসেও যায়? তবুও মুখ ফুটে কিছু বললাম নাহ। চুপ করেই থাকলাম উনার আরও কিছু রিয়েকশন দেখার জন্য। আমার চুপ থাকা কাজে দিলো। হঠাৎই পূর্ণ ভ্রু কুচকে আমার বাহু আলতো করে ঝাকিয়ে বললেন,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

—তুরফা? তোমাকে কিছু বলতে বলেছি আমি। কথা বলছোনা কেন? কি সমস্যা তোমার??
—কি বলবো?
আস্তে করে বললাম। আমার কথায় ভ্রু কুচকে গেলো উনার। বিরক্তি নিয়ে রাগী গলায় বললেন,

—কি বলবে মানে? একটু আগেই কি করলে ভুলে গেছো? সেটা কেন করলে জিজ্ঞেস করেছি আমি!
উনার কথায় মন বিষিয়ে গেলো আমার। শুরুতে ভয় পেলেও পরক্ষণেই মাথায় এলো যে ভয় পেলে চলবেনা! আমি তো ইচ্ছা করে কিছু করিনি তাই ভয়কে কনফিডেন্স দিয়েই জয় করতে হবে! এজন্য চোখ ছোট ছোট করে ড্যামকেয়ার ভাবে গম্ভীর কন্ঠে উত্তর দিলাম,

—ওহ ওটার কথা বলছেন! দেখুন আমি আসলেও খেয়াল করিনি ওটা আপনার গাল ছিলো। আপনার কাছে অবাস্তব লাগলেও এটাই সত্যি যে আমি মশার দিকে এতটাই মনোযোগ দিয়ে ছুটছিলাম যে সে কোথায় বসেছে খেয়াল করার আগেই মেরে দিয়েছি। এরপরেও আপনার কিছু বলার থাকলে বলে ফেলুন।

আমার গম্ভীর গলা শুনে উনি যেন খানিকটা থমকে গেলেন। কিছু বলতে যেয়েও আর বললেন না। আমিও উনাকে স্বাভাবিকভাবেই ইগ্নোর করে চলে যাচ্ছিলাম। কেন যেন ভালো লাগছেনা আমার! উনার আমার সম্পর্কটা খুব অগোছালো মনে হচ্ছে, আমাদের এই অদ্ভুত সম্পর্কের পরিণতি কি হবে বুঝতে পাচ্ছিনা। একবার উনি আমাকে ইগ্নোর করছেন তো একবার আমি। না জানে এভাবে আর কতদিন চলবে? ভাবতে ভাবতেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো মন থেকে। বিষাদ মনে চলে যেতে নিলেই পূর্ণ খানিকটা রসিকতার সুরে বললেন,

—তাও ভালো। আমি ভাবলাম সকালে খাবার টেবিলে তোমার প্রশংসা না করার জন্য হয়তো রাগ ঝাড়লে আমার উপর!
উনার কথায় পেছন ফিরে তাকালাম। তার ঠোঁটে ব্যাঙ্গাত্বক হাসি। বুঝলাম পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে চাইছেন উনি। তবুও আমার মন গললো নাহ। বারবার উনার ইগ্নোর করার কথা মনে পড়তেই অভিমানের পাল্লা ক্রমশ ভারী হতে ধরেছে হৃদয়জুড়ে। তাই তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললাম,

—আপনার সাথে কি আমার সেই সম্পর্ক আছে যে আমি রাগ ঝাড়বো আপনার উপর?
আমার কথায় পূর্ণর হাসি মিলিয়ে গেলো। গভীর কালো চোখজোড়া যেন অদ্ভুত রকমের শান্ত হয়ে গেলো। কিছু বলতে চেয়েও তবু কিছু বললেন না উনি।

তার চোখের দৃষ্টি আমাকে কিছু বুঝাতে চাইছিলো তবে সে চোখের ভাষা পড়ার ইচ্ছে আজ আমার নেই। আমি ক্লান্ত উনার এই অদ্ভুত গম্ভীরতা দেখতে দেখতে। তাই পুনরায় চলে যাচ্ছিলাম বিছানায় ঘুমাতে। আচমকা হাতে পুরুষালি শক্ত হাতের টান পড়ায় থেমে যেতে বাধ্য হলাম আমি। কিছুক্ষণ হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেস্টা করেও উনার শক্তির সাথে পেরে উঠলাম নাহ। উনি কোমল গলায় বললেন,

—চুড়িগুলো পছন্দ হয়েছে??
উনার প্রশ্নে চমকে গেলাম আমি। ভাবলাম যাক, জনাব তাহলে একটু একটু করে লাইনে আসছেন। তবে এত সহজেই গলে গেলে হবেনা আমার। উনাকে উনার ভাষায়ই বুঝিয়ে দিতে হবে যে আমাকে ইগ্নোর করলে আমার কেমন লাগে। তাই উনার মতোই গম্ভীরভাবে ছোট্ট করে বললাম,
—হুম, সুন্দর।

আমার এত ছোট উত্তরে যেন খানিকটা হতাশই হলেন উনি, যা উনার চেহারা দেখেই বুঝা যাচ্ছিলো। একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তবে আমার হাত ছাড়লেন নাহ এখনও। আমি হাত ঝাকিয়ে ইশারায় বুঝালাম হাত ছাড়তে তবুও উনার শক্ত বন্ধনের বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হলোনা। একিভাবেই ধরে রেখেছেন আমার হাত। শেষে আমি কথা বলতে বাধ্য হলাম। বলেই ফেললাম,

—হাতটা ছাড়ুন। আমি ঘুমাবো।
—সারারাত ঘোড়ার মতো বেঘোরে ঘুমিয়ে এখনই ঘুম ধরছে তোমার? এত ঘুম আসে কই থেকে?

ভ্রু কুচকে বললেন উনি। এবার উনাকে কথা শুনানোর সুযোগ পেয়ে গেলাম যেন আমি! সুযোগমতো বলেই ফেললাম,
—ঘুম না ধরার তো কোন কারণ দেখছিনা আমি। আর আপনার মতো বোরিং লোকের সাথে থাকলে যে কারও ঘুম ধরবে, বুঝেছেন! প্রান্ত ভাইয়াকে দেখেন, আপনার চেয়ে ছোট হলেও উনার দায়িত্বজ্ঞান বেশি। বউকে যখন পারে সময় দেয় কিন্তু আপনি কি করেন? যেটুক সময় বাসায় থাকেন হয় চুপচাপ থাকেন না হয় ল্যাপটপে কাজ করেন। আমি যে একটা মানুষ রুমে থাকি সেটা হয়তো ভুলেই যান আপনি। এমন লোকের বউয়ের তো বোর হতে হতে মরে যাওয়া উচিত!!

—তুরফা…
আহত গলায় বললেন উনি। হাতের বাধনও হালকা হয়ে গেলো। যেন আমার কথাগুলো ভালো লাগেনি উনার। অবশ্য ভালো না লাগারও কথা, সত্যি কথা শুনতে তিতা-ই লাগে। এক নিশ্বাসে এতকিছু বলে আমিও ক্লান্ত হয়ে গেছি তাই চুপচাপ উনার আলগা হাত থেকে হাতের বাধন ছাড়িয়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লাম উল্টোদিক হয়ে।

পূর্ণকে এভাবে কথাগুলো বলতে ভালো লাগেনি আমার নিজেরও তবুও উনাকে বুঝানো দরকার যে আমিও মানুষ, আমারও ভালো লাগা খারাপ লাগা আছে।

উনার কাছে একটা সঙ্গ ব্যতীত আর কিছু আশা করিনাই আমি, যদি উনার সেটাও দেওয়ার আকাংক্ষা না থাকে তবে বিয়ে করার তো দরকারই ছিলোনা আমায়! এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে চোখের কোণে জল গড়িয়ে পড়েছে টেরই পাইনি আমি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকলাম ঘুম আসার অপেক্ষায়!

মাঝরাতে প্রচন্ড পানির পিপাসায় ঘুম ভেঙে গেলো আমার। ঘড়িতে বাজে ২টা। ঘুমু ঘুমু চোখে উঠে সাইড টেবিলে তাকিয়ে দেখি জগে পানি নেই। এখন ডাইনিং পর্যন্ত হেটে যেতে হবে! ধুর!! তাও পিপাসা তো মেটাতেই হবে! তাই ঘুমের রেশ কাটিয়ে এগিয়ে চললাম রুম ছেড়ে।

পানি খেয়ে আসতে আসতেই প্রান্ত ভাইয়ার রুমের সামনে কথার আওয়াজ ভেসে আসছে। প্রান্ত ভাইয়া কিছু বলছেন আর রাইসা খিলখিলিয়ে হাসছে। এই মাঝরাতেও কি সুন্দর গল্প করছে দুজন! ভাবতেই মনটা ভালো হয়ে গেল আমার! রাইসার জন্য মনে মনে ভীষণ খুশি হলাম আমি। এরকম জীবনসঙ্গীই তো দরকার জীবনে! ভালো থাকুক সকলের ভালোবাসা।

নিজরুমে ফিরে এসে দেখি পূর্ণ বিছানার এক প্রান্তে নিশব্দে ঘুমাচ্ছেন। রুমের ড্রিমলাইটের আলো পড়ায় উনার ফর্সা মুখটায় হলুদ আভা এসে অনন্য সৌন্দর্যের সৃষ্টি করেছে। ঘুমের মাঝেও কেন যেন বিষন্ন দেখাচ্ছে উনাকে। হয়তো তখনকার আমার বলা কথাগুলোর জন্য আনমনেই ভাবলাম আমি!

বিছানায় গিয়ে নিজ জায়গায় বসে হেলান দিতেই চোখ গেলো তার গালের লালচে জায়গার দিকে। খোচা খোচা দাড়ির জন্য তেমন বুঝা যাচ্ছেনা তবুও সামান্য লালচে দাগটা চোখের আড়াল হলোনা আমার। আপনাআপনিই হাত চলে গেলো সেখানে। আলতো হাতে হাত বুলিয়ে দিলাম তার গালে।

এই মারাত্মক সুন্দর লোকটা আমার বর, আমার একান্তই আপন মানুষ। এটা ভাবতেই মনের মধ্যে অদ্ভুত শিহরণ জাগে! না চাইতেও যেন উনার প্রতি খানিকটা দূর্বল হয়ে গেছি আমি। তবে উনার মনে আমার জন্য কি আছে আমি এখনও জানিনা। উনার অনুভুতিগুলো যেন ধোঁয়াশে, ঠিক উনারই মতো!!

নিজের চিন্তাভাবনা শেষে আমি সরে যাচ্ছিলাম উনার কাছ থেকে। ঠিক তখনি পূর্ণ হাত চেপে ধরলেন উনি আমার! উনার ঘুম ভেঙে গেছে ভেবে লজ্জায়-ভয়ে শ্বাস আটকে তাকালাম তার দিকে তবে তিনি এখনও চোখ বন্ধ করে আছেন দেখে সস্তিও পেলাম একি সাথে!!

যাক ভালো হবে উনি ঘুমাচ্ছেন নয়তো আমাকে এভাবে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ফেললে বেশ লজ্জায় পড়তে হতো আমার!! আলতো হাতে নিজের থেকে উনার হাত সরানোর চেস্টা করতেই দৃঢ় হলো উনার হাতের বন্ধন। ভ্রু কুচকে গেলো আমার! লোকটা ঘুমের মধ্যেও এভাবে শক্ত করে হাত চেপে ধরেছে? আজকে হাত ধরার কি হয়েছে উনার!! আড়চোখে উনার দিকে তাকিয়ে হাত ছাড়ানোর ব্যর্থ চেস্টা শেষে ক্লান্ত হয়ে ওভাবেই ঘুমিয়ে পড়লাম আমি!

সকালবেলা বড়াম্মু আমাকে ও পূর্ণকে একসাথে ডেকে পাঠালেন উনার রুমে। আমরা দুজন যথারীতি ভদ্র ছেলেমেয়ের মতো চলে গেলাম সেখানে। গিয়ে দেখি বড়াব্বু ও বড়াম্মু বেশ সিরিয়াস মুখে বসে আছেন। আমাদের আসতে দেখেই বড়াম্মু বললেন,

বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ২২

—এসে গেছিস তোরা? যাক ভালো হলো। তোদের সাথে একটা জরুরি কথা ছিলো। বিশেষ করে পূর্ণ তোর সাথে।
পূর্ণর দিকে তাকিয়ে বললেন বড়াম্মু। ভ্রু তুলে বড়াম্মুর দিকে তাকালেন তার ছেলে। এদিকে উনাদের দুজনের দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছি আমি। ভাবছি কি এমন কথা বলার জন্য আমাদের এভাবে একসাথে ডেকে পাঠিয়েছেন বড়াম্মু?

বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ২৪