বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব ৫৪

বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব ৫৪
ইলমা বেহরোজ

হিংস্র জন্তুর মতো গর্জে উঠছে বৃষ্টি। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে আকাশ জুড়ে।জানালা দুটো খোলা। জানালা দিয়ে আসা বাতাস রুমটিকে ঘিরে প্রেতাত্মার কান্নার মতো হু হু শব্দ করে ঘুরপাক খাচ্ছে। ধারা ফ্লোরে বসে আছে,দেয়ালে হেলান দিয়ে।বারংবার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে ঠান্ডায়।বিভোরের উষ্ণতার বৃষ্টি পাওয়ার জন্য হৃদয়টা শুকিয়ে খরা লেগে গেছে। বুকে ঝড় বইছে। যে ঝড় দেখা যায়না। শুধু অনুভব করা যায়। দু’হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে উঠলো সে।আর্তনাদ করে বললো,
— “কেনো আসছোনা তুমি!”

তাঁর কিছুক্ষণ পর ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। মিহির নানু এসেছেন সেদিন।অপেক্ষায় ঘুম আসেনা চোখে।তাই লুকিয়ে চারটা ঘুমের ট্যাবলেট নিয়ে আসে। মিহিকে বলে ঘুমের ট্যাবলেট যে এনেছে। মিহি বোঝায় ট্যাবলেট না খেতে।ধারা শুনেনি। মিহি ছোট হওয়ায় জোর করার সাহস পায় না। সকাল এগোরাটায় ঘুম ভাঙে ধারার। ছয়দিন শেষ। ফলাফল খুবই কুৎসিত। ফ্রেশ হয়ে নিজের বাসায় চলে আসে। ড্রয়িংরুমে সবাই ছিল।কেউ কি নিজেদের কাজে যায়নি! ধারা প্রশ্ন করলোনা। উপরে উঠে যেতে নিলে শেখ আজিজুর ডাকেন,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

— “ধারা এদিকে আসো।”
ধারা আসে।আজিজুর বসতে বলেন।ধারা বসে।মাথা অবনত।সামিত বলে,
— “এখন তোর মত কি?”
ধারা জবাব দেয়না গাঁট হয়ে বসে আছে।আজিজুর বলেন,
— ” ছেলে সুবিধার না।ছয়দিনে একবারো খুঁজতে আসেনি।সেই ছেলের হাতে মেয়ে তুলে দেব কোন সাহসে।আশা করি তুমি বুঝতে পারছো আমাদের মনের অবস্থা।ছয়দিন…. সময়টা দীর্ঘ।এবার আর জেদাজেদি করোনা।আমরা যা বলি শুনো।”
ধারা চোখ তুলে তাকায়।চোখের কার্ণিশে জল চিকচিক করছে।সে বিভোরকে এক বিন্দুও অবিশ্বাস করছেনা।বরং কষ্ট হচ্ছে এটা ভেবে যে, বাবা, ভাইদের সামনে আর কখনো উচ্চারণ করার সাহস পাবেনা সে বিভোরকে ভালবাসে।ধারা নিস্তরঙ্গ গলায় বললো,

— “কি শুনবো?”
শেখ আজিজুর থমকে যান।কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করেন।এরপর বলেন,
— “ডিভোর্স টা শেষ করে ফেলো।আমরা তোমার আবার বিয়ে দেব।”
ধারাত চোখ থেকে টুপ করে জল গড়িয়ে পড়ে।এতো বড় সিদ্ধান্ত!তবুও সাহস পাচ্ছেনা বলার,আমি বিয়ে করতে পারবোনা আর আমি ভালবাসি বিভোরকে।
ঢোঁক গিলে মনের কথা হজম করে নেয়।বলে,
— “বলছিলে তোমরা আমাকে দেখতে পারবে।বিয়ের প্রয়োজন নেই।এখন কেনো চাইছো?বোঝা হয়ে গেছি? ”
সাফায়েত বলে,

— “আরেএ না না এসব কিছু না।আচ্ছা বিয়ে দেবনা।আমাদের কাছে থাকবি।ডিভোর্স টা দিয়ে দে।আজাইরা একটা প্রতারক ছেলের বউ হয়ে কেন থাকবি।”
ধারার কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছেনা।মনে হচ্ছে ভাষার ভান্ডারে কোনো কথা মজুদ নেই।সাফায়েত আবার বলে,
— “কিরে দিবি তো?”
ধারা মিনমিনে গলায় বললো,
— “দেখি।”
তারপর দু’তলায় উঠে যায়।রুমে ঢুকেই বিভোরকে কল করে। ফোন বন্ধ!কেনো বন্ধ?কি হয়েছে?কিসের দেয়াল মাঝে!কে দেয়াল দিলো!ধারা মাথায় এক হাত রেখে বসে পড়ে।শরীর ঘামছে।দ্রুত কাপড় চেঞ্জ করে বেরোবার জন্য।পথে আটকায় সামিত।

— “যাচ্ছিস কই?”
ধারা মিথ্যা বললো,
— “একটু হাঁটতে বের হচ্ছি।”
— “এখন কোনো বাইরে যাওয়া-যাওয়ি নাই।বিকেলে বের হচ্ছি সবাই।”
— “কোথায়?”
— “মাইশার বোনের জন্মদিন ইনফিনিটি রেস্টুরেন্টে।
— “আচ্ছা তখনো যাবো।এখন একটু বের হই।”
— “আচ্ছা যা।”
ধারা বের হতে গিয়েও আর হলোনা।রুমে চলে আসে।মাথা ব্যাথা করছে খুব। শুয়ে পড়ে বিছানায়।
এভারেস্টের মুহূর্ত গুলো মনে পড়ছে খুব।প্ল্যান করে রাতে পালাবে এই বাসা থেকে।বিভোরের সাথে দেখা করবে।বিভোরের কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে।

ঘুম ভাঙ্গে মাইশার ডাকে।কয়েক রং মিশ্রিত লেহেঙ্গা পড়ে।তাঁর সব লেহেঙ্গার ব্লাউজ শর্ট।পেট দেখা যায়।বিভোর না করেছে পেট দেখা যায় এমন কিছু পড়ে মানুষের সামনে যেতে।ধারা নিচের স্কার্টটা একটু উপরে তুলে পড়ে।যথাসময়ে চলে আসে পার্টিতে। সবাই আনন্দ করলেও ধারার পরিবার আনন্দ করতে পারছেনা ধারার মন খারাপ দেখে।সবাই চুপ করে বসে আছে।মাইশার বোন আলিশা সামিত, সাফায়েতকে টেনে নিয়ে যায়।ধারা চোখ ঘুরিয়ে চারপাশ দেখছিল।তখন চোখে পড়ে কাচের ওপাশে বিভোর! ধারা উঠে দাঁড়ায়। বিভোর তাকায়।আবার চোখ সরিয়ে জলদি সরে যায়।ধারা দৌড়ে আসে সেদিকে।এসে দেখে বিভোর নেই।হন্ন হয়ে পুরো রেস্টুরেন্ট খুঁজে বিভোরকে।পেলোনা!আবার কল করে বিভোরের নাম্বারে।ফোন অফ!কি হচ্ছে এসব?কেনো বিভোর এতো দূরে দূরে থাকছে।উত্তর নেই ধারার কাছে।ইচ্ছে হচ্ছে ছুটে যেতে বিভোরের বাসায়। কিন্তু এখন সেটা সম্ভব না।রাত এগারোটা অব্দি অপেক্ষা করতেই হবে।ধারা জোরে দম ফেলে।

রাত নয়টায় ওরা বাসায় আসে।এগারোটা না বাজা অব্দি সবাই ঘরে ঢুকবে না।ধারা ফ্রেশ না হয়েই শুয়ে পড়ে।তার কিছু ভালো লাগছে না।কখন বের হবে আর কখন যাবে বিভোরের কাছে।সময় কাটছেই না।কতদিন হলো মুখটা দর্শন করা হয় না। চোখ দু’টি তৃষ্ণায় হাহাকার করছে।বুক টা শূন্য।সময়টা বিষাক্ত,
সহ্য করা যায় না।দু’হাত মাথার নিচে রাখে ধারা।ক্লান্তিতে দু’চোখে ঘুম ঠেলে আসে।মিনিট কয়েক যুদ্ধ করেও ঘুম তাড়ানো গেলোনা।ঘুমিয়ে পড়ে।

আচমকা ঘুম ভেঙে যায় ধারার।এক হাত চলে যায় ঘাড়ে।কেউ এসেছিল!ধারা চারিদিকে তাকায়।বাতি নেভানো। কে নিভিয়েছে? দরজা তো ভেতর থেকে লাগানো।ধারার বার বার মনে হচ্ছে এসেছিল কেউ। এইযে…. এইখানটায়, ঘাড়ে কেউ চুমু দিয়েছে।ধারার সারা শরীর রোমাঞ্চিত হয়ে কেঁপে উঠে।উঠে বসে। বারান্দায় তাকায়। বুক দুরু দুরু করছে। সে দ্রুত দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ে।কোনো দিকে খেয়াল নেই।ড্রয়িংরুম অন্ধকারে তলিয়ে আছে।ধারা দরজা খুলতেই শাফি ডাকে,

— “রাত দুটোয় কই যাচ্ছিস?”
ধারা চমকে তাকায়।কাঁপা গলায় শুধু বলে,
— “ও আসছে।”
এরপরই দৌড়ে বেরিয়ে যায়।গেইটের বাইরে এসে একবার ডান পাশে তাকায় তারপর বাম পাশে।একটা বাইক চলে যাচ্ছে।ধারা চেঁচিয়ে উঠলো,
— “বিভোরর……

বাইক থেমে যায়।মানুষটা ঘুরে তাকায়।বাইক থেকে নামে।ধারার বুকের হৃদপিণ্ড কাঁপছে থরথর করে।দু’হাতে ভারী লেহেঙ্গার স্কার্ট ধরে বিভোরের দিকে দৌড়াতে থাকে।সময়টা যাচ্ছেনা।রাস্তা যেনো শেষ হচ্ছেনা।দুজনের দূরত্ব টা অনেক।ল্যাম্পপোস্টের আলোয় বিভোর দেখছে,ধারা উন্মাদের মতো ছুটে আসছে তাঁর দিকে।স্কার্ট টা নেমে এসেছে নাভি অব্দি। কি আবেদনময়ী মায়াবী মনে হচ্ছে ধারাকে।বিভোরের নিঃশ্বাস কয়েক মুহূর্তের জন্য বন্ধ হয়ে যায়।কপালের ছড়িয়ে থাকা কয়টা চুল রাতের মৃদু বাতাসে দুলছে।ধারা কাছে এসেই ঝাঁপিয়ে পড়ে বিভোরের বুকে।বিভোর টাল সামলাতে না পেরে দু’পা পিছিয়ে যায়।ধারা হাউমাউ করে কেঁদে উঠে।

সর্বাঙ্গ উষ্ণতায় কেঁপে কেঁপে উঠে।বিভোর শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ধারাকে। আট দিন পর ছোঁয়া পেলো।মনে হচ্ছে, কয়েক লক্ষ্য শতাব্দী দেখা হয়নি, ছোঁয়া হয়নি।ধারা কান্নামাখা কন্ঠে বলে,
— “খরা লাগিয়ে দিয়েছিলে তো।”
বিভোর মুচকি হাসে।বলে,
— “বৃষ্টি এখন থেকে সারাজীবন নামবে।আর লাগবেনা খরা।”

বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব ৫৩

বিভোরের কন্ঠও ধারার শরীর কাঁপিয়ে দিচ্ছে।আরো জোরে শক্ত করে ধরে বিভোরকে।বিভোরও যেনো তৃষ্ণার্থ ছিল।সেও ভুলে যায় কোথায় আছে তারা।দু’হাতে ধারাকে মিশিয়ে ফেলে বুকের সাথে।যেনো পিষে ফেলবে নিজের সাথে।দূর থেকে শোনা যাচ্ছে রাত জাগা প্রহরীর হুইসেল আর কুকুরের ঘেউ ঘেউ।একটা ভারী কন্ঠে দুজনের ধ্যান ভাঙ্গে।
ধারা কেঁপে উঠে পিছন ফিরে তাকায়।সামিত দাঁড়িয়ে
সাথে আজিজুর। বিভোর দ্রুত বাইকে উঠে বলে,
— “ধারা উঠে পড়ো।”
সামিত দৌড়ে আসতে আসতে ধারা বাইকে উঠে পড়ে।বিভোর চোখের পলকে বাইক নিয়ে উধাও হয়ে যায়।

বৃষ্টি হয়ে নামো শেষ পর্ব