ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ২০

ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ২০
সাইয়্যারা খান

জারবা আর ইয়াজের কথা আজ বাড়ির সবাইকে জানানো হয়েছে। ইয়াজ নিঃসন্দেহে ভালো ছেলে তাই পরিবারের কেউ আর আপত্তি করে নি। এ নিয়ে সবাই বেশ খুশি। ঘটা করে কবে কথা হবে তা নিয়েই আলোচনা চলছে।

রোদের বাসা থেকে আজ ফলের ডালা পাঠানো হবে সাথে মেয়ে আর মেয়ের জামাইকে দাওয়াত করা হবে শশুর বাড়ী যেতে। এটাই নিয়ম। যদি ও আরো আগেই আসার কথা ছিলো কিন্তু বিভিন্ন কারণে টলতে টলতে এতদিন পর আসছে তারা। রোদ বসে আছে বেঁকে। আদ্রিয়ান এত বুঝালেও বুঝবেনা রোদ। ওর কথা এতদিন ওয়েট করলে পারলে এই মাস পর্যন্ত ওয়েট করুক ততদিনে মিশানও এসে যাবে চারজন একসাথে যাবে। আদ্রিয়ান ঠান্ডা স্বরে বললো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

— সোনা বুঝার চেষ্টা করো কয়েকদিন পরই তো কুরবানির ঈদ তখন কিভাবে যাবো? মিশান আসুক আমরা আবার যাব।
রোদ তীক্ষ্ণ চোখ করে তাকিয়ে বললো,
— এতদিন আপনার পায়ে পরা বাকি ছিলো যে আমাকে বাসায় নিয়ে চলুন বাসায় চলুন কিন্তু আপনি একবারও শুনেছিলেন? না শুনেন নি তাহলে আজ আমিও শুনবো না।
আদ্রিয়ান হার মানলো। এই মেয়ে ওর কথা শুনবেই না। ক্লান্ত শরীর নিয়ে বেডে হেলান দিতেই রোদ পা উঠিয়ে আদ্রিয়ানের শরীর ঘেঁষে বসলো। কপালে হাত দিয়ে জ্বর চেক করে জিজ্ঞেস করলো,

— মাথা ব্যাথা করছে?
— অল্প।
রোদ হাত বাড়িয়ে আদ্রিয়ানের কপাল স্পর্শ করলো। আদ্রিয়ান সুযোগের পুরোপুরি সৎ ব্যবহার করে রোদকে ঠেলে নিজের মাথা রোদের কোলে তুলে দিলো। রোদ চমকে গেলেও পরক্ষণেই হাসলো একটু। নরম নরম হাতে মাথা টিপে দিলো আবার চুল গুলো টেনে টেনে দিলো। আরামে একসময় ঘুমিয়ে গেল আদ্রিয়ান। জ্বরের ক্লান্ত শরীর হওয়ায় এমন হচ্ছে। রোদ সারতে চাইলো কিন্তু ভাবলো এতে তো আদ্রিয়ানের কাঁচা ঘুমটা ভেঙে যাবে। তাই বেডে হেলান দিয়ে ফোন হাতে তুলে টিপাটিপি করলো কিছুক্ষণ।

মিশির ডাকে চোখ খুলে তাকালো রোদ। তাকাতেই নিজের অবস্থান টের পেলো। এটা কিভাবে হলো? রোদের কোলে ছিলো আদ্রিয়ানের মাথা আর এখন আদ্রিয়ানের বুকে ঘুমানো রোদ। আদ্রিয়ান ওর নাক টেনে বললো,
— এত ভাবতে হবে না। উঠো। তোমার বাসার লোকজন এসে যাবে।
রোদ আড়মোরা ভেঙে উঠলো। আদ্রিয়ানের দিকে টেনে চোখ খুলে তাকিয়ে বললো,

— আমি কখন ঘুমালাম?
আদ্রিয়ান রোদের সামনের চুলগুলো গুছিয়ে দিতে দিতে বললো,
— সেটা আপনার জানতে হবে না ম্যাডাম। ফ্রেশ হয়ে আসো যাও।
রোদ ঢুলুমুলু পায়ে ওয়াসরুমে ডুকে পড়লো। বের হতেই দেখলো রুমে দুই কাপ কফি রাখা। আদ্রিয়ান ওকে ইশারায় বারান্দায় যেতে বললো। রোদ মুখ মুছে আদ্রিয়ানের পেছনে পেছনে গিয়ে বসতেই দেখলো মিশি ফুল ছিড়ে কিছু একটা করছে। রোদকে দেখেই এসে মায়ের কোলে উঠে বসলো। খোঁপায় ফুলগুলো লাগাতে চেষ্টা করছে কিন্তু পড়ে যাচ্ছে দেখে মিশি আবারও চেষ্টা করছে। রোদ হেসে বললো,

— কি করছে মাম্মার বাচ্চা?
— মাম্মা ফুল পড়ে যাচ্ছে তো।
আদ্রিয়ান উঠে এসে পুরোটা খোঁপা জুড়ে ফুল লাগিয়ে দিলো। রোদ হেসে বললো,
— ধন্যবাদ।
উত্তরে আদ্রিয়ান শয়তানি হাসি দিয়ে ফিসফিস করে বললো,

— ধন্যবাদে আজকাল পোষায় না আমার বউ। আই নিড এ ডিপ কিস ফ্রম ইউ।
কেশে উঠলো রোদ। চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে বুঝালো মিশি এখানে। আদ্রিয়ান রোদের দিকে কফি এগিয়ে দিয়ে নিজের কাপে মনোযোগ দিলো। মিশি তখন পাশে ফুলের টপগুলো দেখতে ব্যাস্ত। অধৈয্য আদ্রিয়ান উঠে দাঁড়িয়ে গেল। রোদ কিছু বুঝার আগেই টুপটাপ করে চার পাঁচটা চুমু খেয়ে আবার ভদ্র মতো নিজের জায়গায় বসে কফিতে চুমুক দিলো। আকষ্মিক ঘটনায় হতভম্ব রোদ। আদ্রিয়ান একটু গলা ঝেরে বললো,

— এটা এমনিই দিলাম। বিকেলের নাস্তা। রাতে ফুল ডিনার চাই আমার ইউথ ফুল অন…
রোদ উঠে এসে মুখ চেপে ধরলো আদ্রিয়ানের। আদ্রিয়ান হেসেই খুন হয়ে যাচ্ছে যেন। রোদের বুক তখন ধ্রীম ধ্রীম শব্দ করছে। এই আদ্রিয়ান এমন ঠোঁট কাটা কবে হলো? কিসব বাজে কথা শিখছে ইদানীং। উনি কি বুঝে রোদের ছোট্ট মনটা এতসব নিতে পারে না কেমন যেন করে। তিড়িং বিড়িং করে লাফাতে থাকে এই হৃদপিণ্ড।

রোদের বাসা থেকে এত এত ফল পাঠানো হয়েছে। গ্রীষ্মকালীন কোন ফল বোধহয় তারা বাদ রাখে নি। ফেটি ধরে ধরে এনেছে সব। অবাক করার বিষয় হলো জামাই দাওয়াতে মাছ আনা হয় দুটো কিন্তু এরা মাছের ও ছোট খাট এক ডালা পাঠিয়েছে। এই এত বড় মাছ বাজারের লোক ছাড়া তো কাটা সম্ভব নয়। মিশি, আলিফ আর জারবা অবাক চোখে মাছ দেখছে। আশ পাশের অনেকেও দেখতে এসেছে ফল, মাছের ডালা।

এর আবার কারণ ও আছে। বড় বড় দুটো রুই মাছের একটার মুখে সিগারেট গুজে রাখা সাথে এক হাজরের নোট। আরেকটার মধ্যে লাল রং দিয়ে বউ সাজানো সাথে মুখে হাজারের নোট। এ যেন একটা ছেলে মাছ একটা মেয়ে মাছ। সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো কারণ এছাড়াও বড় বড় মাছ অনেকগুলো। সাথে দই-মিষ্টি, পানের বিড়া।

অবশেষে বাজার থেকে জাউলা এনে এই মাছ কাটালো হলো রাত ১২ টার দিকে। ফলমূল সব আত্মীয়দের বিলানো হলো। মামির চোখ যেন জ্বলে উঠলো। এ বাড়ী মোটেও ছোট না। এত বড়লোক বাড়ীতে ছেলে-মেয়েদের বিয়ে দিতে পারলে সারাজীবনের শান্তি ভাবলেন মনে মনে।

রোদ তো দুই ভাই আর চাচাতো ভাই-বোনদের দেখেই ঝাঁপিয়ে পরলো। রাদের বুকে মুখ গুজে কেঁদেই দিয়েছে।ওর কান্নায় আবার যোগ দিয়েছে রুদ্র। ইশান অবশেষে তিন ভাই বোনকে সামলালো।
রাদ অনেক জোর করলেও রোদকে মানাতে পারে নি। রোদের কথায় অবশেষে হার মানলো। রোদ ভাইকে জড়িয়ে ধরে বললো,

— মিশান আসলেই যাব। যানো আমাকে রোদ মা বলে ডাকে। তাহলে আমি আমার ছেলেকে রেখে কীভাবে যাব বলো?
রাদ আশ্চর্য চোখ করে তাকিয়ে রইলো বেশ কিছুক্ষণ। যেই বোনকে দুই দিন আগেও বুকে নিয়ে রেখেছে, হাতে তুলে খায়িয়েছে সেই বোন কি না আজ এতটা দায়িত্বশীল হয়ে গিয়েছে। কিভাবে দুটো বাচ্চা সামলায়। রাদ বোনকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেল মাথায়। রাতে খাওয়া দাওয়া করেই বিদায় নিলো সবাই।

যখন থেকে রাদরা গিয়েছে তখন থেকেই এই যে রোদ কাঁদছে কাঁদছে তো কাঁদছেই। মিশি ঘুমিয়েছে সেই কখন। রাতে খাচ্ছে ও না রোদ। তখন রাদ মুখে তুলে দুই লেকমা খায়িয়েছিলো সেটাই। আদ্রিয়ান খাবার এনে রুমের ছোট টেবিলে রাখলো। রোদ তখনও কাউচে বসে ফুপিয়ে যাচ্ছে। খারাপ লাগলো আদ্রিয়ানের। মেয়েটাকে এত ভালোবাসে আর এই মেয়ে কি না কান্না করছে তাও যদি হয় কারণ আদ্রিয়ান। কত খুশি ছিলো মেয়েটা। আদ্রিয়ান এগিয়ে এসে পাশে বসতেই রোদ মুখ ঘুরিয়ে নিলো। আদ্রিয়ান আসহায় চোখে তাকাতেই রোদ বললো,

— আমাকে বাসায় দিয়ে আসুন।
বুক ধক করে উঠলো আদ্রিয়ানের। রোদ কি চলে যাবে? আদ্রিয়ানের কি হবে?

তখন যখন সবাই ডালা দেখছিলো আশেপাশের পরিচিত লোকও এসেছিলো। রোদ তখন মিশিকে খাওয়াতে ব্যাস্ত। পেছন থেকে শুনতে পেল কিছু কথা যা ছিলো খুবই বিষাক্ত।
এক মহিলা ডালা দেখতে দেখতে মুখ বাকিয়ে বললো,
— আরে এসব পাঠাচ্ছে দোষ ঢাকতে। নিশ্চিত মেয়ের দোষ আছে নাহলে এতবড় ডালা কেন পাঠালো।
পাশ থেকে আরেকজন বললো,

— দোষ না থাকলেই বুঝি দুই বাচ্চার বাপের কাছে এমন ছোট মেয়ে বিয়ে দেয়?
রোদ তাদের উত্তর দেয়ার জন্য এগিয়ে যাচ্ছিলো ঠিক তখনই কানে এলো মামির কন্ঠ,
— আরে এই মেয়ের দোষ আছে মানে? বাজা মেয়ে এনেছে আদ্রিয়ান। রুপই আছে শুধু শুনে আমড়া কাঠের ঢেঁকি।
রোদের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। এগিয়ে গিয়ে প্রতিবাদী কন্ঠে কিছু বলতেই মামি ধমকে উঠলেন,
— বেয়াদব মেয়ে। বড়দের সম্মান করতে জানে না।

বাপ-মা শিক্ষা দেয় নি। আদরে বাঁদর বানিয়েছে।বাজা মেয়েদের গলা নামিয়ে বলতে হয়।
রোদের রাগ যেন হুট করে বেড়ে গেলো। সবার সামনেই মামিকেই কড়া ভাষায় যতটা পারে কথা শুনিয়ে দেয়। ওর শাশুড়ী রোদের এমন আচরণে ধমকে উঠলেন। আগে পড়ে কিছু না জেনে রোদকে কিছু শুনিয়ে দিলেন যাতে করে হতবাক হয়ে যায় রোদ। মায়ের মতো আদর করা শাশুড়ীর এমন আচরণে রোদের কান্না পেয়ে যায়। সেই থেকে রুমে বসে আছে। এতক্ষণে লক খুলছে রুমের তখনই আদ্রিয়ান আসে। জারবার কাছ থেকে সব শুনেছে ও। মাকে কিছুই বলে নি। শুধু বাবার দিকে তাকিয়ে বলেছে,

— আব্বু আমি আমার স্ত্রী, সন্তানদের নিয়ে আলাদা হয়ে যাব সামনের মাসে। বাকি এই কয় দিন যেন কেউ আমার স্ত্রীর সাথে কোন ধরণের খারাপ আচরণ না করে তাহলে আমি সহ্য করব না।
সবাই অবাক হয়ে যায়। আদ্রিয়ানের মা কেঁদেই যাচ্ছেন। মামিরা চলে গিয়েছেন নিজেদের বাট নিয়ে। আদ্রিয়ানের মাকে সামলাচ্ছে সাবা। জারবাও মায়ের উপর চটে আছে। সে তো জানে মামি কেমন। তাহলে কেন রোদকে বকলো। আদ্রিয়ানের মা অনুতপ্ত। ব্যাস্ততার মাঝে বড়দের সাথে রোদকে ওভাবে দেখে মুখ ফসকে ধমকে দিয়েছেন তিনি। ছোট রোদটাকে যে তিনি মেয়ে থেকে কম আদর করে না।

আদ্রিয়ান রোদকে জড়িয়ে নিলো বাহুতে। রোদ এবার জোরে কেঁদে উঠলো। আদর পেয়ে কান্না বেড়েছে ওর। আদ্রিয়ান ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
— একটু সময় দাও চলে যাব। অনেক ভালো রাখব। কারো কথা শুনতে দিব না।
রোদ মুখ তুলে তাকাতেই আদ্রিয়ান বুঝলো ওর প্রশ্ন। চোখ মুছিয়ে ওয়াসরুমে নিয়ে মুখে পানি দিয়ে এনে নিজ হাতে তুলে খাওয়াতে খাওয়াতে বললো,

— কোন কথা না।
— আপনি খেয়েছেন?
— না। তোমাকে খায়িয়ে খাব।
— একসাথে খেয়ে নিন।
— খাচ্ছি।

ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ১৯

বলেই আবার আকুতির স্বরে বললো,
— অনেক সাধনার তুমি আমার রোদ। অবহেলায় তোমাকে রাখব না আমি। কিভাবে এনেছি তা কেবল আমি আর আমার আল্লাহ জানে রোদ। সব ছেড়ে দিব কিন্তু তোমাকে আর সন্তানদের না।

ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ২১