ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৩০

ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৩০
সাইয়্যারা খান

কারো ব্যাথাকাতুর গোঙানির আওয়াজে তন্দ্রা ভাবটা কেটে গেল আদ্রিয়ানের। মাত্রই চোখটা লাগতে নিয়েছিলো। শুয়া অবস্থায় ই রোদের উপর ঝুঁকে ডান গালে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,
— সোনা বেশি খারাপ লাগছে?

রোদ উত্তর দেয় না। মাত্রাতিরিক্ত জ্বরে কিছুটা অচেতন এখন রোদ। পিঠের ব্যাথা আর হাতের জ্বলুনিতে অবস্থা বেগতিক। অল্প আলোতেও আদ্রিয়ান স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে রোদের ব্যাথার্ত মুখটা। জ্বরে শরীর পুড়ে যাওয়ার যোগার হ’য়েছে যেন। পাশ থেকে পানিতে ভিজিয়ে রাখা পাতলা কাপড়টা চিপড়ে রোদের কপালে রাখলো। শরীর ব্যাথার চোটেই এই জ্বর। ঔষধ তো খাওয়ালো কিন্তু কাজ হচ্ছে না। চিন্তায় চিন্তায় ঘাম ছুটে যাচ্ছে আদ্রিয়ানের।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ওর পাশেই কি না ওর রোদ এমন ব্যাথায় কাতরাচ্ছে। রোদের জ্বর কমলো না বরং বাড়লো হয়তো একটু সাথে বাড়লো হাতের জ্বলুনি আর পিঠ ব্যাথা। যেকোনো ব্যাথাই রাতে একটু বাড়ে।অর্ধ জ্ঞান রোদ কেঁদে উঠলো অসহ্য যন্ত্রণায়। আদ্রিয়ানের এখন নিজেকেই পাগল পাগল লাগছে। এই রাত দেড়টা বাজে কোথায় যাবে ও রোদকে নিয়ে? রোদের কান্নায় ওর নিজেরই বুক ফেটে কান্না আসছে। কোনমতে কপালের পানি পট্টিটা পাল্টে দিয়ে রোদের ভালোহাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো,

— ঠিক হয়ে যাবে। কাঁদে না সোনা।
রোদ অসুস্থ বাচ্চাদের মতো কেঁদেই যাচ্ছে। আদ্রিয়ানের আদর পেয়ে কেঁদে কেঁদে অস্পষ্ট ভাবে বললো,
— হাতে জ্বলছে অনেক। ব্যাথা করছে অনেক। পিঠে অনেক ব্যাথা করছে।

আদ্রিয়ানের আর সহ্য হলো না। রোদের উত্তপ্ত দেহটা নিজের বুকে নিতে চেয়েও পারছে না কারণ পিঠে আঘাতের কারণে এখন ওকে নড়ানোই যাচ্ছে না। রোদের মাথায় এক হাত রেখে ফোন হাতে কল করলো আরিয়ানকে। আদ্রিয়ান ওকে তারাতাড়ি আসতে বলতেই আরিয়ান আইডিয়ার উপর বেস করে কিছু মেডিসিন নিয়ে ছুটলো আদ্রিয়ানের ফ্লাটের উদ্দেশ্যে। অসহ্য ব্যাথায় তখনও কেঁদে যাচ্ছে রোদ। আদ্রিয়ান রোদের উপর ঝুঁকে নিজেই কান্না করে দিয়ে বললো,

— এই জান, অনেক কষ্ট লাগছে? আমাকে কিছু কষ্ট দিয়ে দাও। কিভাবে নিব তোমার কষ্ট?
অজস্র পানির ধারা ঝরতে লাগলো দু’জনের চোখ দিয়ে। একজন ব্যাথায় আরেকজন প্রিয় মানুষের কষ্টে।
ঐদিন~

রোদ মিশিকে রাগের মাথায় মে’রে অনুতপ্ত হয়ে’ছে বারবার কিন্তু তাতেও যেন মন মানে নি। নিজের হাত পুড়িয়েছে মোমবাতি দিয়ে। মুখে রোদ স্বীকার করে নি কিন্তু আদ্রিয়ান সাইড টেবিলে দুটো অর্ধগলিত মোম দেখেছিলো যা দেখে আর বুঝতে বাকি রয় নি যে কি হয়েছিলো।
তারমধ্যে আদ্রিয়ান যখন ধাক্কাটা দেয় তখন তা যেয়ে লাগে সম্পূর্ণ রোদের মেরুদণ্ডে। তখন ব্যাথা এতটা তীব্র ছিলো না। কোন মতে দাঁত চেপে সহ্য করেছিলো রোদ।

ফুপাকে নিয়ে যাওয়ার পরই মিশানকে নিয়ে রুমে আসে আদ্রিয়ান। চেঞ্জ করে রেডি হতে বলে আরিয়ানকে ডেকে পাঠায়। আরিয়ান আসতেই দেখলো রোদ বোরকা পড়ে রেডি। কি বলে থামাবে আরিয়ান? কিছুই বলার নেই। আদ্রিয়ান শান্ত কন্ঠে বললো,
— রোদের হাতটা দেখ তো।
রোদ চমকে তাকালো। এতক্ষণ অন্য চিন্তায় থাকায় যেন হাতের জ্বলুনি অনুভবই হয় নি। মনে করায় যেন জ্বলে যাচ্ছে হাতটা। আরিয়ান রোদের হাত দেখেই আঁতকে উঠে বললো,

— হাত কিভাবে পুড়লি?
রোদ মাথা নিচু করে বললো,
— এমনি ভাইয়া।
আদ্রিয়ান শান্ত চোখে তাকালো। আরিয়ান আর প্রশ্ন করলো না। নিজের রুম থেকে প্রয়োজনীয় জিনিস এনে রোদের হাত ড্রেসিং করতে নিলেই রোদ কেঁদে উঠে বললো,

— লাগবে না ভাইয়া।
আরিয়ান কিছুটা রাগী কন্ঠে বললো,
— মাইর খাবি? হাত কি করেছিস এটা? দে হাত দে।
রোদ কিছুতেই হাত দিবে না। আদ্রিয়ান এতক্ষণ ওর কান্ড দেখলেও এবার পাশে বসে রোদকে জড়িয়ে ধরে পুড়ে যাওয়া হাতটা আলত করে নিজের হাতে নিয়ে বললো,
— ড্রেসিং করতে দাও রোদ।

আদ্রিয়ানের বিধ্বস্ত চোখের দিকে তাকিয়ে আর পলক ফেলে নি রোদ। এমন চোখ জোরা ওর শক্তপোক্ত আদ্রিয়ানের কখনো ছিলো বলে তো দেখে নি রোদ। এক পলকে তাকিয়ে হারিয়ে গিয়েছিলো সেই গভীর চোখজোড়ায়। কতটা কষ্ট, অপারগতা লুকিয়ে এই চোখে। রোদের ধ্যানের মাঝেই হাতটা ড্রেসিং হয়ে যায়। আরিয়ান একটা পেইন কিলার খায়িয়ে বলে,

— কাল হসপিটালে নিয়ে চলিস। এই ড্রেসিং এ হবে না। স্কিন বার্ণ হয়ে চর্বির লেয়ারও কিছুটা পুড়েছে।
রোদ নির্বাক ছিলো। আদ্রিয়ান আস্তে করে উত্তর দিলো,
— আচ্ছা।
— এখনই চলে যাবি?
— না আসলে এমনটা হতো না তাই না? আমার আসাটাই উচিত হয় নি। না ঐ দিন বোনের হয়ে কিছু করতে পারলাম আর না আজ বাবা, স্বামী হয়ে।

আরিয়ানের ভেতরে কম্পন টের পেল ছোট ভাইয়ের কথায়। পরিস্থিতি মানুষকে কতটা অসহায় করে তুলে। আজ সান্ত্বনা দেয়ার বাক্যের স্বল্পতা বোধ করলো আরিয়ান। ছোট্ট পরীটা তো আরিয়ানেরও আরেক মা। এতগুলো মানুষ কি না ছোট্ট একটা মা’কে দেখে রাখতে পারলো না।

আরিায়ন যেতেই বাসার লোকজন রুমে আসে। কেউ কিছু বলার সাহস পায় নি। ঘুমন্ত ছোট্ট মিশির দিকে তাকিয়ে আদর করতে নেয় আদ্রিয়ানের বাবা ওমনিই আদ্রিয়ান রোদকে ছেড়ে হুট করে দাঁড়িয়ে বাবা থেকে মিশিকে আড়াল করে নেয়। ছুঁতে দেয় না। আদ্রিয়ানের বাবা অপরাধীর মতো হাত গুটিয়ে নেয় আর মা আঁচলে মুখ গুজে কেঁদে দেন। মিশান আসতেই আদ্রিয়ান ঘুমন্ত মিশিকে কোলে তুলে নিয়ে মায়ের কপালে চুমু খেয়ে বলে,

— তোমার কান্নার কারন আমি হলে তো আল্লাহ নারাজ হবে আমার উপর আম্মু। তুমি কি তা চাও?
আদ্রিয়ান মা কান্না থামিয়ে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বলে,
— আমাকেও নিয়ে চল।
জারবাও কেঁদে যাচ্ছে একাধারে অথচ মেয়েটা জানেই না ওর সাথে ছোট বেলায়ও কারো নোংরা হাতের ছাপ পড়তে নিয়েছিলো। আদ্রিয়ানকে জড়িয়ে ধরে জারবা বলে,

— আমিও যাব।
আদ্রিয়ান নিজেকে শক্ত রাখতে যথেষ্ট চেষ্টা করে কিন্তু এমন বেশিক্ষণ চললে তা টিকিয়ে রাখা দুষ্কর। বোনকে আদর করে সবার থেকে বিদায় নেয় শুধু নিজের বাবা বাদে। মিশানকে বলে,
— মা’কে ধরে নিচে নামাও। হাটতে পারছে না।
মিশান শক্ত হাতে মা’কে ধরে। চারজন আস্তে আস্তে নিচে নেমে আসে। ফুপি রুমের দরজা খুলে নি আর জারা, জুরাইন মাথা নিচু করে বসে আছে। আদ্রিয়ান তাদের কাছে এসে আদর করতেই জারা কেঁদে উঠে। জুরাইন তখনও মাথা নিচু করে বসে। আদ্রিয়ান ওদের আদর করে বলে,

— তোমরা দুজন কোন দোষ করো নি তাই মাথা নিচু করার কোন কথা না। এটা তোমাদের মামার বাসা তাই নিজের মতো থাকবে।
সাবা একটা ব্যাগ এনে মিশানের হাতে ধরিয়ে দেয়।
আদ্রিয়ান বউ,বাচ্চাদের নিয়ে বেরিয়ে যায় সবার দৃষ্টি সীমানার বাইরে। আদ্রিয়ান যেতেই ওর মা কেঁদে উঠে। তার সন্তান কি না তার বুক থেকে আজ এতদূর চলে গেল। এতদিন তো জানতো ননদ চলে গেলেই আদ্রিয়ান ফিরে আসবে কিন্তু আজকের ঘটনার পর আদৌ আদ্রিয়ান ফিরবে কি না জানা নেই কারো।

ফ্ল্যাটে ডুকে মিশিকে শুয়িয়ে দিয়ে সাওয়ার নিতে চলে যায় আদ্রিয়ান। রোদ বোরকা খুলে কোনমতে ড্রয়িং রুমে সোফায় বসে। পিঠে ব্যাথা তখন বাড়ছে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে হাতের জ্বলুনি। এতখানি পুড়ে যাওয়া মোটেও সহজ ব্যাপার না। মিশান দরজা লাগিয়ে এসে চুপ করে মা’য়ের পাশে বসে। রোদ চোখ মেলে তাকাতেই দেখলো মিশান একদম চুপ করে আছে। হাত বাড়িয়ে মিশানের হাতের উপর রাখতেই মিশান আস্তে করে রোদের কোলে মাথা রেখে নিচে বসে পরে। রোদ ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,

— বাবা ফুডপান্ডা অন করো তো। খাবার অর্ডার দেই।
মিশান উঠে না। ওভাবেই মা’য়ের কোলে মাথা দিয়ে রাখে। রোদ জানে মিশান এখন কতটা আপসেট। বয়সটাই এমন আবেগের। রোদ নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক করে। এভাবে মিশানের সামনে থাকলে নিশ্চিত ছেলেটা আরো ভেঙে যাবে। তাই মুখে হাসি এনে দুষ্টামি করে বলে,
— এই যে আব্বাজান আপনার আম্মাজানের তো ক্ষুধায় পেট চু চু করছে।
মিশান ঝট করে মাথা তুলে বলে,

— ফোন নিয়ে আসি।
মিশান আসতেই রোদ দেখলো টেবিলে একটা ব্যাগ রাখা। রোদ জিজ্ঞেস করতেই মিশান ফোন টিপতে টিপতে বললো,
— আসার সময় খালামনি দিলো।
রোদ উঠতে নিলেই মিশান ধরে বললো,
— কোথায় যাও?
— দেখ তো ব্যাগে কি?
মিশান খুলতেই দেখলো খাবারের বক্স দেয়া। রোদকে বলতেই রোদ বললো,
— দেখলা তোমার বাবার টাকা বেঁচে গেল।

মিশান হাসলো। রোদ উঠলে নিলেই পিঠে ব্যাথা পাচ্ছে তাই মিশান নিজেই সব বক্স খুলে খুলে টেবিলে রাখলো। তিনটা প্লেট বের করে পানি এনে সব রাখলো। আদ্রিয়ান এসেই দেখলো টেবিলে খাবার রাখা। নিজে বসে বেড়ে নিলো প্লেটে। মিশানকে দিয়ে আরেক প্লেটে নিয়ে সোফায় যেতেই মিশানও পেছন পেছন গিয়ে সোফায় বসে পরলো। আদ্রিয়ান কিছু না বলে রোদের মুখে খাবার তুলে দেয়। রোদের তখনই জ্বর জ্বর ভাব তাই তখন বেশি খেতে পারে না। আদ্রিয়ান নিজেও খেয়ে সব গুছিয়ে রাখে। রোদের পিঠের ব্যাথা তখন তীব্র থেকে তীব্র হচ্ছিলো। আদ্রিয়ান মিশিকে মিশানের রুমে দিয়ে বললো,

— বাবা বোনকে দেখো। মা’য়ের মনে হয় জ্বর আসছে।
মিশান রোদের কাছে বসে বললো,
— আমি থাকি?
— উহু। বোনকে দেখো। বাবা আসছি একটু পরই।
বাধ্য ছেলের মতো মাথা নেড়ে মিশান রুমে যায়। সোফায় তখন জ্বরে পুড়ছে রোদের দেহ। আদ্রিয়ান ওকে কোলে তুলে নেয়। জ্বরের মেডিসিন দেয়। মাথায় পানি দেয়। কপালে জল পট্টি দেয় কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হয় না। পুড়া হাতের জ্বালায় কাতরায় রোদ। আদ্রিয়ান ওর উপর ঝুঁকে সারা মুখে আদর দেয়।

হঠাৎ কলিং বেল বাজতেই আদ্রিয়ান রোদের গলা থেকে মুখ তুলে দৌড়ে দরজা খুলে। আরিয়ানকে দেখেই সাহস পেল যেন আদ্রিয়ান।জড়িয়ে ধরে অসহায় গলায় বললো,
— ভাই দেখ না রোদটার কি হলো।
আরিয়ান এমন পরিস্থিতিতে যেন ভেঙে পরছে। ডাক্তার হলেও আপন জনের করুন অবস্থায় যেন ওর ভেতরেও ঝর বইছে। ভেতরে ডুকতেই দেখলো জ্বরে, ব্যাথায় মুর্ছে আছে রোদ। কিছুক্ষণ পর পরই গুঙিয়ে গুঙিয়ে কাঁদছে। আরিয়ান চেক করেই বুঝলো অবস্থা বেশ খারাপ। আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে বললো,

— আদ্রিয়ান এভাবে হবে না।
বিচলিত হলো আদ্রিয়ান। হসপিটাল নিতে তাড়া দিতেই আরিয়ান বললো,
— দাঁড়া এত রাতে ডক্টর এভেলএইবেল কি না দেখে নি। নাহলে সারারাত সেলাইন দিয়ে শুয়িয়ে রাখবে।
হসপিটালে কল দিতেই জানলো ইমারজেন্সিতেও কোন বার্ন ইউনিটের ডাক্তার নেই। আরিয়ান কি মনে করে আদ্রিয়ানকে বললো,

— ডক্টর রাতুলকে কল দেই? ও তো বার্ন ইউনিটের।
আদ্রিয়ান তখন পাগল প্রায়। রোদের অসুস্থার সাথে বাড়ছে আদ্রিয়ানের পাগলামি। বারবার ডাকছে রোদকে। আরিয়ান রাতুলের কথা জিজ্ঞেস করতেই আদ্রিয়ান কান্নারত গলায় বললো,
— যাকে খুশি ডাক। আমার রোদকে ঠিক করে দে।

রাতুলকে কল দিয়ে আরিয়ান রোদের কথা জানাতেই রাতুল পাগল হয়ে ছুট লাগায়। মাত্রই বাসার সামনে এসেছিলো রোদের খবর পেয়ে গাড়িতে উঠে ছুট লাগায় দিক বিদিক ভুলে। ঘন্টার রাস্তা যেন কয়েক মিনিটের মধ্যেই পার করে রাতুল হাজির হয়। আরিয়ান ভেতরে নিতেই যেন রাতুলের কলিজা মোচড়ে উঠে। বিছানায় আদ্রিয়ানের কোলে গুটিয়ে কাঁদছে রোদ। কি ক্ষতি হতো আদ্রিয়ানের জায়গায় রাতুল হলে?

আরিয়ানের কথায় ধ্যান ভাঙলো রাতুলের। এগিয়ে এসে হাতের ড্রেসিং খুলতেই ঢোক গিললো কয়েকটা। কতশত পুড়া শরীর রোজ দেখে রাতুল। কত রুগীর চেহেরাটা পর্যন্ত বুঝা যায় না। সারারাত কাতরায় তারা। মেডিসিনও ঠিক মতো পায় না যদি সরকারি হসপিটাল হয়। এখানে রোদের সামান্য হাত পুড়া দেখেই যেন রাতুলের কলিজার পানি শুকিয়ে যাচ্ছে।

হাতটা ভালোমতো ড্রেসিং করে দিয়ে ভালোহাতে ক্যানোলা লাগিয়ে দিলো। রোদের কান্নার শব্দে ততক্ষণে মিশানও উঠে এসেছে। দরজা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে ও। স্যালাইনেই ব্যাথার ইনজেকশন পুশ করে রোদকে একটা ঘুমের ইনজেকশন পুশ করে যাতে আপাতত ব্যাথা অনুভব না হয়। রোদের গুঙানির শব্দ কমে গেলো ধীরে ধীরে। একসময় পুরো ঘুমিয়ে গেল রোদ। আদ্রিয়ান ভয় পেয়ে গিয়ে বললো,

— ও কথা বলে না কেন?
আরিয়ান ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বললো,
— ঘুমের ইনজেকশন দিয়েছে। ধৈর্য ধর।
আদ্রিয়ান কিছুটা শান্ত হলো। রাতুল চেয়েও জিজ্ঞেস করতে পারছে না, কিভাবে রোদের হাতটা পুড়লো? আরিয়ান বললো,
— কাল পিঠের একটা এক্স-রে করতে হবে। ফ্যাকচার হলো কি না দেখতে হবে।
রাতুল আঁতকে উঠল কিছুটা। নিজেকে সামলে বললো,

— কিসের ফ্যাকচার?
— মেরুদণ্ডে আঘাত পেয়েছে।
— ওহ্
ছোট্ট একটা উত্তর দিলো রাতুল। জ্বর কমে গেলো। এখন পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক। কিন্তু রাতুলের তো যেতে মন চাইছে না। ওর রোদ কিভাবে পরে আছে। হঠাৎ আরিয়ান বললো,
— অনেক ধন্যবাদ এতো রাতে আসার জন্য। এখন আসতে পারো।
রাতুলের অনেক করে বলতে মন চাইলো,

— আমি থাকি। এখন তো বাড়ী গিয়েও ঘুমাতে পারব না।
কিন্তু আফসোস তা বলতে পারলো না। রোদের দিকে তাকিয়ে বের হয়ে গেল রুম থেকে। সারারাত আর চোখের পাতা এক করলো না আদ্রিয়ান। ভালোবাসার পাশে বসে পার করলো বাকিটা সময়। আরিয়ান এই অবস্থায় আর বাসায় যায় নি। মিশানের রুমে থেকে যায়।

অন্ধকার এখনও কাটে নি। সামনে থেকেই ভেসে আসছে মিষ্টি মধুর সুরে আজান। মুয়াজ্জিন আহবান করছে আল্লাহর ঘরে আসতে। সেই সুরেই বলছে,”ঘুম থেকে নামাজ উত্তম”। আদ্রিয়ান রোদের পাশ থেকে উঠলো। মুখে ভালোভাবে পানির ছিটা দিয়ে ওযু করে নিলো। রুমেই জায়নামাজ বিছিয়ে দাঁড়িয়ে গেল সর্বশক্তিমান আল্লাহর সামনে। প্রত্যেকটা সিজদাহ্য় আজ স্থান পেল প্রিয়তমার সুস্থতা। সন্তানদের ভালোথাকা। নিজের সবটুকু উজার করে আজ মোনাজাতে চাইলো তার পরিবারের মঙ্গল। চোখগুলো যেন প্রিয় আল্লাহর কাছে বাঁধ ভাঙা বর্ষণের আবির্ভাব ঘটালো।

কতটা অসহায়ভাবে কেঁদেছে তখন আদ্রিয়ান তার সাক্ষী রইলো শুধু মাত্র তার সৃষ্টিকর্তা। নামাজ শেষে উঠে সবার আগে রোদের কপালে হাত রেখে দোয়া পড়ে ফু দিলো। তিন কুল পড়ে ঝেরে দিলো। চোখদুটো বেশ জ্বালাপোড়া করছে তখন। সারারাত নির্ঘুম থাকার ফল এটা। উঠে থাইটা খুলে দিলো ওমনিই ফুর ফুরে ভোরের নির্মল বাতাসে ভরে গেলো কক্ষ।এ যেন সমস্ত বিষাক্ততা শুষে নিচ্ছে। আদ্রিয়ান দাঁড়িয়ে শ্বাস টেনে নিলো যতটুকু পারা যায়। একটু পরই বেলা হয়েছে এর জানান দিতে তোরজোর শুরু করলো সূর্য। উঁকি দিলো আদ্রিয়ানের ঘরেও।

এক ফালি আলোর ঝামটা পরলো রোদের মুখে তাতেই যেন রোদের সৌন্দর্য মিলিয়ে একাকার হলো সূর্যের কিরণের সাথে। আদ্রিয়ান অপলক দৃষ্টি মেলে উপভোগ করলো ঘুমন্ত রোদের মুখ জুড়ে আলোর বিচরণ। এগিয়ে গিয়ে চুমু খেলো সেই মুখে। ঘুমাচ্ছে তার রোদ নাহলে প্রতিদান হিসেবে একটা চুমু আদ্রিয়ানের পাওনা থাকতো। পাওনা শোধ করে নিবে সে রোদ থেকে। চেয়ে নিবে তার পাওনা চুমুটা। একটা হাতও ধরতে পারছে না আদ্রিয়ান। একহাতে ব্যান্ডেজ অন্য হাতে ক্যানোলা। কোথায় ধরবে আদ্রিয়ান? আস্তে করে মাথাটা রাখলো রোদের বুকে। একটু সস্তি চাই এখন আদ্রিয়ানের। আর তো কুলাচ্ছে না শরীরে আর মনে।

ঘড়ির কাটা তখন ৮.৩০। চোখ মেলে তাকানোর চেষ্টা করছে রোদ কিন্তু বেগ পেতে হলো তাতে। বুকে ভারি কিছুর অস্তিত্ব টের পেতেই মাথাটা উঁচু করে দেখার চেষ্টা করলো কিন্তু সম্ভব হলো না। প্রচুর ভার হয়ে আছে মাথা। ভালো হাতটা দিয়ে আদ্রিয়ানকে ছুঁতে নিলেই টান লাগলো। ব্যাথায় মুখ কুঁচকে মুখে “আহ” উচ্চারণ করতেই আদ্রিয়ান উঠে পরলো বুক থেকে। রোদের চোখে তখন পানি। আদ্রিয়ান তারাতাড়ি ধরে বললো,

— সোনা ব্যাথা করছে?
— হুম।
ঘুমের জোরে কথাগুলো যেন বেশ জড়িয়ে যাচ্ছে রোদের। আদ্রিয়ান তা বুঝে বললো,
— আরেকটু ঘুমাবে?
— হু? উহু। মিশি কোথায়?
— আছে।
দরজায় নক হলো তখনই। আদ্রিয়ান দেখলো আরিয়ান দাঁড়িয়ে। সাইড দিতেই আরিয়ান ডুকে রোদকে বললো,

— কেমন আছিস এখন?
— আলহামদুলিল্লাহ ভাইয়া।
— তোর ছেলে তো কাল সারারাত কাঁদতে কাঁদতে শেষ।
রোদ হকচকিয়ে গিয়ে বললো,
— কি হয়েছে?
— আরে আস্তে। তোর জন্য চিন্তিত ছিলো।
বলেই হাত থেকে ক্যানেল খুলে দিলো। কপালে হাত দিয়ে দেখলো জ্বর নেই এখন। আদ্রিয়ান ওকে ধরে আধশোয়া করতেই আরিয়ান জিজ্ঞেস করলো,

— পিঠে ব্যাথা আছে?
— এখন বুঝতে পারছি না কিন্তু হাতে আছে।
— ইনজেকশনের ডোজ শেষ হলেই বুঝা যাবে।
এরপর আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে বললো,
— ফ্রেশ করিয়ে রেডি হ। হসপিটালে বলে রেখেছি। একবার এক্স-রে করলে ভালো হবে।
— হুম।
আরিয়ান চলে যেতেই আদ্রিয়ান রোদকে ধরে উঠিয়ে ফ্রেশ করিয়ে বের হয়। ততক্ষণে আরিয়ান নাস্তা নিয়ে এসেছে। বাচ্চারাও উঠেছে। আদ্রিয়ান কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই আরিয়ান বললো,

— চিন্তা করিস না। সাবা আর জারবা আসছে একটু পরই। ওরা আসলেই যাব।
মিশি উঠেই মায়ের কাছে এসেছে। মিশান কাছে আসছে না। দূরে দূরেই ছিলো। সাবা আর জারবা আসতেই আদ্রিয়ান আর আরিয়ান রোদকে নিয়ে যায়। হসপিটালে তখন রাতুল ছিলো। রোদ আসবে জেনেই এসে পরেছে। এক্স-রে করে তখন বসে ছিলো। আরিয়ান রাতুলের কেবিনে ডুকে বললো,

— রোদ এসেছে। হাতটা কি চেক করবে? এখনও নাকি ব্যাথা করছে যদিও স্বাভাবিক কিন্তু আদ্রিয়ান তো..
— হ্যাঁ হ্যাঁ নিয়ে আসুন প্লিজ।
আরিয়ানকে বলতে না দিয়ে রাতুল বললো। আরিয়ান ওদের নিয়ে আসতেই রাতুল স্বাভাবিক ভাবেই রোদের ব্যান্ডেজ খুলে দিয়ে বললো,

— অয়েনমেন্ট আর মেডিসিন দিচ্ছি। তারাতাড়ি শুকাবে আশা করি। ব্যাথাটা আজ কালকেই সেরে যাবে ইনশাআল্লাহ। তবে দিনে একবার ড্রেসিং করতেই হবে কিছু করার নেই।
রোদ মাথা নাড়ায়। আদ্রিয়ান ভিজিট দিতে চাইতেই রাতুল একটু হেসে বললো,
— দয়াকরে ছোট করবেন না।

এই কথার প্রেক্ষিতে আর আদ্রিয়ান কিছু বলে না। মেডিসিন সব নিয়ে বের হয় রোদকে নিয়ে। ইমারজেন্সিতে রিপোর্ট নিয়ে অর্থোপেডিক্সের কাছে নিতেই দেখে মেরুদণ্ডে আঘাত লেগেছে কিন্তু কোন ফেকচার হয় নি। এক সপ্তাহ থেরাপি নিতে হবে। আজকের থেরাপির পরই রোদ অনেকটা আরাম পায়।

ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ২৯ শেষ 

বাসায় আসতে আসতে প্রায় দুপুর তখন। সাবার সাহায্য রোদ গোসল করে। মিশান মায়ের কাছে তেমন একটা আসছে না। মিশি তো তাও একটু পরপর কোলে উঠছে বা গলা ধরে বসে থাকে কিন্তু মিশান দূরে দূরেই। রোদ ডাকলো বারকয়েক কিন্তু লাভ হলো না।

ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৩০ শেষ অংশ