ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৩০ শেষ অংশ 

ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৩০ শেষ অংশ 
সাইয়্যারা খান

সাবার শরীর কিছুটা অসুস্থ তাই আদ্রিয়ান ওকে বাসায় পাঠিয়ে দিলো কিন্তু জারবা রয়ে গেল। সম্পূর্ণ ঘটনা ইয়াজ জানার পর রোদের বাসায় আর জানতে দেড়ী হয় নি। আদ্রিয়ান নিজেও শশুড়বাড়ী ফোন করে জানায়। রাদ শুনার পর পরই পাগল হয়ে মা-বাবা আর রুদ্রকে নিয়ে ছুট লাগায়। জাইফা একা বাসায় কিন্তু রাদের টেনশন নেই কারণ দিশা আছে।

জাইফার প্রেগন্যান্সির পর থেকেই দিশা উঠে পড়ে জাইফাকে সব কিছুতে সাহায্য করে। রাদ যতক্ষণ বাসায় থাকে ততক্ষণ আসে না কাছে। রাদের অনুপস্থিতেই দিশা জাইফাকে সঙ্গ দেয়। এটা ওটা সব এনে খাওয়ায়। তাই রাদও কিছুটা নিশ্চিতে থাকে কারণ মা তো রুদ্র আর সংসার সামলাতে সামলাতেই দিন শেষ তারমধ্য জাইফাকে অতটা খেয়াল রাখতে পারে না তবুও সবাই নিজেদের সর্বোচ্চ দিয়ে করছে। বংশের প্রথম বাচ্চা বলে কথা। রাদের সাথে ইয়াজও ছুটে এলো। একমাত্র বান্ধুবি বলে কথা।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতেই আদ্রিয়ানের ফ্যাটে হাজির রোদের পরিবার। আদ্রিয়ান অবাক হলো যখন দেখলো ওর মা,বাবা আর জারা, জুরাইন লিফট থেকে নামলো। কিছু না বলে আদ্রিয়ান সবাই’কে ভেতর নিলো। রোদ তখন ঘুমিয়ে ছিলো পাশে জারবা বসা। মেয়ে’র হাতের দিকে তাকিয়েই একদফা কাঁদলেন রোদের মা। কত সুন্দর হাতটা ছিলো তার মেয়ের। রাদ আর রুদ্র বোনের মাথায় কাছে বসে রইলো। রুদ্র তখনও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে। ঘটনা যেহেতু সবাই জানে তাই আদ্রিয়ানকে আর এ নিয়ে জিজ্ঞেসাবাদ করা হলো না। রাদ রোদের কপালে হাত দিয়ে দেখলো হালকা জ্বর জ্বর ভাব। সবার মধ্যেই রোদের বাবা ইচ্ছা প্রকাশ করলেন,

— রোদকে আজ নিয়ে যাব সাথে আমার নাতি- নাতনি আর জামাইকেও। এখানে একা থাকা এই মুহূর্তে ঠিক হবে না।
আদ্রিয়ান মাথা নিচু করে বসে আছে রোদের পায়ের কাছে। কি বলবে? আদৌও কি কিছু বলার আছে? এই অবস্থায় রোদকে এখানে রাখা মোটেও সুবিধার নয় সাথে আবার বাচ্চারা ও আছে। গত রাত কিভাবে অতিবাহিত করেছে তা কেবল আদ্রিয়ান আর ওর আল্লাহ উ জানেন। তাই এখানে দ্বিমত পোষণ করার কোন প্রশ্নই আসে না। আদ্রিয়ানের মা এ শুনে একটু শান্তি পেলেন। নাহলে রোদের এই অবস্থায় এখানে থাকাটা তিনিও মানতে নারাজ ছিলেন।

রোদের ঘুম ছুটছে সন্ধ্যার দিকে। পাশে হুট করে এত মানুষ দেখে প্রথমে চমকে গিয়েছিলো পরক্ষণেই চেনা পরিচিত মুখ গুলো দেখে সস্তি পেলো। নার্স এর আসার কথা হাত ড্রেসিং করতে কিন্তু অবাক হলো সবাই যখন দেখলো রাতুল নিজে এসেছে। আদ্রিয়ান তাতে বিশেষ নজর দিলো না ওর মতে ভালো হ’য়েছে ডাক্তার আরেকবার দেখে গেলো। আর রাতুল হওয়াতে বিশেষ সুবিধা হলো ছেলেটা উঠে পড়ে লেগেছে রোদের ঘা শুকাতে।

সবার সাথে টুকটাক কথা বলে আদ্রিয়ানের জোরে হালকা নাস্তা করেই বিদায় নেয় রাতুল। আশ্চর্যের বিষয় হলো ও রোদের দিকে একবারও ফিরে তাকালো না এমনকি আড় চোখে না। মাথা নিচু করে ড্রেসিং করে অথচ হাত ছোঁয় পর্যন্ত না। হাত থাকে আদ্রিয়ানের হাতের উপর। রাতুলের এখনও কেন জানি মনে হয় রোদের দিকে তাকালে আদ্রিয়ান রেগে যাবে। আসলে ঐ দিনের রোদের গালের সেই দাগ এখনও ভুলতে পারে নি ও অথচ নিজেকে বারবার বুঝায় ও কমিটেড আরেকজনের সঙ্গে।

আদৌও কি তাই? হাজার অন্য সঙ্গে জড়ালেও কি রাতুল এত বছরের প্রেম ভুলে যাবে? কতরাত সে নির্ঘুম কাটালো সেই রাত গুলোর মানেটা বৃথা হয়ে যাবে না? চোখের পানিগুলো মিথ্যা হয়ে যাবে না? মস্তিষ্ককে রাতুল খুব সুক্ষ ভাবে বুঝ দেয় যে রোদকে ভুলে সে এগিয়েছে আরেকজনের হাত ধরেছে কিন্তু মন সেটা খামখেয়ালী ভেবে উড়িয়ে দেয়। কেন দিবে না? এই মনে তো এখনও রাজত্ব করে তার মাসুম সুরতের প্রাণেস্বরী রোদ।

রোদ নিজের বাসায় এলো। রাদের কোলে মিশি। মিশান এখানেও একদম চুপ হয়ে আছে এমনকি রুদ্রর সাথে ও তেমন একটা কথা বলছে না। এসেই রুদ্রর রুমে বসে আছে। জাইফা এতদিন পর রোদকে দেখে ভীষণ খুশি হলো। চাচিরা এসেও রোদকে দেখে গেলো। সবাই রুম ফাঁকা করতেই রোদ আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে বললো,

— মিশিকে নিয়ে এসে চেঞ্জ করিয়ে দিন।
আদ্রিয়ান রোদকে চিন্তা করতে নিষেধ করলো কারণ তিশা একটু আগেই মিশিকে চেঞ্জ করিয়ে নিজের বাসায় নিয়ে গিয়েছে। রোদ চিন্তিত কন্ঠে বললো,
— আচ্ছা মিশানের কি হয়েছে? আমার সাথে কথা বলছে না। কেমন এরিয়ে যাচ্ছে। কোন কারণে কি রেগে আছে?
আদ্রিয়ান নিজের পরিহিত শার্টটা খুলে একটা পাতলা টিশার্ট গায়ে জড়াতে জড়াতে বললো,
— রাগ করার কারণ নেই। তোমার ছেলে একটু পর এমনিতেই আসবে।
রোদ কিছু বলবে তার আগেই আদ্রিয়ান বললো,

— মেডিসিন খাবে এখন। কোন কথা না।
রোদ চুপ রইলেও মুখটা ভোঁতা করে রাখলো। আদ্রিয়ান কিছু না বলে মেডিসিন খায়িয়ে দিয়ে বললো,
— আমি আসছি একটু।
বলেই রুম থেকে বের হলো। রুদ্রর রুমে এসে বললো,
— মিশান আছো?
মিশান বেড থেকে উঠে আসতেই আদ্রিয়ান ওকে ধরে বললো,

— বাবা মা’য়ের সাথে কথা বলে আসো। বারবার তোমার কথা জিজ্ঞেস করছে।
— আমি মা’কে এভাবে দেখতে পারছি না বাবা।
— তোমার মা ভাবছে তুমি রেগে আছো তার সাথে।
মিশান আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে বললো,
— আমি কেন রাগবো বাবা? মা এটা কেন ভাবলো?
কথাটা বলেই মিশান ছুটলো রোদের রুমের দিকে। আদ্রিয়ান অল্প হাসলো। পা বাড়ালো রুমের দিকে। মিশান ডুকেই রোদের পায়ের কাছে বসে ডাকলো,

— মা।
রোদ চোখ বন্ধ করে হেলান দেয়া ছিলো। “মা” ডাক শুনেই চোখ খুলে দেখলো ডাকের মালিক সামনে বসা ছলছল চোখ করে। রোদ বিচলিত কন্ঠে বললো,
— বাবা কি হয়েছে?
মিশান কিছু বললো না। রোদের কোলে মাথা রেখে বললো,
— ব্যাথা পাচ্ছো?
রোদ হেসে বললো,
— না।
— এভাবেই থাকি?
— আচ্ছা।
মাঝখানে কেটে গেল কয়েক মিনিট। মিশান নিজেই বললো,

— তোমাকে অসুস্থ দেখতে পারি না আমি। আমার কষ্ট হচ্ছিলো মা। তুমি কাল রাতে কেমন করে কাঁদছিলে। আমার সহ্য হচ্ছিল না।
রোদ ভালো হাতটা মিশানের মাথায় বুলিয়ে দিয়ে বললো,
— মা ঠিক আছে তো এখন। উঠো। কাঁদে না।
মিশান উঠে না। রোদ ও আর কিছু বলে না। রোদের মা রুমে ডুকে বললেন,
— মা ছেলের হলো দুঃখ বিলাস? খাবে আসো।

মিশান যাবে না অগত্যা রোদের মা রুমে এসে রোদ আর মিশানকে খায়ালো। আদ্রিয়ান অবাক হলো যখন এই অবস্থায়ও ওকে টেবিল ভর্তি খাবার দিয়ে জামাই আদর করা হলো। মিশিকে তিশাই খায়িয়েছে। মা ছাড়া অবশ্য ও খেতে চায় নি তিশা কিসব আজগুবি কাহিনি শুনিয়ে ওকে খায়িয়ে দেয়।
রাতে মিশিকে তিশাই রেখে দিতে চায় কিন্তু রোদ মানে না। জোর করে নিজের কাছেই রাখে। আদ্রিয়ান মিশিকে বেডে দেয়ালের সাইডে ঘুম পারায় কারণ মাঝে রাখলে আবার রোদের হাতে ব্যাথা না লেগে যায়? মিশি ঘুমাতেই আদ্রিয়ান রোদের উপর ঝুঁকলো। রোদ ভ্রু নাচিয়ে কি হয়েছে? আদ্রিয়ান আস্তে করে মুখ নামায় রোদের গলায়। এত এত চিন্তা, কষ্ট সব ভুলে ছোট ছোট আদরে ভাসায় রোদকে।

দুই দিন যেতেই পিঠ ব্যাথা গায়াব হলো রোদের। হাতের অবস্থাও উন্নতির পথে। রাতুল রোজ রোজ এসে ড্রেসিং করছে। আদ্রিয়ান রোদের অবস্থা ভালো দেখে অফিস জয়েন করছে। এখানে তার বউ বাচ্চাদের ভালো যত্নআত্তি হচ্ছে তাই নিশ্চিতে অফিস করছে যদিও বেশি সময় দিতে পারছে না। আজও দুপুর দিকেই শশুড় বাসায় ফিরেছে। মিশি দৌড়ে বাবার কাছে এসে কোলে চড়ে বসে। আদ্রিয়ান রুমে ডুকতেই দেখলো রোদ আলমারি থেকে মিশির কাপড় বের করছে। আদ্রিয়ান নিজেই এগিয়ে সব বের করে মিশিকে গোসল করিয়ে দিলো কারণ মেয়ে আজ কিছুতেই অন্য কারো কাছে গোসল করবে না। মিশির গোসল হতেই আদ্রিয়ান রোদের কাপড় বের করে ওয়াসরুমে রাখতেই রোদ বললো,

— আপনি আগে করুন। আম্মু রান্না শেষে এসে আমাকে করিয়ে দিবে।
আদ্রিয়ান কিছু না বলে রুমের দরজা লক করে দিলো। রোদ বেডে বসে পা ঝুঁলাতে ঝুঁলাতে বললো,
— দরজা লক করলেন যে?
আদ্রিয়ান ঘুরে দুষ্ট হাসলো। রোদ সেই হাসি দেখে হকচকালো। আদ্রিয়ান ওর চকচকানিকে পাত্তা না দিয়ে কোলে তুলে নিলো রোদকে। রোদ কিছুটা চেঁচিয়ে বললো,
— আরে আরে কি করেন? আজব। নামান আমাকে।
আদ্রিয়ান সোজা ওয়াসরুমে নিয়ে দরজা লাগিয়ে দিতেই রোদ কিছুটা রাগী কন্ঠে বললো,

— কি শুরু করলেন?
মুখ খুললো আদ্রিয়ান। দুষ্ট কন্ঠে বললো,
— শুরু করি নি তো এখনও। এখন করব।
— কি?
কৌতুহল কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো রোদ। উত্তরে আদ্রিয়ান ওর কোমড় জড়িয়ে ধরে বললো,
— রোম্যান্স।

রোদের হাতে পলিথিন বেঁধে আদ্রিয়ানের সাহায্যে আজ গোসল করলো। এই গোসল মোটেও সুবিধার ছিলো না। দুষ্ট আদ্রিয়ান আজ অনেক জ্বালিয়েছে ওকে। আপাতত রোদ বেডে বসা। টাওয়াল পেচিয়ে আদ্রিয়ান এসেই আগে রোদের মাথা মুছে দিলো ভালোমতো। দরজায় নক হতেই আদ্রিয়ান পোশাক পড়ে খুলে দিলো। রোদের মা রোদকে দেখেই বললো,
— একা কিভাবে করলি?
— একা কই…
রোদকে সম্পূর্ণ কথা বলতে না দিয়েই আদ্রিয়ান বলে উঠলো,

— আম্মু আমি ওর হাতে পলি বেঁধে দিয়েছিলাম। ও বললো আজ একাই পারবে।
রোদের মা কিছু না বলে চলে গেলেন। রোদ মুখ কুচকে বিরবির করে বললো,
— মিথ্যুক।
— কি বিরবির করো সবই তো শুনা যাচ্ছে।
রোদ কিছুটা জোরেই বললো,
— মিথ্যুক।
আদ্রিয়ান এগিয়ে এসে রোদের হাতে মলম লাগাতে লাগাতে বললো,

— মিথ্যুক আমি নাকি হাঁদারাম তুমি?
রোদ না বুঝে বললো,
— মানে?
— এখনই তো শাশুড়ী আম্মুর কাছে তোমার সাথে আমার ইজ্জত ও পামচার করতা।
— আজব আমি করলাম?
— মাত্রই তো বলতে নিচ্ছিলা যে আমি হেল্প করেছি সাওয়ার নিতে সাথে রোম্যান্স ও করেছি।
রোদ মুখ কুচকে বললো,

ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৩০ 

— ছিঃ কিসব বলেন। আমি মোটেও এটা বলাতাম না।
আদ্রিয়ান ওর নাক টেনে বললো,
— বলতেই পারো বাট তাই বলে শাশুড়ীকে।
— আপনি যাবেন এখান থেকে?
কিছুটা চেঁচিয়ে বললো রোদ। আদ্রিয়ান হাসতে হাসতে বের হলো রুমে থেকে। পেছনে রেখে গেলো লজ্জায় ভিন্ন রং ধারণ করা রোদকে।

ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৩১